জীবনবাবু ফিলিমস্টার

জীবনবাবু ফিলিমস্টার | প্রতীক

প্রতীক

 

 

জীবনদা এখনও গলায় দড়ি দেয়নি, তবে দিতেই পারে। যদি সত্যিই কাজটা করে ফেলে, তা হলে পুরসভার শববাহী গাড়িটার ব্যবস্থা যথাসময়ে হয়ে যাবে। আমাদের কাউন্সিলর চকাদা খুব চটপটে লোক, আর কেউ মারা গেলে সবার আগে ছুটে যায়। নার্সিংহোম-টোমে মারা গেলে তো খবরটা আগে চকাদার কাছেই আসে। ওর ণত্ব-ষত্ব জ্ঞান খুব জোরদার। খবর পাওয়া মাত্রই ধপধপে সাদা পাঞ্জাবি-পাজামা, পায়ে সাদা স্নিকার্স পরে যে বাড়ির লোক মারা গেছে সেখানে পৌঁছে যায়। অভয় দেয়, “কোনও চিন্তা করবেন না, আমি এসে গেছি। ওখানে আমার ছেলেরা চলে গেছে, ঠিক বডি নিয়ে চলে আসবে। আপনারা যদি কেউ যেতে চান, ড্রেস করে নিয়ে আমার গাড়িতে চলে আসুন।” এই কারণেই পাড়ার ছেলে, বুড়ো সকলেই চকাদাকে সম্মান করে। সকলেই মানে যে, মানুষটা ভাল। পাড়ায় দলমত নির্বিশেষে এমন কেউ নেই, যে কখনও না-কখনও চকাদার দ্বারা উপকৃত হয়নি। দুপুর দুটো, ভোর পাঁচটা কি রাত একটা — চকাদাকে সবসময় পাওয়া যায়। সন্ধের পর ডাকলে সঙ্গে মদের গন্ধ ফ্রি পাওয়া যায় ঠিকই, কিন্তু আমাদের পাড়ার ভদ্রলোক, ভদ্রমহিলারা ওটুকু মানিয়ে নিতে আপত্তি করেন না। যে লোক চব্বিশ ঘন্টা পরিষেবা দেয়, তার এইসব সামান্য ব্যাপারে খুঁত ধরা মোটেই ভাল কথা নয়। সকলেরই তো শখ আহ্লাদ থাকে। আজকাল পাড়ার কোন বাড়িতেই বা একটু আধটু চলে না? তা ছাড়া একটা লোক যদি টলতে টলতেও মানুষের সেবা করতে পারে, তা হলে কার কী বলার আছে?

বুঝতে পারছি যে প্রথম লাইনে কোনও এক জীবনদার কথা বলে, এমনকী গল্পের নামে পর্যন্ত তার নাম রেখেও চকাদার কথাই বলে যাচ্ছি বলে অত্যন্ত বিরক্ত হচ্ছেন। কিন্তু কী করব বলুন? সত্যি কথাটা হল, জীবনদা না থাকলেও কিছু এসে যায় না, চকাদা না থাকলে আমাদের পক্ষে ভদ্রতা বজায় রেখে শান্ত, নির্ঝঞ্ঝাট জীবন কাটানো কঠিন হয়ে যাবে। তাই একটু বিস্তারিতভাবে পরিচয়টা দিয়ে নিতে হল আর কি।

এবার জীবনদার কথায় আসি। জীবনদা বরাবরই ঝামেলার লোক। ওর পাশের জমিটায় বাড়ি হওয়ার সময় আইন অনুযায়ী কয়েক ফুট জায়গা নাকি ছাড়া হচ্ছিল না। তা নিয়ে কী অশান্তিই না করেছিল! শেষে পাশের বাড়ির মালিককে তৈরি হয়ে যাওয়া পাঁচিল ভেঙে ফুট খানেক পিছিয়ে নতুন করে করতেই হল। জীবনদার কী যে লাভ হল ওই এক ফুট জায়গা ফাঁকা করিয়ে! যে চকাদাকে সারা পাড়া মানে, তার সঙ্গে পর্যন্ত ও বিবাদ করতে ছাড়ে না। একবার সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখল চকাদার বিজনেসের বালি, স্টোনচিপস ওর বাড়ির সামনে রাস্তার উপর ফেলা হয়েছে। সেদিন অফিস কামাই করে ওগুলো সরাতে উঠে পড়ে লাগল। চকাদার ছেলেরা ভয় দেখিয়ে, গালমন্দ করে সুবিধে করতে পারল না, তাকে সশরীরে আসতে হল। আস্তিন গোটানো দেখে আমাদের তো হাত-পা পেটের ভেতর সেঁধিয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু জীবনদা বুক চিতিয়ে বলল, “মারবেন? মারুন, মারুন। ভালই হবে, পাবলিক রোড এনক্রোচ করার কমপ্লেনের সঙ্গে সঙ্গে ফৌজদারি কেসও ঠুকে দেব। দেখি আপনি কত বড় লিডার।” তা আমাদের চকাদা বুদ্ধিমান লোক। দেখল এই সামান্য কারণে থানা পুলিসের ঝামেলায় জড়িয়ে লাভ নেই, তাই ছেলেদের বলল মালপত্তর সরিয়ে নিতে।

