প্রজ্ঞাদীপা হালদারের মুখপুস্তক থেকে

প্রজ্ঞাদীপা হালদার

 

বসন্ত আসলে বিষণ্ণতার কাল। দুপুরবেলায় কেমন একরকমের খাঁ খাঁ রোদ্দুর। অবন্তীনিহার আবাসনের ছাপ মারা পাঁচিলঘেরা জায়গাটায় দেখতাম পড়ন্ত বিকেলে শুধু একলা একটা টিউবওয়েলের মাথায় একটা একলা ফিঙে বসে আছে। আমাদের বাড়ির পাশের বাঁশঝাড়ের মাথায় উড়ে এসে বসা দোয়েল শিস্‌ দিত অবিরাম। (আমি বলতে লজ্জা পাই, যে দোয়েলের গান আমি চিনি। কোন শিসে দোয়েল বলে আজ রোদ হবে কি বিষ্টি, হাওয়া দেবে কিনা, দোয়েলের শিস্‌ শুনে বুঝতে পারি এসব।)

আকাশটা একরকম ব্যথা পাওয়া নীল হয়ে যায়।

আমাকে মাস্টারমশাই গান শেখাতেন “আকাশ আমায় ভরলো আলোয়/ আকাশ আমি ভরবো গানে”। আর আমার ইচ্ছে করত ওই ব্যথা পাওয়া আকাশের নিচে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে।

সন্ধ্যায় দেখি লেজ উঁচু করে পাতাবাহার ঝোপের তলা দিয়ে গদাইলস্করি চালে হেঁটে যাচ্ছে কালো পাটকিলে ছোপের বেড়াল। শাল আর মেহগনির ঝরা পাতায় ভরা চেনা গলিরাস্তাটা হঠাত ম ম করে ওঠে বাতাবি লেবুর ফুলের গন্ধে। (মেহগনি বললে আমার মনে পড়ে নগ্ন নির্জন হাত। ছোটবেলায় ভাবতাম নগ্ন নির্জন রাত। অনেক কাকাতুয়া পায়রা ছিল, মেহগনির ছায়াঘন পল্লব ছিল অনেক। অনেক কমলা রঙের রোদ ছিল। এই পুরো কবিতায় একমাত্র আকর্ষণ ছিল কাকাতুয়া আর কমলা। আমি এককালে পাখি ভালবাসতেম। যদি জানতেম আমার কিসের ব্যথা, তোমায় জানাতাম।)

বসন্তকালের যে বিষাদ তা আসলে স্মৃতিকাতরতা। সমস্ত শীত আর বসন্ত জুড়ে আমায় অধিকার করে থাকে চলে যাওয়া দিন, ভুলে যাওয়া মানুষ। এইসব বসন্তকালে তাই প্রায়ই আমার একটা না একটা প্রেম হয়ে যেত। আচ্ছা আজকাল বসন্তও কি আসে? বাইরে রোদের দিকে তাকালে মনে হয় প্রখর বৈশাখ। বিশাখা নক্ষত্রের মাস। (উঠে আইল বিশাখা, রাই থাকুক একা, কাছে থাকা ভালো নয়গো। কৃষ্ণহেন ধন যে করে ত্যজন, তার কী জীবনে আশ? তার মরা ভালো, বেঁচে বা কী ফল? কহে দ্বিজ চণ্ডীদাস।) দুপুরে কাকগুলো ঝিমোয়। রাতে ফ্যান চলে বলে আমি পাশের বাড়ির পায়রাগুলোর ডাক শুনতে পাই না। রাতের ঘুমে স্বপ্নে আজকাল বন্ধু বা প্রেম কিছু দেখি না। ছায়া ছায়া কীসব শত্রুভাবাপন্ন স্বপ্ন হয় আমার।

অদ্ভুত অদ্ভুত সব জিনিস মনে থাকে আমার। কবে যেন গাড়ি ছিল না বলে আমি অটোর অ্যাঙ্গেলে করে বারাসাতে যাচ্ছিলাম। সারাদিনের ক্লান্তিতে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। হঠাৎ করে দেখি কে যেন আমার ঘামে ভেজা চুল সরিয়ে দিচ্ছে কপাল থেকে, শক্ত করে ধরে আছে কাঁধ, চোখ মেলে দেখলাম পরিচ্ছন্ন শাড়ি পরা মাঝবয়েসি দরিদ্র মুসলিম এক মহিলা, যার কাচা ওড়না থেকে স্পষ্ট মাড়ের গন্ধ আসছে তখনও। যার চোখে আমার মায়ের মতো কম দামী ফ্রেমের চশমা। আমাকে বললেন-–তুমি পড়ে যাবে তো মা।

