যুগান্তর মিত্র
আচমকা ‘ম্যাও’ শব্দে পিছন ফিরতেই বিড়ালটাকে দেখে চমকে উঠেছিলাম। অবিকল ভালোকাকিমার বিড়ালের মতো দেখতে। সেইরকমই চকচকে কালো পশমে ঢাকা। ডাকটাও একইরকম! এটা এখানে এল কী করে? এত দূরে আসার তো কথা নয়!
অফিসের কাজে এসেছিলাম পঙ্কজ পালের বাড়িতে। সরু গলি, দু-পাশে গায়ে-গায়ে বাড়ি। ফলে গলিটায় এমনিতেই আলো কম ঢোকে। তার ওপর সন্ধে হয়ে গেছে। স্ট্রিটলাইটের পোস্ট বেশ খানিকটা দূরে। সবমিলিয়ে কেমন একটা রহস্যময় পরিবেশ। অনেক খোঁজাখুঁজি করে অবশেষে গলিটার সন্ধান পেয়েছিলাম। পঙ্কজ পালের হাতে ফাইলটা দিয়ে সামান্য কিছু কথাবার্তা বলে যখন ফিরছি, সেইসময় আবার চোখে পড়ল বিড়ালটাকে।
আমার সবসময়ই মনে হয় ভালোকাকিমার বিড়ালটার চোখজোড়া সবুজ হলে মানানসই হত। কিন্তু তার বদলে লালচে এবং খানিকটা ঘোলাটে। দেখলেই ভয়-ভয় করে। ভালোকাকিমাকে দেখলেও আজকাল ভয়ে কুঁকড়ে যাই আমি। আমার বিশ্বাস, ভালোকাকিমা মায়াবী জাদু জানেন।
ভালোকাকু যখন আমাদের বাড়িতে প্রথম আসেন, তখন আমি খুবই ছোট। আমার বাবার সঙ্গে এক ট্রেনে যাতায়াত করতেন। সেই সূত্রেই চেনাজানা এবং ভালো সম্পর্ক। আমাদের বাড়ি থেকে বেশ কিছুটা দূরে ভালোকাকুদের বাড়ি।
ছোটবেলায় ‘ভোলা’ শব্দটা আমার কাছে হয়তো অপরিচিত ছিল। তাই আমি বলতাম ‘ভালোতাতু’। বড় হয়েও ভালো ডাকটাই থেকে গেল। শুধু তাতুর বদলে কাকু ডাকা শুরু করেছিলাম। আর কাকিমাকে সেজন্যই ভালোকাকিমা ডাকি।
ভোলাকাকু বা ভালোকাকুর বাড়িতে আগে কখনও যাইনি। বাবাও কোনওদিন নিয়ে যেতে চাননি। যখনই বলেছি, বাবা হাসিমুখে বলতেন, যাবি যাবি, এত তাড়া কীসের? ভালোকাকুও শুনে হাসতেন। কিন্তু যাওয়ার কথা বলতেন না। আমার খুব অভিমান হত।
ট্রেনযাত্রীদের মধ্যে প্রতি শীতকালে পিকনিক হত। ফ্যামিলি পিকনিক বলে আমরাও যেতাম। তবে মা কোনওদিন যেতে চাননি। বাবার শত জোরাজুরিও ব্যর্থ হয়েছিল। সংসার সামাল দিতেই ব্যস্ত থাকতেন মা। প্রথম যেবার পিকনিকে গিয়েছিলাম, সেবারই কাকিমাকে প্রথম দেখি। প্রতি পিকনিকেই কাকিমা আসতেন আর প্রতিবারই আমাকে কাছে ডেকে নিতেন। আমার মাথাটা বুকের মধ্যে চেপে ধরতেন। তাঁর ছেলেমেয়ে ছিল না বলে আমাকে ছেলের মতোই ভালোবাসতেন। পিকনিকে যোগ দেওয়া আর কারও ছেলে বা মেয়ে আমার মতো ছোট ছিল না। তাই ভালোকাকিমার সব আদর আমারই প্রাপ্য ছিল যেন। মা এসব শুনে মুখ টিপে হাসতেন।
