অয়নেশ দাস
পূর্ব প্রকাশিতের পর
চিরকালের ডি বিয়ার্স
এ ডায়মন্ড ইজ়় ফরেভার:
ওয়ান ওম্যান ক্যাপচারড দিস স্ট্রেংথ অ্যান্ড টাইমলেসনেস ইন ফোর সিম্পল ওয়র্ডস, অ্যান্ড ইন ডুইং সো, শি ক্যাপ্টিভেটেড দ্য ওয়র্ল্ড।
ডি বিয়ার্সের অফিশিয়াল ওয়েবসাইটে গেলে বেশ জাঁক করে লেখা এই লাইনটি আপনার চোখে পড়বেই। পৃথিবী জুড়ে যখন জাঁকিয়ে বসেছে গ্রেট ডিপ্রেশন, সবাই দিন গুনছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের, সেই সময় জার্মান ইহুদি ওপেনহাইমারদের মালিকানায় চলে যাওয়া ডি বিয়ার্স গাঁটছড়া বাঁধে নিউ ইয়র্কের বিজ্ঞাপন সংস্থা এনডব্লিউ আয়ারের সাথে। উদ্দেশ্য— মন্দার সময় পেরোলেই যাতে মার্কিন উচ্চবিত্ত-মধ্যবিত্ত অংশটিতে হীরার বাজারটিকে ঠেলে ছড়িয়ে দেওয়া যায়। দরকার ছিল হ্যামলিনের একটি বাঁশির। বিশ্বযুদ্ধের পরে পরেই ১৯৪৭ সালে নিউ ইয়র্কের এক বিনিদ্র রাতে কপিরাইটার মেরি ফ্রান্সেস গেরেটির হাত থেকে হঠাৎ-ই যেন ছিটকে বেরিয়ে আসে শতাব্দীর স্লোগান— ‘এ ডায়মন্ড ইজ় ফরেভার’। এক লাইনে বাঁধা এক নতুন আমেরিকান রূপকথা।
কিন্তু ডি বিয়ার্স নিজেই পুরো রূপকথার রহস্যটিকে একটি লাইনের মধ্যে পুরে দিলেও তা কি সত্যিই এত সরল ছিল?
কিম্বার্লির খনি পুরোপুরি চালু হয়ে গেলে হীরার উৎপাদনে এক বৈপ্লবিক বৃদ্ধি ঘটে যায়। অথচ ফরাসি বিপ্লবের পর থেকেই হীরার সনাতন ক্রেতা ইউরোপীয় অভিজাতশ্রেণি ক্রমশ ক্ষয়ে এসেছিল। সিসিল রোডসের কাছে দুটি চ্যালেঞ্জ ছিল। প্রথমটি অবশ্যই নতুন বাজার তৈরি। অন্যদিকে আবার জোগানের বৈপ্লবিক বৃদ্ধির জন্য হীরাকে প্রকৃত অর্থে আর দুর্লভও বলা যাচ্ছিল না। যে দুর্লভত্বের গল্পকে ব্যবহার করে হীরার আকাশছোঁয়া দাম ছিল এতদিন, সেই দাম চাহিদা-জোগানের সূত্র অনুযায়ীই পড়ে যেতে বাধ্য ছিল। সুতরাং রোডসের দ্বিতীয় চ্যালেঞ্জ ছিল কিছুতেই হীরার দাম পড়তে না দেওয়া। একমাত্র উপায় ছিল হীরাকে বরাবরের জন্য দুর্লভ করে রাখা। সেই জন্য অবশ্যই দরকার ছিল সারা পৃথিবীর হীরা উৎপাদন ও জোগানের ওপর ডি বিয়ার্সের একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ। এ ব্যাপারে রোডস সত্যিই অদ্বিতীয়। ওপেনহাইমারদের আমলে সেই নিয়ন্ত্রণ যদিও আরও বিস্তৃত এবং দৃঢ়তর হয়েছিল। সিসিল রোডসের হাত ধরে শুরু হওয়া সেই ঔপনিবেশিক একচেটিয়ার মাসুল পৃথিবী কীভাবে চুকিয়েছিল এবং চুকিয়ে চলেছে, সে তো আমরা ক্রমে দেখতে পাব, আপাতত দেখা যাক রহস্যের অন্যদিকটা। কীভাবে আমেরিকার আকাশ হীরার আলোয় ভরিয়ে দিল— সিনেমার মতো— যেন ফ্যান্টাসি ও রোম্যান্সের এক যথার্থ হলিউডি ম্যাগনাম ওপাস।
জিনিসটা হীরে
গভীর মনস্তাত্ত্বিক প্রয়োজন মেটানো ছাড়া হীরার অন্তর্নিহিত মূল্য শূন্য।
অনেক অনেক পরে ১৯৯৯ সালে পৌঁছে ডি বিয়ার্সের মালিক নিক্কি ওপেনহাইমারের নিজেরই করা এই মন্তব্য। এই মন্তব্যের ঢের শতাব্দী আগে থেকেই শুরু হয়েছিল সেই গভীর মনস্তাত্ত্বিক প্রয়োজন মেটানোর রহস্য নির্মাণ। যদিও তা সীমিত ছিল এক কেন্দ্রীয় অর্থনীতির আধারে, ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকা, অতি ক্ষুদ্র এক অন্য পৃথিবীর মধ্যে। বড়াদেও সে পৃথিবীর সৃষ্টি করেননি। সে পৃথিবীর ঈশ্বর যেন অন্য। সে ঈশ্বর সরল মিথোস্ক্রিয়ায় জারিত কাদামাটির প্রলেপ মুহূর্তে চূর্ণ করে খুঁজে নেয় উদ্বৃত্ত সৃষ্টির আকরিক। মূল্য তৈরির ওস্তাদ জাদুর বলে সে ঈশ্বর সর্বশক্তিমান। সেই শক্তির দাপটে উপনিবেশ থেকে উপনিবেশে হাস্যকর হয়ে ওঠে নিতান্তই প্রাগৈতিহাসিক কাদামাটির সৃষ্টি-সারল্য।
বিদায় নেবার সময় কাফির সর্দার বললে— তোমরা শাদা পাথর খুব ভালোবাসো না? বেশ খেলবার জিনিস। নেবে শাদা পাথর? দাঁড়াও দেখাচ্চি। একটু পরে সে একটা ডুমুর ফলের মতো বড় শাদা পাথর আমাদের হাতে এনে দিলে। জিম ও আমি বিস্ময়ে চমকে উঠলাম— জিনিসটা হীরে!
