শঙ্কর রায়
সাংবাদিক, প্রাবন্ধিক
এবার বিধানসভা ভোটের প্রাক্কালে (১-৫ ডিসেম্বর ২০২১) উত্তরপ্রদেশে ৫২ লক্ষ নতুন মহিলা ভোটার নথিবদ্ধকরণ ব্রাহ্মণ ও উচ্চবর্ণ-প্রভাবিত রাজনৈতিক নেতাদের [যারা শুধু ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) নয়, কংগ্রেস, সমাজবাদী পার্টি (এসপি), এমনকি মায়াবতীর একনায়কত্বাধীন বহুজন সমাজ পার্টি (বিএসপি) উচ্চ নেতৃত্বের ঘাড়ে নিঃশ্বাস ফেলে] দুশ্চিন্তায় ফেলে দিয়েছে, বিশেষত বিজেপি উচ্চ নেতৃত্বে। যেদিন প্রিয়াঙ্কা গান্ধি ঘোষণা করলেন যে কংগ্রেসের প্রার্থীদের মধ্যে ৪০ শতাংশ মহিলাদের থেকে মনোনীত করা হবে, সেদিন লক্ষ্ণৌর এক প্রবীণ কলমচি এই প্রতিবেদককে বলেছিলেন, মৌচাকে ঢিল পড়েছে, অনেক কংগ্রেস নেতাও পার্টি যদি ছাড়ে, আশ্চর্য হওয়ার নেই। মোট ভোটার সংখ্যা ১৪.৭১ কোটি থেকে ১৫.০২ কোটিতে বেড়ে গেছে। এদের মধ্যে ৬.৯৮ কোটি মহিলা।
উত্তরপ্রদেশে ৪০৩ জন বিধায়কের মধ্যে ৩৮ জন মহিলা, তার মধ্যে বিজেপি সদস্য ৩২, বিএসপি ও কংগ্রেসের দুজন করে, এসপি ও আপনা দলের একজন করে। এ যাবত উত্তরপ্রদেশ বিধানসভায় এত মহিলা বিধায়ক নির্বাচিত হননি— কিন্তু তা মোট বিধায়কের ১০ শতাংশেরও কম। অথচ মহিলা ভোটারেরা মোট ভোটারদের ৪৬ শতাংশেরও বেশি। পুরুষতান্ত্রিকতা (পড়ুন মনুবাদ) ভারতের সবচেয়ে বড় রাজ্যে কীরকম প্রবল তা এ থেকেই বোঝা যায়, অথচ স্বাধীনতার পরে প্রথম দশকে এ রাজ্যেই ভারতের প্রথম মহিলা মুখ্যমন্ত্রী হয়েছিলেন বঙ্গদুহিতা সুচেতা কৃপালনী— একদা কংগ্রেসের রাষ্ট্রপতি আচার্য জীবৎরাম ভগবানদাস কৃপালনীর সহধর্মিনী। এবার মনে হচ্ছে ৬৯-এর বেশি মহিলা প্রার্থী জয়ী হবেন।
মানবাধিকার সংগ্রামী সংস্থা পিপলস ইউনিয়ন ফর সিভিল লিবার্টিজ (পিইউসিএল) সম্প্রতি প্রকাশিত একটি রিপোর্টে (হিউম্যান রাইটস অ্যাবিউস অ্যাট পিক ইন উত্তরপ্রদেশ: ডায়ালগ উইথ দি কন্টেন্ডিং পার্টিজ ফর গভর্নমেন্ট ফরমেশন ইন ইউপি— ডিম্যান্ড লেটার অফ পিপলস ইউনিয়ন ফর সিভিল লিবার্টিজ ইউপি) লিখেছে: ওই রাজ্য ‘মানবাধিকার লঙ্ঘনে অন্য সমস্ত রাজ্যের চেয়ে এগিয়ে। যত মানবাধিকার লঙ্ঘন ঘটেছে ২০২১এ, তার ৪০ শতাংশই উত্তরপ্রদেশে। বলা বাহুল্য, এই নারকীয়তা সংঘটিত হচ্ছে/হয়ে চলেছে বিজেপি আমলে, রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের (আরএসএস) মনোনীত যোগী আদিত্যনাথের মুখ্যমন্ত্রিত্বকালে।