ক্লাস ইলেভেনে উঠে ভালোকাকুদের বাড়ির কাছাকাছি মৈনাকস্যারের বাড়িতে সপ্তাহে দুদিন অ্যাকাউন্টেন্সি পড়তে যেতাম। সেখান থেকে প্রায় প্রতি সপ্তাহেই যেতাম ওই বাড়িতে। ভালোকাকিমার অপরূপ সৌন্দর্য, নাকি অত্যন্ত স্নেহ আমাকে টেনে নিয়ে যেত, জানি না। বাবা বলতেন, এত যাস না পলাশ। কাকিমা রাগ করতে পারেন। আমি বাবার কথা উড়িয়ে দিতাম। অনেক সময় বাড়িতে বলতামও না সেখানে যাওয়ার কথা। মাকেও বলতে চাইতাম না।
ভালোকাকিমাকে দেখে খুব অবাক হতাম প্রথমদিকে। বাড়ির বাইরে যতটা খোলামেলা, বাড়িতে তেমনটা নন। হঠাৎ হঠাৎ চুপ হয়ে যেতেন। যেন কোনও ভাবনার গভীরে হারিয়ে যেতেন। আর ছিল ঈশ্বরে অসীম ভক্তি। ঘরের দেওয়ালে অনেক দেবতার মূর্তি আঁকা ক্যালেন্ডার ছিল। কাকিমা কথায় কথায় সেদিকে তাকিয়ে কপালে হাত ঠেকাতেন।
অথচ ভালোকাকু ঈশ্বরে বিশ্বাস করতেন না। বাবার কাছে শুনেছি, কোনও মন্দিরে গেলে জুতো খুলতে হবে বলে ভেতরে ঢুকতেন না কাকু। আসলে ভালোকাকু সিপিএম করতেন। বেশ জোরালোভাবেই পার্টি করতেন। পার্টির নির্দেশিকা অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলতেন। অবশ্য সিপিএমের সমর্থক বা দলীয় কর্মী হলেই যে ঠাকুর-দেবতায় বিশ্বাসী হবেন না, তা নয়। আমার বাবাও সিপিএম সমর্থক। কিন্তু পুজো-আচ্চা নিয়ে বেশ মেতে থাকেন।
একবার হাসতে হাসতে ভালোকাকু বলেছিলেন, তোর কাকিমার দুটো পোষ্য আছে এবাড়িতে। একটা মাটির কালীপ্রতিমা আর অন্যটা রক্ত-মাংসের বিড়াল।
–আহা, এভাবে বোলো না! মাকালী আমার পোষ্য কেন হবেন? আমিই বরং কালীমায়ের পোষ্য। আমাকে মাকালী অনুগ্রহ করেন বলেই বেঁচে আছি। দেওয়ালের কালীপ্রতিমার ছবির দিকে তাকিয়ে কপালে হাত ঠেকিয়ে বলেছিলেন কাকিমা।
–বোঝার চেষ্টা কর পলাশ, বাজারহাট আমি করি। আমার পয়সায় কালীঠাকুরের পুজো হয়। আর বলে কিনা কালীর পোষ্য নাকি ও! দমকে দমকে হাসি ছড়িয়ে পড়েছিল ঘরে। তুলোবীজের মতো। আমিও হেসে উঠেছিলাম বলে কাকিমা খুব রেগে গিয়েছিলেন সেদিন।
–তুই কিন্তু তোর কাকার পাল্লায় পড়িস না পলাশ। ঠাকুরের প্রতি ভক্তিশ্রদ্ধা রাখিস! কাকিমা চোখ পাকিয়ে বলেছিলেন। আমি হাসি থামিয়ে যতটা সম্ভব মুখ গম্ভীর করে বসেছিলাম।