তারপর ধরুন, পাড়ার পুজোটাকে জীবনদা কোনোদিনই মন খুলে চাঁদা দেয় না। ওরা যদি গিয়ে পাঁচ হাজার চায়, ও কিছুতেই দু’হাজারের বেশি দেবে না। চাপাচাপি করলে বলবে “দেখো, তোমরা যদি ভয় দেখিয়ে নেবে ভাবো, নিতেই পারো। আমি গেরস্থ মানুষ, বউ মেয়ে নিয়ে পাড়ায় থাকি, বাধ্য হয়ে দিয়ে দেব। কিন্তু সঙ্গে যে অভিশাপটা মিশে থাকবে সেটা কি ভাল হবে? পবিত্র কাজ কি ওভাবে করা উচিত?” পুজো কমিটির লোকেরা অগত্যা মনে মনে খিস্তি করতে করতে যা পায় তা নিয়েই চলে যায়।

জীবন ঘোষ বামুনের ছেলে নয় যে, তার অভিশাপকে ভয় পেতে হবে। ওকে যে ঘাঁটানো হয় না তার কারণ ও হাইকোর্টে কী একটা গুরুত্বপূর্ণ চাকরি করে, ফলে অনেক জজ ম্যাজিস্ট্রেটের সঙ্গে জানাশোনা। পুলিশের উপর মহলেও নাকি আলাপ আছে। আদালতে কাজ করে করে লোকটার নিজেরও ওকালতি বুদ্ধি কম হয়নি। সে বুদ্ধি পাড়ার লোকের কাজেও লাগে অনেকসময়। চ্যাটার্জিদের ছেলের প্রথম বউ যখন ফোর নাইন্টিএইট এ কেস দিয়েছিল, জীবনদাই তো নিজের পরিচিতি ব্যবহার করে, বুদ্ধিসুদ্ধি দিয়ে বাঁচাল। রমানাথ স্যার পেনশন তুলে ব্যাঙ্ক থেকে ফিরছিলেন, পাড়ার বাসস্টপে নামতেই দুটো ছেলে বাইক চালিয়ে এসে হাত থেকে ব্যাগটা নিয়ে হাওয়া। এসব ক্ষেত্রে নাম কা ওয়াস্তে এফআইআর করে দিয়ে হা হুতাশ করা ছাড়া আর কী করার থাকে? অথচ জীবনদা জানতে পেরে আগ বাড়িয়ে উদ্যোগ নিয়ে পুলিসকে বলে ব্যাগ ফিরিয়ে আনতে না পারলেও, চব্বিশ ঘন্টার মধ্যে পেনশনের টাকা অনেকটাই ফিরিয়ে এনেছিল। এই লোকের পেছনে কে লাগতে যাবে?

