মালবিকা মিত্র
মেল ট্রেনের প্রতিটি যাত্রায় স্টিম ইঞ্জিন বিভাগে আমরা পুনঃপ্রকাশ করি পুরনো কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ একটি করে লেখা। এই সংখ্যাতেও তার ব্যতিক্রম হল না। বর্তমান প্রবন্ধটিও একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ লেখার পুনর্মুদ্রণ, তবে লেখাটি পুরনো নয়, সমকালীন। মালবিকা মিত্রের পরিবেশ সম্পর্কিত এই সন্দর্ভটি মাত্র কিছুদিন আগে, সমাজ-সংস্কৃতি বিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ পত্রিকা একক মাত্রা-র ব্লগে প্রকাশিত হয়েছিল। সদ্য-সমাপ্ত কপ-২৬ পরিবেশ সম্মেলনের ওপর ভিত্তি করে আমাদের এই সংখ্যার প্রচ্ছদকাহিনির মূল ভাবনাও পরিবেশ ও তার সঙ্কট। প্রচ্ছদভাবনার সঙ্গে সাযুজ্য রেখেই এবার স্টিম ইঞ্জিনে আমরা প্রকাশ করলাম মালবিকাদেবীর প্রবন্ধটি, পত্রিকা সম্পাদকের সহৃদয় অনুমতিক্রমে।
লেখার খসড়াটা মগজে বহুকাল ধরে তরতাজা। কিন্তু কীভাবে শুরু করব ভেবে পাইনি এতদিন। যে কোনও অংশ থেকেই মনে হয় লেখাটা শুরু করা যায়। তবে লেখার অন্তিম পরিণতি নির্দিষ্ট হয়ে আছে। কিছুতেই সেটা পাল্টাতে পারছি না। আর পূর্ব ধারণা ও পূর্ব সিদ্ধান্ত নির্ভর লেখা আমার পছন্দ নয়। তবুও লিখতে হবে, নির্ভার হবার তাগিদে। কথাগুলো কাউকে বলতে তো হবে। তাই উপসংহার দিয়ে বরং লেখা শুরু করি।
অতএব, ‘দাও ফিরে সে অরণ্য’ই একমাত্র সত্য। মধ্যবর্তী কোনও শর্টকাট পথ জানা নেই। জানি, এই কথা শোনা মাত্র সবাই রে রে করে উঠবে। এও কি সম্ভব? সে তো সভ্যতার গতিরোধ, ইতিহাসের চাকা সময়ের বিপরীতে ঘোরানো। ঘড়ির কাঁটা পিছিয়ে দিয়ে কি সময় পিছিয়ে দেওয়া যায়? মানুষ কি উন্নততর জীবন যাপন করবে না? ‘দাও ফিরে সে অরণ্য’ একটা কথার কথা, বাস্তবে প্রয়োগ অসম্ভব। কবির আক্ষেপের প্রকাশ। বাস্তবে অনুশীলন যোগ্য নয়।
মার্কস সাহেব এর প্রতিবাদ করবেন জানি। নগর বা যন্ত্র- কোনও কিছুর বিরোধী নন তিনি। তিনি উন্নততর জীবন আবাহন করেন। কিন্তু সেটা হবে পরিমিত, পরিকল্পিত ও সংযত। পুঁজিবাদ মানুষের প্রয়োজন নয়, ভোগ নয়, নিজের মুনাফার জন্য উৎপাদন করে। প্রত্যেক পুঁজিপতি চায় সমগ্র বাজারের ওপরে নিজের একাধিপত্য। ফলে চলতে থাকে ‘an uncoordinated optimism’, অস্বাস্থ্যকর প্রতিযোগিতা। ফলশ্রুতিতে যন্ত্রের অবিরাম অপ্রয়োজনীয় উন্নতি, মানবিক শ্রমের অপ্রয়োজনীয়তা, অতি উৎপাদন, মন্দা ও প্রকৃতির উপর লাগামহীন