বিষাণ বসু
এই তো কদিন আগেই জোয়ান ডিডিয়ন (Joan Didion) মারা গেলেন। এক আশ্চর্য গদ্যকার। গত শতকের দ্বিতীয়ার্দ্ধে ইংরেজিতে তো কম বাঘা বাঘা লিখিয়েরা লেখেননি। তাঁদের মনে রেখেই বলি, অন্তত আমার কাছে, তাঁর নিজস্ব একটি বিশেষ ঘরাণায় লেখার ক্ষেত্রটিতে ডিডিয়ন প্রায় অপ্রতিদ্বন্দ্বী।
কিন্তু জোয়ান ডিডিয়ন-এর লেখালিখির পর্যালোচনা করার যোগ্যতাই বলুন বা ক্ষমতা, কোনওটিই আমার নেই। তাঁর জীবনী লেখক-পরিচিতি ইত্যাদি ইত্যাদি উইকিপিডিয়া খুঁজলেই পেয়ে যাবেন, কাজেই সেখান থেকে সহজপাচ্য কপি-পেস্ট করে একখানা লেখা নামানোরও মানে হয় না। কিন্তু যেহেতু তিনি আমার অন্যতম প্রিয় লেখিকা এবং যদ্দূর দেখলাম, এমনকি তাঁর মৃত্যুর পরেও তাঁকে নিয়ে বঙ্গদেশে কেউই বিশেষ আলোচনা করছেন না – অগত্যা অন্তত তাঁর নামটুকুর সঙ্গে পাঠককুলের পরিচয় ঘটানোর জন্য কিছু কথা লেখা জরুরি বলে মনে হল।
না, তাঁর লেখার কোনও সামগ্রিক পরিচিতি ইত্যাদি নয়, আমি ভাবছিলাম, তাঁর লেখা একখানা বিশেষ বইয়ের প্রসঙ্গে কিছু কথা লিখব, যে বইয়ের মূল বিষয় মৃত্যু ও নিকটজনের মৃত্যুতে মৃত্যুশোক। কিন্তু মুশকিল, বছরের শুরুতে মরার কথা মনে করানোটা অশোভন হবে কিনা, সে নিয়েও দোটানা। উপরন্তু অসুস্থতা-মৃত্যু ইত্যকার বিষয় নিয়ে লেখা বই পড়তে গেলেই নিজের চিকিৎসক-সত্তা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে, রসাস্বাদনের পথে সে কিছু কম বিপত্তি নয় – কাজেই যে বই নিয়ে লিখব, সে বই নিজেই সঠিক স্পিরিটে নিতে পেরেছি কিনা, সেও তো কম বড় প্রশ্ন নয়! শেষমেশ একটা মাঝামাঝি ফয়সালা করা গেল। নিজেকে বোঝালাম, যদিও স্বাস্থ্যের লক্ষ্যেই আমাদের পথচলা, তবু একটু গভীরে ভাবতে গেলে, সুস্থতা আর বেঁচে থাকার প্রতিটি মুহূর্তেই অসুস্থতার সম্ভাবনা, মৃত্যুর নিশ্চয়তা আমাদের অনিবার্য নিত্যসঙ্গী। স্বাস্থ্যের কথা ভাবার সময় ডিডিয়নের একখানা বইকে উপলক্ষ্য করে এই জরুরি কথাটুকু মনে করিয়ে দেওয়াটা হয়ত অনুচিত নয়, তাই না?