জীবনদাকে নিয়ে আসল সমস্যা কী বলুন তো? টেঁটিয়া হলেও লোকটাকে নিশ্চিন্তে খারাপ লোক বলা যায় না। পাড়া প্রতিবেশীর বিপদে আপদে এগিয়ে আসে, যেমন রোজগার করে তেমনি দানধ্যানও করে। কারও লেখাপড়া হচ্ছে না শুনলে জীবনদাকে খবর দিন, ব্যবস্থা হয়ে যাবে। নিজের তো বটেই, অন্যের বাড়ির কাজের লোকের মেয়ের বিয়েতেও সাহায্য করেছে অনেকবার। আর ব্যবহার? মাখনের মতো। স্বামী, স্ত্রী দুজনেই ভারী অতিথিবৎসল। চাঁদা নিতে যারা যায় তাদেরও চা, কফি না খাইয়ে ছাড়া হয় না। ঝিমলি, মানে জীবনদার ক্লাস এইটে পড়া মেয়েটি, সে-ও ভারী মিষ্টি। মানে জীবনদার এই কথায় কথায় লড়াই করার অভ্যেসটা যদি না থাকত, তাহলে নিশ্চিন্তে ভাল লোক বলা যেত। কিন্তু এসব করে ও মাঝেমধ্যেই যেভাবে আমাদের ভদ্র পাড়ার শান্তিভঙ্গ করে, সেটা কোনো ভদ্রলোকের কাজ নয়। আসলে সেই যে ছোটবেলায় ফিল্মস্টার হওয়ার শখ হয়েছিল ওর, সেটাই বোধহয় যত নষ্টের গোড়া। ফিল্ম লাইনে যাওয়া হয়ে ওঠেনি, অথচ বোধহয় বিখ্যাত হওয়ার সাধ যায়নি। তাই সারাক্ষণ লড়াই, ঝগড়া করে বেড়ায়। আর কিছু না হোক, এসবের জন্যে অনেকে জীবনদাকে নিয়ে আলোচনা করে, সম্মান না করলেও সমঝে চলে তো বটেই।

ফিল্মস্টার হতে চেয়েছিল কী করে জানলাম, এটাই ভাবছেন তো? আরে না না, গল্পটাকে নির্মাণ করতে গোঁজামিল দিচ্ছি না মোটেই। কথাটা জীবনদা নিজেই আমাকে একদিন বলেছিল। সেদিন অফিস থেকে ফেরার পথে হাওড়ায় এসে শুনি কোথায় ওভারহেড তার ছিঁড়ে গিয়ে আমাদের লাইনে ট্রেন চলাচল বন্ধ আছে। কী করি কী করি ভাবছি, হঠাৎ জীবনদার সঙ্গে চোখাচোখি হয়ে গেল। “আরে তুমি! বাড়ি ফিরবে তো? কিসে যাবে ঠিক করলে? যা শুনছি, এ চার-পাঁচ ঘন্টার আগে মিটবে না।” দুজনে শেয়ারে একটা ট্যাক্সি নিলাম। ওই এক ঘন্টার পথেই জীবনদার জীবনের নানা ওঠাপড়ার গল্প শুনে ফেললাম। আমি এমনিতেই ভাল শ্রোতা, তার উপর জীবনদা বয়োজ্যেষ্ঠ। তাই ও-ই বেশি বলল। আমরা পাড়ায় কয়েক বছর হল এসেছি বলে জানি না – ও বাড়িতে জীবনদাদের চার পুরুষের বাস। বাড়িটা করেছিলেন জীবনদার ঠাকুর্দা মনমোহন ঘোষ। তিনি নাকি শিশির ভাদুড়ির সঙ্গে অভিনয় করতেন। জীবনদার বাবার অবশ্য অভিনয়-টভিনয়ে একদম আগ্রহ ছিল না। তিনি চুটিয়ে কাঠের ব্যবসা করেছেন, যথেষ্ট সফলও হয়েছেন। কিন্তু ছোট থেকে ঠাকুর্দার মুখে থিয়েটারের গল্প শুনে শুনে জীবনদা ঠিক করে ফেলেছিল, অভিনেতাই হবে। “নেহাত খারাপ করতাম না, বুঝলে? স্কুলে, কলেজে নিয়মিত অভিনেতা ছিলাম। চাকরিতে ঢোকার পরেও গোড়ার দিকে পাড়ার নাটকে অভিনয় চালিয়ে গেছি। পাড়ার পুরনো লোকেদের কখনও জিজ্ঞেস কোরো, নরক গুলজারে নারদের রোলটা কেমন করেছিলাম? চুয়া চন্দনে চন্দন ছিলাম ভাই। নেহাত ফেলে দেয়ার মতন নয়।” অমিতাভের অন্ধ ভক্ত ছিল একসময়। মর্দ দেখেছে নবার, জঞ্জীর সতেরোবার, শোলে বত্রিশবার। অমিতাভের গলাটা নাকি দারুণ নকল করতে পারত। ওরকম নায়ক হবে ভেবেছিল।

“কিন্তু ভগবান মেরে রেখে দিয়েছেন। পাঁচ ফুট পাঁচ ইঞ্চিতে কি আর সিনেমার হিরো হওয়া যায় গো?”