—চাঁদের পাহাড়, পৃঃ ৬১
বড়াদেওর কাদামাটি ফুটিফাটা হলে পৃথিবীর অন্য প্রান্তে সে ঈশ্বরের জাদুকাঠির ছোঁয়ায় গভীর মনস্তাত্ত্বিক প্রয়োজনের আল বেয়ে দৈত্যের মুখ থেকে ছড়িয়ে পড়ল রূপকথার রংমশাল— রাজা-রানি-সম্রাট-সম্রাজ্ঞীর কঠিন পৃথিবীর প্রকোষ্ঠ বিদীর্ণ করে শিকাগো-নিউইয়র্ক-বোস্টনের অলিতে-গলিতে-পাবে-রেস্তরাঁয়-আমেরিকান ড্রিম-এ।
বিংশ শতকের শুরু থেকেই প্রবল অর্থনৈতিক শক্তি হিসাবে উত্থান অতিস্বচ্ছল ধনতান্ত্রিক আমেরিকার। সাতচল্লিশে গেরেটির হাত থেকে বেরোল ‘এ ডায়মন্ড ইজ়় ফরেভার’ আর ঊনপঞ্চাশ থেকে ব্রডওয়ে কাঁপানোর পর তিপ্পান্নতে হলিউড মিউজ়়িক্যাল হয়ে আমেরিকা মাতিয়ে দিল ‘জেন্টলমেন প্রেফার ব্লন্ডস্’। মেরিলিন মনরোর জাদু-ঠোঁট ছুঁয়ে আমেরিকান যৌবনের কাছে ‘এ গার্ল’স বেস্ট ফ্রেন্ড’ হয়ে উঠল ডি বিয়ার্স ডায়মন্ড। হীরার আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে ফ্যাশন আর গ্ল্যামার পত্রিকার চার রঙের প্রিন্টে-বিলবোর্ডে-সেলুলয়েডে প্রায় রোজ হানা দিতে থাকলেন মেরিলিন মনরো, লিজ়় টেলর। অপ্রমেয় মনস্তাত্ত্বিক আকাঙ্খার রহস্যে গেঁথে প্রতিটি আমেরিকান বিয়ে হয়ে উঠল হীরায় গাঁথা রূপকথার উপাখ্যান। অনামিকার স্ফটিকখণ্ড যেন হয়ে উঠল চিরস্থায়ী ও দুর্লভ প্রেমের মেটাফর। সে এক অসামান্য ইন্দ্রজাল— পুরুষের প্রেম আর নারীর মূল্য হাত ধরাধরি করে জাদুকরের টুপির ভেতরে ঢুকল আর বেরিয়ে এল কারাটের মাপ হয়ে। কয়েক দশকের মধ্যেই ৭৫ শতাংশ আমেরিকান নববধূর অনামিকায় উঠে এল ফরেভারমার্ক[1]।
সাদা আমেরিকার হাতের কাছে ছিল তবু আর্কডিউক অব ম্যাক্সিমিলানের প্রোপোজ়় ইতিহাস। কিন্তু বাকি পৃথিবী? নিজেদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের প্রতি অতি যত্নশীল বলে যে দেশটিকে আমরা জানি, সেই জাপানে ১৯৬৭ থেকে ১৯৮১; মাত্র কয়েক বছরের মধ্যে বিয়েতে হীরার ব্যবহার ৫ শতাংশ থেকে ৬০ শতাংশে উঠে আসে। জাপান ডি বিয়ার্সের দ্বিতীয় বৃহত্তম বাজার হয়ে উঠতেই চিনও প্রতিযোগিতায় এসে যায় চিনা বিয়েতে ৩০ শতাংশের হীরকময় প্রোপোজ়় পরিসংখ্যান নিয়ে। তারপর? সে অনেক দিনের কথা নয়। রূপকথার রহস্য পশ্চিম হয়ে পূবে দানা বাঁধতে বাঁধতে নব্বই-এর দরজা খুলে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করল যেই দেশে সমস্ত রহস্যের আদিম সূত্রপাত। মুক্ত বাজারের আলো ঝলমল রাজপুত্তুর-রাজকন্যেদের জন্য তো কলামে-বিজ্ঞাপনে-এডিটোরিয়ালে-টিভি স্লটে ঝরে পড়ছিল রূপকথার পথনির্দেশ। একটি ছোট্ট উদাহরণ: যেমন ভোগ ইন্ডিয়া-র পাতায় অভিজাত বিয়ের আংটির জন্য খ্যাত ভারতীয় প্রতিষ্ঠান গেহনা জুয়েলার্সের প্রতিষ্ঠাতা কিরণ দতওয়ানির উপদেশ—
দৌ এভরি স্টোন ক্যান বি কনসিডার্ড অ্যাজ় অ্যান অপশন, নাথিং সেজ় অ্যান এনগেজমেন্ট রিং লাইক ওয়ান উইদ আ ডায়মন্ড অন ইট। অপ্ট ফর দ্য নাইসেস্ট রিং ইউ ক্যান অ্যাফোর্ড।
ষাট ওয়াটের নিভু-নিভু আবছা আলোর মধ্যবিত্ত অলি-গলিতে দেব সাহিত্য কুটিরের বিষ মেশানো হীরের আংটির দিন তবে শেষ হল। প্রথম বিশ্বের দেশ ঘুরে হীরার বাজার এসে পৌঁছল তৃতীয় বিশ্বের মুক্ত বাজারের রূপকথায়। সেই রূপকথা মেখে যত ‘ফ্রগ টার্নড প্রিন্স’ ভারতীয় প্রজন্মের প্রিয়তমা অনামিকারা যখন ঝলমল করে উঠছে চিরস্থায়ী দুর্লভ প্রেমের মেটাফরে, দৈত্যের দ্বিতীয় মুখ থেকে নির্গত হলকারা আফ্রিকা পুড়িয়ে এবার এগিয়ে আসছে বুন্দেলখণ্ডী বড়াদেওর কাদামাটির দেশে। সেই হলকার ঝলকে পুড়তে চলেছে বড়াদেওর সৃষ্টির যাবতীয় ঐশ্বর্য্য। হলকা পৌঁছেছে ম্যান্টল পর্যন্ত। দৈত্যের হলকা খুঁজে নিয়েছে কাদামাটি ভেদ করে যাবতীয় কিম্বারলাইট। কতটা পুড়তে পারে বুন্দেলখণ্ড? তবে একবার দেখে নিই কতটা পুড়েছে আফ্রিকা!
দ্য চেরিশড্ আইডিয়া
‘ক্যাপিটাল’-এ মার্কস প্রশ্ন তুলেছিলেন— ঠিক কীভাবে শুরু হয়েছিল পুঁজিবাদ? শুরুর বিপুল অর্থই বা কোথা থেকে এল? পুঁজিসঞ্চয়ের এক আদিম রূপকে তিনি চিহ্নিত করেছিলেন যা অবশ্যই আহরিত হয়েছিল ইউরোপের বাইরের পৃথিবী থেকে। মার্কস-এর ভাষায়—
আমেরিকায় সোনা ও রূপার আবিষ্কার, আদিম অধিবাসী জনসংখ্যার এক ব্যাপক উচ্ছেদ, দাসত্ব ও সমাহিতকরণের মধ্য দিয়ে, কনকোয়েস্টের প্রারম্ভ ও ইস্ট ইন্ডিজ়়ের নির্বাধ লুণ্ঠনের মধ্যে দিয়ে এবং সারা আফ্রিকা মহাদেশটিকে কালো চামড়া শিকারের নিষ্ঠুর বধ্যভূমিতে পরিণত করার মধ্য দিয়েই সূচনা হয়েছিল পুঁজিবাদী উৎপাদন যুগের গোলাপি ভোরের।
দৈত্যের দুই মুখ যেন সমীকরণের দুই প্রান্ত। একদিকে রূপকথা, অন্যদিকে ধ্বংস। মার্কসের একশো বছর পরে ইউরোপের সমৃদ্ধির দিকে সরাসরি আঙুল তুললেন উহুরু আন্দোলনের[2] নেতা ওমালি ইয়েশিতেলা।
আ ডেভেলপমেন্ট হুইচ নেসেসারিলি মিনস্ হোয়াট হ্যাজ়় টু বি কলড্ দ্য আন্ডারডেভেলপমেন্ট অব আফ্রিকা, এশিয়া অ্যান্ড ল্যাটিন আমেরিকা।
বহু শতাব্দী ধরেই কদর্য দাসপ্রথার বলি এই মহাদেশ, তবুও আমরা যদি ১৮৭৫ নাগাদ এই সময়টার আফ্রিকার দিকে তাকাই তবে দেখব, মোটের ওপর আফ্রিকার মানুষদের হাতেই ছিল ৯০ শতাংশ আফ্রিকীয় ভূখণ্ডের নিয়ন্ত্রণ। পরের দশ বছরের মধ্যে বার্লিন কনফারেন্সে তার অদৃষ্টে লেখা হয়ে যাবে একটি প্রায় অজ্ঞাত মহাদেশের চিরস্থায়ী ধ্বংসের হস্তাক্ষর— ‘স্ক্রাম্বল্ ফর আফ্রিকা’। শুধু মানুষ নয়, গোটা আফ্রিকা মহাদেশ— তার প্রায় সম্পূর্ণ ভূখণ্ড, যাবতীয় জীববৈচিত্র্য-প্রকৃতি— সবকিছুকেই এনে ফেলা যাবে চিরস্থায়ী দাসত্বের আওতায়। ১৮৮৪-৮৫-র বার্লিনে বসে ঔপনিবেশিক ইউরোপীয় দেশগুলির মাথারা আফ্রিকার প্রতিটি ইঞ্চি নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি করে নেওয়ার দলিল তৈরি করে ফেলল— সেই ভাগবাঁটোয়ারার কসাইখানায় একজনও আফ্রিকার নিজস্ব প্রতিনিধি ছিল না, বলাই বাহুল্য।
ইউরোপের দেশগুলি তখন দ্বন্দ্বে দীর্ণ— শুধু বাইরে থেকে নয়, ভিতর থেকেও। নিজেদের জীবনযাত্রার যে মানোন্নয়নের লিপ্সায় এক টুকরো আফ্রিকার জন্য ইউরোপের দেশগুলি বুভুক্ষু হায়েনার মতো জিভ-দাঁত বার করছিল— সে তো শুধুমাত্র তার ধনী বর্গের জন্যই নয়; দেশীয় শ্রমশক্তি ক্রমশ বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠছিল, তাদের সে ক্ষোভ প্রশমনেরও জাদু-মলম যে লুকিয়ে ছিল আফ্রিকা ছিঁড়ে-খুঁড়ে ঔপনিবেশিক লুণ্ঠনের লোভনীয় ভাগে!
এবং সে সাফাই ছিল রোডসের জবানিতেই—
গতকাল পূর্ব-শহরতলির লন্ডনে কর্মহারাদের এক জমায়েতে আমি উপস্থিত ছিলাম। সেখানে যে বক্তব্যগুলি আমি শুনছিলাম, সেগুলো আসলে ছিল রুটির জন্য বন্য চিৎকার। ফেরার সময় আমি আরো বেশি করে সাম্রাজ্যবাদের গুরুত্ব সম্পর্কে নিশ্চিত হলাম…
এই সামাজিক সমস্যার সমাধান হিসেবে, রোডসের ‘চেরিশড্ আইডিয়া’টি হল—
ইউনাইটেড কিংডমের চল্লিশ মিলিয়ন বাসিন্দাকে রক্তাক্ত গৃহযুদ্ধ থেকে বাঁচাতে, আমাদের মতো রাষ্ট্রনায়কদের উচিত আরও বেশি করে নতুন ভূখণ্ড দখল করা, যাতে আমরা আমাদের উদ্বৃত্ত জনসংখ্যাকে সেসব নতুন ভূখণ্ডে থিতু করাতে পারি, আমাদের খনি ও কারখানায় তৈরি পণ্যের জন্য নতুন বাজার সৃষ্টি করতে পারি। আমি বরাবর বলি, সাম্রাজ্য হল পেটের প্রশ্ন। গৃহযুদ্ধ এড়াতে তোমায় সাম্রাজ্যবাদী হতেই হবে।
আফ্রিকার মাটি আর মানুষ পুড়তে শুরু করল রোডস-এর এই ‘চেরিশড্ আইডিয়া’র হলকায়। হ্যাঁ, সেই আফ্রিকা— পশ্চিমি সভ্যতার বাইরে থাকা অনাঘ্রাত এক কাদামাটির মহাদেশ।
এই সেই আফ্রিকা, সেই রহস্যময় মহাদেশ, সোনার দেশ, হীরের দেশ— কত অজানা জাতি, অজানা দৃশ্যাবলী, অজানা জীবজন্তু এর সীমাহীন ট্রপিক্যাল অরণ্যে আত্মগোপন করে আছে, কে তার হিসেব রেখেচে?
