শতাব্দী দাশ
দিল্লী হাইকোর্ট মাহমুদ ফারুকি কৃত ধর্ষণ মামলাটিতে অভিযুক্তকে নিঃশর্ত মুক্তি দিয়েছে। বিদেশী অভিযোগকারিণী ভারতীয় আদালতেরর দ্বারস্থ হয়ে তাঁর ধর্ষককে সাজা দিতে পারলেন না। এমন তো কতই হয় এদেশে! নতুন কী?
খানিক নতুন, খানিক আলাদা বটে। কারণ ৮৪ পাতার রায়টি পড়ে উঠলে বোঝা যায়, তা যুগান্তকারী হতে পারত। সোজা কথায় লিঙ্গভিত্তিক আন্দোলনের ক্ষেত্রে এই রায় ইতিহাস সৃষ্টি করতে পারত। অনেকভাবেই রায়টি ধর্ষণ সংক্রান্ত প্রচলিত ধারণাগুলিকে চ্যালেঞ্জ করে।
আবার বলছি, শুধু জেণ্ডার অ্যাক্টিভিস্টরা নন, শুধু অভিযোগকারিণীর আইনজীবী বৃন্দা গ্রোভার নন, একটি রায় যা কিনা সারভাইভারকে ন্যায় এনে দিতে ব্যর্থ হচ্ছে, সেই রায় নিজেই নানাভাবে তথাকথিত পিতৃতান্ত্রিক সীমাবদ্ধ সংকীর্ণ ধারণাকে চ্যালেঞ্জ করে। করে ফেলে আর কী! যেমন, পিনো-ভ্যাজাইনাল পেনিট্রেশন ছাড়াও ধর্ষণ হয়, তা রায়টি মেনে নেয়। মেনে নেয়, ধর্ষণ তখন হয়, যখন কেউ মনে করে, ‘control over one’s own sexuality’ ছিল না। অর্থাৎ, যৌনক্রিয়ার ব্যক্তির নিজের যৌনতা, যৌন আনন্দের উপর নিয়ন্ত্রণ না থাকাকে ‘ধর্ষণ’ বলে। ধর্ষণ মানে ‘কুমারীত্ব’, ‘সম্মান’ ইত্যাদির অন্তর্হিত হওয়া নয়। অতঃপর, শেষপর্যন্ত এই রায়ের অভিযুক্তকে শাস্তি দিতে ব্যর্থ হওয়াটা খানিক ওয়ার্ল্ড কাপ ফাইনালে মিথালি রাজদের হেরে যাওয়ার মতো।
রায়টি নিয়ে বিশদে আলোচনা যেমন প্রয়োজন, তেমনই প্রয়োজন সুপ্রিম কোর্টে এই রায়টিকে সত্বর চ্যালেঞ্জ করা। দ্বিতীয়টি হবে বলেই খবর। প্রথমটির জন্য যোগ্যতর মানুষ হলেন আইনজ্ঞ ও বিচারকেরা। ইতোমধ্যে প্রাক্তন অ্যাডিশনাল সলিসিটার জেনারেল ও মানবাধিকার সংক্রান্ত বিশিষ্ট আইনজীবী ইন্দিরা জয়সিং বলেছেন, এই রায় শীঘ্র রিভাইজ না হলে অনেক ধর্ষিতাই বিচারাঙ্গনে এসে আশাহত হবেন এর পর। কারণ প্রিসিডেন্স হিসেবে এই রায় ভয়ংকর হতে পারে।
সামাজিক স্তরে আমরা কী করতে পারি? আমরা যৌনতায় সম্মতি বা কনসেন্ট সম্পর্কে আমাদের ধারণাগুলির পুনরালোচনায় ন্যস্ত করতে পারি নিজেদের। প্রয়োজনীয় সংস্কার আনতে পারি সেই ধারণাগুলিতে। এই লেখাটির উপজীব্য সেটাই। এবং ফারুকি-উত্তর পরিস্থিতিতে উক্ত আলোচনায় ফারুকির কেস ও তৎসংক্রান্ত রায়ের প্রসঙ্গও আসবে, আসতে বাধ্য।