লুন্ঠন। অর্থাৎ, পুঁজিবাদের হাতে প্রকৃতি, পরিবেশ ও এই গ্রহ নিরাপদ নয়। শুধু তাই নয়, মুনাফার লক্ষ্যে চলে অস্ত্র উৎপাদন, জীবাণু অস্ত্র, রাসায়নিক অস্ত্র। গবেষণাগারে প্রস্তুত হয় কৃত্রিম মারণ জীবাণু। আবার প্রস্তুত হয় সেই মারণ ব্যাধির প্রতিষেধক ভ্যাকসিন। আরও মুনাফার আয়োজন। যে পুঁজিবাদ ও তাদের তল্পিবাহক রাষ্ট্রনায়করা এই গ্রহ ও গ্রহের বাইরে মহাকাশকে বিষাক্ত করেছে, তারাই আজ দূষণ মুক্ত পৃথিবী গড়ার আলোচনায় সদা ব্যস্ত। অতএব, পুঁজিবাদ এই গ্রহের শত্রু ও দূষণের কারণ। আধুনিকতা নয়, অনিয়ন্ত্রিত অসংযত মুনাফা শিকারী পুঁজিবাদ প্রধান সমস্যা।
এখানেই ছন্দপতন। চতুর্দশ, পঞ্চদশ ও ষোড়শ শতাব্দীর আধুনিক জ্ঞান বিজ্ঞান ও বৈষয়িক জগতের উন্নতি থেকে পুঁজিবাদকে পৃথক করা কি সম্ভব? কলম্বাস আটলান্টিক মহাসাগর পাড়ি দেবেন, রাজা রাণী বণিকের পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়াই! আর এরা পশ্চিম গোলার্ধের প্রকৃতি লুন্ঠন করবে না, সেও কি সম্ভব? সভ্যতার মাপকাঠি হল মাথাপিছু বৈদ্যুতিক শক্তির ব্যবহার। অতএব, কয়লা পুড়িয়ে তাপবিদ্যুৎ অথবা ইউরেনিয়াম পুড়িয়ে পারমাণবিক বিদ্যুৎ, চলবেই। দূষণ চরম সত্য।
আধুনিক সভ্যতার ডাঁটা চিবিয়ে রসাস্বাদন করব, আবার পাতের পাশে ছিঁবড়ে জড়ো হবে না- এই দুইয়ের একত্র সহাবস্থান অবাস্তব। এইখানেই সভ্যতার মর্মে কীট রয়ে গেছে। এই সভ্যতার মধ্যে অবস্থান করব, আবার দূষণমুক্ত বিশ্ব চাইব- দুইই সত্য হতে পারে না। মহাপণ্ডিত রামনাথ ভট্টাচার্যের মতো কেউ কি বৈষয়িক সভ্যতাকে অস্বীকার করতে পেরেছি? রাজা কৃষ্ণচন্দ্র বরেণ্য পণ্ডিত রামনাথের পর্ণকুটিরে হাজির হয়ে বললেন, এই দারিদ্র্য ত্যাগ করে রাজকীয় আতিথেয়তা গ্রহণ করুন। তখন রামনাথ ভট্টাচার্য বলেছিলেন, মেধা ও জ্ঞানান্বেষণে তিনি দরিদ্র নন। তার স্ত্রীর রন্ধনশৈলী অতি উত্তম। এই তিন্তিরি বৃক্ষ, বনের শাকপাতা, কন্দ সমূহ অতি উপাদেয়। আমি তো দরিদ্র নই। আধুনিক সভ্য মানুষের চোখে তিনি জংলি ‘বুনো রামনাথ’।
এভাবে লেখাটা শেষ করা যায়। সমস্যা হল শুরু নিয়ে। আচ্ছা, দুম করেই শুরু করে ফেলি। বলছিলাম কি, কালিপুজো এলেই হালকা শীতের পোশাক, হালকা মাফলার টুপি নামানো হয়। আর সাথে সাথে লগ্ন হয়ে হাজির হয় শব্দ দূষণ চিন্তা, বলা ভালো দুশ্চিন্তা। তারপর ছট্, জগদ্ধাত্রী পুজো চলে গেলে চিন্তা ভাবনা পুটুলি বেঁধে তোলা থাকে। আসছে বছর আবার হবে।