নারীদের প্রতি সহিংসতাতেও শীর্ষে রয়েছে উত্তরপ্রদেশ। ন্যাশনাল কমিশন ফর উইমেন রিপোর্ট উদ্ধৃত করে পিইউসিএল বলছে, এ নিয়ে ২০১৮ ও ২০১৯-এ যত অভিযোগ জমা পড়েছে তার সংখ্যা ১১,২৮৯, সমস্ত রাজ্য থেকে এগিয়ে। দ্বিতীয় স্থানটি দিল্লির দখলে, ওই দু বছরে প্রাপ্ত অভিযোগের সংখ্যা ১৭৩৩। কেঊ যেন আবার ভেবে না বসেন যে এর জন্য দায়ী দিল্লি রাজ্যে ক্ষমতাসীন আম আদমি পার্টি বা তার মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়াল। কারণ দিল্লিসহ রাজধানীর আশপাশে পুলিশ ও আইনশৃঙ্খলা কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের দায়িত্বে, যার দায়িত্বে কট্টর আরএসএস ও প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সবচেয়ে কাছের লোক কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ। অভিযোগ (পরিসংখ্যান) প্রথম লকডাউনের সময়ে, অর্থাৎ ২০২০-র মার্চ থেকে সেপ্টেম্বরের মধ্যে উত্তরপ্রদেশ থেকে ৫৪৭০টি অভিযোগ জমা হয়েছে, যা সমগ্র দেশের ৫৩ শতাংশ। ২০২১-এর এই সময়ে ৬৬.৭ শতাংশ উত্তরপ্রদেশ থেকে। সেখানেও এক নম্বরে। পিইউসিএল লিখেছে, “যে পদ্ধতিতে সরকার প্রথমে হাথরাসে একটি দলিত মেয়েকে ধর্ষণ ও হত্যার মোকাবিলা করেছিল ও তারপরে এলাহাবাদের গোহরিতে, সেসব মহিলাদের বিরুদ্ধে অপরাধের এই উদ্বেগজনক হিসেব চিহ্নিত করে এটা ক্ষমতার বিপজ্জনক প্রবণতা, যা এসব অপরাধকে উৎসাহিত করছে। নারীর বিরুদ্ধে অপরাধ বৃদ্ধি তাদের অধিকার হ্রাসের সূচক, কারণ যে কোনও ধরনের যৌন সহিংসতা শুধু অপরাধ নয়, এটি সেই সমাজের পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতার পরিচায়ক। পিতৃতন্ত্রের উপস্থিতি মানে দুর্বল লিঙ্গকে দমন করা। এই পরিসংখ্যান যে কোনও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের জন্য লজ্জাজনক। অধিকার রক্ষার দায়িত্ব সরকারের, এবং আগামী সরকারের কাছে আমাদের দাবি সমাজে নারীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, রাষ্ট্রে নারীর অধিকার নিশ্চিত করা।”
মুখবন্ধে বলা হয়েছে, “যে কোনও সুস্থ গণতন্ত্রের বৈশিষ্ট্য হল মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা কমা। কিন্তু আমাদের দেশে গণতন্ত্রের বয়স বাড়লেও, বিশেষ করে আমাদের রাজ্যে (অর্থাৎ উত্তরপ্রদেশে) এর বিপরীত ঘটনা ঘটছে। ক্ষমতার দালালদের ও রাজনীতিবিদদের যথেচ্ছাচার মানবাধিকারকে সঙ্কুচিত করছে।”
দলিতদের নিপীড়নেও যোগী আদিত্যনাথের অপশাসন সর্বাগ্রে। পিইউসিএল এই প্রেক্ষাপটে বিধানসভা নির্বাচনে এক ন্যায়ভিত্তিক দিশার অন্বেষণ করেছে। “জনগণ নতুন সরকার নির্বাচন করতে যাচ্ছে। এটাই সঠিক সময় যে আমরা সেই দলগুলোকে ভোট দেব যেগুলো সুচিন্তিতভাবে মাঠে নেমেছে, যারা দরিদ্র, বেকার, দলিত, বনবাসী এবং সংখ্যালঘুদের দুর্দশার প্রতি উদ্বিগ্ন। আমরা ভোটারদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলছি, সবাই দাবি তুলুক যে নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী দলগুলি যেন তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে মানবাধিকার পুনরুদ্ধারের প্রতিশ্রুতি দেয়, নতুন সরকার গঠনের পর এ দিকে দ্রুত পদক্ষপ নেওয়ার অঙ্গীকার করে।”
