শঙ্কর রায়
সাংবাদিক, প্রাবন্ধিক
গঙ্গাসাগরে শেষ হল মেলা। ভিড় জমালেন স্থানীয় ক্রেতা-বিক্রেতা থেকে শুরু করে ভিনরাজ্যের বহু পুণ্যার্থী, তাদের অনেকেই করোনাবিধি অমান্য করলেন অবলীলায়। অধিকাংশ সাধারণ মানুষেরই মাস্ক পরার কোনও বালাই ছিল না! আর, মাস্ক পরলেও তা থুতনিতে। মাস্ক ছাড়াই চলল কেনাকাটা। সাগরের বিডিও সুদীপ্ত মণ্ডল বলেছিলেন— “মেলায় আসা মানুষকে সচেতন ও সতর্ক করতে প্রচার চালানো হচ্ছে। যাদের মুখে মাস্ক নেই তাদেরকে মাস্ক বিলি করা হচ্ছে। সবকিছু জানার পরেও মানুষ যদি সচেতন না হয়, প্রশাসন আর কী করবে? গঙ্গাসাগর মেলার শুরু থেকেই জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে নানা বিষয়ে সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল। তাছাড়াও প্রচারের পাশাপাশি নিয়মিত মাস্ক বিক্রি করা হয়েছে। মেলা প্রাঙ্গন সহ সমস্ত রাস্তায় মোতায়েন ছিল পুলিশ, সিভিক ভলেন্টিয়ার, স্বেচ্ছাসেবক ও আশা কর্মীরা।”
তবে এটা নিয়ে, অর্থাৎ মাস্ক ছাড়াই চলাফেরা করা নিয়ে অত হইচইয়ের বাস্তব যৌক্তিকতা নেই। একবার শিলিগুড়ি ও আশপাশের এলাকা ঘুরে এলেই দেখবেন অধিকাংশ মানুষ মাস্ক ছাড়াই যত্রতত্র যাচ্ছে। সেখানে করোনা ভয়াবহ হয়ে ওঠেনি এখনও। কয়েকদিন আগে ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন ঘোষণা করেছেন যে মাস্ক পরে চলা বাধ্যতামূলক হবে না আর, করোনার সঙ্গে সহবাস করতে হবে, লড়তে হবে। এখন তো দাবী উঠছে স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় স্বাভাবিক ছন্দে ফিরিয়ে আনতে হবে, সেখানে তো ছাত্রছাত্রীদের বড় রকমের ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দেওয়া হবে, তা কিন্তু প্রকারান্তরে মেনেই নেওয়া হচ্ছে।
এ সব কথা লিখেছি বলে কেউ যেন ভেবে না নেন, যে আমি মাস্ক পরে চলাফেরার বিরুদ্ধে। আমার বক্তব্য অহেতুক ভীতি ছড়ানো ঠিক নয়। তাছাড়া করোনা নিয়ে দুনিয়ার বিজ্ঞানীরা পারতপক্ষে কিছু বলছেন না, কারণ এখনও তার জানার চেয়ে অজানার পরিধিটা অনেক বড়। কিন্তু নানা সংবাদ চ্যানেলে মুখ দেখাতে চাওয়া এক শ্রেণির চিকিৎসক, সবজান্তা নেতা-কলমচি যা খুশি বলে যাচ্ছেন— আজ যা বলছেন, কাল তার উল্টো বলছেন। একবার জিজ্ঞেস করুন তো জিন সিকোয়েন্সিং কী, তার বৈজ্ঞানিক ভিত্তি (যার মধ্যে আছে স্ট্যাটিস্টিক্যাল জেনেটিক্স) কী— এঁদের প্রায় কেউই বলতে পারবেন না।
যাই হোক মেলা প্রসঙ্গে আসা যাক। