দেবব্রত শ্যামরায়
রাজনৈতিক ভাষ্যকার
প্রথমেই দুটি সাম্প্রতিক ঘটনার কথা জানানো যাক।
খবর ১। খবরটি অসমের। ২৫ ডিসেম্বর শিলচর শহরে একটি প্রাচীন প্রেসবিটারিয়ান চার্চে ক্রিসমাসের উৎসব চলাকালীন গেরুয়া চাদরে সজ্জিত কিছু যুবক হঠাৎ আবির্ভূত হয় ও উৎসব পালনে বাধা দেয় এবং উপস্থিত হিন্দু দর্শনার্থীদের সেই স্থান ছেড়ে চলে যেতে বলে। যুবকেরা মুহূর্মুহু ‘জয় শ্রীরাম’ স্লোগান সহযোগে যা জানায় তা হল— খ্রিস্টানদের ক্রিসমাস পালনে বাধা দেওয়ার জন্য তারা এই স্থানে আসেনি। খ্রিস্টধর্মাবলম্বীদের সম্পূর্ণ অধিকার আছে যিশুখ্রিস্টের জন্মোৎসব উদযাপন করার। কিন্তু যেসব হিন্দু সেজেগুজে ক্রিসমাসের উৎসবে হাজির হয়েছেন, তারা গর্হিত অপরাধ করছেন, নিজের সংস্কৃতি ভুলে বিজাতীয় ধর্মীয় অনুষ্ঠানের পালন করছেন। ২৫ ডিসেম্বর শুধু ক্রিসমাস নয়, তুলসী পূজন দিবসও বটে। উপস্থিত হিন্দুদের উচিত আজকের দিনে চার্চে না এসে বাড়িতে বা হিন্দু ধর্মস্থানে গিয়ে তুলসী গাছের পুজো করা। এই যুবকেরা নিজেদের বজরং দলের কর্মী বলে পরিচয় দেয় ও পরে প্রশ্ন করা হলে জানায় যে কোভিড ১৯-এর নিয়ম মেনেই তারা চার্চের ভিড় হালকা করার চেষ্টা করছিল অর্থাৎ প্রকারান্তরে মুখ্যমন্ত্রীর কোভিড সংক্রান্ত নির্দেশের যথোপযুক্ত পালন করছিল।
খবর ২। দ্বিতীয় খবরটি কর্নাটকের। ২৩ ডিসেম্বর কর্নাটক বিধানসভার শীত অধিবেশনে ধর্মান্তরবিরোধী বিল, যার পোশাকি নাম কর্নাটক ধর্মাচরণের স্বাধীনতা রক্ষা বিল, ২০২১ (The Karnataka Protection of Right to Freedom of Religion Bill, 2021) ধ্বনিভোটে পাশ করানো হল। কী ছিল এই বিলে? এই বিল একজন মানুষকে ভুল বুঝিয়ে, ঠকিয়ে, জোর করে, লোভ দেখিয়ে এবং বিবাহের দ্বারা অন্য ধর্মে ধর্মান্তরিত করার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা জারি করে (The Bill prohibits conversion from one religion to another by misrepresentation, force, fraud, allurement or marriage.)। যে ব্যক্তি ওপরের কোনও একটি কাজের মাধ্যমে অপরকে ধর্মান্তরকরণের অভিযোগে অভিযুক্ত হবে, অভিযুক্ত প্রমাণিত হলে তার তিন থেকে দশবছর অবধি সশ্রম কারাদণ্ড এবং ২৫,০০০ টাকা থেকে ৫০,০০০ টাকা অবধি জরিমানা ধার্য করা হবে।
আপাতদৃষ্টিতে, এই বিলটি ভারতের সংবিধানে অনুচ্ছেদ ২৫ বর্ণিত একজন নাগরিকের ব্যক্তিগত ধর্মাচরণের অধিকারের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ। আবার বলছি, আপাতদৃষ্টিতে। কোনও পুরুষ বা নারীকে নিজ ধর্ম থেকে ভুল বুঝিয়ে বা জোর করে অন্য ধর্মে ধর্মান্তরিত করা চেষ্টা করা হলে, সেই ব্যক্তির অধিকার ক্ষুণ্ণ হয় বই কি। আর নাগরিকের অধিকার রক্ষা করা অবশ্যই সভ্য রাষ্ট্রের কর্তব্য। এর মধ্যে দ্বিমত বা তর্কের অবকাশ নেই।
