অনির্বাণ ভট্টাচার্য
প্রাক্তনী, বিশ্বভারতী
এতদিন পরেও আজ স্পষ্ট মনে পড়ে, একদিন আষাঢ় মাসের সন্ধ্যাবেলায় শান্তিনিকেতনে গিয়া উপস্থিত হলাম। তখনকার দিনে বোলপুরে রেলস্টেশনটি ছোট ছিল। স্টেশনের বাহিরে বটগাছের তলে কয়েকখানা গোরুর গাড়ি থাকিত; তারই একখানা গাড়ি চড়িয়া শান্তিনিকেতনের দিকে রওনা হইলাম। যখন আশ্রমে গিয়া পৌঁছিলাম তখন অনেকক্ষণ অন্ধকার হইয়া গিয়াছে। কোথায় নামিলাম, কোন ঘরে গিয়া বসিলাম, কাদের সঙ্গে প্রথম কথা বলিলাম, সে কথা আজ আর মনে পড়ে না। কিছুক্ষণ পরেই খাবার ডাক পড়িল। এখন যেখানে লাইব্রেরি তার উত্তর দিকে বড়ো একখানি টিনের ঘর ছিল, তখনকার দিনে সেটি ছিল খাবার ঘর, আর এখন যেখানে আপিস-বাড়ি তারই খানিকটা অংশ ছিল রান্নাঘর। এই টিনের ঘরে লম্বা করিয়া চটের আসন পাতা, শালপাতা আর গেলাস-বাটি সাজানো— এই রকম পাঁচ-ছয়টি সুদীর্ঘ শ্রেণী। খাবারের আয়োজনের মধ্যে খিচুড়ি ও পায়েসের ব্যবস্থা ছিল মনে পড়ে। প্রথম সূচনা নেহাত মন্দ লাগিল না।
কোট আনকোটের ভেতর আচমকা ঢুকে পড়লে যা হয়, শুরুতেই ধরন নিয়ে সমস্যা হয়। লেখার ধরন, গদ্যের ধরন, মানিয়ে নেওয়ার ধরন। নব্বইয়ের দামাল, দাপুটে স্মৃতিকাতরতা পেরিয়ে যখন বাবাদের ট্রান্সফারের চাকরিতে হঠাৎ করেই শান্তিনিকেতন ধরিয়ে দেয় কেউ, বুঝতে পারি না বইয়ের প্রথম থেকে শেষ, না শেষ থেকে শুরুতে পড়তে হয়। তখন প্রতিষ্ঠান বোঝার বয়স ছিল না। শুধু নাইন্টিজের সঙ্গে মিলিয়ে মফস্বল আর বন্ধুযোগ পেয়েছিলাম যা শান্তিনিকেতনের থেকে অনেক প্রাণের মনে হয়েছিল। সেই গায়ে লাগানো মফস্বলের বৃত্ত পেরিয়ে ঠিক কোন জায়গায় পা ঠুকলে তবে শান্তিনিকেতনকে ছোঁয়া যায়, তা বোঝার আগেই এটুকু জেনে গেছিলাম যে এই রাস্তা, এই পাড়া, হ্যালোজেনের আলোয় তখনও বেঁচে থাকা পান্নালাল দাশগুপ্ত, কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়, শান্তিদেব ঘোষ, সোমনাথ হোড়ের নামটুকু শোনা, কখনও বা ছোঁয়াচ পাওয়া একটা মিস্টিকাল দ্বীপ। কমলা রঙের হ্যালোজেনে ছাতিম-ছাতিম ঘোর, যা কাটতে না কাটতেই মাধ্যমিক, এইচএস আর শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের স্ট্রোক। তখন ঘন ঘন কবিসম্মেলনে শ্যামলী বাড়ির