তো যে কথা বলছিলাম, যে বইয়ের কথা মনে পড়তেই এইসব সাতপাঁচ এলোমেলো ভাবনা মাথার মধ্যে ভিড় করল, তার নাম – দ্য ইয়ার অফ ম্যাজিকাল থিংকিং। দু’হাজার চার সালে প্রকাশিত বইটি প্রকাশের পরেপরেই রীতিমতো খ্যাতি পায়। পরের বছরে মার্কিন দেশের ন্যাশনাল বুক অ্যাওয়ার্ড-ও জেতে। সুবিখ্যাত দ্য গার্ডিয়ান পত্রিকা একবিংশ শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ একশখানা বইয়ের অন্যতম হিসেবে এই বইকে বেছে নিয়েছে। ডিডিয়ন এমনিতেই যথেষ্ট খ্যাতিমান ছিলেন, কিন্তু এই বই তাঁর খ্যাতিকে প্রায় অন্য মাত্রায় পৌঁছে দেয়। তাঁর সমকালীন এক লেখিকা যেমন বলেছেন, লেখিকা হিসেবে ডিডিয়ন আগেই গুরুত্বপূর্ণ ছিলেন, কিন্তু এই বই তাঁকে অবশ্যপাঠ্যদের বৃত্তে এনে ফেলল।
বিষয়ের কথা যদি বলতে হয়, যেমন বললাম আগেই, এই আশ্চর্য বইখানা মৃত্যু নিয়ে। ডিডিয়ন-এর স্বামী মারা যান দু’হাজার তিন সালে। সেই মৃত্যু আর শোকানুভূতি নিয়ে এই বই। এ বই পড়তে পড়তে আপনিও পৌঁছে যেতে পারেন অন্য এক অনুভবে, জাগতে পারে অনেক অনেক প্রশ্ন যার উত্তর এককথায় পাওয়া মুশকিল।
যতদিন বেঁচে আছি, মরার কথা ভাবি আর ক’জন! ভাবলেও, কতটুকুই বা!! অন্তত সুস্থসবল থাকার দিনগুলোতে তো একেবারেই নয়। সুসান সন্ত্যাগ বলেছিলেন, আমাদের সকলের মধ্যে থাকে দুটি পৃথক দেশের নাগরিকত্ব – একটি সুস্থতার দেশের, আরেকটি অসুস্থতার। তাঁর কথার সুর টেনে বলি, দুটি পাসপোর্টের কোনটি ব্যবহৃত হবে, তার পেছনে অপর পাসপোর্ট কেমন করে ব্যবহার করা হচ্ছে তার কিছু ভূমিকা থাকে – অন্তত থাকতেই পারে – অতএব সচেতন আত্মবীক্ষা দ্বারা প্রস্তুতির সম্ভাবনা থাকে। অর্থাৎ সুস্থ থাকাকালীন আপনি কেমন নিয়ন্ত্রিত জীবন যাপন করছেন, তার উপর অনেকাংশে নির্ভরশীল আপনার অসুস্থতার দুনিয়ায় প্রবেশের সম্ভাবনা, অন্তত কিয়দংশে নির্ভরশীল তো বটেই। আবার অসুস্থ হওয়ার পর আপনি কত দ্রুত চিকিৎসকের শরণাপন্ন হচ্ছেন, তাঁর পরামর্শ কেমন করে মানছেন – তার উপর নির্ভর করে আপনার সুস্থতার পৃথিবীতে ফিরে আসার সম্ভাবনা। আচমকা অসুস্থতার দুনিয়ায় প্রবেশ করতে হলেও আপনি যদি সজাগ থাকেন, আত্মসমীক্ষা করতে থাকেন – হয়ত দেখতে পাবেন, ঠিক কেমন করে আপনার তথাকথিত সুস্থতার যাপনে লুকিয়ে ছিল অবিমৃষ্যকারী পদক্ষেপ, ঠিক কেমন করে আপনার হইহই জীবন আর অন্যমনস্কতার মাঝে সুস্থতার পাসপোর্টে পড়ছিল অসুস্থতার দেশে অভিবাসনের স্ট্যাম্প। কিন্তু মুশকিল হল, অমন করে খতিয়ে দেখার অভ্যেস ক’জনেরই বা আছে? একদম ‘সুস্থজীবন’-এর মধ্যেই ক্রিস্টোফার হিচেন্স যখন ক্যানসারে আক্রান্ত হলেন – যখন ধরা পড়ল, তখনই একেবারে স্টেজ ফোর – প্রাথমিকভাবে প্রশ্ন করেছিলেন, হোয়াই মি? আমিই কেন? থমকে ভাবতে গিয়ে উত্তর পেয়েছিলেন, হোয়াই নট!! মানে, অনিয়ন্ত্রিত যাপনের শেষে অসুখবিসুখ বেছে বেছে তাঁকেই ছেড়ে দেবে, এমন অবান্তর আশারই বা কারণ কী!! কিন্তু অতখানি খতিয়ে দেখার মন ক’জনেরই বা থাকে? তারপরও যেটা বলার, সবসময় কি কারণটা অতখানি প্রকট হয়?