জানেন, একদা রেলওয়ে স্টেশন প্লাটফর্মে কত কত বৃক্ষ ছিল। শ্রীরামপুর স্টেশনে এমনই এক মহুয়া গাছ। তার তলায় কবি অরুণ কুমার চক্রবর্তী, মৃদুল দাশগুপ্ত’রা আড্ডা দিতেন। সেখানেই সৃষ্টি অরুণদা’র ‘হেই দ্যাখ, তুই হিথাক ক্যানে, তুই রাঙা পাত্থরের দ্যাশে যা, রাঙা মাটির দ্যাশে যা, হিথায় তুকে মানাইছে নাই রে’। এই যা, বেলাইন হলাম বুঝি। তা, আমাদের ভদ্রেশ্বর স্টেশনেও গাছ ছিল। যাত্রী সাধারণ ছায়ায় বসত। আড্ডা দিত বন্ধুর দল, দাদু নাতি, কাকা ভাইপো সবাই। মনে আছে প্রতি বছর প্রথম কালবৈশাখীর রাতে ওভারহেডে তার ছিঁড়ে বড় বড় গাছ পড়ে ট্রেন চলাচল বন্ধ। ট্রেন যাত্রীরা রাত ১২টা, ১টা, ২টোয় ঘরে ফিরত। নিয়ম করে, প্রতি বছর। কখনও কখনও প্রাণহানিও ঘটত। একবার তো সকালে অফিস টাইমে ভদ্রেশ্বর স্টেশনে সশব্দে এক বিশাল বৃক্ষ পড়ল দুটি লাইন জুড়ে। কয়েক জন আহত হলেন, আর একজন বাহান্ন-পঞ্চান্ন বয়সী মানুষ মারা গেলেন। মনে পড়ল কবি অরুণ কুমার চক্রবর্তী’র কবিতাটা: ‘তুই হিথাক ক্যানে’। এই জন্যই বলছিলাম, বেলাইন হইনি, লাইনেই আছি বাবা। প্রথম দিকে তো প্লাটফর্মে ৫০/৬০ ফুট টিনের শেড ছিল। ঝড় বৃষ্টির দিনে দুটি ট্রেন একসাথে ঢুকলে দাঁড়ানোর জায়গা হত না। আর ট্রেন থেকে নেমে ছুটে আসতে আসতে সবাই কাক ভেজা হয়ে যেত।
মনে আছে, ওই দুর্ঘটনার পর বিপজ্জনক গাছগুলো কেটে ফেলার দাবিতে যাত্রীদের স্বাক্ষর সংগ্রহ চলেছে, বক্তৃতা হয়েছে, শেডের সম্প্রসারণ দাবি করেছে রেল যাত্রীরা। আজ সমগ্র প্ল্যাটফর্ম ব্যাপী প্রসারিত শেড। আজ সেদিনের সেই যাত্রীদের অনেকেই এত বৃক্ষচ্ছেদন করে শেড বানানোর প্রতিবাদ করে ফেসবুকে সরব। রেলওয়ে স্টেশন থাকবে, প্ল্যাটফর্মে গাছ থাকবে, যাত্রী শেড থাকবে, জল কাদা থাকবে না, আবার কংক্রিট মোড়া চাতাল হবে না, কিন্তু প্রকৃতি অবিকৃত থাকবে। কী বিচিত্র চাওয়া! নাগরিক চাহিদা এমনই হয়। অথচ প্ল্যাটফর্মবাসী মানুষ বেজায় খুশি- টিনের চালা, কংক্রিট মেঝে। আনন্দ হবেই।
বলতে শুনেছি, এই যে শালের খুঁটির লাইট পোস্ট, নাগরিক রাস্তা আলোকিত করার জন্য কত লক্ষ শাল গাছ কাটা হল ভাবুন। রেল লাইনের স্লিপারের জন্য কত কত বৃক্ষ ছেদন হল ভাবুন। অথচ, আমার মতোই আপনিও নিশ্চিত জানেন, আমাদের বাড়ির সামনে রাস্তার আলো একদিন নিভে থাকলে ওয়ার্ড কাউন্সিলরের মাথা খারাপ করে দিই। শিমুলতলায় যতদিন বিদ্যুৎ ঢোকেনি ততদিন সেখানে সুন্দর বিরাজ করত। এত মিশকালো আকাশ, এত অজস্র তারায় ভরা, এত স্পষ্ট ছায়াপথ ওখানেই প্রথম দেখা। শিমুলতলা আমার প্রাত্যহিক জীবনে থাকে না। আমার বিনোদনের সহচরী।