সামনের মঞ্চের ম্যাজিক। একটাও অক্ষর তখনও অবধি না ছোঁওয়া একটা বিশাল লাইব্রেরি বাড়ি। আর আনুষ্ঠানিকতার প্রতি বরাবর পাশ কাটানো আমার ততটা কাছে না-টানা বসন্ত পৌষ। এর চেয়ে ওই শীতের রোদের কুকুরকুণ্ডলী, পৌষ মেলার শুরুর দিকের আদুরে মাঠ, আম্রকুঞ্জ ছাড়িয়ে ছোট ছোট বৃত্ত ঘিরে ওদের মুখ, শাড়ি, গালের রং, বিভঙ্গ। নাহ, কেউ ছিল না আমার, কেউ না। তখনও সাইকেল শিখিনি। পৌষের মাঠ হয়ে সুবর্ণরেখা, তারপর বাঁদিকে মন্দির হয়ে আমি হাঁটতাম শিক্ষাভবনের দিকে। নার্সারি আর একটা বয়েজ হোস্টেল। চারদিকে ফুলে ঘেরা এইসব বাড়ির কোনওটাতেই আমি থাকি না। আমার বাড়িতে ছাতিমের গন্ধ নেই। এইসব না-এর মাঝে কখন চলে এসেছি ক্যাম্পাস, খেয়াল নেই। যে মেয়েটিকে ভালো লাগত, দুজন বন্ধু নিয়ে পেরিয়ে যেত পাশ দিয়ে। বড় হয়ে ওর বিয়ের ছবি, হোস্টেল, নার্সারির আরও বড় হওয়া, এইসব সিলেবাসের বাইরে পা ফেলে দেখি ব্যাকওয়ার্ড মোশনে ফিরে আসছি সেই মন্দিরের দিকে। মন্দির কেন বাবা? রবীন্দ্রনাথ নিজে এই নাম দিয়েছেন? পাশের বটের গায়ে দেবেন্দ্রনাথ নিজে বসতেন? এসব প্রশ্নের ভেতর অনেকটা বড় হয়ে কেউ বা কারা এঁকে দেয় ফতোয়া। মন্দিরের কাছে ছবি তুলতে গেলে বাধা পাই। পা ফেলতে ভয়। যদি পিছন থেকে পাকড়ে ধরে পেয়াদা, হাউন্ড, একদম বদলে যাওয়া আমাদের আউটসাইডার বৃত্তের একসময়ের স্মৃতিতে থাকা শান্তিনিকেতন। মোটের ওপর, সেই শান্তিনিকেতন চলে গেছিল, আজ না কাল, কবে, মনে পড়ে না…
রবীন্দ্রনাথ তখন শান্তিনিকেতনের দোতলায় থাকিতেন। সেখানে গিয়া দেখিলাম, আমার বয়সের কয়েকটি ছেলে, আর মাঝখানে রবীন্দ্রনাথ। তখনও তাঁহার চুলদাড়ি সব পাকে নাই, কাঁচা পাকা মেশানো, কাঁচার ভাগই বোধ করি বেশি। পরনে পায়জামা ও গায়ে পাঞ্জাবি। তিনি আমাকে বসিতে বলিলেন, আগের সূত্র অবলম্বন করিয়া অধ্যাপনা চালাইতে লাগিলেন। তিনি একজন ছাত্রকে বলিলেন— “আচ্ছা, ইংরিজিতে বল তো, সবির একটি গাধা আছে।” সবি ক্লাসের অপর একটি ছেলের নাম। ছাত্রটি নির্বিকার চিত্তে বলিয়া গেল, Sabi is an ass। আমরা কেহ হাসিলাম না, কারণ গাধা থাকার ও গাধা হওয়ার ভেদ এই বয়সে বোধ করি আমাদের মনে স্পষ্ট হইয়া ওঠে নাই। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ হাসিয়া উঠিলেন, “দেখলি সবি, তোকে গাধা বানিয়ে দিল।” ইহাতেও সবি হাসিল না। বোধকরি পদবৃদ্ধি লোপ হওয়াতে সে কিছুটা ক্ষুণ্ণই হইল।