‘
তবুও, রোগীর কথাই বলুন বা পরিজন, কারণটা খুঁজে পান বা না পান, গুরুতর অসুস্থতার মধ্যে যেটা আমাদের সবচেয়ে বেশি বিস্মিত করে, সেটা হল তার আকস্মিকতা। আর আপাত অসুস্থতাহীন মৃত্যুর ক্ষেত্রে তার অভিঘাত তো বহুগুণে বেশি।
১৯৪১ সালের সাতই ডিসেম্বরের কথা জিজ্ঞেস করলে হনলুলুর বাসিন্দাদের প্রায় সবারই মনে পড়ে, আর পাঁচটা রোববারের মতোই এক অলস ছুটির সকাল ছিল সেদিনও। অথচ সেই দিন, ঠিক সেদিনই পার্ল হারবারে ঘটে গিয়েছিল বিমান হানা। রবিবারের অলস মেজাজের মধ্যে তার তিলমাত্র পূর্বাভাস ছিল না। দুহাজার তিন সালের সেপ্টেম্বরও ছিল তেমনই – চমৎকার এক দিন, সেপ্টেম্বরে যেমন হয়। এই সব কথা দিয়েই শুরু করেছেন ডিডিয়ন। আর পৌঁছেছেন এক ডিসেম্বরের সন্ধেয়।
দুহাজার তিন সালের তিরিশে ডিসেম্বর। মেয়ে আইসিসিইউ-এ মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছে। হাসপাতালে মেয়েকে দেখে বাড়ি ফিরেছেন ডিডিয়ন ও তাঁর স্বামী। বাড়ি ফেরার পথে তাঁরা ভাবছিলেন, বাইরে কোথাও খেয়ে নেওয়া যাক। ডিডিয়ন বলেন, নাহ্, থাক, বাড়িতেই কিছু একটা রেঁধে নেব’খন। প্রবল শীত। রান্নাঘরে ডিনারের তোড়জোড় করছিলেন তিনি। ফায়ারপ্লেসের পাশে প্রিয় চেয়ারে বসে বই পড়ছিলেন জন। জন, ডিডিয়নের স্বামী। জন-এর হাতে থাকা বইটির নাম, ইউরোপের শেষ গ্রীষ্ম – কীভাবে শুরু হল ১৯১৪-র মহাযুদ্ধ। মার্কিন দেশের ক্যালিফোর্নিয়ার শীতে আগুন পোয়াতে পোয়াতে নিজের বাড়ির লিভিংরুমে বসে শেষবারের মতো এই বইটা পড়ছিলেন জন গ্রেগরি ডান। হাতে স্কচের গ্লাস।
ডিনার রেডি হলে তিনি উঠে এসেছিলেন খাবার টেবিলে। খেতে বসার ঠিক আগে আরেকবার একটু স্কচ চেয়েছিলেন। দ্বিতীয় স্কচ হাতে নিয়ে খেতে বসতে বসতে কথা বলছিলেন স্ত্রীর সঙ্গে। স্ত্রী তখন স্যালাড সাজাচ্ছিলেন গুছিয়ে। মনোযোগ ছিল মূলত স্যালাডের দিকেই, কানে আসছিল স্বামীর কথা। স্বামী কথা বলছিলেন এটা-সেটা নিয়ে। কখনও হাতের স্কচ বিষয়ে, কখনও ১৯১৪ সালের ঘটনাচক্র কেমন করে সারা বিশ্বের ইতিহাসকে নিয়ন্ত্রণ করতে শুরু করল, সেসব নিয়ে।
এমন ঘরোয়া দৃশ্যমালা আটপৌরে কথাবার্তা চলতে চলতেই আচম্বিতে ঘটে পটবদল। হঠাৎ, একদম হঠাৎই, জন-এর কথা বন্ধ হয়ে গেল। আচমকা নীরবতায় চমকে গিয়ে ডিডিয়ন প্রথমে ভেবেছিলেন, স্বামীর গলায় হয়ত খাবার আটকে গিয়েছে। দৌড়ে তাঁর শুশ্রূষার জন্য এগোলেন। চেয়ারে সোজা করে বসিয়ে কিছু একটা করতে গেলেন। সঙ্গীর গলায় খাবার আটকে গেলে যা করতে হয়, যেমনটা শিখেছিলেন ফার্স্ট-এইড ক্লাসে, হেইমলিখ ম্যান্যুভার। জন-এর নিথর দেহ মুখ থুবড়ে পড়ল প্রথমে খাবার টেবিলে, তারপর চেয়ার থেকে মেঝেতে। ডিডিয়ন দৌড়ালেন টেলিফোনের দিকে। পাশে রাখা অ্যাম্বুলেন্সের নম্বর। না, নিজের পরিবারে এমন বিপদ আসতে পারে, এমন সম্ভাবনার কথা মাথায় রেখে সেই নম্বর ডিডিয়ন লিখে রাখেননি। রেখেছিলেন, ফ্ল্যাটের আর পাঁচটা বয়স্ক মানুষের যদি আচমকা কিছু একটা হয়ে যায়…
