তানিয়া লস্কর ও অশোক ধনাবত
তানিয়া পেশায় আইনজীবী; অশোক সমাজকর্মী, সমাজবিজ্ঞানী, দলিত অধিকার রক্ষা আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত
কদিন থেকে দুটি ঘটনা ভারতীয় জন-মনে আলোড়নের সৃষ্টি করেছে। প্রথমটি হল প্রাক্তন সেনাপ্রধান তথা ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনির প্রথম প্রতিরক্ষা-প্রধান বিপিন রাওয়াত, তার স্ত্রী এবং ১২ জন প্রতিরক্ষাকর্মীর মৃত্যু৷ অন্যটি জঙ্গি সন্দেহে ভারতীয় সেনাবাহিনি কর্তৃক ১৪ জন নিরীহ নাগরিককের হত্যা।
এই দুটি ঘটনাই দুঃখজনক এবং মানুষের সহানুভূতির দাবি রাখে। কিন্তু যদি আমরা ভালোভাবে লক্ষ করি তাহলে দেখতে পাব যে সমস্ত মূলধারার মিডিয়া থেকে শুরু করে বিকল্প বা সামাজিক মাধ্যমেও নাগাল্যান্ডের ঘটনা নিয়ে এক অদ্ভুত নীরবতা পালন করছে। প্রথমটি নিয়ে রাজনীতিবিদ, চলচ্চিত্র অভিনেতা, ক্রিকেটার থেকে শুরু করে অনেক প্রভাবশালী ব্যক্তি সামাজিক মাধ্যমে শোক প্রকাশ করলেও পরবর্তী ঘটনাটি নিয়ে তাঁরা একবারেই নীরব।
কিছু নির্বাচিত নিপীড়নের ক্ষেত্রে নীরব থাকার সংস্কৃতি
নাগাল্যান্ড একটি উপজাতি অধ্যুষিত রাজ্য। ১৯৫৮ সাল থেকে কঠোর সশস্ত্র বাহিনি বিশেষ ক্ষমতা আইন (AFSPA)-এর অধীনে রয়েছে। এই আইনের অধীনে, যে কোনও সেনাকর্মী, এমনকি একজন নন-কমিশনড অফিসার, নিছক সন্দেহের ভিত্তিতে নাগরিকদের ওপর গুলি চালাতে পারে। আইনটির প্রয়োগ নিয়েও একটি স্বতন্ত্র বিতর্ক হতে পারে। কারণ যে পাঁচটি রাজ্যে এটি বলবৎ রয়েছে, তার মধ্যে তিনটি উপজাতি এবং বাকি দুটি সংখ্যালঘু অধ্যুষিত রাজ্য।
১৯৮০ সালে নাগা পিপলস মুভমেন্ট অফ হিউম্যান রাইটস এই আইনটিকে সুপ্রিম কোর্টে চ্যালেঞ্জ করে। কিন্তু সুপ্রিম কোর্ট এটিকে একটি অস্থায়ী ব্যবস্থা হিসাবে বহাল রাখে। এই তথাকথিত অস্থায়ী ব্যবস্থাটি এই রায়ের চার দশক পরও চালু রয়েছে। ২০১৬ সালে, মণিপুরে অনেকগুলি বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের পরিপ্রেক্ষিতে এটি আবার বিতর্কের মধ্যে আসে। সেই মামলায় AFSPA দ্বারা প্রদত্ত অধিকারের অধীনে ১,৫২৮টি বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে তদন্তের নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। তা সত্ত্বেও, ভারতীয় মিডিয়া এবং অন্যান্য গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলি আইনের নিপীড়নমূলক প্রকৃতি এবং সেই রাজ্যগুলিতে সশস্ত্র বাহিনিকে দেওয়া অযৌক্তিক দায়মুক্তি (arbitrary impunity)-র প্রতি নীরবতার সংস্কৃতি পোষণ করে চলেছে।
এই নীরবতার সংস্কৃতি যে কোনও প্রতিষ্ঠানকে অগণতান্ত্রিক তথা নৃশংসতামূলক আচরণ করতে সাহস জোগায়। ভারতীয় সেনাবাহিনি বিভিন্ন সময় জাতিগত এবং লিঙ্গপরিচয়ের ভিত্তিতে যে হিংস্রতামূলক আচরণ করেছে সেগুলোর বিচারের সময় কিছু বিশেষ অধিকার ভোগ করে আসছে। উদাহরণস্বরূপ, ২০১৪ সালের ডিসেম্বরে, একটি আদালত ভারতীয় সেনাবাহিনিকে থাংজাম মনোরমার পরিবারকে ১০ লক্ষ টাকা এক্স-গ্রেশিয়ার পরিমাণ অর্থ প্রদানের নির্দেশ দেয়, যিনি ভারতীয় সেনাবাহিনির আধা-সামরিক ইউনিট দ্বারা ধর্ষিত হয়ে নিহত হন। কিন্তু সে মামলায় কাউকে সাজা দেওয়া হয়নি।
১৯৯১ সালে কাশ্মিরের কুনান পোশপোরা নামে একটি গ্রামেও এমন ঘটনা ঘটেছিল। ২০০৭ সালে অন্ধ্রপ্রদেশের ভাকাপল্লীতে আরও একটি ঘটনায় নকশালবিরোধী অভিযান করতে গিয়ে পুলিশের বিশেষ বাহিনি গ্রেহাউন্ডস কর্মীরা বন্দুকের মুখে কোন্ধ উপজাতির ১১ জন আদিবাসী মহিলাকে গণধর্ষণ করেছিল। ভুক্তভোগীরা এখনও বিচার পায়নি।