পার্টি যখন হেরে গেল রাজ্যজুড়ে, চারিদিকে পার্টি অফিস ভাঙচুর চলছিল, তখন থেকেই ভালোকাকু ক্রমশ ঝিমিয়ে পড়তে লাগলেন। সেই উচ্ছ্বলতা হারিয়ে গেল। অফিসে যাতায়াত ছাড়া বাড়ির বাইরে বড়-একটা যেতেন না। এমনকি আমাদের বাড়িতে আসাও বন্ধ করে দিয়েছিলেন। পার্টি অফিসে যাওয়ার প্রশ্নই ছিল না। তখন সেটা বিরোধী দলের অফিস হয়ে গেছে। একসময় চাকরি থেকে অগ্রিম অবসর নিয়ে বাড়িতে বসে পড়লেন ভালোকাকু। আমিও ইতিমধ্যে শাসক দলে নাম লিখিয়েছি। কাজকর্ম পেতে গেলে এছাড়া উপায় ছিল না ভেবেছিলাম। কিন্তু কোনও চাকরিই জোটেনি। অবশেষে ভালোকাকুর রেফারেন্সেই এই চাকরিটা পেয়েছি। প্রাইভেট ফার্ম। অ্যাকাউন্টস অ্যাসিসট্যান্ট নামেই। আসলে কিছুই করতে হয় না অ্যাকাউন্টসের। বরং অন্য কাজই বেশি করতে হয়। নানা ক্লায়েন্ট আসে অফিসে। তাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখাটাই এখন আমার একমাত্র কাজ। সেই সূত্রেই আজ একটা ফাইল দিতে এসেছিলাম এখানে।
পঙ্কজ পালের বাড়িতে যাওয়ার সময় বিড়ালটাকে দেখে খানিকটা সংশয় ছিল। ফেরার সময় আচমকা বিড়ালটা লাফ দিয়ে পাঁচিলের উল্টোদিকে নেমে গেল। লেজের ঠিক গোড়ায় একটুকরো সাদা পশম দেখেছিলাম। আমি নিশ্চিত হয়ে গেলাম ভালো কাকিমার বিড়ালই এটা। পাঁচিল থেকে নামার সময় আগের মতোই ‘ম্যাও’ করে উঠেছিল। বিস্ময় আর ভয় মিলেমিশে আমার শিরদাঁড়া দিয়ে একটা হিমস্রোত বয়ে গেল। ও কি আমার পিছু নিয়েছে? কিন্তু কেন?
ভাবতে ভাবতে দ্রুত রাস্তা পেরোনোর সময় দেখলাম বিড়ালটা আমার পেছন পেছন আসছে। মনে হল দ্রুত জায়গাটা থেকে চলে যেতেই হবে আমাকে। বিড়ালের পিছু নেওয়া আমাকে ভীত করে তুলেছিল। হাত-পা অসাড় হয়ে আসছিল ক্রমশ।
প্রায় দৌড়ে বড় রাস্তায় উঠতেই সামনে একটা ফাঁকা টোটো পেয়ে গেলাম। যেন আমার জন্যই অপেক্ষায় ছিল। এক লাফে টোটোতে উঠে পড়ে বললাম, ‘স্টেশনে যাব’। টোটোচালকও কোনও কথা না-বলে চালাতে শুরু করে দিল। পিছন ফিরে বিড়ালটাকে দেখতে না-পেয়ে স্বস্তি পেলাম। সঙ্গে সঙ্গে কাকিমার মুখটা ভেসে উঠল চোখের সামনে।
–তুই নিশ্চয়ই আমাকে ভুল বুঝিসনি পলাশ! আমার সামনে আর কোনও পথ খোলা ছিল না, বিশ্বাস কর! বাইরের ঝিরঝিরে বৃষ্টির শব্দের সঙ্গে কাকিমার কথাগুলো মিশে যাচ্ছিল।