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মেগালোম্যানিয়া-প্রবণতা আরেকবার ফুটে উঠেছিল এবারের গঙ্গাসাগর মেলায়, যেন এটা বন্ধ করলে তাঁর মান বিপন্ন হবে। অন্য অর্থে, এটা ছিল শূন্যগর্ভ ইগোর লড়াই। নাহলে গর্বের সঙ্গে বলতেন না গঙ্গাসাগরের বিপুল আয়োজনে যে পরিমাণ অর্থ ব্যয় হয়, রাজ্য সরকার একাই বহন করে। রাজ্য সরকারের এবার চ্যালেজ ছিল পরিচ্ছন্নতা ও সঠিক পরিষেবা গঙ্গাসাগরে আগত প্রতিটি মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়া। সেটা মনে হয় অনেকটাই পালিত হয়েছে, যদিও এ নিয়ে বিশদ রিপোর্ট এখনও আসেনি। মেলাকে প্লাস্টিকমুক্ত রাখতে এবার অভিনব কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিল রাজ্য প্রশাসন, যেমন— লাগাতার প্রচার চালানোর পাশাপাশি ক্রেতা সেজে দোকানদারদের পরখ করার ব্যবস্থা রাখা, ইত্যাদি।
সুন্দরবন বিষয়ক মন্ত্রী বঙ্কিম হাজরা ও বিদ্যুৎমন্ত্রী অরূপ বিশ্বাস ছাড়াও আরও ছজন মন্ত্রী চব্বিশ ঘন্টা নজরদারি করেছেন। কিন্তু স্থানীয় মানুষের ধারণা মন্ত্রী সুব্রত মুখার্জি একাই সব সামলাতে পারতেন তাঁর স্বভাবজ প্রশাসনিক প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব ও সাধারণ মানুষের সঙ্গে মেলামেশার কারণে। এই প্রথম গঙ্গাসাগর মেলায় সুব্রত মুখার্জি অনুপস্থিত। তিনি এই মেলার আমূল পরিবর্তন এনেছিলেন। গত দেড় দশক তিনি চারদিন এখানেই থাকতেন, উঠতেন তাঁর অধীন জনস্বাস্থ্য ও কারিগরি দপ্তরের আবাসন ঊর্মিমুখরে। প্রশাসনিক দায়িত্ব পালন করতেন কন্ট্রোল রুম থেকে নয়, লোকের মধ্যে থেকে, কথা বলে, আলোচনা করে তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত নিতেন। মেলার কদিন রোজ সন্ধ্যায় তিনি থাকতেন সমুদ্রতটে মেলা অফিসে, সঙ্গে অন্যান্য মন্ত্রী ও বিধায়করা। মেলা অফিসে বসেই সংবাদমাধ্যমের প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার কাজটাও করতেন তিনি। আবাসন থেকে মেলা অফিসে যাওয়ার পথে ঊর্মিমুখরের লাগোয়া একটি চায়ের দোকানে বসে এলাকার বাসিন্দাদের সঙ্গে আড্ডা দেওয়াটা তাঁর অভ্যেস হয়ে উঠেছিল। দোকানটি চালান বিজুরাম দাস। গঙ্গাসাগর মেলায় চারদিন রোজ প্রাতঃভ্রমণ সেরে বিজুরামের দোকানেই চা খেতে আসতেন মন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায়। সেই বিজুরামের স্মৃতিতেও সিক্ত সুব্রতবাবু— “চা খাওয়ানোর পর টাকা নিতে না চাইলে, মিষ্টি হেসে ফ্যাসফ্যাসে গলায় বলতেন, আরে বোকা চা বিক্রি করার জন্যই তো দোকান খুলেছ। টাকা না নিলে লাভ হবে কী করে! তাঁর মিষ্টি হাসিটা যেন চোখের সামনে ভাসছে। আর কথাগুলো কানের মধ্যে বাজছে। এবছর তিনি আসবেন না মেলায়, সেটা বিশ্বাসই হচ্ছে না।” প্রবল ঝুঁকি নিয়ে রাজ্য সরকার মেলা ব্যবস্থাপনার ভার নিয়েছে, নিতে বাধ্য হয়েছে সামাজিক ও রাজনৈতিক কারণে। সুব্রতবাবুর অনুপস্থিতি অবশ্যই অনুভূত হয়েছে।