‘নো মিন্স নো’ একটি আন্দোলনের নাম। ইউকে, ইউএসএ, জার্মানি– বিভিন্ন সময়ে বহু দেশের মেয়েরা এই আন্দোলনে পথ হেঁটেছে। উক্ত বচন শুধুমাত্র ‘পিঙ্ক’ নামক হিন্দি ছবিতে বচ্চন-ব্যারিটোনে শ্রুত হয়নি। ‘যৌনতায় সম্মতি’-র ক্ষেত্রে ‘ইমপ্লায়েড কনসেন্ট’ বলে কিছু হয় বলে এই আন্দোলন মানে না।
ইমপ্লায়েড কনসেন্ট কী? ধরুন, মেয়েটি বারে সার্ভ করে বা এইরকম কোনও ভূমিকায় তাকে প্রায়শই দেখা যায় যার ফলে তাকে ‘সহজলভ্য’ মনে হতে পারে; তার মানেই তার সম্মতি আছে। এই হল তথাকথিত ‘ইমপ্লায়েড কন্সেন্ট’। (‘দ্য অ্যাকিউজড’ ছবিটি মনে পড়ল? সত্য ঘটনার উপর আধারিত কিন্তু ছবিটি। সেই ঘটনার একটা বড় প্রভাব ছিল ‘নো মিন্স নো’ স্লোগানে।)
বা ধরুন, মেয়েটি রাতের বেলায় খাটো পোষাকে নেশাগস্ত অবস্থায় বেরিয়েছিল পথে– তার মানেই তার সম্মতি আছে। এই হল ‘ইমপ্লায়েড কনসেন্ট’।
অথবা ধরুন, মেয়েটি আপনার ডেট; তার মানেই তার সম্মতি আছে– এ’ও ইমপ্লায়েড কনসেন্ট। ডেটিং ভায়োলেন্স/ডেটিং মোলেস্টেশন-রেপ এই মুহূর্তে পশ্চিমে বহু আলোচিত মহামারী।
কিংবা ধরুন, (এই পর্যন্ত মেনে নিলেও এই বার হাঁ হাঁ করে উঠবেন কেউ কেউ) মেয়েটি আপনার প্রেমিকা বা স্ত্রী। এর আগে তাকে আদর করেছেন, ঘনিষ্ঠ হয়েছেন কোনও না কোনওভাবে। তার মানেই তার এর পরে যে কোনও ধরণের যৌনাচারে, যে কোনও সময়ে সম্মতি আছে। ‘না’ হল সেক্ষেত্রে নারীসুলভ ব্রীড়া মাত্র। একেই বলে ‘ইমপ্লায়েড কনসেন্ট’। তার যাবতীয় ‘না’-কে হ্যাঁ ধরে নেওয়াই ‘ইমপ্লায়েড কনসেন্ট’– যা আসলে ইউনিকর্নের সমার্থক।
এইসব যদি আপনারও ধারণা হয়, তবে আপনি ভুল। দ্ব্যর্থহীনভাবে, তর্কাতীতভাবে ভুল। মেনেই নিন। Acquaintance Rape একটি পরিচিত, প্রচলিত লব্জ। এর সাথে পরিচয় ঘটুক আপনার।
এইবেলা মনে করে নেওয়া যাক একটা ঘটনা যা আদালতে গড়ায়নি। আমার পরিচিত এই মেয়েটি কয়েক বছর আগে জানিয়েছিল, সে তার তৎকালীন ফিঁয়াসের দ্বারা ধর্ষিত হয়েছে। সেই ধর্ষকের সাথে বিয়েটা শেষপর্যন্ত হয়নি। কিন্তু বিয়ের কথা পাকা হতে দু বাড়ি থেকে ‘মেলামেশার’ ‘অধিকার’ দেওয়া হয়। সেই সময়কালেই একদিন, সুযোগ পেয়ে ছেলেটি মেয়েটিকে ধর্ষণ করে। এরকম ঘটনা কতই তো ঘটে! আসন্ন বিবাহ, গোলাপি মেজাজ, প্রেম প্রেম ভাব, রোম্যান্টিক শিরশিরানি… কাব্যে মহিমান্বিত এইসব কুয়াশাটুয়াশার মধ্যে কী করে যেন ধর্ষণ হয়ে গেল। আমরা দেখলাম, মেয়েটি শুকিয়ে গেল এবং মায়ের কাছে সব কথা খুলে বলতে গিয়ে আরও শুকিয়ে গেল– কারণ তাকে ‘চেপে যেতে’ বলা হয়েছিল। অতঃপর, তার দীর্ঘ কাউন্সেলিং চলল। অথচ ছেলেটি অপরিচিত নয়, প্রেমিক-স্থানীয়ই ছিল বলা যায়। তার আগে কি তারা ঘনিষ্ঠ হয়নি? হয়েছে। তাহলে আরেকটু বেশি শারীরিক ঘনিষ্ঠতা, সেই ব্যক্তির সাথে যাকে তুমি ভালোবাসো, বা যে তোমার জীবনসঙ্গী হবে, তাকে ধর্ষণ বলা চলে কি? আলবাৎ বলা চলে, কারণ সেই সময়ে সেই কাজে মেয়েটির সম্মতি ছিল না।
এই ঘটনা থানায়, কোর্টে গড়ায়নি, বেশির ভাগ ঘটনার মতো। তবে এক-আধবার এরকম ঘটনাও কোর্ট পর্যন্ত গড়ায় কিন্তু। যেমন ঘটে মাহমুদ ফারুকি নামক পরিচালক ও নাট্যব্যক্তিত্বের ক্ষেত্রে। মন্দ কপাল ফারুকির! বিদেশী অভিযোগকারিনী দেশে ফিরে গিয়েও আবার ভারতে এসেছিলেন, এফআইআর করতে।
ঘটনা বোধহয় আমরা সবাই জানি। বিদেশিনী ছিলেন ফারুকির তত্ত্বাবধানে গবেষক। তাঁদের মধ্যে শুধু পরিচিতি নয়, কিছু ঘনিষ্ঠতাও ছিল। আগে চুম্বনের ঘটনা ঘটেছে– অভিযোগকারিণী মেনে নিয়েছেন। কিন্তু ঘটনার রাতে একসাথে নেমন্তন্নবাড়ি যাওয়ার অছিলায় তাঁকে ডেকে ফারুকি যা যা করেন (বয়ান অনুযায়ী ওরাল সেক্স), তাতে অভিযোগকারী অপমানিত, ধর্ষিত বোধ করেন কারণ মুখে ও আকারে ইঙ্গিতে ‘না’ তিনি বলেছিলেন বহুবার।
ফারুকির পক্ষের আইনজীবী যে যে যুক্তি দেন, সেগুলি পিতৃতান্ত্রিক পরিমণ্ডলে নতুন কথা কিছু নয়। ১) মেয়েটি দেরি করে অভিযোগ করল কেন? ২) যে মেয়ে চুম্বনে সম্মতির কথা স্বীকার করে সে ধর্ষণের অভিযোগ আনে কী করে? ৩) মেয়েটি শিক্ষিত ও সচেতন, এরকম ক্ষেত্রে ‘না’ বললেই ‘না’ ধরে নিতে হবে? (শিক্ষিত, স্বাধীন মহিলারা যৌনতায় সদা আগ্রহী, কে না জানে?) ৪) মেয়েটি ধর্ষণের পরে আরেক জায়গায় বেড়াতে গেছিল না? (অভিযোগকারিণীর বয়ানে ‘ট্রমা কাটাতে’)। ধর্ষণের পর সে মুখ লুকিয়ে থাকেনি মানেই ধর্ষণ হয়েছে কিনা সন্দেহ করাই যায়। এরকম আরও নানাকিছু।