—চাঁদের পাহাড়, পৃঃ ২৩
হিসেব শুরু হয়ে গিয়েছিল। শঙ্করের নিষ্পাপ রোম্যান্সে নিশ্চয়ই এ খবর ছিল না, যে অনেক আগেই ইউরোপীয় ‘চেরিশড্ আইডিয়া’-র শ্যেনচক্ষু ছানতে শুরু করে দিয়েছিল এই মহাদেশের তামাম জল-মাটি-আকাশ-নদী-পর্বতমালা; তার যাবতীয় সম্পদের হাড়-পাঁজরা। হিসেব শুরু হয়ে গিয়েছিল। হায় শঙ্কর! কোনও ট্রপিক্যাল অরণ্যেই আর তাদের আত্মগোপন সম্ভব ছিল না। আফ্রিকা পুড়তে শুরু করেছিল তোমার ইউগান্ডায় পা ফেলার অনেক আগেই। ইউগান্ডা রেলওয়ের কন্সট্রাকশন ডিপার্টমেন্টের স্টোরকিপার হয়ে যে কর্মযজ্ঞে যোগ দিতে তুমি মোম্বাসায় পা দিয়েছিলে সেটা যে ছিল সিসিল রোডসেরই নিজস্ব স্বপ্ন-প্রকল্পের একটি ছোট্ট শাখা! ঔপনিবেশিক দখলদারির শিকড় অক্টোপাসের হাজারটা শুঁড়ের মতো আফ্রিকা জুড়ে ছড়িয়ে দিতে সিসিল রোডসের স্বপ্ন ছিল দক্ষিন আফ্রিকার কেপ টাউন থেকে উত্তরে মিশরের পোর্ট সইদ পর্যন্ত বিস্তৃত ‘কেপ টু কায়রো রেলওয়ে’ প্রকল্প।
সে যাই হোক, আপাতত বিসমার্কের[3] প্রাসাদেই লুটের জন্য ভাগ হয়ে গেল আফ্রিকার যাবতীয় কাদামাটি-সম্পদ— জমি-শস্য-রাবার-আইভরি-সোনা-জানোয়ার-মাছ-মানুষ এবং অবশ্যই যার কথা সবার আগে বলতে হয়— সেই মহামূল্যবান রহস্যখণ্ড— হীরা।
সাদা ঈশ্বরের ওস্তাদ জাদু
একদিন সন্ধ্যাবেলার দুর্জয় শীতে তাঁবুর সামনে আগুন করে বসে আলভারেজ বললে— এই যে দেখছ রোডেসিয়ার ভেল্ড অঞ্চল, এখানে হীরে ছড়ানো আছে সর্বত্র, এটা হীরের খনির দেশ! কিম্বার্লি খনির নাম নিশ্চয় শুনেচ। আরও অনেক ছোটখাটো খনি আছে, এখানে ওখানে ছোট বড় হীরের টুকরো কত লোক পেয়েচে, এখনো পায়।
—চাঁদের পাহাড়, পৃঃ ৮৮
আলভারেজ যখন আগুনের আলোয় শঙ্করকে এসব বোঝাচ্ছিল তার দু-দশক আগেই মাটাবেলল্যান্ড ও মাশোনাল্যান্ডের এই সব ভেল্ড অঞ্চল[4], যেখানে হীরা ছড়ানো আছে সর্বত্র, ব্রিটিশ সাউথ আফ্রিকা কোম্পানির প্রতিষ্ঠাতা-ম্যানেজিং ডিরেক্টর সিসিল জন রোডসের নামে দুনিয়ার কাছে পরিচিত হয়েছিল রোডেশিয়া নামে। হ্যাঁ বিএসএসি আর ডি বিয়ার্সের দুই রোডস আসলে একই ব্যক্তি। একাধারে সাম্রাজ্যের রাষ্ট্রনায়ক ও ব্যবসায়ী। একদিকে আগুনের হলকা তো আরেক দিকে রূপকথার রহস্য। অথচ অক্সফোর্ড শেষ করে সদ্য যুবক সিসিল যখন ভাই ফ্রাঙ্ক-কে নিয়ে আফ্রিকা পৌঁছেছিল তখন তার প্রাথমিক আগ্রহ ছিল তুলো চাষের ব্যবসায়। কিন্তু হীরা চিনে নিয়েছিল হীরাকে। নাথান রথস্চাইল্ডের অর্থ ও নিজের ইন্দ্রজালে ১৮৮৮-তেই কিম্বার্লি ছাড়াও কেপ কলোনির যাবতীয় ছোট-বড় হীরার খনির মালিকানা চলে এসেছিল রোডসের হাতে। এর পর? দু-দশক পরের এক দুর্জয় শীতের রাতে আলভারেজ ও শঙ্কর যেখানে শীত তাড়াতে আগুন করেছিল, ১৮৯০-এর গোড়াতে ঠিক সেখানে ছড়িয়ে পড়েছিল ‘চেরিশড্ আইডিয়া’-র হলকা। কাদামাটি পুড়ছিল। যেন পোড়ার কথাই সবসময়। পুড়তে পুড়তেই এবার এই কাদামাটির মানুষ রুখে দাঁড়াল। এই সূত্রেই আরেকবার বিভূতিভূষণে ফেরা যাক।
ওরা চলে গেলে আলভারেজ বললে— ওরা মাটাবেল জাতির লোক। ভয়ানক দুর্দান্ত, বৃটিশ গভর্ণমেন্টের সঙ্গে অনেকবার লড়েছে। শয়তানকেও ভয় করে না। ওরা সন্দেহ করেচে আমরা ওদের দেশে এসেচি হীরের খনির সন্ধানে। আমরা যে জায়গাটায় আছি, এটা ওদের একজন সর্দারের রাজ্য। কোনো সভ্য গভর্ণমেন্টের আইন এখানে খাটবে না। ধরবে আর নিয়ে গিয়ে পুড়িয়ে মারবে। চল আমরা তাঁবু তুলে রওনা হই।
—চাঁদের পাহাড়, পৃঃ ৯২-৯৩
লড়তে নেমেছিল কাদামাটির মানুষ— দুই যোদ্ধা উপজাতি— মাটাবেল ও শোনা। অসভ্য ও বর্বর। যাদের দেশে কোনও ‘সভ্য’ গভর্নমেন্টের আইন খাটে না। তবে সভ্য সাদা গভর্নমেন্টের আইন কীভাবে খাটে? পশ্চিমি সভ্যতার এক ক্ষুদ্রতম প্রতিনিধি হিসেবে আলভারেজের জবানিতে থেকেই ধার করা যেতে পারে সে ইঙ্গিত—
শঙ্কর বললে— তবে তুমি বন্দুক আনতে বললে কেন?
