হিমের রাতে ঘুরি রাস উৎসবে

হিমের রাতে ঘুরি রাস উৎসবে -- জগন্নাথদেব মণ্ডল

জগন্নাথদেব মণ্ডল

 

মানুষ দেখার নেশা ছুটিয়ে মারে দিনরাত। অনেক অনেক মানুষজন, হিমের রাতে জন্ম নেওয়া দৃশ্যের ঘোর থেকে আমার ছুটকারা নেই জানি।

আমার জন্ম দাঁইহাটে, মায়ের পেটের মতো দাঁইহাট আমাকে জন্মের পর থেকে আগলে রেখেছে, কোলে নিয়ে বড় করে তুলেছে। এখানে সাইকেল নিয়ে অবিরত আমার দশদিক চষে বেড়ানো।

রাসপূর্ণিমার চাঁদ যখন কুয়াশার ভিতর দিয়ে কালোবাওরের মাথায় চেপে বসে আলো বিলাতে শুরু করে তখন ঘোর লেগে যায় সবার। পিলপিল করে ছুটে চলা মানুষ, মদের পিপে গলায় ঢেলে এগোনো ও ধনুক থেকে তীর ছুটে যাওয়ার মতন লোক তখন মাতোয়ারা হয়ে ওঠে।

 

কত কত আলো, কত কত নাগরদোলা, হরেক পসরা, গান, শৈব শাক্ত বৈষ্ণব অনেক মতের প্রতিমা সব মণ্ডপে মণ্ডপে স্থির ও অরব। মাটির বিষ্ণুপ্রিয়া কেঁদেই চলে খড়ম আঁকড়ে, শবশিবার মরা শিব একটুও নড়ে না, অভিমান শেষে রাই রাজা হয়ে আছে।

আমাকে নাচ অধিকার করে। হাত পা নাভি পেট অস্থির ও শুকনো হয়ে ওঠে একটু নাচের জন্য। আমি তখন নাচতে থাকি দিবালোকে ও রাতের বেলা। দুহাত তুলে নাচি, কোমরে হাত দিয়ে নাচি, দরদর করে ঘামি, কদমকাঁটা জেগে ওঠে রাসের রাতে। গলার স্বর তখন আমার ভিজে ও পাখিডাকের মতো হয়ে আসে।

 

 

প্রাচীন আমাদের রাস উৎসব। গোরুর গাড়িতে চেপে আখড়া, মুস্থলী, ঘোড়ানাশ, চাণ্ডুলি গাঁ থেকে ঝেঁটিয়ে লোকজন আসত লণ্ঠন দুলিয়ে। কবেকার হারানো জামগাছের মতো সবাই, কিছুতেই দেখা পাওয়া যায় না। তারও আগে এখানে বাঘ চরত দিনের বেলায়। হারানো জুলজুলে বাঘ জুলজুলে লণ্ঠন।

 

এ বছরের রাসে আমি খোঁড়া বেলুনওয়ালা দেখেছি, এক হাতে নেচে যাওয়া লোক, উদাসীন পাগল, পেটের খিদেয় হাতে গৌরনিতাই গড়া মহিলা, শবদেহ নামানোর জায়গায় ছবি বিক্রি করছে একজন, মসজিদ থেকে শুরু করে অভিনেতা অভিনেত্রীদের সবার ছবি, সে ঘুমিয়ে কাঁথা মুড়ে, সকাল থেকে উবু হয়ে বসে জিলিপির বেসন গোলাচ্ছে ন্যাড়ামাথার একজন, সে শখ করে হাতআয়না আর ঔষধি গাছের গুণাগুণ কিনল।

 

 

রাস ফুরিয়ে এলে মনখারাপ করে। রোদ ঝিমিয়ে আসে। ঢাকের দল বাড়ি ফিরে যায়, বাজনাও। এক মেহন্দি পরা হাত জাপটে ধরে রেখেছিলাম আট বছর আগে রাসের রাতে, সে হাত চলে গেছে আজ, মনে পড়ে সেই মেহেন্দি বেড়ার কথা, অভিমানে চোখে জল আসে, মনকেমন করে, সৎ ও সত্যি মনকেমন, একেবারে ছোটবেলার মতো…

তবু বেঁচে থাকি আমি এই গাঁ গেরামের ভিতর। নবান্নের চালের মতো ধপধপে আলো। একলা একলা ঘুরে বেড়াতে বেড়াতে অপেক্ষা করি। ‘সে আসিবে আমার মন বলে সারাবেলা’।

দূরের শহর থেকে আমার বন্ধু আসবে এমন এক কার্তিকের রাতে। আমি ছোট্ট দাঁইহাট ইস্টিশনে নলকূপের পাশে আছি ওঁর অপেক্ষায়। এই প্রথমবার ওঁর দাঁইহাটে আসা। অপেক্ষায় অপেক্ষায় নিজেকে রোগা মেয়েপিঁপড়ে মনে হয়। অথবা মনে হয় মুখে পাথর নিয়ে এগিয়ে চলা সূর্যাস্তের নরম গাধা।

চাঁদ ঢলছে একটু একটু। বনে শৃগাল। বন্ধু আসছে। বন্ধু এল। ভিড় থেকে সখামুখ খুঁজে বার করছি। জড়িয়ে ধরছি বুকে। শ্যামলা বন্ধু আমার। মাথায় পাখি পালকের মতো চুল। বুকে জড়িয়ে ধরেছি।

তারপর দুজনে শস্তার হোটেলে ডিমভাত খেয়ে এক চাঙাড়ি জিলিপি গিলব। একটু মদও হতে পারে। ঘাসমাঠ বনবাদাড় ফেলে আমরা হিমের রাতে দুজন ঘুরব আলোর ভিতর আর আঁধারের ভিতর।

গলায় দুলিয়ে নেব গাঁদাফুলের মালা। রাজবাড়ির বারান্দায় জিরিয়ে সমাজবাটীর কাছে টলোমলো হয়ে নাচব। ওঁর স্বেদবিন্দু দেখে আমার সমাধি হবে। দুজন দুজনকে বহন করে লালবাড়ির পাশে রেললাইনের ধারে পাকুড়গাছের কাছে দুজনে শুয়ে থাকব।

রাতচরা পাখি ডাকবে। মাথায় বিলি কেটে দেবে ফুল। বন্ধুকে এমন করে রাসের রাতে পেয়ে আনন্দে চোখ ভেসে যাবে অগাধ হাওয়ায়। রাসরাতে হাত দিয়ে জাপটে রাখব হাত। এই আমার ইচ্ছে। অশেষ স্বপ্ন। ভালোবাসার হাত, পানবরজের হাত, জলের হাত, ফেরিওয়ালার হাত। আমরা রাসপূর্ণিমাকে প্রণাম করে, সন্ধের বাঁশজঙ্গল নমস্কার করে চিরদিন ঘুরে বেড়াব লোকাল বাস আর লোকাল ট্রেনে…

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4879 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...