“কেন, আপনার তো এমনিতে বেশ পরিষ্কার রং, কাটা কাটা চোখ নাক। টালিগঞ্জ পাড়ায় চেষ্টা করেছিলেন?”

“ইউনিভার্সিটির এক বন্ধু নিয়ে গেছিল একজনের কাছে। সে তো হাইট দেখেই বলে দিল ‘হিরো হবে না। অন্য রোলে দেখতে পারি।’ তারপর কী একটা ডায়লগ বলতে বলল। একটু টেনশনে ছিলাম তো, তাই বার দুয়েক ফাম্বল করেছিলাম। ব্যস, সোজা দরজা দেখিয়ে দিল। লেগে থাকলে হয়তো অন্য কোথাও কিছু হত। কিন্তু আমার খুব প্রেস্টিজে লেগে গেল, বুঝলে? তাই আর… তবে আমি এখনও অমিতাভের ভক্ত। ওটিটি-তে ওর যে ক’টা বই আছে বারবার দেখি।”

জীবনদার সম্পর্কে যেটুকু ভক্তিশ্রদ্ধা ছিল, সেটুকুও সেদিন উবে গেল। কোনও সুস্থ রুচির লোক পকেটের পয়সা খরচ করে ন’বার মর্দ দেখতে পারে? তা-ও বাপের পয়সা, কারণ আশির দশকে জীবনদা হাইস্কুলের ছাত্র ছিল। বোঝাই যাচ্ছে, ছোট থেকে ওইসব গ্যাদগেদে মেলোড্রামা দেখে লোকটার মাথাটা গেছে। ভাবে, অমিতাভ বচ্চনের মত একাই গোটা দুনিয়ার সঙ্গে লড়ে সবাইকে হারিয়ে দেবে। এইসব ধেড়ে খোকারা চিরকাল বিপদ ঘটায়, জীবনদাও ঘটাল।

আমাদের পাড়ায় ভোট এমনিতে শান্তিতেই হয়। বারোটা-সাড়ে বারোটার মধ্যে ভোট দিয়ে এলেই কোনও সমস্যা নেই, কিন্তু জীবনদা প্রত্যেকবার ভোট দিতে যায় দুপুরের খাওয়াদাওয়া সেরে, বেলা দুটো নাগাদ। ওই সময়টায় একটু অন্যরকম ভোট হয়। মানে, কেউ হয়তো নজর রাখবে কাকে ভোট দেওয়া হল, বা হয়তো শুনবেন আপনার ভোট পড়ে গেছে। আমরা সচরাচর এ নিয়ে ঝামেলা করি না। নিজের নিরাপত্তা নিজের কাছে। হইহল্লা করে বিপদ বাড়ানোর কী দরকার? কিন্তু জীবনদা তো অমিতাভ ধাতুতে গড়া। ও কোনও গোলমাল দেখলেই চেঁচামেচি শুরু করে দেয়। নিদেনপক্ষে টেন্ডার ভোট না দিয়ে কোনওদিন বাড়ি ফেরে না। এ নিয়ে আমরা অনেকে অনেকবার সাবধান করেছি।

“বছরের পর বছর এইসব করে লোকাল নেতাদের চক্ষুশূল হয়ে যাচ্ছ, এরা কি চিরকাল ছেড়ে দেবে তোমাকে?”

“আমিও তৈরি আছি। আইনের বাইরে একটা কথাও বলি না। আর আমার গায়ে হাত দিলে কাদের সঙ্গে ডিল করতে হবে ওরাও ভাল করে জানে।”

“আরে শুধু নিজের কথাই ভাবছ? বৌদি আছে, বয়স্থা মেয়ে আছে তোমার। ওদের যদি কোনও ক্ষতি করে দেয়? তখন পুলিস, আইন আদালত করে কী হবে?”

“আমাদের এই পাড়ায় একশো বছর হতে চলল। আমার মেয়ে, বউয়ের দিকে হাত বাড়ালে পাড়ার লোকে ছেড়ে দেবে? অত সোজা?”