আলভারেজ হেসে বললে— দেখ, ভেবেছিলাম যদি ওরা খেয়েও না ভোলে, কিংবা কথাবার্তায় বুঝতে পারি যে, ওদের মতলব খারাপ, ভোজনরত অবস্থাতেই ওদের গুলি করব। এই দ্যাখো রিভলবার পিছনে রেখে তবে খেতে বসেছিলাম, এ কটাকে সাবাড় করে দিতাম। আমার নাম আলভারেজ, আমিও এককালে শয়তানকে ভয় করতুম না, এখনো করিনে। ওদের হাতের মাছ মুখে পৌঁছবার আগেই আমার পিস্তলের গুলি ওদের মাথার খুলি উড়িয়ে দিত।
—চাঁদের পাহাড়, পৃঃ ৯৩-৯৪
এই সাবাড় করে দেওয়াটা তো খুবই সাধারণ এবং জনগ্রাহ্য একটা ব্যাপার। একটা শ্রেণির সেটা সাধারণ অধিকারের মধ্যেই পড়ে। আবার সেই শ্রেণিটি যদি পশ্চিমি সভ্যতার পতাকাবাহী হয়, তাহলে তো আর কথাই থাকে না। তাছাড়া, মতলব তো খারাপই ছিল ‘ওদের’। কারণ ওরা যে নিজেদের শাসনেই বাঁচতে চেয়েছিল। মাথা রেখে ঘুমোতে চেয়েছিল নিজেদের মাটির উপরেই। কী স্পর্ধা! আবশ্যই কাদামাটির মানুষ ওরা— কিন্তু যোদ্ধা। লড়তে নেমেছিল ওরা। দলে-দলে, দঙ্গলে-দঙ্গলে, হাজারে-হাজারে। উঁচু-নীচু ঢিবির বিস্তীর্ণ ভেল্ড ভরে গেল কালো-কালো মাথায়। শয়তানকে ওরাও ভয় করে না। কিন্তু তাতে কী? দূর পৃথিবীর সর্বশক্তিমান সাদা ঈশ্বরের দখলে ছিল ওস্তাদ জাদু। সব কাদামাটি অবলীলায় পুড়িয়ে দিল ওস্তাদ জাদু। কীভাবে?
হোয়াটেভার হ্যাপেনস্, উই হ্যাভ গট
দ্য ম্যাক্সিম গান, অ্যান্ড দে হ্যাভ নট—দ্য মডার্ন ট্রাভেলার, জোসেফ হিলেয়ার বেলোক
১৮৮৪-তে স্যর হিরাম স্টিভেন্স ম্যাক্সিম আবিষ্কার করলেন রিকয়েল প্রযুক্তির স্বয়ংক্রিয় মারণযন্ত্র— ম্যাক্সিম মেশিনগান বা সংক্ষেপে ম্যাক্সিম গান— সাদা ঈশ্বরের ওস্তাদ জাদু। ব্রিটিশ সৈন্যদলের মাত্র চারটি ম্যাক্সিম গানের বিরামহীন হলকায় পুড়ে গেল মাটাবেলল্যান্ড। মুখোমুখি সাক্ষাতে চুর-চুর হয়ে ঝরে গেল পাঁচ হাজারেরও বেশি কাদামাটির মাটাবেল— অসভ্য-বর্বর। জবানিতে অটুট ছিলেন সিসিল রোডস। এই পরম বীরত্বের পুরষ্কার হিসেবে রোডসের ৬১২ জন সৈন্য লাভ করেছিল ৬০০০ একর ভূখণ্ড, যা কালক্রমে পরিচিত হল সভ্য ব্রিটিশ কোম্পানি গভর্নমেন্টের ‘কলোনি অব রোডেশিয়া’ নামে।
লিভিংস্টোন-স্ট্যানলি আর আড়ালের চতুর্থ ‘সি’
আফ্রিকা পুড়ছিল। ‘স্ক্রাম্বল্ ফর আফ্রিকা’। পুড়ছিল হীরার দেশ। কেপ কলোনি-রোডেশিয়া-নামিবিয়া-কঙ্গো। কাদামাটির কালো চামড়া পুড়ে আরও উজ্জ্বল হয়ে উঠল আফ্রিকার তাবৎ সাদা উজ্জ্বল হীরকখণ্ড ও তাদের লেবেল— ডি বিয়ার্স কার্টেল। কেপ কলোনি-রোডেশিয়া-নামিবিয়া-কঙ্গো। পুড়ে যাচ্ছিল আফ্রিকা। দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়ছিল শ্বেত ঈশ্বরের ওস্তাদ জাদুর হলকা। এক এক ভূখণ্ডে এক এক রকম রহস্য তার।
বিভূতিভূষণের শঙ্কর উড়ে যেতে চেয়েছিল। পৃথিবীর দূর, দূর দেশে— শত দুঃসাহসিক কাজের মাঝখানে। লিভিংস্টোন, স্ট্যানলির মতো…। শুধু শঙ্কর নয়, বিভূতিভূষণের হাত ধরে বাংলার ঘরে-ঘরে তার পর থেকে প্রজন্মের পর প্রজন্ম এই দুটি নাম স্বপ্নে নিয়ে ঘুমোতে গিয়েছে, ঘুম থেকে জেগে উঠেছে।
অতিকায় সিংহ-মাছি-ম্যালেরিয়া-স্লিপিং সিকনেসের দুরূহ অরণ্য ছেনে, কয়েকজন মাত্র কালো অনুচর সঙ্গে, নীল নদের উৎস খুঁজে বেড়াচ্ছেন এক ভিক্টোরিয়ান মিশনারি— নিষ্ঠুর দাসব্যবসায় চূর্ণবিচূর্ণ কাদামাটির দুখী আফ্রিকার সমব্যথী মহৎপ্রাণ বন্ধু ডঃ ডেভিড লিভিংস্টোনের এভানজেলিস্ট অ্যাডভেঞ্চারে শিহরিত হয়েছি কত প্রজন্ম। রাত্রির নিঝুম পর্বে, অতলান্ত কল্পনার ভাসানে, নীল নদের উৎস সন্ধানে চুমা আর সুসির[5] মতো তাঁর সঙ্গী হয়েছি তো আমরাও। তিনটি ‘সি’ দিয়ে দাসব্যবসার অন্ধকার থেকে আফ্রিকাকে উদ্ধার করতে চেয়েছিলেন লিভিংস্টোন— ক্রিস্টিয়ানিটি, সিভিলাইজেশন ও কমার্স। কিন্তু তিনটি ‘সি’ জুড়ে যে আরেক ‘সি’-টি অলক্ষ্যে এসে দাঁড়ায়, তাকে আড়াল থেকে বের করে দেখার ক্ষমতা আমাদের কৈশোর রোমান্টিসিজ়়মে ছিল না। লিভিংস্টোনের মৃত্যুর পরে-পরেই দাস ব্যাবসার কুয়াশা ছাপিয়ে যে আরও ঘন অন্ধকারে সম্পূর্ণ ঢেকে গিয়েছিল কাদামাটির আফ্রিকা, তার নাম— কলোনিয়ালিজ়ম।