মহিলার আইনজীবী বৃন্দা গ্রোভার সেগুলিকে কাউন্টার করেন যথোপযুক্ত ভাবে– যে যে ভাবে একজন সচেতন, নারীবাদী আইনজীবীর করা উচিত। যদিও এর পরেও ফেমিনিস্ট কোর্টরুম ট্রায়ালের দৃশ্যে আমরা মাচো বচ্চনের ব্যারিটোনই শুনব। ‘কনসেন্ট’ শব্দের আইনি তাৎপর্য তিনি আদালতকে মনে করিয়ে দেন। ধর্ষণ সংক্রান্ত আইপিসিতেই যেখানে ‘কনসেন্ট’ সংজ্ঞায়িত করা আছে, সেখানে শুধু ‘ভার্বাল’ নয়, ‘নন-ভার্বাল’ উপায়ে অসম্মতি জানানোকেও গ্রাহ্য ধরা হয়েছে। মেয়েটি যেখানে বারবার বলছে যে সে তার নিজের অন্তর্বাস বহুবার টেনে তুলেছিল, ‘না’ মুখেও বলেছিল– সেখানে কনসেন্টের অভাব নিয়ে কোনও সংশয় থাকতে পারে না।
এইবারে, লক্ষ করুন, ফারুকির উকিল কীভাবে চ্যালেঞ্জ করলেন এই বক্তব্য। তিনি বললেন, মেয়েটি অর্গ্যাজমের ভান করেছিল। তাহলে হয় সে উপভোগ করেছিল, নয় উপভোগ করার ভান করেছিল। ফারুকি তবে তার ‘না’ বুঝবেন কেমন করে?
এর উত্তরে অভিযোগকারিণী যা বলেছেন, তা লিঙ্গনির্বিশেষে যে কোনও ভারতীয়র কাছেই লজ্জাজনক, বিশেষত ভারতীয় পুরুষেরা এরপর আত্মসমালোচনা না করলে আর করবেন কবে?
মহিলা কিন্তু ‘অর্গাজমের ভান’ অস্বীকার করেন না। করতেই পারতেন, ভিডিও ফুটেজ তো ছিল না। কিন্তু করেন না। বলেন, প্রতিহত করতে ব্যর্থ হওয়ার পর, ধর্ষিতা হওয়ার সময়, তাঁর নির্ভয়ার কথা মনে পড়ে। তাঁর মনে হয়, আরও বাধা দিলে হয়ত নির্ভয়ার মতোই শতচ্ছিন্ন মৃত্যু লেখা আছে কপালে। মানে, তাঁর গাইড, পরিচিত, বন্ধু, ভালোলাগার মানুষ এক মুহূর্তেই তাঁর কাছে শুধু ও শুধুমাত্র ‘ভারতীয় পুরুষ’ হয়ে গেছিল– যে যেকোনও মুহূর্তে ধর্ষণ করতে পারে আর বাধা দিতে গেলে যোনিতে রড ঢুকিয়ে পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে পৌঁছে যেতে পারে অন্ত্র অবধি। ব্যাপারটা যাতে অন্তত তাড়াতাড়ি মেটে, তাই উনি অর্গ্যাজম-এর ভান করেন।
আমরা আরও জানতে পারি, মেয়েটির কাছে ক্ষমা চেয়ে মেইল গেছিল ফারুকির তরফ থেকে। জানতে পারি, অভিযুক্তর স্ত্রীর সাথেও ইমেইল চালাচালি হয় অভযোগকারিণীর– যেখানেও ক্ষমা চাওয়া হয় ও অভিযুক্তের তথাকথিত ‘বাইপোলার ডিসঅর্ডার’-এর কথা জানানো হয়।
এই সুদীর্ঘ তর্ক বিতর্কের নিট ফল কী? গ্রোভারের তোলা অনেক পয়েন্টই কিন্তু বিচারক মেনে নেন। বিপক্ষের উকিলকে ধমকে বলেন, ধর্ষণের পর ধর্ষিতা বেড়াতে যাবেন না জিবেগজা খাবেন– তাঁর ইচ্ছে। একই ঘটনার পর এক এক জন এক এক ভাবে ট্রমার সাথে যুঝতে চান ও যুঝতেই পারেন। শুধু তাই নয় সব এভিডেন্সকেই ‘স্টারলিং এভিডেন্স’ বলে চিহ্ণিত করেন বিচারক। অভিযুক্তকে অভিযোগকারিণী অকারণে ‘ফাঁসাবেন’, এমন কোনও ‘মোটিভ’-ও পান না তিনি। মেনে নেন বিশেষ ধরণের পেনিট্রেশন ছাড়াও ধর্ষণ হয় ও নিজ যৌনতায় নিজের নিয়ন্ত্রণ না থাকাই ধর্ষণ– যা আগেই বলেছি।