এমন লোককে বেশি বোঝাতে যাওয়া বৃথা। এবার ভোটের দিন জীবনদার একেবারে ডানা গজাল – পিপীলিকার মতো। তার জন্যে অবশ্য শিবরাম সরকারও অনেকটা দায়ী। উনি এত পয়সাওয়ালা, ক্ষমতাবান লোক, অথচ আমাদের ওয়ার্ডে ওঁর পার্টি কিছুতেই প্রার্থী দিয়ে উঠতে পারছিল না। আসলে চকাদাকে কেউ চটাতে রাজি নয়। পাঁচ বছর নিঃস্বার্থভাবে কাজ করে যদি লোকটা ভোটের দিন একটু শান্তি চায়, তাতে ক্ষতি কী? চকাদা তো এমনিও জিতবে, অমনিও জিতবে। বিরোধী প্রার্থীর ভোট তিন অঙ্কেও পৌঁছবে না। তার উপর ভোটের দিন কখন চকাদার ছেলেরা সবাইকে বাড়ি পাঠিয়ে দেবে, তারও ঠিক নেই। তাই আর কেউ ভোটে দাঁড়াতে রাজি হচ্ছিল না। অনেক কষ্টে শিবরামবাবু এমন একজন সমর্থককে রাজি করিয়েছিলেন যে অফিসের কাজে বছরে ছ’মাস বাইরেই থাকে। সেই যুক্তিতে সে আপত্তি করেছিল, শিবরামবাবু বলেছিলেন “জিতলে কাজ করতে অসুবিধা হত। সে চান্স তো নেই। তোমায় প্রচার-টচার কিচ্ছু করতে হবে না। শুধু আমাদের পার্টির একটা ক্যান্ডিডেট না-থাকলে খুব বেইজ্জতি, তাই নাম কা ওয়াস্তে দাঁড়িয়ে যাও।” মনোনয়ন তোলার ঠিক আগের দিন সে-ও বেঁকে বসল। আসলে তার বিধবা মাকে কয়েকজন এসে বলে গেছে, “মাসিমা, বাড়িতে এক্সট্রা থান রাখবেন। দশ তারিখের পর আপনার সঙ্গে আপনার বউমাকেও পরতে হবে।” এরপর শিবরামবাবু দেখলেন সমর্থক খোঁজার চেয়ে সাহসী লোক খোঁজা বেশি জরুরি। পাড়ার ছেলেরা সাহসী শব্দটা শুনেই এক বাক্যে জীবনদার নাম বলল। অমনি শিবরামবাবু পৌঁছে গেলেন ঘোষবাড়ি। জীবনদা কোন পার্টিকে ভোট দেয় আমি জানি না, পাড়ার কেউই জানে বলে মনে হয় না। কিন্তু শিবরামবাবুর তাতে কিছু এসে যায় না। ওই ওয়ার্ডে প্রার্থী দিতে না-পারলে পার্টির উপরতলার নেতাদের কাছে আর কোনও দামই থাকবে না।

জীবনদা তো এক পায়ে খাড়া। আমার বাল্যবন্ধু লাল্টু শিবরামদার পার্টির ছেলে। নেতার মুখের উপর কথা বলতে পারে না বলে সঙ্গে গিয়েছিল রাজি করাতে। কিন্তু মনে মনে তো পাড়ার লোকের অমঙ্গল চাইতে পারে না। ঘুরে এসে আমাকে বলেছিল, “শালা যেমন লোকটা গেঁতো, তেমনি তার গিন্নী আর মেয়ে। আমি ভাবলাম ওরা বারণ করবে। বললে বিশ্বাস করবি না, বৌদি বলল ‘তুমি অবশ্যই দাঁড়াও। অন্তত কাউকে তো রুখে দাঁড়াতে হবে। হারজিত বড় কথা না।’ আর মেয়েটা! উফ! বলে ‘ব্যাব্যা, তুমি লোকের জন্যে এত করো, দেখো সবাই তোমার পাশে থাকবে।’ এরা কোন জগতে থাকে মাইরি!”