রবীন্দ্রনাথ সম্বন্ধে ইহাই আমার প্রথমতম স্মৃতি।
আমার প্রথমতম স্মৃতি বলতে শান্তিনিকেতন-ঘেঁষা সেই মফস্বলের রাস্তায় রবীন্দ্রনাথের জুড়ুয়া, তখন আমাদের হিন্দি ছবির জীবনে এমনই সব নিকনেম, শব্দমালা। একমুখ দাড়িগোঁফ, জুতোর দোকানে বসে থাকতেন ভদ্রলোক। আবার তেমনই আরেকজন পৌষ মেলার মাঠে বেহালা বাজাতেন। নাম জিজ্ঞেস করিনি। বিশ্বাস করেছিলাম রবীন্দ্রনাথ বেঁচে আছেন। ধরা দিচ্ছেন না, এই যা। মৃত বন্ধুদের মতো আর কী। তারপর বহুদিন সেই মানুষটির সঙ্গে আর কোনও যোগাযোগ বা দেখা শোনা হয়নি। ছবির রবীন্দ্রনাথ, মিথের রবীন্দ্রনাথ অবশ্য আনুষ্ঠানিকতায় আসতেন। বড়দিন, মহর্ষি স্মরণ, উৎসবে তাঁর গান, একই উচ্চারণে, একই মুখভঙ্গিতে, একই পোশাক-শাসনে শুনতে শুনতে মনে হত একটা অভিনয়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি আমি। পর্দা উঠবে, নামবে— মাঝে রবীন্দ্রনাথ কী কী করেছেন, কী কী ভাবে আমাদের জীবনে জড়িয়ে আছেন, পড়া হবে, মুখস্থ হয়ে গেলে হাত মুখ দিয়ে বলা হবে, যাও আজ তোমার ছুটি। এই গোটা আনুষ্ঠানিকতা, এই রবীন্দ্রনাথের বাইরে কোনও কিছু নিয়ে একটু বেশি ভাবতে গেলেই থামিয়ে দেওয়া, বসিয়ে দেওয়ার এই যে চূড়ান্ত অরাবীন্দ্রিক রেওয়াজ, মনে হল এতেই খোদ মানুষটাকেই গাধা বানিয়ে দেওয়া হচ্ছে সিলেবাসে। ‘সবি ইজ অ্যান অ্যাস’। ইজ এবং হ্যাজের ছোট্ট নুয়ান্স গৌণ হয়ে যাচ্ছে প্রাতিষ্ঠানিক ধ্বজাধারীদের হাতে। মৃত রবীন্দ্রনাথের, থেকেও না থাকা রবীন্দ্রনাথের তাতে একটুও হাসি পাচ্ছে না…
ভীমরাও হাসুকর শাস্ত্রী। শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে পারদর্শী। শান্তিনিকেতনে এসে রবীন্দ্রসঙ্গীত তাঁর হৃদয়ের বস্তু হয়ে উঠেছিল। তারপর একসময় শান্তিনিকেতন পরিত্যাগ করেন, এবং বেশ কয়েকবছর পরে, তখন রবীন্দ্রনাথের তিরোধান ঘটেছে, তিনি এসে দেখলেন যে শান্তিনিকেতন গীতিস্তব্ধ। যেখানে আগে সুরে বেসুরে, তালে বেতালে অনবরত গান শোনা যেত, এখন তা খাঁ খাঁ করছে। …. তাঁর পূর্বপরিচিত একজন গোপনে জানাল, এখন এখানে গান করবার বিপদ আছে। –‘বিপদ?’ চমকে উঠলেন পণ্ডিতজী। আমি তো জানতাম গান না করতে পারলেই এখানে বিপদের আশঙ্কা। –‘না পণ্ডিতজী, এ অন্যরকম বিপদ। এখন আনাচে কানাচে স্বরলিপি বই হাতে করে বসে থাকে। বেসুর কানে এলেই বেসুরোকে সনাক্ত করতে চেষ্টা করে। এরকমভাবে কয়েকজন বেসুরো ধরা পড়ে বিড়ম্বিত হয়েছে। ফলে লোকে গান গাওয়াই ছেড়ে দিয়েছে।’
তাঁর কথা শুনে পণ্ডিতজী বিমূঢ় হয়ে একটা গাছের গুঁড়ির ওপর বসে পড়লেন, বললেন— হা ভগবান, এর মধ্যে কী পরিবর্তন ঘটে গিয়েছে! গুরুদেব বলতেন, গানের প্রেরণা প্রাণের উচ্ছ্বাস, তার সঙ্গে বিশুদ্ধ সুর তাল থাকে উত্তম, না থাকে ক্ষতি নেই, তবে প্রাণের উচ্ছ্বাসটা অবশ্যই থাকা চাই।
–এখন সেসব রীতি উল্টে গিয়েছে, আর গুরুদেব যে ওসব কথা বলেছিলেন, তারও প্রমাণ নাই, থাকবার মধ্যে আছে, মুদ্রিত স্বরলিপিগুলো।
এবারে পণ্ডিতজী আর মনের অশান্তি চাপতে পারলেন না, বললেন— “তবেই রবীন্দ্রসঙ্গীতের ইতি।”
ইতির পরেও শুরুর টান থেকে যায়। আমরা যারা জর্জ বিশ্বাসকে সেভাবে পাইনি, পীযূষকান্তি শুনে বড় হয়েছি, আর অকালমৃত্যুর পাহাড় ডিঙোতে ডিঙোতে পেরিয়ে গেছি শান্তিনিকেতনের রাস্তা তাদের কাছে গানের অ আ ক খ বলতে ঠাকুমার ষাটোর্ধ্ব গলায় কাঁপতে কাঁপতে কণ্ঠ রোধ করার গান। আমার ছোটবেলাদের সারেগামা বোধে তিরতিরে নদীর মতো লেগে থাকা মণিহার, যা আমার মতো বেসুর বেতাল গান-না-শেখা ছেলেমেয়েদের কাছে ‘নাহি সাজে’। এবং টাইম স্পেস পেরোনো একটা সন্ধেয় রবীন্দ্রনাথ রানি চন্দকে বলে বসেন, “মেয়েদের দেখেছি আমি, গানে যে দরদ সেটা বয়সের ইমোশনের সঙ্গে আসে, ওটা আগে পিছে জোর করে হয় না।” তবু, কী ভাগ্যিস আমাদের ঠাকুমারা প্রতিষ্ঠানের হন না, ফলে পারিবারিক মেন্টাল ভায়োলেন্স ছাড়া তাঁদের গান ছেড়ে দেওয়ার আর কোনও কারণ থাকে না। আমিও পরে, অনেক পরে ‘দূরে কোথাও’-এর নন্দিনী মালিয়ার মতো দেখতে একটা মেয়ের গলা থেকে কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়ের স্বর কীভাবে আসছে ভাবতে ভাবতে ঢুকে পড়ি সেই প্রতিষ্ঠানেই, প্রিয় মেয়েটির গলা থেকে প্রকাশিত হন রবীন্দ্রনাথ, ওর বান্ধবীদের খুলে রাখা চুলে ঝিকমিক করে বিজন ঘর, স্বপ্নে দেখি, মেয়েদের