আমি অবাক হয়ে তাকিয়েছিলাম কাকিমার দিকে। খোলা চুলে সুন্দরী কাকিমার মুখে বিষণ্ণ ছায়া দুলে উঠতে দেখেছিলাম। আচমকা বিড়ালটা তার উঁচু-করা লেজ আমার পায়ে বুলিয়ে চলে গেল। অন্যদিন হলে বিরক্ত হতাম। যদিও সেই বিরক্তি কখনও প্রকাশ করিনি। কেননা প্রিয় পোষ্যের অবমাননা কাকিমা মেনে নিতে পারতেন না। এই নিয়ে ভালোকাকুকেও অনেকবার কথা শুনিয়েছেন আমার সামনেই। তবে মনে মনে রাগ আর বিরক্তি মিলেমিশে যেত। কাকিমার আড়ালে বিড়ালটার দিকে কটমট করে তাকাতাম। আর সে ঐ লালচে ঘোলাটে চোখে স্থির হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে থেকে চলে যেত কোথাও। যেন আমাকে নিরাসক্ত ভাব দেখিয়ে আসলে উপেক্ষা করছে। আমার রাগ আরও বেড়ে যেত। কিন্তু সেদিন কাকিমার কথা শোনার পরও আমার কোনও ভাবান্তর হয়নি বিড়ালটাকে নিয়ে। আশ্চর্য ঘটনা হল, বিড়ালটা তবু ঠান্ডা চোখে আমার দিকে তাকিয়ে কিছুক্ষণ দেখেছিল। তারপর যথারীতি চলে গিয়েছিল কোথাও।
সেদিন একটু আগেই ভালোকাকুর বাড়িতে ঢুকেছিলাম। আগেরদিনই কাকিমা বলেছিলেন কাকুর এক ভাগ্নে আসবে। আমারই বয়সি। যদিও সে কী কারণে যেন আসেনি। আমি অবশ্য হতাশ হইনি শুনে। কেননা তাকে আমি চিনি না। সমবয়সি হলেও সে কেমন ছেলে, আমি জানতাম না। তাই তাকে নিয়ে আগ্রহ তৈরি হয়নি।
অবাক হয়ে দেখছিলাম ভালোকাকু চুপ করে বসে বৃষ্টির দিকে তাকিয়ে আছেন। আমি যে এসেছি, খেয়াল করেননি। আজকাল কোনওকিছুই খেয়াল করেন না কাকু। মাথাটা বিগড়ে যাওয়ার পর ভালোকাকুকে মাটির দিকে তাকিয়ে বসে থাকতেই দেখেছি। ঘাড় একদিকে কাত করা থাকত। বেশিরভাগই বামদিকের ঘাড় নুয়ে পড়ত। মুখ থেকে লালা পড়ত গড়িয়ে। এমনভাবে বসে থাকতেন যে ভালোকাকুর থাইয়ের ওপর সেই লালা টপটপ করে পড়ত। তারপর সেসব গড়িয়ে নামত সাদাকালো চকমেলানো মেঝেয়। যেন ভালোকাকু তাঁর লালারসে দাবার বোর্ড ভিজিয়ে দিতে চাইছেন।
–ভালোকাকু এমন হয়ে গেলেন কী করে কাকিমা? প্রশ্নটা বেরিয়ে এসেছিল মুখ থেকে।
–ওর এইরকম হওয়ার জন্য কে দায়ী জানিস?
–কে কাকিমা? কৌতূহল তীব্র হয়ে উঠেছিল আমার।
–কে আবার! ও নিজেই। চকিতে বলে উঠেছিলেন কাকিমা।
–ভালোকাকু কী করেছিলেন?
–অনেক কিছুই। তবে সত্যি কথা বলতে কী, আমার জন্যই ও এইরকম হয়ে গেছে।
একবার বলছেন কাকু নিজেই দায়ী, আবার বলছেন কাকিমাই এর জন্য দায়ী! আমার মাথা গুলিয়ে গিয়েছিল। ধাতস্থ হতে সামান্য সময় লেগেছিল। জিজ্ঞাসা করেছিলাম, কী হয়েছিল কাকিমা? একটু খুলে বলো না!