কপিল মুনির মন্দিরের আশেপাশে ভিড় জমানো সাধুসন্তদের আখড়ায় প্রত্যেক বছর নিয়ম করে যেতেন তিনি। সকলের সুবিধা অসুবিধার কথা শুনে প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিতেন আধিকারিকদের। তিনি হয়ে উঠেছিলেন গঙ্গাসাগরের ঘরের ছেলে। মকর সংক্রান্তির পুণ্য লগ্নে পুণ্যার্থীদের ভিড়ের মধ্যেই সমুদ্রে নেমে পুণ্যস্নান করতেন— স্মৃতিচারণ করছিলেন স্থানীয় বিধায়ক বঙ্কিম হাজরা। “১৯৭২ সালে সুব্রত মুখোপাধ্যায় এর হাত ধরে কলেজ রাজনীতিতে যোগ দিই। দীর্ঘদিন ওঁর সঙ্গে একান্তে কাটিয়েছি। সাগরদ্বীপের উন্নয়ন ও গঙ্গাসাগরের সৌন্দর্যায়নের অগ্রগতি নিয়ে সুব্রতবাবুর সঙ্গে প্রচুর স্মৃতিবিজড়িত ঘটনা সাক্ষী আমি। রাতের অন্ধকারে ঘুরে দেখতাম পুণ্যার্থীদের জন্য তৈরি শেডগুলি। কপিলমুনির মন্দিরের পাশে সাধুসন্তদের জন্য যে কংক্রিটের শেড তৈরি করা হয়েছে, তার সবটাই সুব্রতবাবুর জন্য।” গঙ্গাসাগরের সৌন্দর্যায়ন ও উন্নয়ন নিয়েও এলাকার বিধায়ক বঙ্কিমচন্দ্র হাজরার সঙ্গে বিভিন্নরকম পরিকল্পনা করতেন। তৃণমূল সরকারের দায়িত্বে থাকা মন্ত্রী হিসেবে কলকাতায় ফিরে গিয়ে সেই পরিকল্পনার কথা মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে জানাতেন না। যাঁর রাজনৈতিক গুরু ছিলেন সুব্রতবাবু। তাঁর সুপারিশেই ১৯৮৪ সালে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যাদবপুর লোকসভা কেন্দ্রে কংগ্রেসের প্রার্থী হয়েছিলেন ও ২০ হাজারের বেশি ভোটে সিপিআই(এম)-এর হেভিওয়েট প্রার্থী সোমনাথ চ্যাটার্জিকে হারিয়েছিলেন।
কিন্তু এবার বেঁচে থাকলে আকস্মিক ওমিক্রন ভাইরাসের ব্যাপক আক্রমণের পরে সুব্রতবাবুও কি এ বছরের জন্য মেলা স্থগিত রাখার কথা বলতেন? স্থানীয় যাঁরা প্রতিবছর তাঁকে দেখে এসেছেন, তাঁদের কারও কারও অভিমত লোক মারফত যা জানলাম, তাঁদের ধারণা, করতেন না, চ্যালেঞ্জ হিসেবেই নিতেন। এই কথাটা এজন্যে বলছি সুব্রতবাবুকে আমি বছর পনেরো খুব কাছে থেকে দেখেছি। রিপোর্টারি করার সুবাদে সপ্তাহে অন্তত দু দিন, ওয়েস্ট বেঙ্গল প্রভিনশিয়াল কংগ্রেসের (ডব্লুবিপিএনটিইউসি) সভাপতি থাকাকালীন তাঁর সঙ্গে আড্ডা মেরেছি, খবর করেছি (ব্রেকিং নিউজও)। আমি সাধারণত তাঁর ডানদিকে বসতাম। ধর্মভীরু মানুষটি ভারতের বৃহত্তম বার্ষিক মেলাকে রাজনৈতিকীকরণ করতে দিতেন না।
এটা ঠিকই যে নানা দিক থেকে রাজ্য সরকার এক চক্রব্যূহে আটকে পড়েছিল। এক, কলকাতা হাইকোর্টের দ্বিচারিতা। প্রথমে তিন সদস্য বিশিষ্ট কমিটি যাতে কোনও চিকিৎসক ছিল না। পরে আবার তা পালটে অবসরপ্রাপ্ত হাইকোর্টের বিচারপতি সমাপ্তি চট্টোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে তিন সদস্যের কমিটি। উত্তরাখণ্ডের হাইকোর্টের মত কলকাতা হাইকোর্ট মেলা বন্ধের নির্দেশ দেয়নি। কোন হাইকোর্ট ঠিক, তা আমাদের চর্চার বাইরের ব্যাপার।
পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপাল জগদীপ ধনখড়ের বিরক্তিকর আচরণে আমরা অভ্যস্ত। মাঝে মাঝে মনে হয় তিনি এক ব্যর্থ রাজনৈতিক ভাঁড়। দিল্লির নির্দেশে কলকাঠি নাড়া তাঁর কাজ। তৃণমূল কংগ্রেস বিপুল সংখ্যাধিক্যে নির্বাচিত হলেও প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি-কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ-র চক্ষুশূল এই সরকার। রাজ্যপাল কেবলই সেই সরকারকে কাজে বাধা দিয়ে যাচ্ছেন আর নিজের এক্তিয়ারের গন্ডি ছাড়িয়ে যাচ্ছেন।
