অশোক মুখোপাধ্যায়
পূর্ব প্রকাশিতের পর
মানবমস্তিষ্কের গঠন
কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্র তো বটেই, সমগ্র স্নায়ুতন্ত্রের সদর দপ্তর হল মস্তিষ্ক। মস্তিষ্কে সংবাদ না দিয়ে কারও পক্ষে কোনও কাজই করার উপায় নেই। কিছু কিছু পেশীসঞ্চালনের কাজ সুষুম্না কাণ্ড থেকেও পরিচালিত হতে পারে। অনেক সময় হয়েও থাকে। কিন্তু সাধারণত সেইসব সংবেদনও মস্তিষ্কের নির্দিষ্ট অঞ্চলে পৌঁছে যায়। এই জন্য মস্তিষ্কের বিশ্রাম নেওয়ার কোনও সুযোগ নেই। যখন বহির্জগত থেকে কোনও সংবেদন আসছে না, অর্থাৎ প্রাণী বা মানুষ যখন বিশ্রাম নেয়, শুয়ে থাকে বা ঘুমায়, তখনও হৃৎপিণ্ড, ফুসফুস, যকৃৎ ইত্যাদি অভ্যন্তরীণ অঙ্গগুলির কাজ চলতে থাকে এবং মস্তিষ্কের সঙ্গেও তাদের সংযোগ বজায় থাকে। এমনকি কেউ যদি অজ্ঞান হয়ে পড়ে, তখনও মস্তিষ্কের কিছু কিছু অংশ সক্রিয় থাকে।
এই সব বিষয়ের দিকে তাকিয়ে একটা সময় পর্যন্ত স্নায়ুশারীরতত্ত্ববিদরা মনে করতেন, বিভিন্ন দেহাঙ্গগুলিকে কেন্দ্রীয়ভাবে সঞ্চালন নিয়ন্ত্রণ ও সমন্বয়ন করাই মস্তিষ্কের প্রধান কাজ। অর্থাৎ, একটা অঙ্গের কাজ যেন অন্য আর একটার কাজে বাধা না দেয়, বরং পরস্পর সমন্বয়ের ভিত্তিতে কাজ করে যেতে পারে, সেটা দেখা, বা সুনিশ্চিত করা। যেমন ধরুন, আপনি টেবিলে একটা ডিমসেদ্ধ দেওয়া হয়েছে দেখে সেটা খাওয়ার জন্য হাত বাড়ালেন। আর ঠিক সেই সময় দুটো মশা আপনার পায়ে বসল এবং তাদের কামড় খেয়ে আপনার দুই পা টেবিলের উলটো দিকে হাঁটতে শুরু করল। তাহলে আপনি ডিমসেদ্ধটা খাবেন কীভাবে? আসলে মস্তিষ্ক এরকম সমস্যা উদ্ভূত হতে দেয় না। যদি খাওয়ার তাগিদ বেশি হয়, হাত আর পা দুইই টেবিলের দিকে যাবে। আর যদি মশার কামড় থেকে বাঁচার প্রয়োজনই মুখ্য হয়, তাহলে হাতজোড়া টেবিলের দিকে না গিয়ে পায়ের দিকেই বরং নজর দেবে। অর্থাৎ, যে কাজই আপনি করুন, হাত পা— এমনকি চোখ কানও— সেইদিকেই অভিমুখিত হবে। মস্তিষ্কের মাধ্যমেই শরীরের সমস্ত প্রত্যঙ্গের কাজকর্মের মধ্যে সামঞ্জস্য বজায় থাকে। এই অবধি ঠিক আছে।
কিন্তু রুশ শারীরবিজ্ঞানী— ইভান পেত্রভিচ পাভলভ (১৮৪৯-১৯৩৬)— বিংশ শতাব্দের গোড়ায় এসে দেখালেন, তাই বলে উপরোক্ত ধারণাটা পুরোপুরি ঠিক নয়। কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্র ও মস্তিষ্ক শুধু দেহের মধ্যেকার অঙ্গগুলির কার্যকলাপের মধ্যে সমন্বয় সাধন করে তাই নয়, একই সঙ্গে বাইরের