কিন্ত আমরা যদি বিলের বক্তব্যের দিকে আরেকটু মনোযোগ দিয়ে তাকাই, তাহলেই এই বিলের সমস্যা ও সীমাবদ্ধতাগুলোকে স্পষ্ট দেখতে পাব। প্রথমত, misrepresentation, fraud, allurement— এই শব্দগুলির ব্যাখ্যা অনির্দিষ্ট, পরিভাষাগুলি সংজ্ঞায়িত করা হয়নি, যার ফলে এগুলিকে নানাভাবে ভেঙেচুরে ব্যাখ্যা করা যেতে পারে। কোনটা সঠিক ব্যাখ্যা বা কোন ব্যাখ্যাটি বেঠিক, এর কোনও প্রামাণ্য ‘ফ্রেম অফ রেফারেন্স’ হাজির করা কঠিন। প্রায় প্রতিটি প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মই মানুষকে নানা অপার্থিব প্রাপ্তির প্রতিশ্রুতি দেয় ও পরলোকে পরমার্থলাভের কথা শোনায়, যা অপ্রমাণিত। অর্থাৎ অভিযোগকারীর ইচ্ছানুযায়ী অন্য ধর্মের প্রায় প্রতিটি প্রতিশ্রুতিকেই লোক ঠকানোর আওতায় আনা যেতে পারে। সেক্ষেত্রে এমন একটি চূড়ান্ত অস্বচ্ছ বিল বা আইন থাকলে তা দিয়ে যে কোনও ধর্মান্তরিত ব্যক্তিকে ইচ্ছেমতো ফাঁসানো যায়, তাকে আইনি ও মানসিক নিগ্রহ করা যেতে পারে। কারণ বিলে বর্ণিত নিয়ম অনুযায়ী, ধর্মান্তরে আগ্রহী ব্যক্তিকে ধর্মান্তরের সর্বনিম্ন তিরিশ দিন আগে জেলাশাসককে ধর্মান্তরের কারণ জানিয়ে আবেদন করতে হবে। জেলাশাসক প্রশাসন ও পুলিশকে কাজে লাগিয়ে ধর্মান্তরের প্রকৃত কারণ অনুসন্ধান করবেন। তিনি অনুমতি দিলে তবেই ধর্মান্তর গ্রাহ্য হবে। অর্থাৎ জেলাশাসকের অনুমতি না পেলে ভিনধর্মী দুই তরুণ-তরুণীর বিবাহও এই নতুন আইনের বলে আটকে দেওয়া যেতে পারে। অপরদিকে, আমাদের দেশে নরনারীর আন্তঃধর্ম বিবাহ এই দেশের বহুত্ববাদী সংস্কৃতিকে জোরদার করার দিকে একটা উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ বলে গণ্য হতে পারত।
বস্তুত, কর্নাটকের আগে যে কটি রাজ্যে এই ধরনের ধর্মান্তরবিরোধী আইন কার্যকর করা হয়েছে, যেমন গুজরাট, উত্তরপ্রদেশ, ছত্তিশগড়, মধ্যপ্রদেশ, ঝাড়খণ্ড, উত্তরাখণ্ড, অরুণাচল প্রদেশ, হিমাচল প্রদেশ— বলা বাহুল্য, প্রতিটি রাজ্যেই ভারতীয় জনতা পার্টি অথবা তাদের ঘনিষ্ঠ সহযোগী দল ক্ষমতায় আছে, এবং প্রতিটি রাজ্যেই এই আইনের মাধ্যমে সংখ্যালঘুদের, বিশেষত খ্রিস্টান ও মুসলিম নাগরিকদের প্রতি অত্যাচার নামিয়ে আনা হয়েছে, তাদের অধিকার খর্ব করা হয়েছে। উত্তরপ্রদেশে এই আইনের বাজারচালু নাম, অ্যান্টি লাভ-জেহাদ আইন। আমরা সময় করে ইন্টারনেটে একটু খোঁজ করলেই জানতে পারব এই আইনের বলে উত্তরপ্রদেশে প্রেমসম্পর্কে আবদ্ধ বা বিবাহে ইচ্ছুক কয়েকশো ভিনধর্মী তরুণ-তরুণীকে কীভাবে হয়রান করা হয়েছে, কত সংখ্যক মুসলিম তরুণকে জেলে পোরা হয়েছে।
