জয়রাজ ভট্টাচার্য
নাট্যকর্মী, সমাজকর্মী
আউট অফ সাইট, আউট অফ মাইন্ড। এই কথাটা বাংলা থিয়েটারে খুব চালু। নাগাড়ে কাজ করে না গেলে দর্শকমানস থেকে হারিয়ে যেতে পারি, এই ভয় অনেক প্রখ্যাত নটকেই প্রলিফিক করে তোলে। তার ফল হয় উলটো। একটা দুটো ভালো কাজ হয়, আর বাকি কাজ হয় মিডিওকার, অ্যাভারেজ। ফলে দারুণ সম্ভাবনা নিয়ে শুরু করা অনেকেই, কিছুদিন পর থেকে দর্শকের চোখে নেহাতই মামুলি প্রতিপন্ন হয়েছেন। শাঁওলি মিত্র কখনও প্রলিফিক হতে চাননি। তাঁর মাতা ও পিতার কাছ থেকে সম্ভবত এটাই ওঁর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অর্জন। ওঁর কাজ ছিল পরিপাটি। যত্ন নিয়ে বোনা সোয়েটারের মত নরম, উষ্ণ আর ব্যক্তিগত ‘মমতার স্পর্শ’ মাখা। বরং বলা চলে অনেকসময় প্রয়োজনের থেকে কিছু বেশিই পরিপাটি। কর্কশ স্বরটিও কিছু বেশি রিনরিনে। কানে মধুর ঠেকে।
স্বজনপোষণ বা পরিবারতন্ত্রের অভিযোগ থিয়েটারের বাতাসেও ভাসে, কিন্তু কোনওভাবেই এই অভিযোগ মিত্রদের শত্রুরাও তুলতে পারবে না। প্রথমত মিত্ররা তিনজনই যোগ্যতার শিখরে বিরাজ করেছেন, ঠেকনা দেওয়ার প্রয়োজনই পড়েনি। দ্বিতীয়ত মিত্রদম্পতিই নিজের দলে মার্জিনাল হয়ে পড়েন, সরে যান। তাই শাঁওলি মিত্রকে স্ক্র্যাচ থেকে নিজের দমে নতুন দল গড়ে, নিজেকে এবং দলকে এস্ট্যাবলিশ করতে হয়। আর এই নিজেকে গড়ে তোলার পর্বে শাঁওলি মিত্র, মাতাপিতার থেকে সবটুকু নিয়েছেন, কিন্তু শুধু মাতাপিতার থেকেই নিয়েছেন এমন নয়। ওঁর অভিনয়ে এবং থিয়েটার ডিজাইনে নানা এলিমেন্টের সম্মিলন দেখা গেছে। বরং বহুরূপী, শম্ভু মিত্র পরবর্তী সময়েও অনেক বেশি ঘরানা কনশাস থেকেছে, কিছুটা এক ধাঁচের ডিজাইনে লিমিটেড থেকেছে। শাঁওলি মিত্রের রেঞ্জ ছিল বিশাল। উনি খুব কম প্রযোজনা করলেও, সেই রেঞ্জ বুঝতে অসুবিধা হয় না। ওঁর প্রতিটা মুভমেন্ট ও স্বরের নিক্ষেপে যে গভীর প্রত্যয় আর সংবেদ কাজ করেছে, তা বুঝতে একটিমাত্র প্রযোজনাই যথেষ্ট।
অনেকদিন পর্যন্ত পাড়ার ফুটবলে কিছুটা আনফিট ভগ্নস্বাস্থ্য ছেলেকে গোলকিপার খেলতে দাঁড় করিয়ে দেওয়া হত। অথচ সবচেয়ে ফিট, সবচেয়ে রিফ্লেক্স ভালো এমন খেলোয়াড় গোলকিপার হওয়া উচিত। প্রফেশনাল ফুটবলে তাই-ই হয়। কারণ গোলকিপার ভুল করলে টিম হারবে। অনেককাল থিয়েটার নিয়েও এরকম একটা ভ্রান্ত ধারণা কাজ করেছে। গান শিখতে হয়, নাচ শিখতে হয়, ছবি আঁকা শিখতে হয়, কিন্তু থিয়েটার শিখতে হয় না। পাড়ার গোলকিপারের মতই, থিয়েটার নিয়ে একটা হেলাফেলার মনোভাব সর্বস্তরে ছিল। অথচ আর্ট প্র্যাক্টিস নিয়ে সার্বিক বোঝাপড়া না থাকলে থিয়েটারে খুব বেশি কিছু করা সম্ভব নয়। শাঁওলি মিত্রর বাংলার থিয়েটারে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য অবদান— ট্রেনিংয়ের গুরুত্ব প্রতিষ্ঠা করা। একটা ট্রেনিং মডিউল এবং মেথোডলজি তৈরি করা। অভিনয় করতে হলে, নিজের শরীর, স্বর, এবং আবেগের ওপর যে নিয়ন্ত্রণ কায়েম করতে হয় ধারাবাহিক চর্চায়, তার ক্ষেত্র প্রস্তুত করেছিলেন শাঁওলি মিত্র। আজ বাংলা থিয়েটারে ওয়ার্কশপ প্রসেসের যে রমরমা সব দলেই দেখা যায়, তার শুরুয়াত দুই সমকালীন নটীর হাতে। শাঁওলি মিত্র এবং স্বাতীলেখা সেনগুপ্ত। দুজনেই একই সময়ে প্রয়াত হলেন। দুজন একই সময়ে বাংলা থিয়েটারে পুরুষের আধিপত্যকেও নিজেদের যোগ্যতায় ভেঙে দিতে পেরেছিলেন।
একটা বিশেষ সময়ে বাংলার রাজনীতিতে শিল্পীদের, চিন্তকদের রাষ্ট্রশক্তির বিরুদ্ধে ডিসেন্ট তৈরি করার যে অমোঘ ক্ষমতা, তার প্রয়োগের ক্ষেত্রে একইসঙ্গে দার্শনিক অভিজ্ঞান ও কার্যকরী ভূমিকায় অবতীর্ণ হন শাঁওলি মিত্র। সফল হন। কিন্তু বাংলার দুর্ভাগ্য, ডিসেন্ট নির্মাণের প্রাজ্ঞ প্রবক্তারা অচিরেই সরকারি কনসেন্ট নির্মাণের মেশিনারিতে পর্যবসিত হয়েছিলেন।
থিয়েটারের কাজের ক্ষেত্রে ঘন ঘন কাজ না করার, সময় নিয়ে, রেওয়াজ করে প্রযোজনা নির্মাণের যে নিজস্ব নিয়ম শাঁওলি মিত্র বজায় রেখেছিলেন আজীবন, তা তো আর সরকারি পদে আসীন থাকলে সম্ভব নয়। সেখানে সরকারি নিয়মই একমাত্র নিয়ম। এই কনট্রাডিকশন অন্যান্য সরকারি নটদের ক্ষেত্রে নেহাত ফার্স, কিন্তু শাঁওলি মিত্রর ডিগনিটির কারণেই এটা একটা ট্র্যাজেডি হিসেবেই চিহ্নিত থাকবে। পশুখামারে ঢুকলেও শাঁওলি মিত্র তাঁর প্রেজেন্সে ব্যতিক্রম ছিলেন সেই খামারে। উনি সেই যৌথখামারে একা। রক্তকরবীর রাজার মত একা। ওঁর পিতার মতই একা।