সিঁড়ির দিকে তর্জনী উঁচিয়ে কাকিমা মৃদুকণ্ঠে জবাব দিয়েছিলেন, ঐ ওপর থেকে তোর কাকুকে ধাক্কা মেরে ফেলে দিয়েছিলাম। অনেকক্ষণ ডাক্তার ডাকিনি। অজ্ঞান হয়ে পড়েছিল।
–সেকি! কেন? আঁতকে উঠেছিলাম আমি।
–কেন ফেলব না বলতে পারিস? ও আমাকে বিয়ের আগে নানা কথা বলত। আমি সেসব কথায় প্রভাবিত হয়ে ওকে ভালোবেসে ফেলেছিলাম। তখন বুঝতে পারিনি, ও ঈশ্বরে বিশ্বাস করে না। বুঝতে পারিনি, ওর যা-কিছু দাপট, সব আসলে ওপরচালাকি। বুঝতে পারিনি, ও টাকাপয়সা জমাতে জানে না। ভবিষ্যৎ নিয়ে ও একটুও ভাবে না। তাছাড়া তোর কাকু জানতই না পৃথিবীতে টিঁকে থাকতে গেলে অনেককিছু চেপে যেতে হয়! অনেককিছু মানিয়েও নিতে হয়। নিজেকে বদলাতে হয়। অথচ ওর সঙ্গে যাদের ওঠাবসা, তারা সবাই এসব জানত। ওকে বিয়ে করার পরে সব বুঝেছি একে একে। অনেকদিন অপেক্ষা করেছিলাম। ওকে শুধরে দিতে চেয়েছিলাম। যখন বুঝলাম ও শোধরাবে না এতটাই একগুঁয়ে, তখন আমার সামনে আর কোনও পথ খোলা ছিল না! এখন নিজের ইচ্ছেমতো ওকে চালাব।
বিস্মিত হয়ে কাকিমাকে দেখে যাচ্ছিলাম আমি। অনেকক্ষণ। আমার মুখ থেকে কোনও কথা বের হচ্ছিল না। তার মধ্যেই কাকিমা বলেছিলেন, আমার গুরুদেব আমাকে জড়িবুটির রস তৈরি করে দিয়েছেন। সেটা প্রতিদিন খাইয়ে দিয়েছি অল্প অল্প করে। আস্তে আস্তে ও এইরকম হয়ে গেছে। কোনও ডাক্তারের সাধ্যই ছিল না ওকে সারানোর।
এরপর কী বলব আমি বুঝতে পারছিলাম না। মাথা নীচু করে নিশ্চুপ বসেছিলাম। তখনই কাকিমা ভুল না-বোঝার কথাটা বলেছিলেন। কিছুটা সময় আমাদের দুজনের মাঝখান দিয়ে বৃষ্টিপতনের শব্দ বয়ে যাচ্ছিল। একসময় আমি বলে উঠেছিলাম, বৃষ্টি বোধহয় আর ধরবে না কাকিমা। আমি চলে যাই। রাত হয়ে যাচ্ছে।
–যাবি? বেশ। আমি তোর জন্য রিকশা ডেকে দিচ্ছি। কথাটা বলেই বিল্লু নামের একজনকে ফোন করলেন কাকিমা। রিকশা আসার আগে কাকিমা ফিসফিস করে বললেন, একটা কথা শুনে রাখ পলাশ। আমি আজ যা যা বললাম, কাউকে বলবি না সেসব। যদি বলিস, তাহলে কিন্তু তোর খুব ক্ষতি হয়ে যাবে!
কাকিমার শেষ বাক্যের প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই বিড়ালটা কোথা থেকে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল একেবারে সামনে। আমার প্যান্টের নীচের দিক কামড়ে ধরে টানাটানি করল কিছুক্ষণ। তারপর ফ্যাঁচ ফ্যাঁচ শব্দ করে দৌড়ে অদৃশ্য হয়ে গেল। আতঙ্কে আমার বুকের ভেতরে একটা চড়াইপাখি লাফালাফি শুরু করে দিয়েছিল।
–ও আমার পোষ্য, জানিস তো! আমি ইশারা করলে ও কী যে করতে পারে, তুই ভাবতেও পারবি না পলাশ! তাই বলছি, খবরদার এসব কথা কাউকে বলিস না। তোর ভয়ঙ্কর ক্ষতি হয়ে যাবে। মাথা তুলে আর দাঁড়াতেই পারবি না। সাঙ্ঘাতিক বিপদেও পড়বি!
