বিপুল চক্রবর্তী
ভ্রমণে যখনই যাই— যেখানেই যাই, একরাশ বিষণ্ণতা নিয়ে ফিরি। আমাদের ধোপদুরস্ত টুরিজম, মনে হয়, ভ্রমণের অর্ধেক আকাশ দেখিয়ে ফেরত পাঠায়। সেখানে টুরিস্ট গাইডের সিলেবাস মেনে এখান থেকে সেখান… এ হোটেল থেকে সে হোটেলে যাতায়াত চলতে থাকে; থাকে ঘড়ি-ধরে শপিং-উইন্ডো, স্যুভেনির-সংগ্রহ, এমনকী সোশ্যাল মিডিয়ার জন্য ডিপি-শুটেরও তাড়া। কিন্তু, সেই ভ্রমণে পাখিদের কথা, গাছেদের কথা, ধুলো-মানুষের কথা থাকে না।
এসব অস্বস্তির কথা ভাবতে-ভাবতেই বেলা গড়ায়— ভ্রমণের সময় ফুরিয়ে আসে। কিন্তু, যে ছবিগুলি খুঁজতে এসেছিলাম তার অধিকাংশই যে না-দেখা রয়ে গেল— এই অতৃপ্তির বোধ কুয়াশার মতো লেগে থাকে মনে— ভ্রমণশেষে ঘরে ফিরে আসার পরেও…
মুখ-কথা
যদিও সে রাজধানী, তবু
জয়পুরে এবারে যাব না
এসেছি উদয়পুরে, প্রিয়
ভ্রমণের দিন হাতেগোনা
চিতোর যেতেই হবে আর
তারপর মাউন্ট আবু যাব
জয়শওলমীর তার পরে
সেইখানে লোকগান পাব
দাপু খানকে পাব সেইখানে
নইলে, যাব কলাকার-ধানি
এসব তো জয়পুরে পাব না
যেহেতু সে ব্যস্ত রাজধানী
জয়পুরে এবারে যাব না
জয়পুরে এবারে যাব না
উদয়পুর
সূর্যের আগুন ঠোঁটে উড়ে আসে একঝাঁক টিয়া
ধবধবে উদয়পুর প্যালেসের চত্বরে দাঁড়িয়ে
দেখি, তারা তাদের সবুজ ছায়া
পিছোলার জলে রেখে ক্ষিপ্র উড়ে যায়
গাইড ব’লে চলে তার নানা কথা নানান কাহিনি
সেসব কি কাজে লাগে পাখিদের, তারা উড়ে যায়
তাদের সবুজ ডানা খুঁজে ফেরে
পাহাড়ের, অরণ্যের সবুজ আশ্রয়
মাঝখানে আমি, আমরা, ধোপদুরস্ত বিমূঢ় টুরিস্ট
চিতোর
চিতোর মানেই ইতিহাস থেকে
খ’সে পড়া কিছু পাতা
কিন্তু, ফোর্টে ঢুকেই দেখছি—
গাছে গাছে ফ’লে আতা
সে সবুজ থেকে দু’চোখ সরাতে
পারছি না কিছুতেই
সেই-ই তো ধাত্রী পান্না কিংবা
পদ্মাবতী বা, সেই
মীরাবাঈ-কথা— বরং আমার
হৃদয়ে অন্য টান
শুনি আমাদের গাইড, লড়াকু
মেয়েটির আখ্যান
মাউন্ট আবু
গতবার
মাউন্ট আবুর পথে সকালবেলায়
কুয়াশাখণ্ডের মতো মেয়েদের হাত থেকে
কচি কচি লাল মুলো গাড়ি দাঁড় করিয়ে কিনেছিলাম
আচম্বিতে সেই কথা মনে প’ড়ে গেল
তারপর
দিলওয়ারা টেম্পল
সঙ্গী-সাথীরা সব মুগ্ধ
কেউ কেউ এমনকী ব’লে ফেলল—
আশ্চর্য সুন্দর, তাজমহলের থেকেও নিপুণ
তারপর
শিখরে উঠেই
বন্ধুরা যে যার মতো ছড়িয়ে পড়ল
হোটেলের বারান্দায় ব’সে ব’সে একাকী আমার
আরাবল্লী পর্বতমালার বুকে বিকেলের সূর্যটিকে দেখা
জয়সওলমীর
অনেক উৎসাহ নিয়ে এসে শুনি দাপু খান নেই
মুহূর্তে আমার কাছে বদলে গেল জয়সওলমীরের মানেই
প’ড়ে রইল গানহীন চারপাশের রিক্ত বালিয়াড়ি
প’ড়ে রইল দাপুহীন সোনার কেল্লায় একা মুকুলের বাড়ি
কনৈ, কলাকার-ধানি
চিতোর
উদয়পুর
মাউন্ট আবু বা
জয়সওলমীর
দুর্গে
প্রাসাদে পাহাড়ে
মরুর বালিতে গান নেই
এবারে কোথাও কোনও গান নেই
সারিন্দা
রাবনহাতা
কামাইচা খঞ্জরা মোরচাং
কোথায় হারাল সব
কোথায় হারাল গায়কেরা
গান
খুঁজতে খুঁজতে
আমরা পৌঁছুলাম
কনৈ, কলাকার-ধানি—
কলাকারদের গানের উঠোনে
বেজে উঠল ঈষাক খানের গান
বেজে উঠল ঢোলক-খঞ্জরা আর সীমাহীন ধূ ধূ মরুভূমি
আরাবল্লী
গাছেরা আসেনি তখন মাটিতে
পাহাড় উঠেছে জেগে
প্রাক্-ইতিহাস সেই সে সময়
এখনও পাথরে লেগে
পাথরে সেজেছে রাজার প্রাসাদ
লোকালয়, ঘরবাড়ি
পাথরে পাথরে জাগে ঝংকার
যুদ্ধের তরবারি
কত যে যুদ্ধ— রাজারাজড়ার
হানাহানি, হতাহত
কত যে কাহিনি অবমাননার
যেমন, জহরব্রত
সব লীন আজ, জেগে আছে তবু
লোককথা-লোকগান
বালিতে পাথরে সারিন্দা বাজে
কামাইচা, মোরচাং
পশুপাখি আর ধুলো-মানুষেরা
রয়ে গেছে সেই সুরে
বেদনায়, প্রেমে আরাবল্লীর
প্রাচীন হৃদয়পুরে
*সমস্ত ছবি কবির সৌজন্যে