হোস্টেলের পাশের মাঠে জড়সড় হয়ে শুয়ে আছে শীতের কুকুর, ছড়িয়ে পড়ছে সেই পুরনো কমলা রঙের হ্যালোজেন আর অদ্ভুত নিরাপত্তাহীনতার পরেও বুক চিতিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে আমার নারী, ‘আমি তাইতে কী ভয় মানি, জানি, জানি বন্ধু জানি, তোমার আছে তো হাতখানি’। কী ভাগ্যিস, আমার রবীন্দ্রনাথ প্রতিষ্ঠানের নন…
পুরানো সেই দিনের কথা নামে যা লিখছি তাকে শান্তিনিকেতনের ইতিহাস বলা যাবে না। কারণ ইতিহাস লিখবার ধাত আমার নয়। আর শান্তিনিকেতনের ইতিহাস লিখবার সময় এখনো আসেনি। সে কাজ করতে পারতেন রবীন্দ্রজীবনীকার প্রভাত মুখোপাধ্যায়। তাঁর ধাত ও হাত দু-ই ইতিহাসের। অন্য নামের অভাবে এই রচনাকে অবশ্য পুরাণ বলা যেতে পারে। পুরাণ আর কিছুই নয়, তুচ্ছ কথার পত্রপুটে অমৃত পরিবেশনের প্রয়াস। অনেক অভিলষিত চলতি ব্যক্তির সাক্ষাৎ এতে পাওয়া যাবে না। পাওয়া যাবে না অনেক অতি প্রসিদ্ধ ঘটনা। এর মধ্যস্থলে আছেন রবীন্দ্রনাথ, তাঁকে মন্থন দণ্ড রূপে ব্যবহার করে সুধা তুলবার প্রচেষ্টা। কিন্তু সবচেয়ে বেশি করে আছে তুচ্ছ কথার পসরা। আমি তুচ্ছ কথার কারবারী। এই স্বীকারোক্তির সঙ্গে মনে করিয়ে দিতে চাই তুচ্ছ কথা মানে মিথ্যা কথা নয়।
তুচ্ছ বলতে কী বোঝায় জানি না। মনের বাইরে বৃহত্তর ক্ষেত্রে যা তুচ্ছ যা বোধহয় বাইরে না। তখন গ্র্যাজুয়েশন। বল্লভপুর ঘেঁষা হরিণের বাগান। ওদের শিং, দ্রুতি, চমক শরীরে কেমন সব আনে। যখন পাই না, মনে হয় কিছু নেই, কোথাও নেই। যখন আসে, যেন চুমু, ঝড়, যেন তুমুল আকাশ ফাটানো বৃষ্টি। তেমনই একটা সোনাঝুরি গাছের নিচে সেই মেয়েটা একটা শরীর পেয়েছিল। তুলতুলে নরম শরীর। কোন মেয়েটা? সে, যাকে দেখতাম, ভাবতাম আমার হবে কোনওদিন। ছোট্ট একটা হরিণের শরীর। স্পন্দনহীন। ধুকপুক নেই, ত্রাস নেই, তীব্র বেগ নেই। চোখ খোলা। যেন কোনও এক নক্ষত্রের রাতে বাকি হরিণের সঙ্গে ওর দেখা হবে না বলে খসে পড়েছে হঠাৎ। সে ওকে কোলে নিল, তাকিয়েছিল অপলক, একবার আমার দিকে, বাকিদের দিকেও। সেই সোনাঝুরির মাটি খুঁড়েই ওকে গেঁথে দিয়েছিল ভেতরে। শান্তিনিকেতনের মাটি, লাল, ভালোবাসার মাটির ভেতরে শেষবার রেখে দিয়েছিল ওকে। আমাকেও। কেন জানি মনে হয়েছিল, ও