অরুণ চক্রবর্তী: আমার তার্কিক বন্ধু ও স্বজন

অভিজিৎ সিরাজ

 



সাংবাদিক, প্রাবন্ধিক

 

 

“প্রশ্নের জবাব এড়ানোটাও বাঙালির বৈশিষ্ট্য। তবে যাই বলুন, তর্কপ্রিয়তা বাঙালির বড় গুণ। খোদ অমর্ত্যবাবু কেতাব লিখে দেখিয়েছেন। তাই ছেড়ে কথা কইব কেন?….”

ঠিক এভাবেই এক বর্ষীয়ান ও পূর্ণতর অভিজ্ঞ মানুষের সঙ্গে অপেক্ষাকৃত তরুণতর একজনের কথোপকথন চলত ফেসবুকের দেওয়ালে। মতের অমিল তো হামেশাই ছিল, ফলে সরাসরি আক্রমণাত্মক খেলে যেতে হত নবীন পক্ষকে। বৃদ্ধ মানুষটি অবশ্য তাতে গোঁসা না করে বরং উস্কানি দিতেন আরও প্রবল উদ্দীপনায়। যাতে তর্কের পাল্লাটাও বেড়ে ওঠে উষ্ণতর মাত্রায়। অবশেষে অনুজ পক্ষটি ক্ষান্ত দিয়ে লিখত মৃদু ভাষায়, “আপনি লোকটি কেন আমার পিতৃদেবের প্রিয়পাত্র ছিলেন, তা বোঝা যায়। আমার বাবা বলতেন, তর্ক না করলে সত্যে পৌঁছনো যায় না। পাল্টা মত না তোলা হলে সভ্যতার সৃষ্টি হত না।… আসলে আপনি যথার্থ নিরপেক্ষ ও বলিষ্ঠ মতের অধিকারী বলেই আপনার কাছে প্রত্যাশাটা বেশি। সেখানে সামান্য অসঙ্গতি দেখলেই ক্ষোভ জাগে। তাই প্রতিবাদ করি।…”

হ্যাঁ, তিনি অরুণ চক্রবর্তী। জীবনের নানা বিচিত্র বলয়ে পা-ফেলা দক্ষ ও প্রতিভাবান মানুষটির সঙ্গে আমার কথাবার্তা চলত এরকম ‘তর্কপ্রিয় বাঙালি’-র সংস্কৃতিকে মান্য করেই। যুগপৎ তিনি আমার ‘বন্ধু’ এবং ‘প্রতিপক্ষ’ হয়ে উঠেছিলেন জীবনের শেষ প্রান্তে এসে। তার আগে, আমি তাঁকে চিনতাম আমাদের পারিবারিক গণ্ডির ভেতর। কিশোর বয়স থেকেই এই  বিচিত্র মানুষটিকে আমাদের বাড়িতে আসতে দেখেছি বাবা ও মায়ের হিতৈষী স্বজন রূপে। তখন “দিল্লির অরুণকাকু” নামেই তিনি পরিচিত ছিলেন আমাদের ভাইবোনেদের কাছে। একদা তিনি ছিলেন আনন্দবাজার পত্রিকায় বাবার সহকর্মী। কিন্তু সেই পর্যায়ের অরুণ চক্রবর্তীকে ততটা চেনাশোনার পরিধিতে আনতে পারিনি। তিনি সাংবাদিকতার চাকরি ছেড়ে যখন পাড়ি দেন রাজধানীতে নতুন কাজের নেশায়, তখন তাঁকে আমরা জেনেছি দিল্লিতে প্রবাসী বাঙালি জগতের একজন উদ্দীপক প্রতিনিধির চেহারায়। শুধু তাই নয়, সেখানকার সাংস্কৃতিক চর্চা ও বিনোদনে তাঁর অগ্রণী ভূমিকার কথাও আমাদের জানা হয়ে গিয়েছিল। ঘটনাচক্রে সেই ‘অরুণকাকু’ যোগ দিয়ে ছিলেন কেন্দ্রীয় সরকারের একটি বিখ্যাত প্রকাশনালয় “ন্যাশনাল বুক ট্রাস্ট”-এ, যাদের কাজ ছিল উল্লেখযোগ্য সাহিত্যকর্মকে বিভিন্ন ভারতীয় ভাষার মঞ্চে তুলে ধরা। দেশজ সাহিত্যের পাশাপাশি বিদেশি লেখকদের সঙ্গেও পাঠকদের পরিচিত করার প্রয়াস চালাত ন্যাশনাল বুক ট্রাস্ট। সেই প্রকাশনীর বাংলা বিভাগের দায়িত্বভার অর্পণ করা হয়েছিল প্রাক্তন সাংবাদিক অরুণ চক্রবর্তীকে। এতে তাঁর চাকরি জীবনে ব্যক্তিগত সমৃদ্ধি কতদূর বেড়েছিল, তা ভিন্ন আলোচনার বিষয়। কিন্তু কর্মোদ্যোগী মানুষটি ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন বাংলার শিল্পী-সাহিত্যিকদের গোটা দেশের দরবারে তুলে আনার কাজে। বাঙালি লেখকদের গল্প-উপন্যাস ও অন্যান্য রচনার ভাষান্তর ঘটানো ও সেই সঙ্গে তাঁদের নিয়ে নানা সভাসমিতি ও কর্মশালা গড়ার ব্যবস্থা করতেন তিনি। দিল্লি ছাড়াও প্রতি বছর দেশের নানা শহরে “রাইটার্স’ ক্যাম্প”-এর আয়োজন করা হতো মূলত অরুণবাবুর উদ্যোগেই। লেখকদের যাতায়াত, থাকা-খাওয়া ও অন্যান্য ব্যয়ভার বহন করত ট্রাস্ট। এই প্রসঙ্গে উল্লেখ করি, ছয়ের দশকের শেষ ভাগে, হাওড়া-দিল্লি রাজধানী এক্সপ্রেস ট্রেনটি তখন সদ্য চালু হয়েছে। গোটা ট্রেনটি শীততাপ নিয়ন্ত্রিত এবং মাত্র আঠেরো ঘন্টায় যাত্রা সম্পূর্ণ করত, এটা সেই আমলে বিস্ময় সৃষ্টি করত মধ্যবিত্তশ্রেণির কাছে। ট্রেনের টিকিট ছাপা হত ঠিক বিমানের আদলে। ন্যাশনাল বুক ট্রাস্ট কলকাতার সাহিত্যিকদের রাজধানী এক্সপ্রেসের টিকিট কেটে দিত তাঁদের দিল্লি আগমনের জন্য। আমরা শৈশবে বাবার কাছে সেই টিকিট হাতে নেড়েচেড়ে দেখে বিস্মিত হতাম এবং অবশ্যই জানতাম, দিল্লির অরুণকাকু আছেন এসবের নেপথ্যে।