জগতের সঙ্গে দেহের জৈবনিক কার্যকলাপের ভারসাম্য রক্ষা করাও তার একটা বড় কাজ। কারণ একটা প্রাণী শুধু অভ্যন্তরীণ দেহাঙ্গের বাঁধাধরা কাজকর্মের মধ্যে দিয়ে বাঁচতে পারে না। তাকে প্রতিনিয়ত পরিবেশের ওপর নির্ভর করতে হয়, সেখান থেকেই খাদ্য ও যৌনসঙ্গী সংগ্রহ করতে হয়, বিপদ-আপদ থেকে আত্মরক্ষা করতে শিখতে হয়, পরিবেশের নানারকম পরিবর্তনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে, অভিযোজন করে চলতে হয়, ইত্যাদি। বিভিন্ন ইন্দ্রিয় বাইরের পরিবেশের বস্তুগত উদ্দীপনা থেকে যে অসংখ্য সংবেদন স্নায়ুতন্ত্রের মাধ্যমে মস্তিষ্কের কাছে বয়ে নিয়ে আসে তাতে সাড়া দিতে গিয়ে অভ্যন্তরীণ দেহাঙ্গগুলির বাঁধাধরা কাজের ছন্দেও পরিবর্তন ঘটাতে হয়। এটাই তার জৈবিক অভিযোজনের প্রচেষ্টার প্রকাশ। যত উচ্চতর প্রাণী তার অভিযোজনেও তত বৈচিত্র্য। প্রচণ্ড গরমে কুকুর মুখব্যাদান করে জিহ্বা বাইরের দিকে ঝুলিয়ে বসে থাকে; মোষ জলের মধ্যে বসে বা দাঁড়িয়ে থাকে। বিপদাপন্ন বা আক্রান্ত হয়ে একটা প্রাণী বা মানুষ যখন দৌড়ে পালায় তখন তার হৃৎপিণ্ড আর ফুসফুসকে অনেক বেশি কাজ করতে হয়। কেন না, পায়ের পেশীগুলিতে রক্তের সংবহন হার বাড়িয়ে অতিরিক্ত শর্করা ও অক্সিজেন পৌঁছে দিতে হয়।
এই সব ঘটনা লক্ষ করে পাভলভ কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রের সমগ্র কার্যকলাপকে দুটো স্তরে ভাগ করলেন। দেহের অভ্যন্তরীণ প্রত্যঙ্গসমূহের সঞ্চালন ও নিয়ন্ত্রণের কাজগুলিকে তিনি বললেন নিম্নতর স্নায়বিক কার্যকলাপ (lower nervous activity)। কিন্তু বহির্জগতের সঙ্গে দেহের কাজকর্মের সুষ্ঠু সমন্বয়ের জন্য মস্তিষ্ককে যে কাজগুলি করতে হয়, তা হল উচ্চতর স্নায়বিক কার্যকলাপ (higher nervous activity)।[1] মানবমস্তিষ্কের গঠনের সঙ্গে মিলিয়ে বিচার করলে দেখা যাবে, অভ্যন্তরীণ সামঞ্জস্য রক্ষার কাজগুলি মূলত মস্তিষ্কের নিম্নাংশ, এমনকি সুষুম্না কাণ্ড থেকেও পরিচালিত হয়। কিন্তু পরিবেশের সঙ্গে অভিযোজনের কাজগুলির ক্ষেত্রে মস্তিষ্কের ওপরের অংশের গুরুত্বই বেশি। এই সব কাজ সাধারণত গুরুমস্তিষ্কের আবরণ (cerebral cortex) থেকে পরিচালিত হয় বলে জানা গেছে। স্বভাবতই বিবর্তনের চালচিত্রে যে প্রাণী যত উন্নত, তার গুরুমস্তিষ্কও ততই বিকশিত হয়; তার ফলে তাদের উচ্চতর স্নায়বিক ক্রিয়ার ক্ষমতাও সচরাচর সেই অনুপাতে বেশি হয়ে থাকে।