সাদা সভ্যতায় পুড়ে গেল কালো আফ্রিকা। সে অনেক-অনেক দিনের কথা নয়। সে কিছু পৌনে দুশো বছরের কথা। তার ঢের-ঢের শতাব্দী আগেই আফ্রিকা পিরামিড বানিয়েছিল। ইউরোপের জানা-বোঝার ঢের শতাব্দী আগেই তার আয়ত্তে ছিল ফ্রাক্টাল জ্যামিতি। পিথাগোরাস থেকে পিকাসো— সে ঋণ স্বীকার না করলেও আলোকিত ছিল কাদামাটির মহাদেশ— ঢের-ঢের শতাব্দী আগে থেকেই। তিনটি ‘সি’-র আড়ালে কলোনি শাসন কী দিয়েছিল তাকে? সে তো ধ্বংসের অন্ধকার। সমব্যথী লিভিংস্টোনের চাওয়া-না চাওয়ায় তার কিছু হেরফের ঘটার ছিল না। আফ্রিকা অন্ধকার হয়েছিল অনেক-অনেক পরে। যেমন করে অন্ধকার হয়েছিল লাতিন আমেরিকা-এশিয়া-অস্ট্রেলিয়া। সে প্রক্রিয়ারই অংশ হিসেবে ভারতে পা রেখেছিলেন মার্কো পোলো-ট্যাভার্নিয়ের। হয়তো না চাইলেও নীল নদের উৎস-সন্ধান তার থেকে আলাদা ছিল না। আফ্রিকা অন্ধকার ছিল না। সে ছিল নিজের মতো। পশ্চিমি সভ্যতা তাকে অন্ধকার বলে চিনেছিল। হেনরি মর্টন স্ট্যানলির লেখা ‘থ্রু দ্য ডার্ক কন্টিনেন্ট’-এর আগে কেউ তাকে কখনও অন্ধকার মহাদেশ বলে ডাকেনি।
মৃত্যুর আগে লিভিংস্টোন তাঁর শেষ আবিষ্কার, বিশাল লুআলাবা নদীটিকে দেখে ভেবেছিলেন তিনি পেয়ে গিয়েছেন নীল নদের উৎস। কিন্তু লিভিংস্টোন ভুল ছিলেন।[6] লিভিংস্টোন সেদিন ভুল হলেও সে আবিষ্কার আফ্রিকার উপনিবেশিকরণে নীল নদের উৎস আবিষ্কারের মতোই একইরকম গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে। কারণ লুআলাবা নামের সুবিশাল জলরাশিটি ছিল আফ্রিকার আরেকটি মহতী নদীর উৎস— তা হল কঙ্গো।
লুআলাবার পাড় ধরে, প্রতি মুহূর্তে জীবন বিপন্ন করে লেক টাঙ্গানিকা থেকে কয়েকশো মাইলের এক অসম্ভব যাত্রায়, এক বিচিত্র নেশায় হারিয়ে ছিলেন বর্ষীয়ান মিশনারি। ছয় বছর সভ্যজগতের সঙ্গে সম্পর্কহীন, খোঁজহীন। সে ছিল এক রহস্য। নিউ ইয়র্ক হেরাল্ডের মালিক গর্ডন বেনেট উদ্যোগী হয়েছিল সেই রহস্যভেদে। অবশেষে বেনেটের টাকায় নিউ ইয়র্ক হেরাল্ডের হয়ে দীর্ঘ নয় মাস অজানা ক্রান্তীয় অরণ্যের মধ্য দিয়ে পথ হেঁটে ১৮৭১-এর এক দুপুরে নিরুদ্দেশ লিভিংস্টোনকে খুঁজে বের করে হেনরি মর্টন স্ট্যানলি। লেক টাঙ্গানিকার তীরে উজিজি নামে এক গ্রামে দুজনের সাক্ষাতের মুহূর্তটি ইতিহাস হয়ে রয়েছে। লিভিংস্টোনের মৃত্যুর পর লুআলাবার রহস্য গিয়ে পড়ে স্ট্যানলির হাতে। লুআলাবার পশ্চিম প্রান্ত ধরে ধূ-ধূ সীমাহীন এক রহস্যময় অনাঘ্রাত ভূখণ্ড— কঙ্গো। লুআলাবা থেকে কঙ্গো বেসিন ধরে ৯৯৯ দিনের এক দুঃসাহসিক অভিযানের শেষে পশ্চিমে আটলান্টিকে পৌঁছল স্ট্যানলির দল। সেই সঙ্গে পরতে পরতে খুলে গেল কঙ্গো নামে নদীটির রহস্য। সে পথ ধরে খুলে গেল কঙ্গোর কাদামাটি-নকশা— যে নকশায় ইউরোপের জন্য অপেক্ষা করে ছিল অফুরন্ত রাবার-তামা-কোল্টান-হীরা। আর সে পথের অনতিদূরে এক নির্জন বাওবাব গাছের নীচে সমাহিত লিভিংস্টোনের হৃদয়ে তখন কাদামাটি চুঁইয়ে জমছিল ক্রান্তীয় বৃষ্টির জল। জিজ্ঞাসা করতে ইচ্ছে করে, দেড়খানা শতক পরে সে কি আজও শুধুই বৃষ্টির জল, ডঃ লিভিংস্টোন?