আমার না। এত বিষাদ আমার না। আমার লঘুত্ব প্রাপ্য। চলে আসি ছেড়ে। দেখি সুনীতিদা টিমটিম আলোয় বুদ্ধজীবনী পড়ছেন। মাসিমা বলছেন, চা করে দেব ভাই? দুজন প্রজ্ঞা সারল্যের পরাকাষ্ঠা হয়ে কাটিয়ে দিচ্ছেন অহংহীন জীবন। যখনই যেতাম, প্রায় কিছুই জানি না আমাকে আপনি সম্বোধনে বসাতেন অমন আকাশের কাছাকাছি থাকা সুনীতিদা। “রিলিজিয়ন মানে কী ভাই? রিলিজিয়ন তো ধর্ম না। রিলিজিয়ন পারটিকল। সেটা এরা বুঝবে? এরা জানে কিছু?” সুনীতিদার বাড়ি খাঁ খাঁ করছে মনুষ্যহীনতায়। সন্তান বাইরে, স্ত্রী ঘরে নিজের সংসারে অদ্ভুত সরল। সঙ্গী স্যার রোয়েরিক, বই, টিমটিম আলো, ঘরের বাইরের বাগানের কয়েকটা কুকুর, শান্তিনিকেতনের গাছ আর সিদ্ধার্থ, সুনীতিদার একান্ত ঈশ্বর— সিদ্ধার্থ। মহামানব বারবার আসেন, রূপে গন্ধে মিশিয়ে দেন শরীর। সুনীতিদা তাঁর ঈশ্বর, তাঁর মহামানবকে খুঁজছেন, আমি যেন সুনীতিদাকে খুঁজছি, আমার মহামানব। দিকে দিকে রোমাঞ্চ লাগছে। একবার প্রতিষ্ঠানের মাপা উচ্চারণে, কৃত্রিমতার বাইরে এক বসন্তসন্ধ্যায় শান্তিনিকেতনের খোলা আকাশে এক নারী গেয়েছিল— চাঁদের হাসি বাঁধ ভেঙেছে। সেই প্রথম ও শেষ। শান্তিনিকেতনে মাটিতে শোনা রবীন্দ্রনাথের কোনও গানকে এত কাছে আগে কখনও মনে হয়নি। সেই নারীর সঙ্গে আলাপ হয়নি। আমি তাকে চিনি। সে চেনে না আমায়। এই অপরিচয়ই ভালো। অপরিচয় আমাকে অবনপল্লীর অচেনা ঠিকানা খুঁজে পৌঁছে দেয় পুরনো স্যারের বাড়ি। স্যার পিতৃস্নেহে বসান। কৃত্রিমতার সংখ্যাগরিষ্ঠতাঁর মাঝে এমনই কোনও কোনও মুখ ব্যতিক্রম হয়। এস্রাজে ভাসা রবীন্দ্রনাথের সফট টোনে কোথাও মিশে যায় বাৎসল্য। আমি স্যারকে চলি বলে উঠে আসি। কষ্ট হয় নৈকট্যে। বললাম না, এই অপরিচয়ই ভালো। শান্তিনিকেতনের এক ঝড়ের মধ্যে হঠাৎ তার সঙ্গে দেখা। তখনও সে আমার না। তখনও যে যেকোনও অন্য পুরুষের হতে পারত এমন এক সময়ের ঠিক আগে। ঝড়টা এমনি এমনি এসেছিল? কয়েক সেকেন্ডের জন্য? বিশ্বাস করি না। আমি কয়েকমুহূর্তের জন্য ডেস্টিনি চিনি, ঈশ্বরবিশ্বাসী হই। ওকে জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে করে। ওষ্ঠে ওষ্ঠ রাখতে ইচ্ছে করে। ‘দুয়ারে এঁকেছি/ রক্তরেখায় পদ্ম-আসন,/ সে তোমারে কিছু বলে?’