এহেন অরুণকাকুর তোলা ছবিতে আমরা দেখতাম, পুনে শহরে গিয়ে ‘মুলা’ ও ‘মুঠা’ নদীর ধারে পাহাড়ি উপত্যকায় বাবার সঙ্গে পাশাপাশি বসে আছেন নীরেনজেঠু (নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী) ও কবিতাপিসি (কবিতা সিংহ)। আজও মনে আছে, বাবা দিল্লিতে একবার ওয়ার্কশপে যোগ দিতে গিয়ে উঠেছিলেন অশোকা হোটেলে। আর একবার হোটেল রণজিৎ-এ। সেইসব ছবিও তুলে দিয়ে ছিলেন অরুণকাকু। কলকাতায় ফেরার সময় বাবার লাগেজে বইপত্রের সঙ্গে আমরা খুঁজে পেতাম ‘কালাকাঁদ’ মেঠাই ও আরও হরেক রকমের উপহার। এছাড়া দিল্লি ভ্রমণের সময় ‘সিরাজদা’ কর্মশালা নিয়ে ব্যস্ত থাকলেও অরুণবাবুর স্ত্রী দীপ্তিদেবী প্রিয় ‘হাসনে আরা-বৌদি’কে সঙ্গ দিতেন, ঘুরিয়ে দেখাতেন নানা পর্যটনস্থল। তাঁদের সেইসব মধুর স্মৃতি আজও আমাকে আচ্ছন্ন করে।

আগেই বলেছি, আমাদের পারিবারিক জীবনে অরুণকাকুর একটা বড় জায়গা ছিল। বাবা ও মা দুজনের কাছেই তিনি ছিলেন অত্যন্ত কাছের। কলকাতা এলেই অরুণকাকু ছুটে আসতেন আমাদের পার্ক সার্কাসের ফ্ল্যাটে। মায়ের হাতের চা ছিল তাঁর খুব প্রিয়। পরপর বেশ কয়েক কাপ চা পানের আবদার করতেন তিনি ‘বৌদি’র কাছে। একবার তিনি হঠাৎ হাজির হয়েছিলেন একটি ভিডিও ক্যামেরা নিয়ে। সেটা ছিল ২০০২ সালের ফেব্রুয়ারি মাস। বাবার সঙ্গে ঘরোয়া কথোপকথনে একটি অন্তরঙ্গ সাক্ষাৎকার নিয়ে ফেললেন তিনি। বাদ দিলেন না মা-কেও। সেই চমৎকার ও ঐতিহাসিক সাক্ষাৎকারটি পরে তিনি ইউটিউবে আপলোড করেছিলেন। এ পর্যন্ত প্রায় সাড়ে ছয় হাজার দর্শক ছবিটি দেখেছেন। সৌভাগ্যক্রমে, চিত্রগ্রহণের দিন আমিও হাজির ছিলাম সেখানে।