তাহলে? সব তো ঠিকই ছিল। যুক্তিপূর্ণ, ন্যায়ানুগ। এবার আপনি আশা করতেই পারেন, সুবিচার হবে। ধর্ষণকে ধর্ষণ বলে চিহ্নিত করা হবে এবং শাস্তি হবে।
কিন্তু হল না। ক্ষমতা বড় বালাই। অভিযুক্ত, তাঁর স্ত্রী– এরা সাংস্কৃতিক জগতে, বিশেষ করে নাট্যজগতে বড়সড় নাম। ‘হ্যাঁ’ আর ‘না’-এর মাঝের অঞ্চল মোটেই কুয়াশাচ্ছন্ন নয়, যেমনটা আপনারা দাবী করেন। কুয়াশাচ্ছন্ন সেইসব পিছনপথ, যে পথে ক্ষমতা ও প্রভাব এসে আদালতের রায়কে ঘুরিয়ে বাঁকিয়ে দিয়ে যায়।
বিচারক তাঁর রায়ে ফারুকিকে সব অভিযোগ থেকে মুক্ত করেছেন শেষপর্যন্ত। দুটি তত্ত্ব (পড়ুন, অসার কথামালা) তিনি ব্যবহার করেছেন ফারুকির মুক্তি নিশ্চিত করতে।
১) ফারুকির কথিত বাইপোলার ডিসঅর্ডার– যা এমনকি ফারুকির তরফের উকিলের বক্তব্যেও ছিল না, শুধু ফারুকির স্ত্রী ইমেইলে অভিযোগকারীকে একবার জানিয়েছিলেন।
বুঝে দেখুন, এমনকি ফারুকির উকিলও অফিশিয়ালি ডাক্তারি কাগজপত্র সহযোগে দাবী করেননি, তাঁর ক্লায়েন্ট অসুস্থ। কিন্তু বিচারক মেয়েটির উপর ফারুকির হামলার কারণ হিসেবে এটিকেই সম্ভাব্য ধরে নিলেন।
উল্লেখ্য, হামলা করা হয়েছিল এবং জোর খাটানো হয়েছিল, তা বিচারক অস্বীকার করেননি। তিনি সন্দেহ করছেন, ‘না’-এর অর্থ ‘না’-ই তো? সেই ‘না’ সঠিকভাবে প্রকাশিত হয়েছিল তো? এই প্রশ্নের ঘোরপ্যাঁচে একটি ধর্ষণের মামলা খারিজ হয়ে গেল স্রেফ। এখান থেকেই আসে বিচারকের দ্বিতীয় অসার তত্ত্ব।
২) কেন ‘না’-এর মানে ‘না’ হবে না? উত্তর খুঁজতে গিয়ে বিচারক সর্বনাশের পথে আরও এক পা বাড়িয়ে আনলেন নারী-পুরুষ বাইনারি তত্ত্ব। যৌনতার ইচ্ছে পুরুষ নাকি প্রকাশ করে সোচ্চারে। আর নারীরা সলাজ ‘না’-এর মাধ্যমে ‘হ্যাঁ’-ও বলে থাকতে পারেন। কে বলছেন? একজন বিচারক। ‘সামাজিক নির্মাণ’-এর হয়ে সাফাই গাইছেন একজন বিচারক। যার রায় হওয়ার কথা ছিল এইসব ক্ষুদ্রতা, ভেদাভেদ, পক্ষপাতিত্বের ঊর্ধ্বে। সামাজিক নির্মাণ অনেক কিছুই তো! রাতে একা বেরোনো মেয়েরা বেপরোয়া– সমাজনির্মাণ। ছোট পোশাকের মেয়েরা বেশ্যা– সমাজনির্মাণ। বউ-এর একমাত্র কর্তব্য সর্বংসহা হয়ে পতি ও পতিগৃহের সকলের সেবা করা– সমাজনির্মাণ। এইসব মাথায় রেখে এবার থেকে আদালত রায় দেবে কি?