বেশ মনে পড়ছে, স্কুলের বিজ্ঞান প্রদর্শনীতে ছাত্রদের দিয়ে মডেল বানানো হল: ‘জলাভূমি সংরক্ষণ’। কীভাবে প্রত্যেক নগরীর বেসিন হিসেবে জলাভূমি উদ্বৃত্ত জল, নগরীর বর্জ্য ধারণ করে। সূর্যালোক, শামুক, কেঁচো, গেঁড়ি গুগলি, ফাঙ্গি অ্যালিগাই সেই বিষাক্ত বর্জ্যকে নিখরচায় বিষমুক্ত করে। এই জলাভূমি যেন নগরীর কিডনি। এই জলাভূমি চুঁইয়ে মাটির নিচের জলস্তরকে তুলে ধরে। বলা ভালো, ফিক্সড ডিপোজিটের ঘাটতি পূরণ করে। ওই জলাভূমির মৎস্যচাষ স্থানীয় বাজারে মাছের জোগান বজায় রাখে। বর্জ্য থেকে প্রস্তুত সার স্থানীয় বাজারে টাটকা সবজির চাহিদা মেটায়। কত শত সহস্র জীবিকা যুক্ত এই জলাভূমির সাথে। জনস্বাস্থ্য পরিবেশ রক্ষার প্রশ্ন যুক্ত। তবুও… তথাপি…।
সল্টলেক রাজারহাট নিউটাউন লেক টাউন আমাদের স্বপ্ন। এসবই গড়ে উঠেছে জলাভূমি ভরাট করে। এই ব্যাপারে বিধান রায় থেকে জ্যোতি বসু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় একই নৌকার সওয়ারী। কারণ, নগরায়নকেই সভ্যতার মাপকাঠি নির্ধারণ করা হয়েছে। ব্যাবিলন থেকে মিশর হরপ্পা মহেঞ্জোদারো সবই নগর সভ্যতা। প্রথম পর্বের নগরায়ন, দ্বিতীয় পর্বের নগরায়ন দিয়ে প্রাচীন সভ্যতার পর্ব বিভাজন হয়। নাগরিক জীবনের সুতীব্র আকাঙ্ক্ষা, আলোকসজ্জা, হইচই জমজমাট কোলাহল, এর সাথে যুক্ত গতি এক স্বপ্নের জগৎ নির্মাণ করে।
আমরা খুব নিরাপদ সুবিধাজনক অবস্থান নিয়ে নাগরিক জীবনকে অক্ষুন্ন রেখে পরিবেশ রক্ষার আন্দোলন করে থাকি। মানবকে কনস্ট্যান্ট বা ধ্রুবক ধরে নিই। মানব বলতেও নাগরিক মানবকে বুঝি। এখানেই যত সমস্যা। এই গ্রহের অন্যান্য জীব জন্তু কীট পতঙ্গ এমনকি জীবাণু, যাদের ইতিহাস মানুষের চেয়েও প্রাচীন, তাদের এই গ্রহে সমান অধিকার আমাদের মেনে নিতে হবে। অর্থাৎ, শুধু মানবিক নয়, অ-মানবিক পরিবেশ চর্চা ছাড়া এই গ্রহ রক্ষা পাবে না। এই গ্রহ না বাঁচলে মানুষ বাঁচবে না। কেমন ভাবের ঘরে চুরি ভাবুন। মানুষের সমানাধিকার যারা স্বীকার করতে পারলাম না, তারা অন্য জীব ও জীবনের অধিকারের কথা বলছি।