চনমনে ভালোকাকুর অবস্থা স্বচক্ষে দেখার পর আর সাহস হয়নি অন্য কিছু ভাবার।
রিকশার হর্ন শুনে আমি উঠে দাঁড়িয়েছিলাম। কাকিমা আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলেছিলেন, আমার কাছে আসা বন্ধ করিস না পলাশ। না-এলে কিন্তু…
না-এলে কী হবে আর বলেননি কাকিমা। তাতে কি উনি কষ্ট পাবেন? নাকি রেগে গিয়ে আমার ক্ষতি করে দেবেন! কিছুই বুঝতে না-পেরে চুপচাপ রিকশায় উঠে বসেছিলাম। কাকিমা বিল্লু নামের রিকশাচালকের হাতে ভাড়ার টাকা গুঁজে দিয়ে বলেছিলেন, বেশি তাড়াহুড়ো কোরো না। আস্তে আস্তে চালিয়ে ওকে বাড়ি পৌঁছে দিও। আর কখন পৌঁছল আমাকে জানিও।
বিড়ালটার কথা ভাবলেই আমার হাত-পা অবসন্ন হয়ে পড়ে। রাজ্যের ঘুম এসে জড়িয়ে যায় আমার দু-চোখে। কিংবা ঠিক ঘুম নয়, যেন অতল গহ্বরে ডুবে যেতে থাকি ক্রমশ। কাকিমার বাড়িতে আর যাব না ভাবলেই একটা অদৃশ্য লেজ আমার শরীর স্পর্শ করে চলে যায়। তাই যেতেই হয় ওবাড়ি। তবে আগের মতো দু-একদিন বাদে বাদে নয়, এক-দু সপ্তাহ পর পর যাই। কাকিমা একদিন বলেছিলেন, চাকরি নিয়ে তুই এখন ব্যস্ত থাকিস, জানি। নিয়ম করে না-আসলেও হবে। তবে আসা বন্ধ করিস না পলাশ।
প্রতিটি নির্দেশ বা মতামতের পরে কাকিমা এমনভাবে আমার নাম উচ্চারণ করেন যে বুকের মধ্যে হু হু বাতাস বইতে থাকে।
ইতিমধ্যে ভালোকাকুর সেই ভাগ্নে চলে এসেছে। ও এখন ওই বাড়িতেই থাকে। কাকিমার বাজারহাট করে দেয়। পুজোয় সাহায্য করে। কলেজের পাট চুকিয়ে দিয়ে বসেই আছে। একদিন জিজ্ঞাসা করেছিলাম, তুমি চাকরির চেষ্টা করছ না শান্তু?
–চাকরি? না তো! এমনভাবে কথাটা বলেছিল, যেন চাকরির চেষ্টা না-করাটাই স্বাভাবিক। আলতো হাওয়ায় কথা ভাসিয়ে দিয়েছিল, মামি আমারে কইসে চাকরিবাকরি করার দরকার নাই। একটা ব্যবসার ব্যবস্থা করি দিবে।
–কীসের ব্যবসা?
–তা জানি না। তবে মামি যখন কইসে, তখন খারাপ ব্যবসা হইবে না। ওর কথার মধ্যে এক ধরনের রহস্য যেমন ছিল, তেমনি ছিল অপার বিশ্বাস।
শান্তুর সঙ্গে ভাব হয়ে যাওয়ার কয়েকদিন পরেই ওর কথা শুনে বিস্মিত হয়েছিলাম। ভয়ও পেয়েছিলাম খানিকটা। কোনও কারণ ছাড়াই শান্তু বলেছিল, দ্যাখো বাপু, আমার পোন্দে লাইগতে এসোনি। আমি এখেনে দিব্যি আছি। এবার তুমি যদি এসে গেঁড়ে বসো, তাইলে আমার সব্বোনাশ না-হয়ে যায় না। আমি কিন্তু সহ্য করবনি বলি দিলাম!