২০১৮ সালের জানুয়ারিতে, কমলেশ যাদব নামে একজন ভারতীয় সৈন্যের পোস্ট করা একটি ভিডিও সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়েছিল। সেই ভিডিওতে তিনি অভিযোগ করেছিলেন যে তিনি সেনাবাহিনিতে জাতিগত বৈষম্যের সম্মুখীন হচ্ছেন। তিনি আরও জানান, ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে একাধিক অভিযোগ করেও তিনি এর কোনও প্রতিকার পাননি।
ভারত জুড়ে এমন অত্যাচার ও বৈষম্যের অনেক অমীমাংসিত ঘটনা রয়েছে।
মিডিয়া এবং সম্মতি উত্পাদনের বাণিজ্য
নিরাপত্তা বাহিনি নিয়ে রাজনীতি করার অভিযোগের মধ্যেই ২০১৯ সালে বিজেপি ক্ষমতায় আসে। তারপর থেকে মিডিয়া হাউসগুলি প্রত্যেক ইস্যুতেই প্রতিরক্ষা প্রতিষ্ঠানের পক্ষ নিতে শুরু করে। সেনাবাহিনিকে নিয়ে অযৌক্তিক ভাবপ্রবণতা শুরু হয়। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় নোটবন্দির কথা। নোটবন্দির মতো বিপর্যয়কর অর্থনৈতিক পদক্ষেপকে ন্যায্যতা দেওয়ার জন্য আর্মিকে টেনে আনতে দেখা গেছে। সাধারণ মানুষদের ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে থাকাকে সেনাবাহিনির বর্ডারে পেট্রোলিং-এর সঙ্গে তুলনা করে এটিকে যুক্তিযুক্ত করার প্রয়াস করতে দেখা যায়। এধরনের পক্ষপাতিত্বমূলক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে মিডিয়া সরকারের নীতিগুলির পক্ষে সম্মতি উৎপাদনে সাহায্য করেছে। সংবাদমাধ্যমগুলির এরকম অবস্থান দেশের গণতন্ত্রের প্রতি একটি বড় হুমকি হয়ে দাঁড়াচ্ছে।
এমনকি ব্রাহ্মণ্যবাদ দ্বারা প্রভাবিত ভারতীয় অ্যাকাডেমিয়াও এই ধরনের বিষয়গুলি নিয়ে চর্চার ক্ষেত্রে খুব কম আগ্রহ দেখায়। একটি পাল্টা-ন্যারেটিভের অভাবে, সাধারণ জনগণ মূলধারার মিডিয়া-ন্যারেটিভের দ্বারা প্রভাবিত হয় যা সেনাবাহিনির পাশাপাশি পুলিশদের অগণতান্ত্রিক আচরণের পক্ষেও একটি সাধারণ সম্মতি তৈরি করে।
উদাহরণস্বরূপ, আমরা অসমের আরেকটি সাম্প্রতিক ঘটনার দিকে তাকাতে পারি যেখানে ২৯ নভেম্বর এক ছাত্রনেতাকে জনতা পিটিয়ে হত্যা করেছিল। এর প্রতিক্রিয়ায় কিছু মানুষ তাৎক্ষণিক বিচারের দাবিতে সোশ্যাল মিডিয়ায় সরব হন। রাজ্যের একজন বিখ্যাত সাংবাদিককে এই অযৌক্তিক দাবিগুলির পক্ষে সওয়াল করতে দেখা যায়। তিনি যে ছেলেটি সেই হত্যায় মূল অভিযুক্ত তাকে দেখামাত্র কেন গুলি করা দরকার এই কথাটির সমর্থনে যুক্তি দেখিয়ে একটি ভিডিও সোশ্যাল মিডিয়াতে পোস্ট করেন। এবং শেষমেশ বাস্তবে প্রায় সেরকম ঘটনাই ঘটে। দুদিন পর পুলিশ জানায়, গ্রেফতারের পর পুলিশ ভ্যান থেকে পালানোর চেষ্টা করতে গিয়ে আরেকটি পুলিশ ভ্যানের ধাক্কায় সেই ছেলেটি নিহত হয়েছে। তবে সবচেয়ে আশ্চর্যের কথা হল অসমে অনেক সাধারণ লোক বাজি-পটকা ফাটিয়ে এবং স্লোগান দিয়ে এই মৃত্যুকে উদযাপন করেন।
এখানে একথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে এরকম এনকাউন্টার বা তদ্রূপ হত্যাকাণ্ডের বেশিরভাগ মানুষই জাতি, শ্রেণি বা লিঙ্গপরিচয়ে প্রান্তিক শ্রেণির মানুষ। আর যারা এগুলি সমর্থন করে কিংবা করার দাবি জানায় তারা উচ্চবর্ণ, উচ্চশ্রেণির মানুষ।
পুলিশ তথা সেনাবাহিনির পক্ষে এধরনের অন্যায্য দায়মুক্তি বা arbitrary impunity দেশে আইনের শাসনের সম্পূর্ণ পতন ঘটাতে পারে। তাই মূলধারার মিডিয়া, রাজনৈতিক দল এবং অন্যান্য গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানকে এই ধরনের ইস্যুতে নীরবতার সংস্কৃতির অবসান ঘটিয়ে জনতার পক্ষে সওয়াল করতে হবে। তা না হলে বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্র হিসেবে আমাদের সমস্ত অর্জনগুলো খুব শীঘ্রই হুমকির মুখে পড়বে।