শেষ বয়সে অরুণকাকু যখন প্রায় ঘরবন্দি, স্ত্রী ভিন্ন দ্বিতীয় কোনও স্বজন তাঁর পাশে ছিল না। পুত্রকন্যারা কর্মসূত্রে ভিনশহরে প্রবাসী। ফলে ফেসবুক ছিল তাঁর সংযোগরক্ষার একমাত্র অবলম্বন। ঠিক এই সময়ে আমি তাঁর নিয়মিত ‘বন্ধু’ হয়ে উঠি ফেসবুকের মাধ্যমে। সমকালীন নানা বিতর্কে তাঁর সঙ্গে আমার মতের আদান-প্রদান ঘটত। সদর্থক জীবনবোধে বিশ্বাসী ছিলেন তিনি। সুশিক্ষিত ও প্রগতিশীল মননের অধিকারী হয়েও ভিন্ন মতের প্রতি অসহিষ্ণুতা কখনও প্রকাশ পায়নি তাঁর কথাবার্তায়। তিনি নিজেও একদা সাংবাদিকতার পেশায় যুক্ত ছিলেন বলেই আমার সঙ্গে মিডিয়া সংক্রান্ত আলোচনায় যোগ দিতেন। আমার পোস্টগুলির মনোযোগী পাঠক ছিলেন অরুণবাবু। “মিডিয়া যেমন দেখছি” নামে একটি সিরিজ লেখার সময় আমার লেখনীর প্রশংসায় উচ্ছসিত হয়ে উঠেছিলেন তিনি। “তোমার লেখাগুলো সাংবাদিকতা বিভাগের পড়ুয়াদের পক্ষে খুবই আবশ্যিক ও মূল্যবান”— এমন স্তুতি শুনে প্রবল সঙ্কোচ বোধ করেছিলাম। কিন্তু আবার যখন উনি সংবাদপত্রের কড়া সমালোচনা করতেন, আমি ওঁকে বারবার ছাপা কাগজ পাঠ করার পরামর্শ দিতাম। কারণ অরুণবাবু ডিজিটাল মিডিয়া পাঠ করতেন। যেখানে সদাই উত্তেজক ও বিনোদনী খবর দেখে ধরে নিতেন, সেটাই মূল সংবাদপত্রের খবর। সে-কারণে ওই ধরনের খবরের তুমুল নিন্দা করতেন। এর প্রতিক্রিয়ায় আমিও কড়া ভাষায় তাঁর ভুল শোধরানোর চেষ্টা করতাম। একটা সময়ে তা চরমে উঠলে আমিই বলতাম, “এটাই শেষ তো? আশা করি, বিতন্ডার এখানেই ইতি?” কিন্তু তাতে দমানো যেত না কৈশোরে ঘরছাড়া এই পোড়খাওয়া মানুষটিকে। বলতেন, “বাঃ, এই তো চাই। সিরাজদার যোগ্য উত্তরসূরি। তোমার বাবাকেও দেখেছি, সব কিছু সহজে মেনে নিতেন না।” এই প্রশ্রয়মুখী জবাবের পর আর কী-ই বা বলা যায় তাঁকে? সন্ধি করতেই হত। তবে আক্ষেপ শুধু এই, তাঁর সেই অসাধারণ আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থটি (‘যে জীবন আমার ছিল না’) আমার হাতে পাওয়া হল না। বইটি তিনি সই করে আমাকে পাঠাবেন বলে জানিয়ে ছিলেন। অসুস্থতাহেতু তা আর সম্ভবপর হয়নি তাঁর পক্ষে।

অরুণ চক্রবর্তী নিউটাউনের বাসিন্দা ছিলেন। আমার বহুকালের বন্ধু চিত্রনির্মাতা সৌমিত্র দস্তিদার তাঁর প্রতিবেশী। সাম্প্রতিক কালে বাংলাদেশ বিষয়ে কিছু পড়াশোনা ও গবেষণা করতে গিয়ে সৌমিত্র অরুণবাবুর বাবা, মওলানা ভাসানীর অনুগামী শ্রী বরদা চক্রবর্তীর কিছু ঐতিহাসিক সূত্রের সন্ধান পেয়ে যায়। তৎক্ষণাৎ সে আমাকে ফোন করে অরুণবাবুর কাছে যাবে বলে জানায়। আমাদের দুর্ভাগ্য, অরুণবাবুর স্বাস্থ্যের প্রবল অবনতি ঘটায় সৌমিত্রর ইচ্ছাপূরণ করা সম্ভব হয়নি। এর মাত্র দিন দুয়েক বাদেই চিরবিদায় নেন আমার পরম প্রিয় তর্কপ্রিয় বন্ধুটি। যিনি ছিলেন একদিকে আমার পিতৃসখা, আবার অন্যদিকে আমারও কাছের বান্ধব ও স্বজন।

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4880 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...