এমন সময় কাকিমা এসে পড়েছিলেন সেখানে। জিজ্ঞাসা করেছিলেন, কী বলছিস রে শান্তু? কী সহ্য করবি না?
–ও কিছু না মামি। আসলে পাড়ার বখাটে ছেলেপিলেরা ওরে একা পাইয়া খুব রগড়ে দিতে চাইছিল। তাই কইতাছিলাম, আমার মামি থাকতে ভয় কী?
কথাটা ঘুরে যাওয়ায় অবাক হয়ে তাকিয়েছিলাম শান্তুর দিকে। ভালোকাকিমা হেসে বলেছিলেন, তোর কোনও ভয় নেই পলাশ। আমি আছি, শান্তু আছে।
আরও একদিন সন্ধ্যায় গিয়ে দেখেছিলাম ভালোকাকু বারান্দার ছোট্ট চৌকিতে ঘুমোচ্ছেন। সেইসময় কোনওদিন ঘুমোতে দেখিনি কাকুকে। তবু আমি আশ্চর্য হইনি। কেননা কাকিমার ওখানে গেলে আমি যেন আশ্চর্য হতেই ভুলে যাই। আমাকে দেখে শান্তু বলেছিল, মামিমা এখন পুজোয় বইসে।
–এখন? এইসময় পুজোয় বসেন নাকি কাকিমা?
–আজ তো আমাবস্যা, জানো না?
–ও। আজ অমাবস্যা বুঝি? তা প্রতি অমাবস্যায় কাকিমা পুজোয় বসেন সন্ধেবেলায়?
–হ্যাঁ, প্রতি অমাবস্যায়। আবার মধ্যরাইতে বসবে। চলো দ্যাখবা।
প্রত্যেক অমাবস্যায় কাকিমা পুজোয় বসেন, অথচ আমার সেসব জানা নেই! এতদিন ধরে এখানে যাতায়াত, এর মধ্যে অমাবস্যা তিথি আসেনি! ভাবনাটা মাথায় নিয়েই পরপর তিনটে ঘর পেরিয়ে একেবারে শেষের দিকে কাকিমার পুজোর ঘরে এসে পড়লাম। আমার সামনে শান্তু শ্লথ পায়ে হেঁটে যাচ্ছিল। আমি আগে কোনওদিন সেই ঘরে যাইনি। যাওয়ার কথা বললেই কাকিমা বলতেন, এখন থাক। অন্যদিন যাবি।
ভেজানো দরজা খুব ধীরে খুলেছিল শান্তু, এত আস্তে খুলেছিল যে, কোনও শব্দই হয়নি। ভেতরের দৃশ্য দেখে আমার চোখ বড় বড় হয়ে গিয়েছিল। দ্রুত ফিরে আসব কিনা ভাবছিলাম। কাকিমাকে ওইরকমভাবে দেখতে ইচ্ছে করছিল না। শান্তু কি আমার মনোভাব বুঝতে পেরেছিল! কেননা ও তখন আমার হাত চেপে ধরেছিল। একবার হাতের দিকে তাকিয়ে শান্তুর দিকে চোখ রাখতেই ও ইশারা করেছিল নীচে বসে পড়তে। আমিও ভয় পেয়ে বসে পড়েছিলাম ঠান্ডা মেঝেতে।
পদ্মাসনে বসে-থাকা কাকিমার চোখ বোজা। সারা শরীরে একটুকরো সুতোও নেই। খোলা পিঠে এলোকেশ ছড়িয়ে আছে। কোমরে লাল তাগা। পাশ থেকে দেখা যাচ্ছিল উদ্ধত স্তনবৃন্ত। ডানদিকের বাহুতে রুপোর তাবিজ। গলায় রুদ্রাক্ষের মালা। কাকিমার মুখোমুখি তিন-চার হাত দূরে প্রায় ফুট তিনেকের দক্ষিণা কালীমূর্তির চোখ জ্বলজ্বল করছিল। একটা গম্ভীর শব্দ বেরিয়ে আসছিল কাকিমার মুখ থেকে। যেন অস্ফুট শব্দে মন্ত্রোচ্চারণ করছেন। শান্তুও দেখলাম চোখ বুজে হাতজোড় করে বসে আছে। আমিও কি হাতজোড় করব? চকিতে মনে হয়েছিল, এখান থেকে এই সুযোগে পালিয়ে যেতে হবে। কেমন একটা দমবন্ধ করা অবস্থা হচ্ছিল আমার। অতি সন্তর্পণে উঠে দাঁড়াতে যাব যখন, তখনই কাকিমা বলে উঠেছিলেন, চুপ করে বসে থাক পলাশ। যতক্ষণ-না আমার উপাসনা শেষ হয়, উঠবি না। চোখ বন্ধ করেই বলে গেলেন! কীভাবে বুঝলেন আমার উপস্থিতি! কাকিমার নির্দেশ উপেক্ষা করে আমি উঠে দাঁড়াতে চেষ্টা করেও পারিনি। কে যেন আমার শরীরটা চেপে ধরে রেখেছিল মেঝের সঙ্গে। অসহায় আমি চোখ বন্ধ করে বসেছিলাম কাকিমার পরবর্তী নির্দেশের অপেক্ষায়।
সমস্ত ভাবনা ছিঁড়ে গেল নিমেষে। হিসহিস শব্দে রাস্তার উল্টোদিকে তাকিয়ে দেখলাম বিড়ালটা চকিতে দেখা দিয়েই অদৃশ্য হয়ে গেল। আর অদৃশ্য হওয়ার ঠিক আগেই বিড়ালটার লালচে জিভ দুলে উঠেছিল ওর মুখের ভেতরে, গোঁফের ফাঁক দিয়ে। স্ট্রিটলাইটের আলো এসে পড়েছিল বিড়ালটার মুখে। এবং ঠিক সেইসময়ই বুঝতে পারলাম টোটোটা স্টেশনের পথ না-ধরে অন্যপথে চলেছে। ভালো করে তাকিয়ে দেখি, টোটোচালক শান্তু। আমার পাশে বসে আছেন কাকিমা। তাঁর কোলে সেই কালো বিড়ালটা। টোটোর দুলুনিতে কাকিমার গলায় দুলছে রুদ্রাক্ষের মালা। চুল উড়ছে হাওয়ায়। আমার বুকের মধ্যে অনেকটা দমকা হাওয়া ছোটাছুটি করতে শুরু করল। শরীরের সবটুকু শক্তি জড়ো করে এক লাফে টোটো থেকে নেমে দৌড়তে শুরু করলাম। পিছনে দৌড়চ্ছে বিড়ালটাও, বুঝতে পারছি আমি। কিন্তু পিছন ফিরে তাকাতে ইচ্ছে করছে না। শুধু দৌড়েই চলেছি। কানে ভেসে আসছে থেকে থেকে বিড়ালের ‘ফ্যাঁচ ফ্যাঁচ’ শব্দ আর ‘ম্যাও’ চিৎকার। একই সঙ্গে কাকিমা আর শান্তুর হা হা হাসি। সেদিন পুজোর শেষে যেমন করে দুজনে হাসছিল আর আমি অবশ শরীরে বাড়িতে ফিরে এসেছিলাম। অবিকল সেইরকম হাসি আজও কানে তপ্ত সীসার মতো ঢুকে যাচ্ছে। ক্রমশ অবশ হয়ে যাওয়া শরীর টানতে টানতে আমি ছুটেই চললাম, যেভাবেই হোক কালো বিড়ালটার আওতার বাইরে যেতেই হবে আমাকে।
অনেকটা পথ দৌড়ে এসে হাঁপাচ্ছি আর ভাবছি, বিড়ালটা কি ধরতে পারবে আমাকে? বাকি দুজনও?