হ্যাঁ, আমরা যতদিন পুরোপুরি সুস্থ-স্বাভাবিক জীবন যাপন করছি, ততদিন কখনওই ভাবি না যে, এমন খারাপ কিছু এমনই আকস্মিকভাবে আমাদের জীবনেও ঘটে যেতে পারে। যেমন ধরুন, পরিচিত মানুষজন দশদিন ভেন্টিলেটরে লড়াইয়ের শেষে মারা যাওয়ার পরেরদিনই আমরা হইহই করে আড্ডায় বসতে পারি কোভিডের ভয় তুচ্ছ করে, কেননা, ওই যে, নিজেদের জীবনে এমন বিপদ ঘটতে পারে, সে সম্ভাবনা কখনওই আমাদের মাথায় আসে না। নিজেদের খুচরো অসুস্থতা, এমনকি বয়স্ক বাবা-মায়ের টুকটাক সমস্যা আমরা যতদিন সম্ভব চেপেচুপে রাখি – তা যে বড় অসুখের প্রাথমিক উপসর্গ হতে পারে, এমন সম্ভাবনা আমাদের মাথায় কখনওই আসে না, কেন না অনেক অসুখ অনেক মৃত্যুর গল্প শোনার পরেও আমাদের কাছে সেসব অপরের কাহিনী হয়ে রয়ে যায়। নিজেদের জীবনে তেমন বিপদের মুহূর্ত উপস্থিত হওয়া মাত্র আমরা হতচকিত হয়ে যাই। অসুস্থতা – এমনকি মৃত্যু – যে জীবনের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গী জড়িয়ে থাকা বাস্তব, সে উপলব্ধি আমাদের আর হয়ে ওঠে না। অশীতিপর ভগ্নস্বাস্থ্য বৃদ্ধকে যখন বাড়াবাড়ি নিউমোনিয়া নিয়ে হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়, তখনও মৃত্যুর অনিবার্যতার অনুভবের পরিবর্তে চিকিৎসায় গাফিলতিই আমাদের প্রস্তুতিহীন চোখে যুক্তি হিসেবে অধিকতর গ্রহণযোগ্য মনে হয়।
ডিডিয়নের বৃত্তান্তের পরের অংশটুকু আমাদের জানা। অ্যাম্বুলেন্স আসা, ডিফিব্রিলেটর দিয়ে হৃদস্পন্দন ফিরিয়ে আনার মরিয়া প্রয়াস, তড়িঘড়ি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া, আর তার পর…
ভেতরে ভেতরে গুঁড়িয়ে যাওয়া, উদভ্রান্ত ডিডিয়নের মনের ঝড় বহিরঙ্গে দৃশ্যমান হয়ে ওঠে না। হাসপাতালের করিডোরে উচ্চকিত হাহাকারে তিনি কেঁদে উঠতে পারেন না, হয়ত স্বভাবসিদ্ধ মাত্রাবোধের কারণে, কিংবা এতই চকিত এ মৃত্যুর অভিঘাত, তার ধাক্কা বাইরে প্রকাশের সময়টুকু পায় না। হাসপাতালের কর্মী আরেক কর্মীকে বলেন, ইটস্ ওকে, শি ইজ আ কুল কাস্টমার। যেমনটি আমাদেরও করতে হয়েছে কখনও না কখনও, বা করতে হবে নিশ্চিত কোনোদিন, আপাত ঠাণ্ডা মাথায় হাসপাতালের ফর্ম্যালিটি সম্পূর্ণ করেন তিনি। মনে ঘুরতে থাকে ওই “কুল কাস্টমার” শব্দদুটি। ভাবেন, অন্য কী আচরণ সম্ভব ছিল ওই মুহূর্তে? ভেঙে পড়া? অক্ষম রাগে চিৎকার করে ওঠা? আর কী কী সম্ভাব্য আচরণের চয়েস ছিল তাঁর সামনে ওই মুহূর্তে??
আর হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফিরে?
যে প্রশ্নটা আমার মনে বারবার ফিরে ফিরে আসে, আজীবন সঙ্গীকে শেষবারের মতো হাসপাতালে ফেলে এসে, বা শেষকৃত্য থেকে ফিরে এসে – বাড়ি ঢোকার পর জীবিত সঙ্গীর অনুভূতি ঠিক কেমন দাঁড়ায়? ঘরের মধ্যে সেই দেওয়ালঘেরা শূন্যতার অনুভূতি ঠিক কতখানি সর্বগ্রাসী? এদিক-ওদিক সেই সঙ্গীর অগোছালো ছাড়া জামা – যে পোশাক আর পরা হবে না কখনও – ইতস্তত ছড়ানো জিনিসপত্র, উলটো করে রেখে যাওয়া বই – যে বই শেষ করতে পারার আগেই সব শেষ হয়ে গেল – বাথরুমে ঝুলতে থাকা ভেজা তোয়ালে, জরুরি ওষুধপত্র এদিক-সেদিক, ফ্রিজে ঢাকা দেওয়া খাবার, প্লাগে ঝুলতে থাকা ফোনের চার্জার – বারবার বলার পরে চার্জারের স্যুইচ অফ করতে ভুলে যাওয়া, সে নিয়ে কত খিটিমিটি – সবকিছু ছেড়ে চলে যেতে পারা মানুষটির অনুপস্থিতিতে, এই সবকিছুর অভিঘাত কেমন দাঁড়ায় একাকিত্বের সেই মুহূর্তে? ডাবলবেড খাটে একা হয়ে গিয়ে প্রথমবারের জন্যে রাত্তিরের দুঃসহ নিঃসঙ্গতার অনুভূতি ঠিক কেমন?
ডিডিয়ন যেমন, প্রথমবারের সেই বাড়ি ফেরার মুহূর্তে, প্রায় একটা ঘোরের মধ্যে যা যে করে চলেছিলেন, তা যাকে বলা যায় রুটিন কাজ, প্রায় প্রতিবর্ত ক্রিয়ার মতো করে। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তাঁর হাতে দিয়েছিলেন জন-এর মানিব্যাগ ইত্যাদি, কিছু খুচরো টাকা। ডিডিয়ন সেই টাকা ভরে রাখছিলেন নিজের ব্যাগের মধ্যে – সাজিয়ে – একশ টাকার নোটের সঙ্গে একশ টাকার নোট, দশ টাকার সঙ্গে দশ টাকা, যেমন করে আমরা রাখি আর কী! জন-এর জুতো এনে রাখছিলেন জুতোর জায়গায়, মোবাইলটা চার্জে বসাচ্ছিলেন। আর কী কী কাজ বাকি রয়ে গিয়েছে, তা মনে করানোর জন্য, বা সে নিয়ে আলোচনা করার জন্য জন-কেই খুঁজছিলেন। এত বছরের অভ্যেস, যা যা হয়, দুজনে আলোচনা না করে এগোন না তো! সবসময় মতের মিল হত, এমন তো নয়। তবু আরেকজনকে না জানিয়ে সিদ্ধান্ত না নেওয়াটাও অভ্যেস।
তো আমাদের এই বেঁচে থাকা, রোজকার জীবনযাপন, ভালো লাগা, খারাপ লাগা, ভালোবাসা – সুস্থ থাকা, সুস্থ বোধ করা – সবকিছুর মধ্যে মিশে থাকে অভ্যেস। সে অভ্যেসে আমরা এমনই নিমজ্জিত, অবচেতন অবধি নিমজ্জিত যে, অভ্যাসের পিছনে রয়ে যাওয়া মানুষগুলো বা সামাজিক সম্পর্কগুলো আমাদের তেমন করে নজরে পড়ে না। শারীরিক অনুপস্থিতি হোক বা অন্য কোনও কারণে, সম্পর্ক পুনরুদ্ধার-অযোগ্যভাবে ছিঁড়ে যাওয়ার আগে অবধি আমাদের দৈনন্দিন যাপনের অভ্যেসে উল্টোদিকের মানুষের গুরুত্ব আমরা তেমনভাবে অনুভব করে উঠতে পারি না। কচিৎ-কদাচিৎ অনুভব করলেও, উপলব্ধি করে উঠতে পারি না। অন্তত অনুপস্থিতির মুহূর্তে নিজের প্রাত্যহিক যাপনে উল্টোদিকের মানুষটার ভূমিকা যতখানি আত্মগোচর হয়, উপস্থিতির দিনগুলোতে অতখানি হতে পারে কি?
ডিডিয়নের বইটির বিশদ বিবরণ দেওয়া আমার উদ্দেশ্য নয়। আর সে অভিপ্রায় যদি বা থাকত, এমন তীব্র আবেগী ও গভীর গদ্যের ভাষান্তরিত সংক্ষিপ্তসার লিখে বসা, অন্তত আমার পক্ষে, সম্ভব ছিল না। বইটির নাম, আগেই বললাম, দ্য ইয়ার অফ ম্যাজিকাল থিংকিং। ডিডিয়নের দীর্ঘ লেখকজীবনকে বর্ণনা করতে চাইলে অনায়াসেই লেখা যায়, দ্য ইয়ার্স অফ রাইটিং ম্যাজিকাল প্রোজ। যার অনুবাদ আমা-হেন অর্বাচীনের কম্মো নয়।
এই বইটিতে স্বামী মারা যাওয়ার পরের একটি বছরের কথা লিখেছেন ডিডিয়ন। কখনও শূন্যতার বোধ, কখনও অবিশ্বাস, কখনও অলীক আশা – নিজের শোক, তার বিভিন্ন পর্যায়কে যে এমন করে লেখায় আনা যায়, সে না পড়লে বিশ্বাস করা মুশকিল। নিকটজনকে হারানোর অভিজ্ঞতা যাঁদেরই হয়েছে, তাঁরাই জানেন, ডিডিয়নের বিবরণ ঠিক কতখানি নিখুঁত বাস্তববাদী। যেমন, একাকী ঘরে বসে তিনি বারবার ফিরে দেখতে চান জন-এর মৃত্যুর আগের কয়েকটি সপ্তাহ, কয়েকটি