অতএব জীবনদা বুক চিতিয়ে নমিনেশন পেপার তুলল এবং জমা দিল। রোজ দুবেলা সন্ধের পর ঘোষবাড়ির সামনে একদল ছেলেপুলে এসে অকথ্য গালিগালাজ করা শুরু করল। প্রথম ক’দিন জীবনদাও পাল্লা দিয়ে চিৎকার করল, তারপর দেখলাম দুপুর থেকেই দরজা জানলা সব বন্ধ থাকছে। ছেলেগুলোর অবশ্য কর্তব্যে ফাঁকি নেই।

ভোটের দিন জীবনদার যা চেহারা দেখলাম সে আমরা কল্পনাও করিনি। পোলিং এজেন্টকে বসতে দেওয়া হয়নি বলে দারোগাকে বিস্তর ধমকাল, যদিও দারোগা স্ট্যাচু হয়ে রইল। ওর তেজ দেখে অনেকে বাড়ি ফিরে যাবে ঠিক করে ফেলার পরেও ঢুকে পড়ে ভোট দিয়ে গেল। চকাদার ছেলেরা বেশ খানিকক্ষণ হম্বিতম্বি করেও লোকের উৎসাহ দেখেই বোধহয় আটকাতে সাহস করল না। শেষে চকাদা নিজে এসে বেলা তিনটের সময় ধাক্কা মেরে জীবনদাকে রাস্তায় বার করে দিয়ে ব্যাপারটা সামলাল। জীবনদার স্ত্রীকে বলেও গেল, “আপনার হাজবেন্ডের সিকুরিটির দায়িত্ব কিন্তু আর আমার না। আপনি বুঝে নেবেন।” যে ঘটনা জীবনদাকে ফিল্মস্টার বানিয়ে দিয়েছে, সেটা ঘটল পরের দিন সন্ধেবেলা, আমার চোখের সামনেই।

স্রেফ জীবনদা জেদ করে ভোটে দাঁড়িয়েছিল বলেই আমাদের পাড়ার পরিবেশটা ভোটের ক’দিন আগে থেকে একেবারে দূষিত হয়ে গিয়েছিল। সারাক্ষণ বেপাড়ার গুন্ডা বদমাইশদের আনাগোনা, জীবনদার বাড়ির সামনে দল বেঁধে গালিগালাজের ফলে আমাদের মতো ভদ্রলোকেদের পক্ষে বাড়ি থেকে বেরনোই বিপজ্জনক হয়ে উঠেছিল। ভোটের আগের দিন রাতে তো দু-চারটে বোমা পর্যন্ত ফেটেছিল। ভোট মিটতে পাড়ার পরিবেশটা আবার খোলামেলা হল, রাস্তার উপর আড্ডাগুলো ফের চালু হল। আমি সেরকমই একটা আড্ডায় বসে চা খাচ্ছিলাম। এমন সময় দেখি জীবনদা আর ঝিমলি বাজারের ব্যাগ হাতে হেঁটে মেন রোডের দিকে যাচ্ছে। আমাদের মধ্যে এক রসিক পেছনে লাগার উদ্দেশ্যে চেঁচাল “কী দাদা, কাল তো রেজাল্ট। ক’টা ভোট পাবেন?” জীবনদা একগাল হেসে বলল “বোধহয় একটাই। গিন্নীও মনে হচ্ছে আমায় ভোট দেয়নি।” বলে কয়েক পা এগিয়েছে, একটা বাইক উল্টো দিক থেকে সোজা এসে থামল ওদের সামনে। চাপাই দিয়ে দেবে ভেবে আমরা লাফিয়ে উঠেছিলাম। ঝিমলি আর জীবনদাও চিৎকার করে উঠেছিল। যে চালাচ্ছিল তার কিন্তু দারুণ নিয়ন্ত্রণ। প্রায় জীবনদার গায়ে উঠে পড়ে স্টার্টটা বন্ধ করল, তারপর দাঁত বার করে বলল “এ বাবা! আরেকটু হলেই তোর বিচিটা যেত রে।”

