সাধন দাস
আনন্দবাজারের গল্প
সে একটা বাঘসেঁধুনো রাত। হু হু শীত। ভল্লুকের গায়ের লোমও খাড়া হয়। সাবওয়ের নীচে একটা কালো কুটকুটে কম্বল। উঁচু ঢিপ অন্ধকার। অন্ধকারের নীচে আরও ঘুটঘুটে অন্ধকার। তার মধ্যে হাত পা ছোড়াছুড়ি করে বুড়ো আর বুড়ি। বুড়ি আর বুড়ো। দুজনে হুটোহুটিতে চারজন। ওদের গায়ে লোম নেই। কম্বলখানাও রোঁয়া ওঠা, এখানে ছেঁড়া, ওখানে ফুটো, সর্বাঙ্গে তালিমারা। বুড়ি খিঁচ মারে, ফুটো দিয়ে বুড়োর হাত বেড়িয়ে যায়। বুড়ো টান দেয় বুড়ির পিঠে হিম ছ্যাঁক করে ওঠে। বুড়ি জোড়া পা সোজা সেঁধিয়ে দেয় বুড়োর পেটে। দুজন মিলে চারজনের খটাখটি। রাত জুড়ে শীতের দাপট।
বুড়ো ঠোঁটে মাড়িতে ঠকঠকিয়ে বলে— রবি কি আটকে রেখেছিস, হিংসুটি? এখনও উঠছে না কেন?
বুড়ির গালে কঙ্কাল হাসে— হিহিহিহি… রবির লোম তুলে বিক্রি হচ্ছে।
–ইয়ার্কি মারছিস!
–লোম মানে রোদ্দুর। হিহিহিহি…
গলা কাঁপানো ঠান্ডায় এক কথা পাঁচবার বেরিয়ে আসছে— কাল সকালে যেতে যেতে যেতে যেতে দেখলাম, একটা টিকিট কাটা পার্কে কত রোদ্দুর!
বুড়ির হা হা হাসি ফুঁড়ে দুর্গন্ধ আর গরম ভাপ বেরিয়ে আসছে— উঁহুঁহুঁহুঁ…
বুড়ো কম্বলে হ্যাঁচকা মেরেছে— আর একটু হাস। বুকের গরম পাচ্ছি। সেই প্রেম করার মতো।
–আঃ মোলো যাঃ!
বুড়ি হুঁচকি টান মারে। বলে— রোদ্দুরের লোমে তৈরি ছয়েটার পরে ছ্যামড়াছ্যামড়িরা দেখলাম পার্কের দিকে যাচ্ছে। আমিও সাত হাত দূরে ওদের পেছন পেছন যাচ্ছিলাম। একটু একটু গরম লাগছিল।
বুড়ো চুপ। বুড়ির গায়ে রোদ্দুরের লোমে তৈরি ছয়েটারের ওম সেও একটু একটু পাচ্ছে।
কম্বলের ফুটো দিয়ে বুড়োর হাত বেরিয়ে গেছে। বাইরের হাত দিয়ে ভিতরের বুড়িকে বুকে জাপ্টে ধরতে চায়।
–আমার ছ্যামড়া হতে খুব ইচ্ছে করছে।
–আমারও ছেমড়ি হতে। ফুলের মতো রোদ্দুরে তৈরি তুলোর ছয়েটার গায়ে দিতে।
বুড়ির গা ঘেঁষে হাঁ মুখের গরমে ঢুকে পড়তে চায় বুড়ো। মুখ বেয়ে বুকের মধ্যে।
বুড়ি ব্যথা পেয়ে কঁকিয়ে ওঠে— বুকের খাঁচাখান ভেঙে দিবি নাকি রে?
