অরবিন্দু দাশগুপ্ত
লেখক অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মচারী
ভারতবর্ষের রাজনৈতিক চালচিত্র নয়া অর্থনীতির আগমনের পর প্রত্যেক দিন নতুন নতুনভাবে উন্মোচিত হচ্ছে। নয়া অর্থনীতির তিনটে দশক অতিক্রান্ত। গত শতাব্দীর ’৭০, ’৮০ দশক পর্যন্ত কেউ ভাবতে পারত না কোনও এক দলের প্রবক্তা আবার কিছু দিন পর সেইই আবার অন্য দলের নেতা। পৃথিবীর কোনও দেশে বোধহয় এমন নজির নেই। প্রশ্ন হল এই নতুনগুলি কী? অতীতে রাজনৈতিক দলগুলি সংসদসর্বস্ব হলেও অন্যের থেকে পৃথক সত্তা নিয়ে সমাজ ও জনগণের কাছে হাজির হত। জনগণের অংশবিশেষ হিসেবে কেউ কেউ তাদের সমর্থন করতেন আবার কেউ করতেন না। অর্থাৎ পার্টির দিশা জনগণের কাছে ভোটের বিচারে প্রাধান্য পেত। এটা ঠিক সংসদীয় রাজনৈতিক পার্টিগুলি সরকারে ক্ষমতা দখল করে কী প্রোগ্রাম গ্রহণ করে সেটা জনগণের বিচারে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। অর্থাৎ প্রায়োগিক রূপ হিসেবে জনগণ জীবনধারণের সাপেক্ষে সরকারের কাছ থেকে কী পাচ্ছে এটাই ছিল গুরুত্বপূর্ণ। শেষ বিচারে জনগণের চোখে রাষ্ট্রের আর্থিক সংস্কারই হল আসল বিষয়। খোলা মনে দেখলে জনগণের বেঁচে থাকার সঙ্গে যুক্ত বিষয়গুলি। যেমন নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য জনগণের সাধ্যের মধ্যে রাখা, সমাজে নতুন চাকরি সৃষ্টি করা যাতে কলেকারখানায়, অফিসে মানুষ চাকরি খুঁজে পায়, শিক্ষাকে জনমুখী করতে প্রত্যন্ত গরিব শিশুদের শিক্ষার আলোয় আসার জন্য সরকারি শিক্ষার পরিকাঠামো তৈরি করা, ভর্তুকি, সরকার পরিচালনার অন্তর্গত দানখয়রাতি হিসেবে ব্যবহার করে সামাজিক ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধি করা… ইত্যাদি ছিল রাজনৈতিক পার্টিগুলির সরকার পরিচালনার দিশার অন্তর্গত। নব্বইয়ের দশক থেকে অর্থাৎ নয়াঅর্থনীতি বিশ্বায়ন এসব এদেশে আসার পর থেকে জনগণের জন্য সরকারের পদক্ষেপগুলি পরিবর্তন ঘটতে শুরু করে। এইসবগুলি আস্তে আস্তে বন্ধ হতে শুরু করে। অন্যদিকে দেশি বিদেশি বুর্জোয়াদের রাষ্ট্রের ওপর চাপ ক্রমাগত বাড়তে থাকে। ফলে সরকারের সমস্ত কর্মসূচি মালিককেন্দ্রিক, গ্রামাঞ্চলে উদীয়মান নব্য কৃষিপ্রভুদের স্বার্থে রচিত হয়। স্বাভাবিকভাবে সরকারের সঙ্গে জনগণের ব্যবধান ক্রমাগত বাড়তে থাকে। জনগণের সঙ্গে রাজনৈতিক পার্টিগুলির ব্যবধান দূর করতে ধর্ম ও জাতের বিভাজনকে আশ্রয় করে ভোটযুদ্ধে জিততে সমস্ত সংসদীয় পার্টিগুলি মরিয়া। ধর্ম ও জাতের বিভাজন আমাদের সমাজে বাস্তবতা। ভারতীয় জনগণকে যদি ধর্মের নিরিখে বিচার করা হয় তবে সেনসাস ২০১১ অনুযায়ী মুসলমান জনগণ হলেন ১৪.২ শতাংশ। উল্টোদিকে হিন্দু জনগণের সংখ্যা ৭৮.৯০ শতাংশ। সমস্যা হল ২০১১ সোশিও ইকনমিক কাস্ট সেনসাস (SCSS) তথ্য অনুযায়ী ভারতে বিভিন্ন আর্থসামাজিক অবস্থান অনুযায়ী ছেচল্লিশ লক্ষ ধরনের জাতের ভাগ আছে। ধরে নেওয়া যেতে পারে তাদের সবাই কোনও না কোনও মুখিয়ার নেতৃত্বে গোষ্ঠীবদ্ধ। এই প্রভাবকে সমস্ত পার্টি স্বীকৃতি দেয়। তাই ভোটের সময় এরাই বিভাজিত হয় সর্বভারতীয় পার্টিগুলির মধ্যে অথবা জাতের পার্টিগুলির মধ্যে। সরকারের আর্থিক সংস্কারের পথ যখন জনগণ থেকে বড় পুঁজিপতিদের দিকে ঢলে পড়ে তখন স্বাভাবিকভাবে জনগণের ভোট নিজেদের অনুকুলে আনার জন্য নতুন নতুন চমকের মাধ্যমে জাতের মধ্যে বিভাজন ঘটানো হয়। এবং ভোট মিটে গেলে উঁচু জাতের দ্বারা