কবে যেন বাড়ির জন্যে কেক কিনতে গিয়ে দেখি কাছে পর্যাপ্ত পয়সা নেই। দিদিভাইকে বললাম পাঁচশো টাকা ধার দে, এক্ষুণি এটিএম থেকে তুলে দেব। দিদিভাই ব্যাগ দেখে বলল ওর কাছে নেই, হঠাৎ পাশের দিকে তাকিয়ে দেখি টোটোওয়ালা আমার দিকে বাড়িয়ে রেখেছে একটা পাঁচশো টাকার নোট। কেন, কে জানে। আমি ধমক দিয়ে বললাম তোমার টাকা নিয়ে আমি কী করব? রাখো নিজের পকেটে।

এই তো গেল শুক্কুরবারে আমাদের বাড়ির সামনে একটা হলদে পাখিকে ধরে খেল একটা কুকুর। পাখিটার হলুদ পালক ছড়িয়ে রইল সিঁড়ির ওপর। প্রথমে দুঃখ হলেও আমি তো জানি যে সব কুকুর শেয়াল হলুদ পাখি খেয়ে ফ্যালে তাদের আসলে কী হয়। হয়তো কালই দেখব আমাদের পাড়ায় একটা সোনালি সবুজ ডুরি কাটা পাটকিলে চোখের মণিওয়ালা বাচ্চা আসবে কারও ঘরে, যার ঝিনুকের মতো পাতলা কান, ওপরটা খোঁচা মতন। আমার অবশ্য নিদুলি মন্ত্র, সোনারুপোর মাদুলি, পাঁচঠেঙো মাকড়শা এসব কিচ্ছু লাগবে না।

বেশি ভাবতে গেলে আজকাল আমার ঘুম পায়। আমার মনোবিদ আমাকে বলেছেন “আপনি নিজের চারপাশে একটা কল্পনার জগত গড়ে নিয়েছেন। মানুষগুলোকেও কল্পনা করেছেন, কিন্তু বাস্তব আপনার কল্পনার সঙ্গে মেলে না বলে আপনার আশাভঙ্গ হয়। আর বার বার আশাভঙ্গ হওয়ার ফলে যা হওয়ার তাই হয়েছে। আপনি ডিপ্রেশনে ভুগছেন। কল্পনা থেকে বেরিয়ে আসুন, স্বাভাবিক মানুষ হন।”

আজ সকাল থেকে চারপাশ কেমন মায়ের আঁচলের মতো ছায়াটানা। বাইরে টিপটিপ বৃষ্টি। আমার জানলার পাশের আমগাছের পাতার তলায় দুটো জড়সড় চড়ুই বসে আছে। ঘরের ভিতরে জামাকাপড়ের রাশ গুছিয়ে তুলতে ইচ্ছে হয় না, আমার দিগ্বিদিক আন্ধার করা ঘুম পেতে থাকে। আমার মনে পড়ে দাদামশাই বলতেন কতক বৈদিক সূক্ত ঋষিরা খুঁজে পেয়েছিলেন, চারণভূমিতে। রবীন্দ্রনাথ তারই অনুবাদ করেছেন এই তো তোমার আলোকধেনু, সূর্যতারা দলে দলে, কোথায় বসে বাজাও বেণু, চরাও মহাগগনতলে। ওহ্‌ লর্ড ইজ মাই শেফার্ড। ঈশ্বর আমার মেষপালক। যিনি ঈশ্বর, তিনিই প্রকৃত মেষপালক।

আমার ফোন বেজে ওঠে এক মেঘলা বসন্তের সকালে। “একরাশ বিপদের মাঝখানে শুয়ে আছি, কানাঘুষো শোনা যায় বসন্ত এসে গেছে, তারছেঁড়া যন্ত্রের মাঝখানে শুয়ে আছি, আমলকি বনে শোনো, বসন্ত এসে গেছে”।

আমার ভীষণ ঘুম পায়। তমোগুণানিদ্রা, স্মৃতিবিনাশিনী।

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4879 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...