পিইউসিএল সামন্ততান্ত্রিক মানসিকতার বিষময় দিকের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। “ভারতীয় সমাজে বর্ণ ও জাতপাতের অমানবিক অসম ব্যবস্থা বিদ্যমান। এমন কিছু বিধান আছে সংবিধানে যা ভাঙার ব্যবস্থা করা হলেও কোনও সরকারই তার কোনও চেষ্টাই করেনি, এমন হৃদয়হীন সেই ব্যবস্থা (সামন্ততান্ত্রিক) বর্তমান সময়ে (অর্থাৎ বর্তমান রাজ্য সরকারের আমলে) প্রাতিষ্ঠানিক নিপীড়নের এক চরম রূপ পরিগ্রহ করেছে, যা যে কোনও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের জন্য খুবই লজ্জাজনক। বর্ণপ্রথা ও গণতন্ত্র একসঙ্গে চলতে পারে না। দরিদ্র জনগোষ্ঠীর, যারা শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে মানবাধিকার থেকে বঞ্চিত, তাদের মানবাধিকার রক্ষা ও বাস্তবায়নের দায়িত্ব সরকারের। সমস্ত নির্বাচনী দলগুলির কাছে পিইউসিএলের দাবি তারা জাতিগত নিপীড়ন বন্ধ করার প্রতিশ্রুতি দেবে, প্রতিটি স্তরে তাদের নির্বাচনী ঘোষণা এবং সরকার গঠনের পর তাদের সরকার এই প্রতিশ্রুতি পূরণ করবে।”
উত্তরপ্রদেশ যে দেশে হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির একটি শক্ত ঘাঁটিতে পরিণত হয়েছে তা যে বলে বোঝানোর অপেক্ষা রাখে না, এইসব পরিসংখ্যান থেকে সেই সত্যটি পরিষ্কার। সংখ্যালঘুদের উপরে, বিশেষ করে মুসলমানদের প্রতি ১৯৯২ সালে বাবরি মসজিদ ধ্বংসের পর থেকে এই অপরাধপ্রবণতা সরকারি স্তরেও বেড়েছে, অর্থাৎ প্রায়ই এসব অপরাধ সরকারি যন্ত্রের সহায়তায় দায়বদ্ধ রূপ নিয়েছে। প্রতিবাদ গড়ে উঠেছে বাঁচার তাগিদে। উত্তরপ্রদেশ হয়ে উঠেছে নাগরিকত্ব আইনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের শক্ত ঘাঁটি। ক্ষোভের কারণ শুধু নাগরিকত্ব আইনের বিরুদ্ধে নয়, সরকারি প্রচারণায় মুসলিম সম্প্রদায়কে গত কয়েক বছর ধরে মুসলমান সন্ত্রাসী হিসেবে তুলে ধরার অপচেষ্টা চলছে। পিউসিএলের মতে নাগরিকত্ব আইনের বিরুদ্ধে আন্দোলনের ওপর বর্তমান সরকারের দমন-পীড়ন বেআইনি। অথচ সরকার শতাধিক মানুষকে কারারুদ্ধ করেছে, প্রধানমন্ত্রী নিজেই ‘প্রতিশোধ’ নেওয়ার হুমকি দিয়েছেন।
পিইউসিএলের এই রিপোর্ট প্রত্যক্ষভাবে না হলেও নির্বাচকমণ্ডলীর কাছে বিজেপির বিরুদ্ধে এক ইস্তাহারের মত। মহিলা, দলিত, সংখ্যালঘু মানুষদের বিজেপির বিরুদ্ধে এককাট্টা হওয়ার যৌক্তিকতা এই রিপোর্ট তুলে ধরেছে।