এক আছে বুড়ো, আর আছে বুড়ি। সাবওয়ের নীচে। আর ছিল এক বুড়ি, আর এক বুড়ো। চারজন মিলে দুজন। দুজন মিলেমিশে একজন। কম্বলের নিচে সে একটা বাঘসেঁধুনো রাত। হু হু শীত। ভল্লুকটার গায়ে লোম উঠে গেছে। এখানে ছেঁড়া ওখানে ফাটা। দলা পাকিয়ে পড়েছিল সাবওয়ের কোণে। ভোররাতে ফেরার পথে অনেকেই দেখেছে। ভয়ে পালিয়েছে কেউ কেউ। যারা দেখেনি, পরদিন খবরের কাগজে পড়েছে। না পড়লে পিছিয়ে পড়তে হয়।
ইন্দু
সকালের ব্যাচে আমরা গোল হয়ে বসে অর্থনীতি পড়তাম। ইন্দুর ভরা কৈশোর। লোভনীয় চোখে দেখতাম। ইন্দুর মুখ ভেবে প্রাইভেট স্যার ভারতবর্ষ এঁকে পাজামা নষ্ট করতেন। ভোরের চোখে অর্থনীতিকে আবিষ্কার করতাম স্যারের পাজামার ফাঁকে। পরীক্ষার খাতায় নোট উগরাতে ভুল হয়ে যেত।
ক্লাসের ব্ল্যাকবোর্ডে ভূগোল স্যার ইন্দুর আদল তৈরি করতেন ভারতবর্ষ বোঝাতে। ইতিহাস স্যার ইচ্ছে করে, দেশের অতীতকে বর্তমানের গুরুদেব বলে চালাতেন আর অপলক তাকিয়ে থাকতেন ইন্দুর বুকে। আমরা ঘাড় ঘুরিয়ে ইন্দুকে দেখার সাহস পেতাম না। সেয়ানা ছিলেন পলিটিক্যাল স্যার। সরাসরি ইন্দুকে বলতেন— স্ট্যান্ড আপ। আজও মেকআপ ঠিকঠাক হয়নি। না হলে তোমার মন ভালো থাকে না। এই কারণে আগের দিন সংবিধান বুঝতে পারোনি। জাতীয়তাবোধও আজ বুঝিয়ে প্রকাশ করতে পারবে না। শান্তি বজায় রাখতে ক্লাস রোজ মুলতুবি রাখা সম্ভব নয়। ইচ্ছে করলে আমার প্রাইভেট টিউশানে আসতে পারো।
আমরা ভয় পেতাম। এরপর ইন্দুকে স্যারের প্রাইভেটের আন্ডারে যেতেই হবে। নইলে পরীক্ষার খাতায় দেখে নেবেন। অসহায় ইন্দু আতঙ্কে আমাদের দিকে তাকাত। অবলা মুখটাকে আমরা তখন ভালোবেসে ফেলতাম।
ছিপছিপে ইন্দু ছিল আসল মিস ইউনিভার্সের মতো। ঐশ্বর্যা রাইয়ের সিনেমায় ওকে পাপড়ি ছাড়িয়ে দেখতাম। ইন্দুর সুখে, আড্ডায় গ্যাঁজা ভরে বিড়ি টানতাম। গড়ের মাঠকে ভাবতাম ইন্দু শুয়ে আছে। চিয়ারলিডার্সদের ভঙ্গিতে সৌরভের ছক্কা লুফতাম শহীদ মিনারের নীচে উপুড় হয়ে।
ইন্দুকে ভালোবাসতে কেউ লটারির দোকানে লাইন দিলাম। কেউ চপপেঁয়াজির কুটিরশিল্প গড়ে তুললাম। পলিটিক্যাল স্যারের চাকরকে দেখলাম, কোচিংয়ের নিষিদ্ধ ঘর থেকে তাড়া খেয়ে বেরিয়ে হা রে রে শব্দে ছুটে যাচ্ছে। দু হাত তুলে চেঁচাচ্ছে— আজ হোলি খেলেঙ্গে ইন্দুইয়োর সঙ্গে…
ভোট আসছে। শহর জুড়ে মিছিল। দর্জির দোকানে লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে আছি। ফেস্টুন আর ফ্ল্যাগ বানানোর ধুন্ধুমার চলছে। ব্যর্থ প্রেমে চুলে জট বাঁধিয়ে ফেলেছি। অগত্যা হিমালয়ে আশ্রয় নেব। লাল গেরুয়া সবুজের আলখাল্লা বানাচ্ছি। ইন্দুকে দেখলাম; মুখখানা কালো রুমালে বাঁধা, শরীর বোরখায় ঢাকা, চুপিচুপি নিলামবাজারের দিকে টেনে নিয়ে চলেছে ওর বাবা। বোরখার জেলখানায় ওর ভয়ার্ত চোখ। অসহায় চাহনিতে ছিল আপ্রাণ ভালোবাসার আকুতি। প্রেমের লাইনে আমার পিঠ ঠেকেছিল শেষ দেওয়ালের শেষ ইটে। হিমালয়ে ঠান্ডায় যখন মরতেই যাচ্ছি, ইন্দুকে নিলামের বাজারে ঢুকিয়ে দেওয়ার আগে… একবার বাঁচাতে পারি কিনা দেখি! লাইন ভেঙে ছুটতে শুরু করলাম। পিছন ফিরে দেখলাম, তেলেভাজা, লটারি ইত্যাদি ফেলে কেউ কেউ ছুটে আসছে। তার পিছনে একটা মিছিল। ইনক্লাব। মিছিলের পিছনে সিনেমার লাইন ভেঙে লম্বা কোলাহল। খেলার মাঠ ভেঙে দলে দলে চুম্বন উড়ে আসছে প্রেমের আকুতির দিকে। জিন্দাবাদ।
আরে বাহ! দুর্দান্ত লিখেছেন মশাই।একশোয় একশো পাঁচ।
হীরক সেনগুপ্ত