লিওপোল্ডের ভূত
ইউরোপে বসে তখন আরেকজনের জন্য ভীষণরকম জরুরি হয়ে পড়েছিল সেই অনাঘ্রাত ভূখণ্ডের আনাচ-কানাচ, তার তন্ন-তন্ন সুলুকসন্ধান। হাতে-গরম ছিল স্ট্যানলির সদ্যোসমাপ্ত কঙ্গো অভিযান। ‘থ্রু দ্য ডার্ক কন্টিনেন্ট’-এর ১৮৯৯ সংস্করণের ভূমিকায় স্ট্যানলি লিখছেন—
দেখা গেল কন্টিনেন্টে (ইউরোপে) একজন মানুষের আফ্রিকা নিয়ে আগ্রহ সবচেয়ে বেশি করে মূর্ত হয়ে উঠেছিল এবং অবশ্যই, আমার ইউরোপে ফেরার কয়েকদিনের মধ্যেই তিনি আমার সাহায্য চাইলেন। … এই মানুষটি ছিলেন দ্বিতীয় লিওপোল্ড যাঁর চমৎকার চরিত্র এবং অসামান্য ক্ষমতা তখনও পৃথিবীর কাছে অজ্ঞাত ছিল।
বার্লিনের কনফারেন্সের আগে থাকতেই কাগজেকলমে কঙ্গো— রোমাঞ্চকর কঙ্গো ফ্রি স্টেট— জঙ্গল-নদী-পাহাড় ঘেরা একটি পুরো দেশ, সাত লক্ষ সত্তর হাজার বর্গমাইল নির্ধারিত হয়ে গিয়েছিল রাজা লিওপোল্ডের ব্যক্তিগত সম্পত্তি হিসেবে। তখনও কঙ্গোর হীরক-ঐশ্বর্য্য অনাবিষ্কৃত। রাবার সম্পদই ছিল লিওপোল্ডের প্রাথমিক লক্ষ্য। সেই লক্ষ্য সামনে রেখে উদার পার্লামেন্টারি মনার্কির মাথায় বসে রাজা লিওপোল্ডকে নিতে হয়েছিল অন্ধকার ফুঁড়ে কাদামাটির কঙ্গোতে সভ্যতার আলো পৌঁছে দেওয়ার মহান ব্রত— ‘সিভিলাইজ়়িং মিশন’। অন্ধকার মহাদেশটিকে চাবকে সভ্য করার ফিলানথ্রপিস্ট তাগিদ। রাজার উদ্যোগে তৈরি হল ইন্টারন্যাশনাল আফ্রিকান অ্যাসোশিয়েশন। সভ্যতার পরাকাষ্ঠায় উঠল দেদার ডোনেশন। সভায় রাজার হৃদয়স্পর্শী ভাষণে অভিভূত হয়ে পড়ল সুসভ্য ইউরোপীয় শ্রোতৃমণ্ডলী।
টু ওপেন টু সিভিলাইজেশন দ্য ওনলি পার্ট অব আওয়ার গ্লোব হুইচ ইট হ্যাজ় নট ইয়েট পেনিট্রেটেড, টু পিয়ার্স ডার্কনেস হুইচ হ্যাংস ওভার এন্টায়ার পিপলস্, ইজ, আই ডেয়ার সে, আ ক্রুসেড ওয়র্দি অব দিস সেঞ্চুরি অব প্রোগ্রেস।
এহেন ফিলানথ্রপিস্ট রাজা লিওপোল্ডের চিফ এজেন্ট হয়ে সে ‘ক্রুসেড’-এর পতাকাটি নিজের চওড়া ঘাড়ে তুলে নেবে দুঃসাহসী অভিযাত্রী হেনরি মর্টন স্ট্যানলি। আর স্ট্যানলির বর্ণনামতো যতদিনে অসামান্য ক্ষমতাসম্পন্ন, চমৎকার চরিত্রের রাজাধিরাজ মানুষটিকে বাকি পৃথিবীর ভালো করে চেনার সুযোগ হবে, ততদিনে সেই মহান মিশনে নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছিল কঙ্গোর অর্ধেক জনসংখ্যা— দশ মিলিয়ন কাদামাটির মানুষ।
যে সময়টাতে আলভারেজ শঙ্করকে নিয়ে রোডেশিয়ার জঙ্গলে ঘুরতে-ঘুরতে প্রাণ হাতে ঢুকে পড়েছিল অসভ্য মাটাবেল সর্দারের রাজ্যে, যেখানে কোনও সভ্য দেশের গভর্নমেন্ট ছিল না, সেই সময়টাতেই একটু দূরে কঙ্গোতে লিওপোল্ডের সভ্য গভর্নমেন্টের ঝুড়ি ভরে উঠছিল কৃষ্ণকায় কাটা হাতের স্তুপে। আর অনেক আগেই কঙ্গোতে সে গভর্নমেন্টের ভিত তৈরি হয়েছিল যার হাতে, তার নাম হেনরি মর্টন স্ট্যানলি। অসভ্য কোনও সর্দারের রাজ্য তখনও রোডেশিয়ায় টিঁকে থাকলেও কঙ্গোতে তা হওয়ার ছিল না। লিওপোল্ডের সাফ কথা ছিল—
ইট ইজ় আ কোয়েশ্চন অব ক্রিয়েটিং আ নিউ স্টেট, অ্যাজ় বিগ অ্যাজ় পসিবল্, অ্যান্ড অব রানিং ইট। ইট ইজ়় ক্লিয়ারলি আন্ডারস্টুড দ্যাট ইন দিস প্রজেক্ট দেয়ার ইজ়় নো কোয়েশ্চন অব গ্রান্টিং দ্য স্লাইটেস্ট পলিটিক্যাল পাওয়ার টু দ্য নিগ্রোজ়়।
এ ব্যাপারে স্ট্যানলির কৃতিত্ব প্রায় কিংবদন্তি। অসভ্য-বর্বর সর্দারদের থেকে ভূখণ্ডের পর ভূখণ্ড হস্তগত করে, গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে, রাস্তা ও বাণিজ্যকেন্দ্র বানিয়ে, এমনকি তিন বছরের মধ্যেই কঙ্গোর স্রোতে স্টিমশিপ ভাসিয়ে ১৮৮৪-র মধ্যেই কঙ্গো ফ্রি স্টেটের ভিত তৈরি করে দিয়েছিল এই ওয়েলশ-আমেরিকান অভিযাত্রী। কাদামাটির জনজাতিকে কীভাবে বাগে আনতে হয় তা খুব ভালো করেই জানা ছিল স্ট্যানলির—
দ্য স্যাভেজ ওনলি রেসপেক্টস ফোর্স, পাওয়ার, বোল্ডনেস অ্যান্ড ডিসিশান।
থ্রু দ্য ডার্ক কন্টিনেন্ট। কঙ্গো অভিযানের অভিজ্ঞতার আলোয় রাজা লিওপোল্ডের কাছে কালো আফ্রিকার গোপন দরজাটি খুলে দিয়েছিল যে মানুষটি, সে আর কেউ নয়— হেনরি মর্টন স্ট্যানলি। আলভারেজ উল্লেখিত সভ্য গভর্নমেন্টের আইন কঙ্গো নদীর দুই পাড়ে স্ট্যানলির হাত ধরেই পাকাপাকি হয়ে উঠেছিল। আভিযাত্রী স্ট্যানলি অবশ্য কিছুদিন পর ত্যাগ করেছিল কঙ্গোর মাটি, ততদিনে কঙ্গোর যাবতীয় কাদামাটির কোনও দুর্গমতাই আর অগম্য ছিল না। সংখ্যাহীন হত্যা, গ্রামের পর গ্রাম ধ্বংস, হাতির দাঁত লুঠ ও সীমাহীন যৌন অত্যাচার— কঙ্গোর পাহাড়-উপত্যকা-জঙ্গল-জনপদে উন্মত্ত কুয়াশার মতো ছড়িয়ে গিয়েছিল সুসভ্য লিওপোল্ডের ভূত।