এই রায় সুপ্রিম কোর্টে চ্যালেঞ্জ হবেই। হার হোক বা জিত– দিনে দুপুরে ‘মেয়েদের না মানেই হ্যাঁ’ ধরণের ন্যাকামির আড়ালে নিগ্রহ মেনে নেওয়া হবে না। কিন্তু যা যা শিক্ষণীয় এখান থেকে–
ক) সাংস্কৃতিক ও বৌদ্ধিক অসাধারণত্ব দিয়ে মানুষ চেনা যায় না, বিশেষত লিঙ্গভিত্তিক অপরাধের ক্ষেত্রে। এঁরা বৌ-পেটানো বা মোলেস্ট বা ধর্ষণ করতেই পারেন। করেন। পিরিয়ড।
খ) প্রগতি আর লিঙ্গসাম্যের বুলি কপচানো মহিলারা, ফারুকির স্ত্রী রিজভির মতো, আপৎকালে ‘স্বামী’-র পাশে থাকেন। বরের বদলে প্রেমিক বা বাপ বা ভাই থাকলেও তাঁরা পাশে থাকতেন। কোথাও গিয়ে ধর্ষককে ‘অপরায়িত’ এঁরাও করেন– এই তথাকথিত সচেতন মহিলারা। আমার বর, আমার ভাই, আমার বাবা, আমার প্রেমিক ধর্ষক নয়– এটা প্রমাণ করতেই হবে আমাকে! ধর্ষক অন্য কেউ– দুই শিং বিশিষ্ট কোনও অদ্ভুতুড়ে প্রাণী হবে হয়ত সে। লজ্জাজনক।
গ) এদেশের বিচারব্যবস্থা প্রায়শই মরাল জ্যাঠা বা কোনওদিন-বারমহল-না-দেখা-বিধবা-পিসির মতোই আচরণ করবে, সেরকমই ডিকশন ব্যবহার করবে। এটা মেনে নিয়ে আবার এগোতে হবে।
ঘ) এবং, লাস্ট বাট নট দ্য লিস্ট-এ বঙ্গের বুদ্ধিজীবীগণ। যারা রোম্যান্টিক কুয়াশা কেটে যাওয়ার ভয়ে মুহ্যমান হয়ে পড়েছেন আর ক্রমাগতই ‘না-এর মানে হ্যাঁ কেন হবে না গো? আমরা তো এমনটাই জানতাম’ গেয়ে চলেছেন। এতেই ক্ষান্ত হচ্ছেন না, কথায় কথায় পরশুরামের রেফারেন্স টানছেন শুধু। সেই যে বুঁচকি বলেছিল ‘যাঃ!’, প্রেমিকমহাশয় পড়েছিলেন ফাঁপরে, আর গল্প শেষ হয়েছিল তৃতীয় ব্যক্তির এক্সপার্ট কমেন্ট দিয়ে, ‘যাঃ মানেই হ্যাঁ!’ এঁরা সেইখানে পড়ে আছেন। কেন আছেন? কারণ তাঁদের এনটাইটেলমেন্টের উপোযোগী এই লাইন। পুরো গল্প ছেঁকে এইটুকু সার তাঁরা পেয়েছেন। এমনকি বিশ্বসাহিত্য ছেঁকে এরকম উদ্ধৃতি তাঁরা প্রায়ই বের করেন। যুক্তির বদলে প্রতিযুক্তি না দিয়ে উদ্ধৃতি নাড়েন নাকের ডগায়।
এই প্রসঙ্গে মনে পড়ল, আমেরিকায় অন্য একটি ধর্ষণের মামলা খারিজ করে দেওয়ার আগে বিচারপতি শেক্সপীয়ার উদ্ধৃত করেছিলেন— ‘Hell hath no fury like a woman scorned.’ অতএব নাকি প্রমাণ হয়ে গেল, অভিযোগ মিথ্যে!