ঝড়টা এমনি আসেনি। ঝড় কখনও এমনি আসে না…
অদূরে বটগাছতলায় জগদানন্দবাবু বসিয়া বইয়ের প্রুফ দেখিতেছিলেন। তাঁহাকে গিয়া প্রণাম করিলাম। তিনি অর্ধমনস্কভাবে প্রতিবার যেমন বলিয়া থাকেন তেমনি বলিলেন, “কী, চললে? আবার কবে আসছ?” আমি বলিলাম, “আমি তো আর আসব না।“ এবারে তিনি কাগজ হইতে মুখ তুলিয়া অন্যমনস্কভাবে মাঠের অপর প্রান্তে তাকাইয়া রহিলেন।
পুব দিকের সদর রাস্তার উপরে স্টেশনগামী মোটর দাঁড়াইয়া ছিল। আমি ধীরপদে দুই দিকে শেষ নজর নিক্ষেপ করিতে করিতে সেই দিকে চলিলাম। একদিকে কূজনহীন আম্রকুঞ্জ, আর-একদিকে বাসিন্দাহীন বীথিকা গৃহ; প্রথম দৃষ্টির বিস্ময় ও শেষ দৃষ্টির অতৃপ্তির আবহাওয়া তাহার চারি দিকে আর মাঝখানে নিস্তব্ধ নিঃশব্দ বিগতকুসুম শালের শ্রেণী। শিরিষগাছে বাঁধা দোলনাটা পূর্বস্মৃতির সুখে ঈষৎ কম্পিত; শূন্য দেহলী বাড়িটার সুখদুঃখের পালা অবসিত; সম্মুখের আমলকী গাছটার পাতার ঝালরে রী রী কম্পন আজ নিস্তব্ধ, সেখানে কাহারো অতর্কিত আহ্বানে আর কেহ আসিয়া উপস্থিত হইবে না। মেয়ে বোর্ডিঙের দোতালার দরজা জানলাগুলা হা হা এবং ঘরগুলা খাঁ খাঁ করিতেছে। কেবল চালের উপরে শালিখ দম্পতি নীরব। দৃষ্টির দিগন্তের মধ্যে কেহ কোথাও নাই। আসর যখন ভাঙে এমনি করিয়াই ভাঙে।
ভাঙনের পথে উপলক্ষহীনতা পড়ে থাকে। পড়ে থাকে ঘটনাবিহীন দুপুর। রবীন্দ্রনাথের বাগান থেকে ঝড়ে পড়ে যাওয়া পাতা, বাসি শুকনো পাতা সরিয়ে দেওয়া ভালো লাগত না। বলতেন, ওরাও থাকুক। ওরা কোথায় যাবে? চলে যাওয়ার অর্থ প্রেক্ষিতে পাল্টে পাল্টে যায়। আমাদের যায় যে দিন, একেবারেই কি যায়? সেইসব মুহূর্ত, পল দো পল বদলে যায় কথাকাটাকাটিতে, দোতলা বাড়ির চেয়েও বড় কোনও বুদ্ধমূর্তি কেমন একটা অহং-এর মতো মনে হয়। মনে হয় এ অনর্থক উচ্চতা এখানে কেন! এই প্রাচীর এখানে কেন! এই নিজস্ব রীতি-বহির্ভূত একঝাঁক স্থাপত্যসমাহার এখানে কেন! এত আমিত্ব এখানে কেন!
বিভূতি, প্রমথকে নিয়ে শিক্ষক নেপালচন্দ্র রায় ছাত্রীদের হোস্টেলে আসা চোর ধরতে বেরিয়েছিলেন। খোয়াইয়ের রাতের কাঁকুরে রাস্তায় পড়ে যাচ্ছিলেন, আর টেনে ধরছিলেন ছাত্ররা। নেপালচন্দ্র বারবার বলছিলেন, “হাসছিস কেন? এতে হাসার কী আছে?” পরক্ষণেই সামলাতে না পেরে— “ওরে পড়ে গেলাম, টেনে রাখিস, টেনে রাখিস।”
কে টেনে রাখবে শান্তিনিকেতনকে? মাস্টারমশাইরা ভয়ে থাকেন। ছাত্ররা ভয়ে থাকে। গাছগাছালি ভয়ে থাকে। আজকাল মনে হয়, বিশ্বভারতী যৌথতার মতো, নব্বইয়ের সেইসব বাড়িগুলোর মতো, সোনালি গানগুলোর মতো একটা বিশাল একান্নবর্তিতা ছিল, বলার মতো একটা সময় ছিল মাত্র। রবীন্দ্রনাথ পিতামহের মতো এবং পরের দিকে ক্ষিতিমোহন, বিধুশেখর, গোঁসাইজিরা যতদিন পেরেছেন টিমটিম আলো-আঁধারিতে বাঁচিয়ে রেখেছিলেন সেই লেগ্যাসি। আরও সমস্ত ভালোটুকুর মতো সে আসরও ভেঙেছে, এমনি করেই ভেঙেছে…
ঋণস্বীকার— প্রমথনাথ বিশী