মাস, কয়েকটি দিন – হয়ত সেই দিনগুলোয় জন-এর আচার-আচরণ কথাবার্তা ব্যবহারে কোনও ইঙ্গিত ছিল আসন্ন অসুস্থতার, মৃত্যুর – ডিডিয়ন প্রাণপণ খুঁজতে থাকেন সেই প্রচ্ছন্ন সূত্রগুলো, যেন সেই সূত্র মিললেই তিনি জন-কে বাঁচিয়ে রাখতে পারতেন – এমনকি, যে সূত্রগুলো নিখুঁত করে বুঝতে পারলে তিনি জন-কে বাঁচিয়ে তুলতে পারেন। যেমন, আস্তে আস্তে ঘর থেকে জন-এর ব্যবহৃত জিনিসপত্র কমতে থাকলেও প্রাণে ধরে ডিডিয়ন জুতোজোড়া কাউকে দিয়ে উঠতে পারেন না – জন ফিরে এলে ওই জুতোর তো দরকার হবে।
একদিকে জন-এর মৃত্যু, আরেকদিকে মেয়ের গুরুতর অসুস্থতা – যুগপৎ শোক ও উৎকণ্ঠার এক আশ্চর্য বিবরণী এ বই। জন-এর মৃত্যুর ঠিক এক বছরের মাথায় এ বই লেখা শেষ হয়। এই বছরটির মধ্যেই মারা গিয়েছেন জোয়ান ডিডিয়নের মেয়েও, কিন্তু সে ঘটনা তিনি এই বইয়ে ঢোকাননি। আবারও বলি, বইয়ের বিশদ পরিচয় দেওয়া বা তার সংক্ষিপ্তসার আপনাদের শোনানো আমার এই লেখার লক্ষ্য নয়। ডিডিয়নের মৃত্যুসংবাদ শুনে বইখানার কথা মনে পড়ে গেল, আর মনে চলে এল বেশ কিছু এলোমেলো ভাবনা। এবং সত্যি বলতে কি, ভাবনাগুলোর শুরু ওই বইয়ের কথা মনে পড়া দিয়ে হলেও, ভাবনার সঙ্গে বইটার মিল সামান্যই।
ভাবছিলাম, আমরা যতদিন অবধি সুস্থসবল বেঁচে থাকি, ততদিন যেন গুরুতর অসুস্থতা ও মৃত্যুকে একটা প্রায় অবাস্তব সম্ভাবনা হিসেবে ভুলে থাকি। অথচ, জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে যা আমাদের সঙ্গে হাঁটতে থাকে, তা ওই মৃত্যু। ভাস্কর চক্রবর্তী লিখেছিলেন – “দুটি দীর্ঘশ্বাসের মধ্যিখানে, মৃত্যু, আমি তোমাকে জন্মাতে দেখেছি।” কথাটা দুটি শ্বাসের মধ্যিখানেও হতে পারত। আমাদের প্রতিটি শ্বাস তক অন্তিম শ্বাসের পথে যাত্রা। না, সবসময় রোগভোগের ভয়ে আতঙ্কিত হয়ে বাঁচবেন, বা কারণে-অকারণে ডাক্তার-বদ্যি-হাসপাতালে দৌড়াদৌড়ি করে দিন কাটাবেন – এর কোনওটিই কাম্য নয়। আমি বলছি, শুধু এটুকু মনে রাখা, এইটুকু আত্মস্থ করা, যে, গুরুতর অসুস্থতা ও মৃত্যু জীবনেরই অংশ, জীবনের অনিবার্য পরিণতি। কথাটা আপনার নিজের ক্ষেত্রেও সত্য, আপনার নিকটজনের ক্ষেত্রেও সত্য। জীবনের অর্থ বুঝতে হলে, জীবনকে জানতে হলে এই অনিবার্যতাকে চিনে তবেই জানা সম্ভব।
আমরা তো সকলেই অল্পবিস্তর আত্মকেন্দ্রিক। নিজেকে কেন্দ্র করেই আমাদের নিখিলবিশ্ব আবর্তিত হয়। তবু মনে রাখা ভালো, অজস্র সম্পর্কের এক জালের মধ্যে আমাদের এই বেঁচে থাকা। সেই বৃহত্তর জালের একটি বড়সড় গিঁট, নিজেকে বড়জোর এটুকু ভাবতে পারেন, এর বেশি গুরুত্বপূর্ণ না ভাবাই ভালো। একেকজন প্রিয়জনের মৃত্যুতে একটি একটি করে সুতো ছিঁড়ে যেতে থাকে, জাল আলগা হতে থাকে। প্রস্তুতিহীন আমরা আকস্মিক বিহ্বল হয়ে পড়ি। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রিয়জনের মধ্যে মৃতের সংখ্যা বাড়তে থাকে, বিহ্বলতার অনুভূতি নিঃসঙ্গতা বাড়তে শুরু করে। প্রতিটি মৃত্যুর মুহূর্তে প্রস্তুতিহীন আমরা বিশ্বাস করতে চাই, আরেকটু চেষ্টা করলেই এ পরিণতির উলটপুরাণ সম্ভব ছিল, অন্তত সাহচর্যের দিনগুলো অন্যরকম হতে পারত।