মানুষের মস্তিষ্কের গঠন সম্পর্কে সংক্ষেপে একটা ধারণা দেওয়া যাক। তার জন্য চলুন, মস্তিষ্কের সামনে থেকে পেছনের একটা লম্ব প্রস্থচ্ছেদ নিয়ে দেখি (চিত্র: ৩)। আমরা এখানে সম্পূর্ণ গঠনের ছবি দেখাচ্ছি না; যেটুকু আমাদের এই আলোচনায় লাগবে শুধু মাত্র সেইটুকুই নকশাকারে রাখছি।
এতে সুষুম্না কাণ্ড এসে মস্তিষ্ক দণ্ডের পশ্চাদ বা নিম্ন অংশের সঙ্গে যেখানে মিলেছে, তার নাম মেডালা অবলঙ্গাটা (medulla oblangata)। সংক্ষেপে শুধু মেডালা। এর কাজ হৃৎপিণ্ড ফুসফুস খাদ্যনালী ইত্যাদির কাজ নিয়ন্ত্রণ করা। হাঁচি-কাশির সঞ্চালনও এখান থেকেই হয়। এইখানে জোরে আঘাত লাগলে বা (ফাঁসিতে ঝোলানো বা ঝুলে পড়ার দরুন) রক্ত সরবরাহ বন্ধ হয়ে গেলে তা দ্রুত মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়ায়। কেন না, তখন মস্তিষ্কে অক্সিজেন ও গ্লুকোজ সরবরাহ বিঘ্নিত হয়। এরই উপরের দিকে এবং মাথার পেছনভাগে আছে লঘুমস্তিষ্ক, যেখান থেকে আমাদের দাঁড়ানো, হাঁটাচলা, দৌড়ানো, এবং এই সব কাজের সময় শারীরিক ভারসাম্য রক্ষার কাজ নিয়ন্ত্রিত হয়। আমরা সজাগ বা সচেতন না থাকলেও লঘুমস্তিষ্ক তার দায়িত্ব পালন করে যায়। আঘাতের ফলে বা অতিরিক্ত সুরাপানের জন্য এর ক্ষতি বা ক্রিয়া ব্যাহত হলে চলাফেরা করা বেশ কষ্টকর হয়ে পড়ে। রাস্তায় মদ খেয়ে যে সমস্ত মাতালদের টলমল করে চলতে দেখা যায়, তারা সাময়িকভাবে এই সমস্যার শিকার।
মানুষের মধ্যমস্তিষ্ক খুব গুরুত্বহীন হয়ে পড়েছে। সরীসৃপ জাতীয় প্রাণীদের পর্যায় পর্যন্ত এখান থেকে দর্শন এবং তার পরের পর্যায়ের প্রাণীদের ক্ষেত্রে দর্শন ও শ্রবণ নিয়ন্ত্রিত হয়। কিন্তু মানুষের দর্শন ও শ্রবণ সংবেদক অঞ্চল অগ্রমস্তিষ্কে উঠে এসেছে। মধ্যমস্তিষ্ক দর্শন ও শ্রবণ অনুভূতির কিছু কিছু তাৎক্ষণিক ক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ করতে পারে।
মস্তিষ্কদণ্ডের একেবারে উপরে দুটো অংশ। পেছনদিকের বড় ভাগটি হল থ্যালামাস (thalamus), যার কাজ প্রধানত সংবেদন গ্রহণ এবং নির্বাচন করে অগ্রমস্তিষ্কে প্রেরণ করা। আর এর সামনের দিকের ছোট অংশটির নাম হাইপোথ্যালামাস (hypothalamus), যেটি প্রধানত একটি সঞ্চালক কেন্দ্র। এখান থেকেই শরীরের আর্দ্রতা, তাপমাত্রা, চাপ রক্ষণাবেক্ষণ এবং ক্ষুধা, তৃষ্ণা, নিদ্রা, ইত্যাদি নিয়ন্ত্রণ ও নিবৃত্তির নির্দেশনা যায়। উত্তেজনার ফলে মানবদেহ থেকে যে ঘাম বেরোয়, কাঁপুনি ধরে, রক্তচাপ বৃদ্ধি পায়, ইত্যাদি, তারও নির্দেশক হচ্ছে এই হাইপোথ্যালামাস।
