সমর বাগচি
পরিবেশবিদ, প্রাবন্ধিক
২০২১-এর রেকর্ডভাঙা তাপদাহ, অরণ্যে আগুন, হাড়হিম করা ঠান্ডা এবং প্রবল বারিপাত আমাদের বোঝাচ্ছে যে অস্বাভাবিক আবহাওয়া হচ্ছে এখন খুবই স্বাভাবিক (New Normal)। পৃথিবীর সব বিখ্যাত জলবায়ুবিজ্ঞানীরা জানাচ্ছেন যে এটা আজ এক “প্রতিষ্ঠিত সত্য” (established fact) যে মানুষ যে গ্রিনহাউস গ্যাস বাতাসে ছাড়ছে তার ফলেই ঘটছে ঘনঘন চরম আবহাওয়ার অবস্থার সৃষ্টি।
United Nations Framework Convention on Climate Change (UNFCC)-এর প্রাক্তন প্রধান Christiana Figueres বলছেন, “The sad fact is climate cange and extreme weather have become the norm.” তাপামাত্রা সাধারণত গড়ে এক ডিগ্রির ভগ্নাংশর মত বাড়ে। কিন্তু, এই বছরের জুন মাসের শেষে কানাডার লিটন নামে এক গ্রামের তাপমাত্রা ৫ ডিগ্রি বেড়ে ৪৯.৬ ডিগ্রি সেলসিয়াসে পৌঁছোয়। পরের দিন একটা wild fire ওই গ্রামের এক বড় অংশকে বিধ্বস্ত করে। উত্তর গোলার্ধের নানা জায়গায় বিপর্যয় নেমে আসে। সাইবেরিয়ার উত্তরের অরণ্য (boreal forest) আগুন লেগে ঝলসে যায়। আমেরিকার ক্যালিফোর্নিয়ার অরণ্যে প্রতি বছর আগুন লাগে। এবছরের আগুন ৩৯০০০ হেক্টর অরণ্যকে ধ্বংস করে রেকর্ড সৃষ্টি করে। গ্রিস ও তুরস্কেও বিরাট খারাপ প্রভাব পড়ে। সারা পৃথিবী জুড়ে যে অরণ্যে আগুন লাগছে তার ফলে রেকর্ড পরিমাণ কার্বনের নিঃসরণ ঘটেছে। যার ফলে পৃথিবী উত্তপ্ত ও শুষ্ক হয়েছে।
জুলাই মাসে তুরস্কে তাপমাত্রা বিরাটভাবে বাড়ে। আগস্ট মাসে ইটালির সিসিলিতে ইউরোপের সবচেয়ে বেশি তাপমাত্রা অনুভূত হয়। দক্ষিণ আমেরিকায় বিভিন্ন দেশে খরা দেখা দেয় যার ফলে ঐ মহাদেশের দ্বিতীয় দীর্ঘতম নদী প্রানার জলের তল বিরাটভাবে নেমে যায় যা বিগত ৭৭ বছরে দেখা যায়নি।
তাপমাত্রা বৃদ্ধিই শুধু একমাত্র সমস্যা নয়। আমেরিকার টেক্সাসে হাড় কাঁপানো শীত নেমে আসে। ফেব্রুয়ারি মাসে সাধারণত যে তাপমাত্রা ওখানে হয় তার চেয়ে ২৮ ডিগ্রি কমে যায়। ওই ঠান্ডায় পাইপে জল জমে যায় এবং বিদ্যুৎব্যবস্থা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বিজ্ঞানীরা সন্দেহ করছেন যে এর কারণ বোধহয় উত্তর মেরুর বরফের গলে যাওয়া যা আবহাওয়া ব্যবস্থাকে বিপর্যস্ত করছে।
জলবায়ুর পরিবর্তন আমাদের অস্তিত্বের সঙ্কট সৃষ্টি করছে। সেই সঙ্কট শুরু হয়ে গেছে। বিভিন্ন দেশে ভয়ঙ্কর বন্যা হচ্ছে। চিনের হেনান জেলার ঝেংঝৌ শহরে ২০ জুলাই এক ঘন্টায় ২০০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয় যা সর্বকালের এক জাতীয় রেকর্ড। শহরের মেট্রো জলে ডুবে গিয়ে ১৪ জন মারা যায়। ওই মাসেই জার্মানি ও বেলজিয়ামে বিরাট বৃষ্টিতে ধ্বস নামার ফলে ২০০ লোকের মৃত্যু হয়। দক্ষিণ সুদানে পরপর তিন বছর বিরাট বন্যা হয়। ভারতের বিভিন্ন প্রদেশে বন্যা নেমে আসে। সেপ্টেম্বর মাসে যখন আমেরিকার পূর্ব উপকূলে হারিকেন ইডা ঝাঁপিয়ে পড়ে তখন নিউইয়র্কের তলঘর ডুবে যায়।বহু মানুষ ডুবে জায়। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বলেন, “Climate change poses an existential threat of our lives, our economy, and threat is here.”
এই বছরে স্কটল্যান্ডের গ্লাসগো শহরে ৩০ নভেম্বর থেকে ১৩ ডিসেম্বর কপ-২৬ হয়ে গেল। ১৯৭টা দেশের প্রতিনিধি সেখানে উপস্থিত ছিলেন। সম্মেলন শুরু হওয়ার আগে রাষ্ট্রসংঘের প্রধান Antonio Gueteres ও IPCC-র বিজ্ঞানীরা জলবায়ু পরিবর্তনের আসন্ন বিপদের কথা জানান। কিন্তু, ভারত, চিন ও জীবাশ্ম জ্বালানি লবির বিরোধিতার জন্য কার্বন ডাই অক্সাইডকে ‘phase out’ করার ব্যাপারে কোনও সিদ্ধান্ত নেওয়া গেল না। জীবাশ্ম জ্বালানিকে মাটির নিচে রাখতে হবে। তবে কি বিজনেস যেমন চলছিল চলতেই থাকবে? যদি তাই হয় তাহলে Feed Back Loop শুরু হয়ে যাবে। তখন তাপ বৃদ্ধিকে আর রোখা যাবে না। ডেভিড ওয়ালেস ওয়েলস ২০১৯ সালে প্রকাশিত তাঁর “An Uninhabitable Earth” গ্রন্থে বলছেন যে একইভাবে সমাজ চললে পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়ে যাবে। কোন এক ভগ্ন পৃথিবী রেখে যাব ভবিষ্যৎ বংশধরদের জন্য? তাহলে মানুষ কি বিলুপ্ত হবে পৃথিবী থেকে? যেমন বলছেন স্ট্যানফোর্ড, প্রিন্সটন ও বারক্লে-র বিজ্ঞানীরা? রবীন্দ্রনাথ ‘সভ্যতার সংকট’-এ বলছেন, “মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারানো পাপ।” কিন্তু, ৯০ বছরের এই আমি তো আর এই সর্বগ্রাসী ভোগবাদী সভ্যতার প্রতি বিশ্বাস রাখতে পারছি না। যেখানে মানুষ নিজের কবর নিজেই খুঁড়ছে।