রাজ্য বিজেপিও রাজনীতি করেছে। পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য বিজেপি সভাপতি ডঃ সুকান্ত মজুমদার ও তাঁর সাঙ্গপাঙ্গরা (প্রাক্তন রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষও) মেলা নিয়ে রাজনীতির খেলায় মেতেছিলেন। বিজেপি সভাপতি বলেছেন, ‘‘হিন্দু বিরোধী তকমা থেকে বাঁচতেই গঙ্গাসাগর মেলা করতে চাইছেন মুখ্যমন্ত্রী। এই মুহূর্তে মানুষের জীবনের গুরুত্ব সবচেয়ে বেশি। কিন্তু চক্ষুলজ্জায় গঙ্গাসাগর মেলা বন্ধ করতে পারছে না রাজ্য সরকার। বড়দিনের পর থেকেই সংক্রমণের এই বাড়বাড়ন্ত রাজ্যে। বড়দিন বন্ধ করতে পারেনি বলে, এখন গঙ্গাসাগর মেলা বন্ধ করতে চক্ষুলজ্জায় বাঁধছে।” কথাগুলো তিনি মন থেকে বলেননি, উস্কানি থেকে বলেছেন, কারণ বন্ধ করলেই রাজ্য জুড়ে আসন্ন পুরসভা ভোটে গেরুয়া পার্টির ধর্মগত মেরুকরণের প্রচারে সুযোগ পাবে। গেরুয়া শিবির করোনা পরিস্থিতিতে মেলা বন্ধ করার দাবি তুলেছিল। এ দলের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য স্পষ্ট— যে ধর্মের রাজনীতি করার অভিযোগ রাজ্যের শাসক তৃণমূল তাদের বিরুদ্ধে তোলে, সেই অভিযোগের অভিমুখটি তাদের দিকেই ঘুরিয়ে দিচ্ছিল পদ্মশিবির। ভিন রাজ্য থেকে প্রচুর পুণ্যার্থী আসেন। পশ্চিম, উত্তর এবং মধ্যভারতের পুণ্যার্থীর সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে বেশি থাকে। এর মধ্যে বিজেপি-শাসিত উত্তরপ্রদেশ, উত্তরাখণ্ড, মধ্যপ্রদেশ, হিমাচল প্রদেশ, গুজরাত থেকেও অনেক পুণ্যার্থী আসেন। উত্তর-পূর্বের অসম, ত্রিপুরা থেকেও আসেন পুণ্যার্থীরা। সেই সব রাজ্য থেকে আগত পুণ্যার্থীর ঢল যাতে নিয়ন্ত্রণ করা যায়, তার জন্যও রাজ্য বিজেপি উদ্যোগী। দলের মুখপাত্র শমীক ভট্টাচার্য তো বলেইছিলেন ‘‘আমাদের শীর্ষনেতৃত্বের সঙ্গে আলোচনা করে আমরা পদ্ধতি ঠিক করব। তবে আমরা চাই না, অন্য রাজ্যের মানুষ বাংলায় এসে এখানে সংক্রমণ ছড়িয়ে যান বা নিজেরা সংক্রমিত হন। কিন্তু পুণ্যার্থীদের তো আর জোর করে সাগরে আসতে বাধা দেওয়া যায় না। তাই আমরা চাই নিয়ন্ত্রণ। যাঁরা একান্তই আসবেন তাঁরা যেন নিজের রাজ্যেই স্বাস্থ্যপরীক্ষা করিয়ে আসতে পারেন।’’
মেলা শেষ। এর ফল কী হল, তা সকলেই জানতে চান। কত লোক হয়েছিল এ নিয়ে যা যা খুশি বলে যাচ্ছে। কেউ বলছেন ৫৫ লক্ষ, তো কেউ বলছেন তিন কোটি। যাই হোক না কেন, মেলা থেকে সংক্রমণের হার বৃদ্ধির তথ্যের জন্য আমাদের আরও কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে। মানুষকে নিয়ে রাজনীতির ফাটকা খেলায় কে হারল কে জিতল, তখনই বলা যাবে।