নিচু জাতের মানুষের ওপর সামাজিক প্রাধান্য অনুযায়ী পাশবিক অত্যাচার নামানো হয়। আমাদের দেশে ধর্ম ও জাতের বিভাজনের দীর্ঘ ইতিহাস আছে। এর পাশাপাশি আরও একটি বিষয় আমাদের সামনে হাজির হয়ে গেছে। এক রাজনৈতিক দল অন্য রাজনৈতিক দলের এমপি, এমএলএ নেতাদের নিজেদের দলে এনে পূর্বতন দলের ভাঙন ধরানো। তৃণমূল গোয়াতে, মণিপুরে কংগ্রেস দলে ভাঙন ধরাচ্ছে, যেমন সাম্প্রতিক অতীতে ত্রিপুরাতে করেছিল। বিজেপি কংগ্রেস সহ নানা দলে ভাঙন ধরাতে পাকা খেলোয়াড় হয়ে গেছে। সমাজবাদী পার্টি বিজেপির মধ্যে ভাঙন ধরিয়ে নিজের দলকে পুষ্ট করছে। কয়েকটি পার্টির নাম এখানে বলা হলেও অনেক পার্টিই এই দোষে দুষ্ট। এমনকি সম্প্রতি মুলায়েমের এক ছেলের বউ বিজেপিতে যোগ দিয়েছে। খুব স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন ওঠে দল ও ব্যক্তির মধ্যে এত ভাগাভাগি হয় কী করে? ২০১৪ পর কংগ্রেসের অনেক নেতা কংগ্রেস ছেড়ে বিজেপিতে যোগ দিয়েছেন।
প্রশ্ন ওঠে দল ও ব্যক্তির/নেতার মধ্যে আন্তঃসম্পর্ক কী? এ কথা সকলেই জানেন দলের প্রয়োজন নেতাকে জনগণের মধ্যে দলের দিশা প্রচারের জন্য, অন্যদিকে ব্যক্তির প্রয়োজন দলকে তার সামাজিক আর্থিক অস্তিত্ব বিকাশের স্বার্থে। এই সম্পর্কটি একমাত্র সুবিধাবাদী সংসদীয় দলগুলির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। এখানে দল ও ব্যক্তির সম্পর্কটি একই অভিলক্ষ্যে চালিত হয় না। অর্থাৎ এক ব্যক্তি, নেতা নিজের লক্ষ্যপূরণে যে কোনও সময় যে কোনও দলেই চলে যেতে পারে। তার কাছে নিজের ব্যক্তিস্বার্থ ছাড়া অন্য কোনও দিশা নেই। ভারতবর্ষের বর্তমান রাজনৈতিক চালচিত্রে এই বাস্তবতাটি প্রকট হয়ে উঠেছে। সমস্ত সংসদসর্বস্ব পার্টির ক্ষেত্রে এই ধারাটি দেখা যাচ্ছে।
পার্টিগুলির সঙ্গে যেহেতু পুঁজিপতিশ্রেণির অটুট বন্ধন, বিশেষত নয়াঅর্থনীতির পর বহুল পরিমাণে এই বন্ধন বেড়ে গেছে। পার্টির সঙ্গে পুঁজিপতিদের শুভ পরিণয়ের দক্ষ ঘটক হন এইসব নেতারা। তাই নেতা প্রভূত ক্ষমতার মালিক। পুঁজিপতিদের কাছে নেতাদের দায়বদ্ধতা অনেক বেশি হওয়ার দরুন নেতার কাছে সমস্ত পার্টিই সমান। তাই যে কোনও সময়ে নেতা ব্যক্তিটি তার ব্যক্তিগত সুবিধা অনুযায়ী অন্য দলে চলে যেতে পারে। এবারে আর একটি প্রশ্ন ওঠে যে নেতা সময়সুযোগ অনুযায়ী অন্য দলে চলে যায় তার সঙ্গে জনগণের সুসম্পর্ক থাকে কী করে?
নেতা তার চারপাশে এক ক্যাডারবাহিনি গড়ে তোলে, তাদের মাধ্যমে জনগণের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলে। কখনও সে রবিনহুড আবার কখনও বা ভয়ঙ্কর সন্ত্রাস সৃষ্টিকারী। এদের মাধ্যমেই বস্তি জ্বালিয়ে গরিবের ঠাই ভেঙ্গে উন্নয়নের জোয়ার তৈরি হয়। জলা, বনভূমি, কৃষি জমি পুঁজিপতিদের হাতে তুলে দিয়ে হয় নতুন নতুন পুঁজি গঠনের ভিত্তি তৈরি করা হয়।
ভারতবর্ষের এই রাজনৈতিক চালচিত্র অন্তর্বস্তুতে জনগণবিহীন একমাত্রিক রাজনৈতিক কাঠামো গড়ে তুলছে যা আবার অন্ধকারে, তলানিতে চলে যাওয়া জনগণকে বিপরীত মেরুতে ঐক্যবদ্ধ করছে। যদিও এর কোনও সাংগঠনিক রূপ আজ নেই, কবে হবে তা বলা সম্ভব নয়। তবে এ কথা অবশ্যই বলা যায় বস্তুগতভাবে দেশের নিপীড়িত শোষিত জনগণ, যারা সম্প্রদায়গত শাসন ও শোষণের শিকার, যারা নিচু জাতের মানুষ হিসেবে বর্ণের ভেদাভেদের শিকার এবং সামগ্রিকভাবে অর্থনৈতিক বৈষম্যের শিকার— এই জনগণের একটা ঐক্যের বাতাবরণ শাসকরা তৈরি করে চলেছে। .