প্রস্তুতিহীন মৃত্যু-উপলব্ধিহীন আমরা উল্টোদিকের মানুষটার জীবদ্দশায় তাঁর প্রতি মনোযোগ দিয়ে উঠতে পারিনি – সম্পর্কের নিবিড় আস্বাদনের উপযোগী অবসর জুটিয়ে উঠতে পারিনি – ইতিউতি ব্যস্ততায় সঙ্গীর (শব্দটা লিঙ্গনিরপেক্ষভাবে ব্যবহার করতে চাইলাম এক্ষেত্রে) কথাটুকু শুনে উঠতে পারিনি – আকস্মিক অনুপস্থিতির মুহূর্তে না-শুনে-উঠতে-পারা কথাগুলো শোনার ইচ্ছে হয়, সে ইচ্ছেপূরণ অসম্ভব বুঝে খুব রাগ হয়, অভিমানও হয়ত। অথচ এ আক্ষেপ না রাখার প্রস্তুতি তো আগেও শুরু হতে পারত। উইকএন্ডে পাঁচতারা হোটেলে হুল্লোড় দিয়ে নয়, সামারে প্যারিস-সুইজারল্যান্ডের প্যাকেজ ট্যুর দিয়েও নয় – স্রেফ সন্ধেবেলায় ঘরে বসে চা-বিস্কুট সহযোগে এটা-সেটা অকাজের গল্প করতে করতে। আরও আরও বেশি ভালো থাকা, আরও আরও বেশি বিত্তবান যাপন – এই লোভে ছুটতে ছুটতে কত অভিমানের কথা, কত অগোছালো আপাত-অকাজের টুকরো গল্প শোনার ভান করেও শোনেননি, শোনা হয়নি, শোনার অবকাশ হয়নি। সম্পর্কের মানুষটার উপস্থিতি এমন অভ্যেস হয়ে দাঁড়ায় যে, অনুপস্থিতির প্রস্তুতি হয়ে ওঠে না। অনুপস্থিতিতে শোক অনিবার্য, সেই শোকে আক্ষেপ মিশে থাকলে তা যে দুঃসহ হয়ে দাঁড়ায়।
আর শেষমেশ, আপনার নিজের কথাও। পরজন্মে বিশ্বাস করুন বা না করুন, মৃত্যুর সঙ্গেই তো সবকিছু শেষ হয়ে যায় না। পরজন্মে বিশ্বাসী হলে, তা ওই স্বর্গ-নরক-মুক্তি ইত্যাদি প্রভৃতি। আর বিশ্বাস না করতে চাইলে, মৃত্যুর পরে আপনি থাকবেন মানুষের মধ্যে স্মৃতি হয়ে। যেহেতু আমাদের মধ্যে খুব কমজনই বৃহত্তর প্রেক্ষিতে স্মরণযোগ্য কিছু করে যেতে পারেন, কাজেই আমাদের অধিকাংশের মৃত্যু-পরবর্তী বেঁচে থাকা নিকটজনের স্মৃতি হয়ে। স্বীকার করুন বা না করুন, মরতে আমরা কেউই চাই না – মরার পরেও যতদিন সম্ভব বেঁচে থাকতে চাই, যত বেশি সম্ভব জ্যান্ত থাকতে চাই। নিকটজনের কাছে সুখস্মৃতি হয়ে বেঁচে থাকার জন্যে তো সেই স্মৃতির নির্মাণের মতো অবকাশ তাঁদের দিতে হবে! বাবা প্রতিদিন রাত্তির এগারোটার আগে বাড়ি ফিরতে পারত না, বাড়িতে থাকতই না প্রায় – বাবার সঙ্গে গল্প করার সুযোগই হয়নি – শুধু মাঝেমধ্যে বেড়াতে গিয়ে খুব হইহই হতো, দামী খেলনা কিনে দিত – স্মৃতি বলতে কি এটুকুই আশা করেন! একেবারে পারিবারিক বৃত্তের বাইরে যদি বেরোই? কখনও