বেশি কিছু ছাড়তে হত না, প্রাইভেট ট্রান্সপোর্ট তুলে দিয়ে একমাত্র পাবলিক ট্রান্সপোর্ট চালু থাকলে যানবাহন নির্গত দূষণ বহুলাংশে হ্রাস পেতে পারত। কাকস্য পরিবেদনা! দিল্লিতে মুখ্যমন্ত্রী কেজরিওয়াল শুধুমাত্র জোড়-বিজোড় নম্বরের গাড়ি একদিন অন্তর পর্যায়ক্রমে চালু করেছিলেন। অন্তত পঞ্চাশ শতাংশ গাড়ির দূষণ কমত। এতে প্রচুর ব্যঙ্গ বিদ্রুপ জুটেছিল বেচারা মুখ্যমন্ত্রীর কপালে।
একবার সোভিয়েত ইউনিয়ন ও গণ প্রজাতান্ত্রিক চীন একই সময়ে আলবেনিয়ার সাথে সমস্ত অর্থনৈতিক রাজনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করে। ভয়াবহ বিদ্যুৎ সংকট দেখা দেয়। আলবেনিয়া সরকার অল্প বিদ্যুৎকে যথাযথভাবে ব্যবহার করতে হাসপাতাল ও জরুরি পরিষেবায় বিদ্যুৎ সরবরাহ বজায় রেখে, অফিস স্কুল-কলেজ কল-কারখানার সময় সারণি পাল্টে দিল। ভোরে সূর্যোদয় থেকে শুরু হত কর্মদিবস। সন্ধ্যার আগেই কাজকর্ম সমাপন। তাড়াতাড়ি আঁধার নামত এবং ভোর থাকতে জেগে উঠত। হ্যাঁ, রাজধানী টিরানাও এর ব্যতিক্রম ছিল না। এই নিয়ে তথাকথিত উন্নত পশ্চিমী দুনিয়ার কত ঠাট্টা বিদ্রুপ। মায়াবী আলোয় ভাসে না নগর, হাসে না বার নাইটক্লাব, নেই লাস্যময়ীর চোখের ইশারা। এ কেমন রাজধানী?
কখনও কখনও ক্ষুদ্র পরিসরে দূষণ বিরোধী চেতনা সক্রিয় হলেও তা সর্বব্যাপী নয়। যেমন, এক ছাত্র গল্প করছিল, জার্মানিতে পরিবেশ আন্দোলন খুবই সক্রিয়। সেখানে সারাদিন লক্ষ লক্ষ গাড়ি চললেও কখনও গাড়ির হর্ন শোনা যায় না। পেছনে পেছনে চলাটাই দস্তুর। হর্ন বাজানোর অর্থ সামনের গাড়িকে অপমান করা। শুনে বেশ খুশি হলাম। তারপর কথা প্রসঙ্গে বললাম, এই যে ফুটবলে বিশ্বকাপ জিতল জার্মানি, এখানকার মতো এত বাজি ফাটানোর উল্লাস আছে ওখানে? ছাত্র বলল, না বাজি ফাটেনি, আছে অন্যরকম প্রকাশ- প্রচুর মদ্যপান ও রাস্তার ওপর বোতল ভাঙা। জার্মান ফ্ল্যাগ ও সমর্থকদের জামা কাপড় ওয়াইনে ভিজিয়ে বন বন করে ঘোরানো। আর তার ফলে অনেক দূর অবধি ওয়াইন ছেটানো। আর লক্ষ লক্ষ গাড়ি সারা রাত একসাথে এক নাগাড়ে হর্ন বাজানোর শব্দে কান ঝালাপালা। আমি শুনে বাকরুদ্ধ। ‘নো হর্ন’ মন থেকে নয়, বাধ্য হয়ে। তাই আনন্দের প্রকাশে বাঁধ ভাঙে।
ক্লাসে ছাত্র বলেছিল, সিন্ধু নদীতে বন্যার ফলে নিম্ন ও মধ্য উপত্যকায় পলিজ সমৃদ্ধি। এটাই সমস্ত নদীমাতৃক সভ্যতার সাধারণ বৈশিষ্ট্য। তাহলে ওই মানুষ কেন নদী উপকূলে বাসস্থান গড়ে? কেন বন্যা নিয়ন্ত্রণ করতে গেল? কেন নদীতে পার বাঁধ নির্মাণ করল? যার ফলে নদীগর্ভে পলি জমে নিম্ন উপত্যকা উঁচু হল। স্বভাবতই নদী তার গতিপথ পরিবর্তন করল। মানুষ যদি বন্যাপ্রবণ অঞ্চল ছেড়ে কয়েক কিলোমিটার দূরে বসতি গড়ে, তবে নগরও বাঁচত। ভূমি উর্বরতাও থাকত। বন্যা কোনও সমস্যা হত না।