মুসলিমদের ক্ষেত্রে যেমন লাভ-জিহাদ, খ্রিস্টান চার্চের ক্ষেত্রে তেমনিভাবে খাদ্য-বস্ত্র-শিক্ষার লোভ দেখিয়ে ঢালাও ধর্মান্তরকরণ— এই ধরনের ধারণা, বেশ কিছুটা অর্ধসত্য এবং অনেকখানি মিথ্যার ভিত্তিতে দীর্ঘদিন ধরে সযত্নে ও সুকৌশলে প্রচার করে সাধারণ্যে ধর্মান্তরকরণের মিথটি গড়ে তোলা হয়েছে। ফলস্বরূপ, বিগত চার দশক ধরেই আক্রান্ত হচ্ছেন মিশনারিরা। ১৯৯৯-এ গ্রাহাম স্টেইন ও তাঁর দুই শিশুসন্তানকে জ্বলন্ত পুড়িয়ে মারার স্মৃতি আমাদের স্মৃতিতে এখনও রক্তাক্ত। তাঁর প্রতিও গ্রামবাসীকে ধর্মান্তরিত করার অভিযোগ ছিল। স্টেইন হত্যার পর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী লালকৃষ্ণ আদবানি ঘটনার তদন্তের জন্য ওয়ার্ধা কমিশন বসান যা তদন্ত শেষ করে রিপোর্ট দেয় যে গ্রাহাম স্টেইনের কর্মক্ষেত্র ওড়িশার কেওনঝড়ে খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীদের সংখ্যায় কোনও বৃদ্ধি হয়নি। পাশাপাশি আদমশুমারি থেকে প্রাপ্ত তথ্য আমাদের দেশে খ্রিষ্টান জনসংখ্যা সম্বন্ধে কী বলছে দেখা যাক।
সাল | ভারতের খ্রিস্টধর্মাবলম্বীদের জনসংখ্যা (মোট জনসংখ্যার শতাংশের ভিত্তিতে) |
১৯৭১ | ২.৬০ |
১৯৮১ | ২.৩৪ |
১৯৯১ | ২.৩৪ |
২০০১ | ২.৩০ |
অর্থাৎ বিগত পাঁচ দশকে ভারতবর্ষে খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীদের সংখ্যা তো বাড়া দূরের কথা, শতাংশের বিচারে কমেছে। এই একটিমাত্র টেবিলের সাহায্যে আমাদের দেশে খ্রিস্টান মিশনারি কর্তৃক বিপুল সংখ্যক হিন্দুর ধর্মান্তরিত হওয়ার মিথের বেলুনটিকে ফুটো করে দেওয়া সম্ভব। অথচ গণপরিসরে যেকোনও নন-অ্যাকাডেমিক আলোচনায় কান পাতলেই বোঝা যাবে যে মিশনারিদের দ্বারা ধর্মান্তরকরণের মিথটি সাধারণ হিন্দুর মনে কতখানি গভীরে শিকড় ছড়িয়েছে।
দীর্ঘদিন ধরে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে লাগাতার এই অপপ্রচার চালানো হয়েছে। তার কারণ সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের অপরায়ণ ও দানবায়ণের মাধ্যমেই সংখ্যাগুরুর পরিচিতি-নির্ভর রাজনীতি পুষ্ট হয় এবং অন্য সমস্ত সামাজিক-অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে ব্যর্থ হয়েও শাসক নিজের আধিপত্য বজায় রাখতে পারে। হ্যাঁ, একথা ঐতিহাসিকভাবে সত্য যে খ্রিস্টধর্ম ও ইসলাম ভারতীয় উপমহাদেশে পা রাখার পর ধর্মপ্রচারের মাধ্যমে নিজের অবস্থান দৃঢ করেছিল, ব্রাহ্মণ্যবাদী ধর্মে উচ্চবর্ণের অত্যাচার ও জাতপাতের অভিশাপ থেকে বাঁচতে সমাজের নিচের দিকে থাকা একটা বড় অংশের প্রান্তিক মানুষ ধর্মত্যাগ করেছিলেন, মানুষ হিসেবে ন্যায্য সম্মান, সামাজিক ন্যায় ও স্বাচ্ছন্দ্যের আশায়, যা