তারপর সেই অভিযোগকারিণী, Peggy Sanday জবাব দিয়েছিলেন ‘A Woman Scorned: Acquaintance Rape on Trial’ নামে বইটি লিখে, যা বিচারব্যবস্থাকে গালে হাত দিয়ে ভাবতে বাধ্য করে অতঃপর।
পেগিকে পড়া দরকার। এইসব ‘স্পর্ধায়’ আপনাদের পৌরুষ বিষম খাবে, পৌরুষ মুহুর্মুহু হেঁচকি তুলবে, তাও পড়া দরকার।
আরও কয়েকটা কথা স্পষ্ট বলি। স্পর্ধা সহ্য করে বুঝুন–
১) হ্যাঁ, পরিচিত বা প্রেমিকা বা আধা-প্রেমিকা বা যৌনকর্মী– সকলেরই সম্মতি নিতে হয়।
২) হাত ধরার সম্মতি মানেই চুমু খাওয়ার সম্মতি নয়।
৩) চুমু খাওয়ার সম্মতি মানেই ওরাল সেক্সের সম্মতি নয়।
৪) ওরাল সেক্সের সম্মতি মানেই ভ্যাজাইনাল সেক্সের সম্মতি নয়।
৫) ভ্যাজাইনাল সেক্সে সম্মতি মানেই অ্যানাল সেক্সে সম্মতি নয়। ইত্যাদি।
৬) অর্থাৎ সব রকম যৌনাচারের জন্য আলাদা আলাদা ভাবে উভয় পক্ষকে সম্মত থাকতে হয়। এমনকি চৌষট্টি কলার প্রতিটির জন্য।
৭) ‘না’ বুঝতে যেহেতু খুবই অসুবিধে হয় আপনাদের, তাই সেক্সুয়াল কনসেন্ট বিষয়ক একদম সাম্প্রতিক ট্রেন্ড ও স্লোগানটিও আপনাদের জানিয়ে দিই। খুঁটে তো কিছুই খাবেন না। জানিয়েই দিই।
‘No means no’-এর পর আরও সাম্প্রতিক স্লোগানটি হল ‘Yes means yes’. অর্থাৎ ‘না’ যখন বুঝতেই পারছেন না, চাপ নেবেন না, বাদ দিন– একমাত্র তখনই এগোন যখন সুস্পষ্ট ভাবে ‘হ্যাঁ’ শুনলেন বা প্রশ্ন করে সুস্পষ্ট ‘হ্যাঁ’-বাচক উত্তর পেলেন।
জানি, এসব আত্মীকরণ ও আত্তীকরণ করা কঠিন। পুরুষতান্ত্রিক হেজেমনি মন ও মগজকে আচ্ছন্ন রাখে। জানি, দেশের পরিস্থিতি খারাপ, একের পর এক উইমেন স্টাডিজ-জেন্ডার স্টাডিজ সেন্টার বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে ও হবে– যাতে মানুষ এইসব জানতে না পারেন, যাতে ভিক্টিম ব্লেমিং সর্বজনীন হয়, যাতে বিচারক ধর্ষকের পক্ষে রায় দেন। কিন্তু কঠিন হলেও অসম্ভব নয় ‘আনলার্নিং’। জানলা-দরজা-চোখকান খোলা রাখলে অসম্ভব নয় পিতৃতান্ত্রিক ফসিলে পরিণত হওয়ার বদলে যোগ্যতর যৌনসঙ্গী, বন্ধু বা সহমানুষ হয়ে ওঠা।