কি এমন শুনেছেন, এক মৃত ব্যক্তিকে কেউ মনে রেখেছে তাঁর কত দামী গাড়ি ছিল বা তাঁর যাপন কত বিলাসী ছিল বা তিনি কোন ক্লাবের মেম্বার ছিলেন, সেই তথ্য দিয়ে? সাধ্যমতো পাশের মানুষটির বিপদে-আপদে সহায় হোন, গরীব বাচ্চার লেখাপড়ার ভার নিন, যেটুকু পারেন অপরের পাশে থাকুন – স্মৃতি হিসেবে এগুলোই মানুষের মনে থাকে। আত্মকেন্দ্রিকই না হয় হলেন, হিসেবীই না হয় হলেন – নিজের স্মৃতি ঠিক কোন পথে আরও বেশি মানুষের মনে আরও বেশিদিন টিকে থাকবে, সেই হিসেবটাও কষুন।
আজকাল বড় বেশি মনে হয়, সুস্থ যাপন – যে সুস্থতা কেবলমাত্র ল্যাবরেটরি-ক্লিনিকে পরিমাপযোগ্য শারীরিক সুস্থতার অতিরিক্ত কিছু – তার জন্যে মৃত্যুর অনিবার্যতার বোধ খুব জরুরি। সেই বোধ আমাদের সচেতন করে তোলে, যত্নবান করে তোলে, বিনয়ীও (হাম্বল অর্থে) করে তোলে। সেই অনিবার্যতার উপলব্ধি আপনি-আর-কপনি-র আত্মময়তা অতিক্রম করে অল্পবিস্তর পরার্থপরতার বোধ জাগাতে পারে, অন্তর্দৃষ্টি গড়ে তুলতে পারে।
মনুষ্য মাত্রেই মহত্তর লক্ষ্যে ধাবিত – এমন অবাস্তব আব্দার আমি কোনওভাবেই জুড়ছি না। সুখের লোভ, ভোগের প্রতি আসক্তি মানুষের, সম্ভবত, মজ্জাগত। কিন্তু সুখেরও তো প্রকারভেদ হয়। বিলাসী গাড়ির ঠাণ্ডায় বসে আরও বিলাসী গাড়ি কেনার আশা অ্যাফোর্ড করতে পারার মধ্যে অবশ্যই সুখ রয়েছে। আবার শীতের দুপুরে আমবাগানে সপরিবারে সদলবলে পিকনিক আড্ডা মাংসের সুবাস নাকে ক্রিকেট খেলা, তার মধ্যেও কি সুখ নেই? সুখ নেই কি সর্বজনীন বৃহত্তর কোনও সুখের লক্ষ্যে যাত্রার অতি তুচ্ছ অংশীদার হতে পারার মুহূর্তে? ফুটপাতে শুয়ে থাকা বৃদ্ধার শরীরে শীতবস্ত্র তুলে দেওয়ার মুহূর্তে সেই মানুষটার হাসিতে? খেতে না পাওয়া কিশোরের ভরপেট খাবারের শেষের তৃপ্তির দৃষ্টিতে? আমাদের “সুখ”-এর সংজ্ঞাটা কেন এমন করে একমাত্রিক হয়ে গেল??
আজকাল কেমন যেন মনে হয়, বাজারশাসিত ভোগবাদের বাড়বাড়ন্ত আর অসুখ-অসুস্থতা-মৃত্যু-কে জীবনের অনিবার্য অঙ্গ হিসেবে দেখার পরিবর্তে এড়িয়ে-যাওয়া-সম্ভব-এমন আপদ হিসেবে দেখার প্রবণতা – দুটির বিকাশ নিছক সমাপতন নয়, রীতিমতো কার্যকারণ সম্পর্কে যুক্ত। সে নিয়ে কি কিছুমাত্র ভাবনা জরুরি নয়?
যাক গে, এলোমেলো কথা বলতে বলতে লেখাটা বিস্তর লম্বা হয়ে গেল। কথাগুলো নিয়ে ভাবতে চাইলে ভাববেন, না চাইলে ভুলেও যেতে পারেন। ভুলে গেলে অপূরণীয় কিছু ক্ষতি হয়ে যাবে, এমন হয়ত নয়। তবু বলি, ডিডিয়ন-এর আর কোনও বই না পড়লেও দ্য ইয়ার অফ ম্যাজিকাল থিংকিং-টা সম্ভব হলে পড়ে দেখুন।
সবশেষে শুভেচ্ছা। এই বছরে তো বটেই, আগামী দিনেও যেন আপনার জীবনে এমন দুঃখজনক ঘটনা কখনওই না ঘটে, নতুন বছরের শুরুতে এই শুভেচ্ছা রইল।