কথাটা যথার্থই বলেছে। তবে সেটা হত প্রকৃতির সার্থক অনুশীলন ও অভিযোজন। কিন্তু সভ্য মানুষের ট্রাজেডি এটাই। প্রাকৃতিক সমৃদ্ধি, ফলে উদ্বৃত্ত, হস্তশিল্প ও কৃষি পণ্যের বাণিজ্য। বাণিজ্যের সুবিধার্থে নদী উপকূলের নিকটবর্তী স্থানে বসতি স্থাপন ও নগরায়ন। কৃষি সমৃদ্ধি হয়ে দাঁড়ায় নগরীর হিন্টারল্যান্ড বা পশ্চাদভূমি। এক আত্মঘাতী সভ্যতার সওয়ারী আমরা। ধরতি মাটির ওপরে পরম স্নেহে যত্নে রূপে রসে গন্ধে বর্ণে সুরে সাজিয়ে গুছিয়ে দিয়েছে। আমার আঁশ মেটেনি। না দেখা, গোপন স্থানে আমি উঁকি দিলাম। ধরতিকে বেআব্রু করলাম। নন্দিনী বলেছিল, ও যে যুগ যুগ ধরে সঞ্চিত মরা ধন। পৃথিবী তাকে কবর দিয়ে রেখেছে। বারণ শুনিনি। এই না শোনাটাই আধুনিক সভ্যতার ট্রাজেডি।
বাস্তবিকই, আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, আধুনিক সভ্যতার অংশীদার হয়ে আমি পরিবেশ রক্ষার কোনও কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারি না। আমি তৃপ্ত হই, যখন সকলেই অবাক হয়ে বলে ‘ফ্লোরটা মার্বেল পাথরে করলেন না!’। আমি অন্তত ওই পাহাড় ভাঙার শরিক হইনি। কিন্তু সিমেন্ট? সেটা এল কীভাবে? আমি প্রাইভেট মোটরকার কিনিনি, ঘরে এসি মেশিন লাগাইনি। এটা আমার অহমিকা। কিন্তু আমার ফ্রিজ, ভাড়ার মোটরগাড়ি- বাদ দিতে পারিনি তো।
আমি পাহাড়ে অন্যান্য জীবের মতো একটি জীব হয়ে বাঁচতে শিখিনি। আমার চোখে পাহাড় মানেই আকরিক, হিমাটাইট কিউপ্রাইট ডলোমাইট বক্সাইট। লোহা অ্যালুমিনিয়াম তামা ম্যাগনেসিয়াম। আমার লোভে চকচক চোখ। আমি অন্যান্য জীবের মতো নদী সমুদ্র দেখি না, আমি অতলে ডুব দিয়ে মুক্তো মাণিক প্রবাল তুলে আনি। দৃশ্যগ্রাহ্য অদৃশ্য যা কিছু সব আমাদের চাই। আমরা জগতের শ্রেয়তর জীব। মানুষ। আর যেহেতু ‘Resources are Scarce’, তাই সবাই মিলে তো আর ভোগ করা যায় না। তাই, দৃশ্যগ্রাহ্য অদৃশ্য যা কিছু সব আমার, শুধুমাত্র আমার চাই। অতএব, এমত আধুনিকতার অট্টালিকার মধ্যে অবস্থান করে সেই ইমারত ভাঙা যায় না। সে ক্ষেত্রে চাপা পড়া ও মৃত্যু সুনিশ্চিত।
অধর্মে দিয়েছি যোগ…
এক কালে ধর্মাধর্ম দুই তরী ‘পরে
পা দিয়ে বাঁচে না কেহ।
বারেক যখন নেমেছে পাপের পথে
কুরু পুত্রগণ, তখন
ধর্মের সাথে সন্ধি করা মিছে।
পাপের দুয়ারে পাপ সহায় মাগিছে।
*বানান অপরিবর্তিত