কিলড্ ওয়ান হান্ড্রেড ফিফটি মেন, কাট অফ সিক্সটি হ্যান্ডস্, ক্রুশিফায়েড উইমেন অ্যান্ড চিল্ড্রেন, অ্যান্ড হাং দ্য রিমেইনস অব মিউটিলেটেড মেন অন দ্য ভিলেজ ফেন্স।
—কঙ্গো থেকে বাড়ি ফিরে এসে এক বেলজিয়ান সৈন্যের জবানবন্দি
কঙ্গো-বিজয়ী শ্বেত ঈশ্বরের ওস্তাদ জাদুর হস্তাক্ষর হয়ে সারা কঙ্গো জুড়ে জমা হচ্ছিল লক্ষ-লক্ষ কাটা হাতের স্তূপ। কাদামাটির কালো মানুষগুলোর জন্য স্থির হত দৈনিক শ্রমের কোটা। হয় সে কোটা পূরণ করতে হত, নয়তো শরীর থেকে ছিন্ন করে দেওয়া হত হাত। শরীর থেকে ছিন্ন হয়েও আঙুলগুলো থরথর করে কাঁপতে থাকত— কাঁপতেই থাকত— কাঁপতে কাঁপতেই তাদের জায়গা হত বেতের ঝুড়িতে। তারপর তারা পৌঁছে যেত কমিশনারের বাংলো। সেখানে দাখিল হত সৈন্য পিছু কাটা হাতের তালিকা। ততক্ষণে কাঁপুনি থেমে গিয়ে নিস্পন্দ হাতে পচন ধরে যেত। পচা দুর্গন্ধে কঙ্গো ফ্রি স্টেটের আকাশ-বাতাস নিশ্চয়ই ভারী হয়ে আসত। যদিও সে দুর্গন্ধের স্বাদ তাকে নিজেকে কোনওদিন নিতে হয়নি, কারণ নিজের উপনিবেশে কোনওদিন পা রাখেনি রাজা লিওপোল্ড। তবে পচে আসা কাটা হাতের স্তূপ থেকে মুনাফার গন্ধ ছড়াত কিন্তু চমৎকার। অ্যাংলো-বেলজিয়ান ইন্ডিয়া রাবার অ্যান্ড এক্সপ্লোরেশান কোম্পানির মুনাফা বেড়েছিল এক লাফে ৭০০ গুণ। এমনকি আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র পর্যন্ত তার হঠাৎ দাপটে মুনাফার বাজারে প্রায় উড়ে গিয়েছিল।
…থ্রু দ্য ডার্ক কন্টিনেন্ট। আলভারেজের বয়ানমতো অসভ্য সর্দারের বর্বর আইনের ভয় সেখানে ছিল না। কারণ কাদামাটির যাবতীয় প্রতিরোধ সেখানে পচে যাওয়া কাটা হাতের বৃষ্টি হয়ে ঝরে গিয়েছিল। যদিও সে দুর্গন্ধ কঙ্গোর উজান বেয়ে, রোডেশিয়ার ভেল্ড পেরিয়ে, সৌভাগ্যক্রমেই হোক বা দুর্ভাগ্যক্রমে, বাংলাদেশের এঁদো গ্রামের রাঙা মাটির পথ ঘুরে শঙ্করের কাছে এসে পৌঁছয়নি; তাই আজও, অন্তত কৈশোর ভাসানো যত স্বপ্নে বাংলার যত শঙ্করের মন উড়ে যেতে চায় পৃথিবীর দূর, দূর দেশে— শত দুঃসাহসিক কাজের মাঝখানে। লিভিংস্টোন, স্ট্যানলির মতো…।
(ক্রমশ)
[1] ফরেভারমার্ক: ডি বিয়ার্স হীরার একটি ব্র্যান্ড যার ট্যাগলাইন হল Beautiful, Rare & Responsibly Sourced Diamonds.
[2] উহুরু আন্দোলন: আফ্রিকান পিপলস্ সোশালিস্ট পার্টির নেতৃত্বে সারা পৃথিবীর আফ্রিকীয় মানুষের মুক্তি, সামাজিক ন্যায় ও আত্মনির্ভরতার প্রশ্নটিকে লক্ষ্যে রেখে ১৯৭২-এ শুরু হয় এই আন্দোলন যা আজও চলছে।
[3] অটো ফন বিসমার্ক: জার্মান সাম্রাজ্যের প্রথম চ্যান্সেলর (১৮৭১-৯০)
[4] ভেল্ড: আফ্রিকা মহাদেশের দক্ষিণাংশে ছড়ানো অতি দূর বিস্তৃত উন্মুক্ত ঘাসজমি
[5] চুমা ও সুসি: জেমস চুমা এবং আব্দুল্লাহ সুসি ছিল লিভিংস্টোনের দুই আমৃত্যু বিশ্বস্ত মধ্য আফ্রিকীয় অনুচর। লিভিংস্টোনের মৃত্যুর পর আজকের জ়়াম্বিয়ার চিতাম্বো গ্রাম থেকে তাঁর মরদেহ যে আশ্চর্য যাত্রায় তানজ়়ানিয়ার উপকূলে সুদূর বাগামোয়ো বন্দরে বহন করে ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষের হাতে তুলে দেয় চুমা ও সুসি, সেও কেবল রূপকথার সঙ্গেই তুলনীয়।
[6] সে কৃতিত্ব যায় জন হ্যানিং স্পেক ও রিচার্ড বার্টনের নামে, যাদের নিয়ে উইলিয়ম হ্যারিসনের লেখা উপন্যাস ‘বার্টন অ্যান্ড স্পেক’ অবলম্বনে তৈরি হয়েছিল ১৯৯০-এর হলিউড ছবি— ‘মাউন্টেন অব দ্য মুন’। সে চাঁদের পাহাড়ের আরেক গল্প।
[7] সুবিখ্যাত এই ফোটোগ্রাফটি মিশনারি এবং ডকুমেন্টারি ফোটোগ্রাফার অ্যালিস সিলি হ্যারিসের (Alice Seeley Harris) তোলা। ইনিই সম্ভবত আলোকচিত্রে সর্বপ্রথম লিওপোল্ড অধিকৃত কঙ্গোর আসল চিত্র বাইরের পৃথিবীর কাছে তুলে ধরেন। ছবিটির কেন্দ্রীয় চরিত্রের নাম ন্সালা (Nsala)। রাবার চাষের দৈনিক কোটা পূরণ করতে না পারায় লিওপোল্ডের সৈন্য ন্সালার পাঁচ বছরের ছোট্ট মেয়ের হাত কেটে নেয়। পরে তাকে হত্যা করে। এখানেই শেষ নয়। জল্লাদেরা ন্সালার স্ত্রীকেও হত্যা করে এবং তারপরে দুজনের ছিন্নভিন্ন শরীর ক্যানিবালাইজড করে। মেয়ের কাটা হাত দুটো তারা ন্সালাকে উপহার দিয়ে মনে করিয়ে দেয় যেন আর কখনও সে তার কোটা অপূর্ণ না রাখে।