তারা জন্মসূত্রে শূদ্র হিসেবে পাচ্ছিলেন না। পরবর্তীকালে এর সবচেয়ে বড় উদাহরণ স্বাধীন ভারতের সংবিধানপ্রণেতা বাবাসাহেব আম্বেদকর স্বয়ং। বঞ্চিত দলিত মাহার সম্প্রদায়ের সন্তান আম্বেদকর ঘোষণা করেছিলেন— তিনি হিন্দু শূদ্র হিসেবে জন্মগ্রহণ করেছেন বটে কিন্তু তিনি হিন্দু হিসেবেই মৃত্যুবরণ করবেন না। তিনি তা করেনওনি, মৃত্যুর দুমাস আগে ১৯৫৬ সালের ১৪ অক্টোবর বাবাসাহেব নাগপুরে নিজের বিপুল সংখ্যক অনুগামীকে নিয়ে প্রকাশ্য অনুষ্ঠানে বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করেছিলেন। অর্থাৎ ভারতের ইতিহাসে ব্রাহ্মণ্যধর্মের নিগড় থেকে বেরিয়ে প্রান্তিক মানুষের অন্য ধর্ম গ্রহণ করার দায় ব্রাহ্মণ্যবাদ নিজেই এড়াতে পারে না, আর সেটা আজও বিজেপিসহ দেশের হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির শিরঃপীড়ার একটি বড় কারণ। ব্রাহ্মণ্যধর্মের অত্যাচার নানা রূপে আজও চলছে, তাই চুনী কোটাল বা রোহিত ভেমুলাকে আত্মহত্যার পথ বেছে নিতে হয়। ধর্মাচরণের স্বাধীনতা রক্ষার এই আইন তাই আসলে একটি ভানমাত্র। আসল উদ্দেশ্যে হিন্দুধর্ম (পড়ুন ব্রাহ্মণ্যবাদের আওতা) থেকে একটি মানুষও যেন অন্য ধর্মের ছাতার তলায় চলে না যায়।
দেশের শাসকগোষ্ঠীর এই ভানটি আরও স্পষ্ট হয়ে যায় কর্নাটক বিধানসভায় আলোচ্য বিলে উল্লেখ্য ব্যতিক্রমের দিকে তাকালে। বিলে একটিমাত্র ব্যতিক্রমের কথা বলা আছে যেক্ষেত্রে ধর্মান্তর গ্রাহ্য হবে। যদি কোনও ব্যক্তি তার বর্তমান ধর্ম থেকে নিজের আগের বা পূর্বসূরির ধর্মবিশ্বাসে পুনরায় ফিরে যেতে চায়, একমাত্র তাহলেই সেই ধর্মান্তর গ্রাহ্য হবে (Exemption: The Bill provides an exemption in the case of a person who “reconverts to his immediate previous religion” as “the same shall not be deemed to be a conversion under this Act”)। স্পষ্টতই, দলিত মুসলিম বা খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী মানুষ যদি পৈতৃক ধর্মমত অর্থাৎ ব্রাহ্মণ্যবাদের অধীনের ফিরে যেতে চায়, একমাত্র তাহলেই তাকে নিঃশর্ত অনুমতি দেওয়া হবে। এর সহজ অর্থ, ঘর-ওয়াপসি চালু থাকবে, কিন্তু হিন্দুর ধর্মত্যাগ মেনে নেওয়া যাবে না। আমাদের প্রতর্কটি সম্বন্ধে আমরা আরও সুনিশ্চিত হই যখন জানতে পারি, এই বিল সংক্রান্ত বিতর্ক চলাকালীন কর্নাটকের গ্রামোন্নয়ন ও পঞ্চায়েতরাজ মন্ত্রী কে এস ঈশ্বরাপ্পা মন্তব্য করেছেন যে— আমরা ধর্মরক্ষা করবই। আমাদের এ কাজে যারাই বাধা দিতে আসুক না কেন, তাদের কেটে টুকরো টুকরো করে ফেলা হবে। (“We will protect the dharma. We will cut into pieces whoever comes in the way.”)