মস্তিষ্কদণ্ডের ওপর দিকে যে দুটি স্ফীত অংশ দেখা যায় তারই নাম অগ্রমস্তিষ্ক। মাঝখান বরাবর এটি দুই অর্ধাংশে বিভক্ত। তাদের যথাক্রমে বাম ও ডান গোলার্ধ (left and right hemisphere) বলা হয়ে থাকে। এখানকার স্নায়ুকোষগুলির মূল অংশ (নিউক্লিয়াস ইত্যাদি) ওপরের দিকে একটা পাতলা ধূসর চাদর বা আবরণীর আকারে বিন্যস্ত হয়। এরই নাম সেরিব্রাল কর্টেক্স। আর এর কোষগুলি থেকে স্নায়ুতন্তু বেরিয়ে শরীরের বিভিন্ন অংশের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে। মানুষের অগ্রমস্তিষ্কে এরকম কয়েক হাজার কোটি স্নায়ুকোষ রয়েছে। এত বিপুল সংখ্যক কোষ মাথার খুলির সীমিত আয়তনের মধ্যে স্থান সঙ্কুলান করাতে গিয়ে সেরিব্রাল কর্টেক্সে অসংখ্য ভাঁজ এবং কয়েকটি খাঁজ তৈরি হয়েছে। মানুষের এবং অন্যান্য উচ্চতর স্তন্যপায়ী প্রাণীর) সমস্ত জটিল আচরণ এই কর্টেক্স থেকে পরিচালিত হয় (চিত্র: ৪)।
অগ্রমস্তিষ্কের দুটি গোলার্ধকেই আবার চারটি ভাগে ভাগ করা হয়। করোটির সামনের দিকের অংশের নাম সম্মুখকপাল পিণ্ড (frontal lobe)। ডান বা বাঁদিকের অংশের নাম পার্শ্বকপাল পিণ্ড (temporal lobe)। পেছনের দিকে উপরিভাগে রয়েছে মধ্যকপাল পিণ্ড (parietal lobe) আর তার নীচের অংশকে বলে পশ্চাদকপাল পিণ্ড (occipital lobe)। সম্মুখকপাল পিণ্ডের ওপরের দিকে কর্টেক্সের একটা অংশকেই সঞ্চালক কর্টেক্স বলা হয়। এখান থেকেই সারা দেহের সমস্ত কঙ্কাল পেশীগুলির কাছে সঞ্চালনের নানারকম নির্দেশ যায়। ঘ্রাণ সংবেদন এবং বাক্ সঞ্চালন কেন্দ্রও এই পিণ্ডে অবস্থিত। তবে সাধারণত মানুষের অগ্রমস্তিষ্কের ডান গোলার্ধে কোনও সক্রিয় বাক-অঞ্চল দেখা যায় না। মধ্যকপাল পিণ্ডের একটা অংশে বিভিন্ন পেশী থেকে এবং দেহের নানা অঙ্গ থেকে অভ্যন্তরীণ সংবেদন এসে পৌঁছায়। একে বলা হয় দেহানুভূতি অঞ্চল (kinesthetic sensory area)। এই অঞ্চলটির বিশেষ গুরুত্ব আমরা পরে উপযুক্ত জায়গায় আলোচনা করব। এছাড়া পার্শ্বকপাল পিণ্ডের একটা অংশে শ্রবণ সংবেদনগুলি গৃহীত ও বিশ্লেষিত হয়। পক্ষান্তরে পশ্চাদকপাল পিণ্ডের একটা অংশে রয়েছে দর্শন কর্টেক্স।
এই হচ্ছে মানবমস্তিষ্কের গঠন এবং কার্যকলাপের প্রাথমিক ও সংক্ষিপ্ত বিবরণ। এরই ভিত্তিতে আমরা মানুষের চিন্তা করার ক্ষমতা বিকাশের বিবর্তনের ধারাপথটিকে অনুধাবন করার চেষ্টা চালাব।
[এরপর আগামী সংখ্যায়]
[1] Pavlov n. d.b, 285