ওরা তিনজন। চেহারা দেখে বোঝাই যায় ভদ্রলোক নয়, ভাল উদ্দেশ্য নিয়ে পাড়ায় ঢোকেনি। আমার তখন গলা শুকিয়ে গেছে, অন্যরা বাড়ির দিকে হাঁটা দিয়েছে। জীবনদাকে দেখে এই প্রথম মনে হল ভয় পেয়েছে, ঝিমলি তো পেয়েছেই। আমরা যার দোকানে বসে চা খাচ্ছিলাম, সেই রতনের বোধহয় ছেলেগুলো চেনা। দেখি বেশ গটগট করে এগিয়ে গিয়ে বলল “অ্যাই বাচ্চু, ছেড়ে দে না। ভোট মিটে গেছে, যা হবার হয়ে গেছে। যা বাড়ি যা।” যার নাম বাচ্চু, সে আলতো ধাক্কা মেরে রতনকে সরিয়ে দিল। “তুই এর মদ্যে আসিস না। এটা অন্য কেস।” তারপরই তিনজন মিলে জীবনদাকে পেটাতে শুরু করল। ঝিমলি বাধা দিতে গিয়েছিল, একজন ওর চুলের মুঠি ধরে আমার পাশে এনে দাঁড় করিয়ে দিয়ে বলল “একে এখানেই দাঁড়াতে বলুন। এখন মেয়েছেলের মুড নেই তাই। নইলে…”

কী আপদ ভাবুন! ভয়ের চোটে নড়তে পারছি না, নইলে তখন ওখানে কেউ দাঁড়িয়ে থাকে? আবার আমার উপরে মেয়েটাকে সামলানোর দায়িত্ব চাপাচ্ছে! ওর বাবাকে চোখের সামনে তিনটে ষণ্ডা মিলে পেটাচ্ছে, ও নাকি সুস্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকবে। ঝিমলি যথারীতি চিৎকার করে কেঁদে গেল, আমার মতো রাস্তার দু’ধারে যারা গান্ধীমূর্তি হয়ে দাঁড়িয়েছিল তাদের “বাঁচাও, আমার বাবাকে মেরে ফেলবে। বাঁচাও” বলতে লাগল। কে বাঁচাবে রে বাবা? নিজে বাঁচলে তবে তো বাঁচাবে। তবে আমার প্রথম থেকেই ভরসা হচ্ছিল, খুন করতে ওরা আসেনি। কারণ, তা হলে এত সময় লাগাত না।

জীবনদা নীরবেই মার খেয়ে যাচ্ছিল, যখন তলপেটে লাথি মেরে একেবারে শুইয়ে দিল তখন গলা বেরোল। “মেরে ফ্যাল রে ভাই, মেরেই ফ্যাল। কী হবে বেঁচে? মেরে ফ্যাল।”

“মারব না তোকে, ঘাবড়াস না। তোর বুকনি জম্মের মতো বন্দ করে দিয়ে যাব শুদু। অ্যাই নাড়ু, খোল তো। সালার প্যান্টটা খুলে নে”, বাচ্চু আদেশ দিল। জীবনদা বাধা দেওয়ার অবস্থায় ছিল না। আমার তখন চোখ জ্বালা করছে, মাথা ঘুরছে, ঝিমলির দিকে তাকাতে পারছি না। চোখ নামিয়ে নিয়েছিলাম। কানে এল বাচ্চু বলছে, “ভিডিও কর, ভিডিও কর। পুরো ইন্ডিয়াকে এই বাঞ্চোদের নুনু দেখাব। জীবনবাবু ফিলিমস্টার হয়ে যাবে রে। হ্যা হ্যা হ্যা। খানকির ছেলে সব জাগায় নাক গলাবে। ওর নাকি কে সব দাদা আচে, তাদের জন্যে অত গলার জোর। আমরা এখন এইখানে বসে চাট দিয়ে মাল খাব। তুই যা তোর কোন দাদা আচে ডেকে নি আয় বাল। তোর প্যান্ট জমা রইল। ন্যাংটো পোঁদে যা, দাদাকে নিয়ে আসতে পাল্লে প্যান্ট ফেরত পাবি।”

সেই ভিডিও পুরো ইন্ডিয়া দেখেছে কিনা জানি না, এই শহরে কারও দেখতে বাকি নেই। সত্যিই, চব্বিশটা ঘন্টার মধ্যে জীবন ঘোষকে যতজন চিনে গেছে লোকটার সারাজীবনে ততজন ওর নাম শোনেনি। সকাল থেকে ভাবছি, এখন জীবনদা যদি অপমানে গলায় দড়ি দেয়, তাহলে অমিতাভ বচ্চন না হলেও এ কে হাঙ্গল হওয়া হবে। সেই যে বেশরম ছবিটায়? কাজটা করে ফেললেই পারে। সৎকারে ত্রুটি হবে না। চকাদা সব সামলে নেবে।

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4879 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...