এই পর্যন্ত এসে আমরা যদি খবর ১ এবং খবর ২-কে মেলানোর চেষ্টা করি, তাহলে দেখতে পাব দুটো খবরকেই একটা বিশাল জিগস পাজলের দুটো আলাদা আলাদা খোপে নির্ভুল সামঞ্জস্যে বসিয়ে দেওয়া যায়। এই বিরাট জিগস পাজলের আরেকটা খবরের টুকরো নিশ্চিতভাবে সুপ্রিম কোর্টের বাবরি মসজিদ সংক্রান্ত রায় ঘোষণা। তার পরবর্তী টুকরোটা নিশ্চয়ই প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি কর্তৃক অযোধ্যায় রাম মন্দিরের ভূমিপূজন। পাজলের আরেকটি টুকরো এনআরসি, সিএএ। আসলে সবকটা টুকরো একসঙ্গে মিলিয়ে ফ্যাসিস্ট হিন্দুরাষ্ট্রের সর্বগ্রাসী রূপটি ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে উঠছে। সংবিধান-বর্ণিত ধর্মনিরপেক্ষ ভারতের ধারণার থেকে এক ইঞ্চি দু ইঞ্চি করে হিন্দু ভারতের ধারণার দিকে সরে সরে যাচ্ছি আমরা, এই ছোট ছোট ঘটনাগুলি সেই বৃহত্তর হিন্দুরাষ্ট্র নির্মাণের একেকটি প্রয়োজনীয় ইট ও পাথর।
আরও ভয়ানক হল, আজ থেকে তিরিশ বছর পূর্বে সংখ্যালঘুদের মনে ভয় ধরানোর জন্য রাষ্ট্র-বহির্ভূত গুণ্ডা বা লুম্পেন বাহিনির ওপর নির্ভর করতে হত। উদাহরণ, ১৯৯২ সালে বাবরি মসজিদ ভাঙতে করসেবকদের শরণাপন্ন হতে হয়েছিল। আর ২০২১-এ পৌঁছে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে বলিয়ান হয়ে প্রধানমন্ত্রী নিজে রাম মন্দিরের ভিত্তিপূজা করলেন এবং আসমুদ্রহিমাচলে একটিও সংসদীয় বিরোধী দল এই কাজের নিন্দায় একটি শব্দও ব্যবহার করতে পারল না। যাজক গ্রাহাম স্টেইনকে মারার জন্য সেদিন কিছু মগজধোলাই হওয়া গুণ্ডাবাহিনীকে কাজে লাগাতে হয়েছিল, আজ ধর্মান্তরকরণ-বিরোধী বিল রাষ্ট্রকে সরাসরি ও সরকারিভাবে সংখ্যালঘুকে হেনস্থা করার অধিকার অর্পণ করল। অর্থাৎ যে কাজগুলো আগে সংসদ-বহির্ভূত শক্তিকে কাজে লাগিয়ে বেআইনি পথে করতে হত, আজ সেই একই কাজ সংসদে-বিধানসভায় দাঁড়িয়ে আইনি স্বীকৃতি নিয়েই মাথা উঁচু করে করা যাচ্ছে।
গত তিন দশকে এটাই সংখ্যাগুরুর ধর্মীয় আধিপত্যবাদী রাজনীতির অগ্রগতি, আর ভারতবর্ষ নামক উদার বহুস্তর ও ‘ইনক্লুসিভ’ ধারণাটির পিছু হটা। রোম নগরী একদিনে তৈরি হয়নি, হিন্দুরাষ্ট্রও একদিনে তৈরি হবে না। প্রতিদিন আমাদের চোখের সামনে আমরা তাকে একটু একটু করে নির্মিত হয়ে উঠতে দেখছি।