সব্যসাচী কমিউনিস্ট সুশীল চট্টোপাধ্যায়

শঙ্কর রায়

 

“নেপালের কমিউনিস্ট পার্টির অন্যতম স্থপতি মনমোহন অধিকারী বেনারসে ছাত্রাবস্থাতেই ১৯৩৮-৩৯ সাল নাগাদ কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে পরিচিত হন। ১৯৪২ সালে ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলনে যোগ দিয়ে তিনি গ্রেপ্তার হন। দেড় বছর কারাবাসের পর মুক্ত হলে তিনি নেপালের তৎকালীন বাণিজ্যকেন্দ্র বিরাটনগরে এসে শ্রমিক আন্দোলন সংগঠিত করতে শুরু করেন। তখনও নেপালের কমিউনিস্ট পার্টি গঠিত হয়নি। ১৯৪৭ সালে মার্চ মাসে বিরাটনগরে শ্রমিক আন্দোলন তীব্র হয় ও শ্রমিক ধর্মঘট শুরু হয়। এই ধর্মঘটের কয়েক মাস আগে নেপালের রাষ্ট্রীয় কংগ্রেস গঠিত হয়েছিল। কিন্তু বিরাটনগরের শ্রমিক আন্দোলনের অন্যতম নেতা মনমোহন অধিকারী আন্দোলনের জন্য সাহায্য চান দার্জিলিংয়ের কমিউনিস্ট পার্টি ও শ্রমিক নেতা তৎকালীন বিধায়ক রতনলালর ব্রাহ্মণের কাছে। রতনলালর ব্রাহ্মণ বিরাটনগরে গেলেন সুশীল চ্যাটার্জিকে নিয়ে। শ্রমিকসভায় তাঁর ভাষণে শ্রমিকদের মধ্যে যেমন উদ্দীপনার সৃষ্টি হল, তেমনই মনমোহন অধিকারীর সাংগঠনিক ক্ষমতায় আকৃষ্ট হলেন রতনলাল ব্রাহ্মণ। এই যোগাযোগেই নেপালের কমিউনিস্ট পার্টির গঠনের ভিত্তি স্থাপিত হল।”

এই দীর্ঘ উদ্ধৃতি সিপিআই(এম)-এর রাজ্য কমিটি সদস্য ও দার্জিলিং জেলার পার্টি নেতা জীবেশ সরকারের লেখা ‘সুশীল চ্যাটার্জি— এক অসাধারণ সংগঠক’ থেকে। বাসু আচার্য সঙ্কলিত ও সম্পাদিত ‘সুশীল চট্টোপাধ্যায়: এক অনন্য কমিউনিস্ট বিপ্লবী’ বই থেকে নেওয়া। জীবেশবাবুর বড় লেখা থেকে সঙ্কলিত এই প্রবন্ধটি নানা কারণে উল্লেখ্য। সুশীল চট্টোপাধ্যায়ের ১২৫তম জন্মবর্ষপূর্তিতে (২০২১) এই মূল্যবান প্রকাশনা। আমাদের যৌবনের সুশীলদা যে দার্জিলিং-এ কমিউনিস্ট পার্টি প্রতিষ্ঠার প্রধান ছিলেন ও একদা গরিব গোর্খালি-নেপালিদের রবিনহুড রতনলাল ব্রাহ্মণকে পার্টিতে এনেছিলেন এটা জানতাম। কিন্তু নদিয়া জেলার কমিউনিস্ট পার্টি গড়ার অন্যতম প্রধান কারিগর যে নেপালে কমিউনিস্ট পার্টি গড়ারও সূত্রধর ছিলেন, তা জীবেশবাবুর কথাতেই জেনে ঋদ্ধ হলাম। পার্টি ভাগ হলে রতনলাল সিপিআই(এম)-এ যোগ দেন, সুশীল চ্যাটার্জি মূল পার্টি সিপিআইতেই থেকে যান। জীবেশবাবু লিখেছেন, “মতাদর্শগত প্রশ্নে কমিউনিস্ট পার্টি বিভক্ত হলে সুশীল চ্যাটার্জি সিপিআইতে গেলেও রতনলাল ব্রাহ্মণ … জীবনের শেষদিন পর্যন্ত … সুশীল চ্যাটার্জির প্রতি অপরিসীম শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করে দার্জিলিং জেলার কমিউনিস্ট পার্টি গঠনে তাঁর অনবদ্য ভূমিকার কথা উল্লেখ করতেন।”

জীবেশবাবুর এত দীর্ঘ উদ্ধৃতি দিলাম এজন্যে যে শুনলাম সিপিআই(এম)-এর এ রাজ্যে প্রধান প্রকাশনা ও পুস্তক-পত্রিকা বিক্রয় সংস্থা ন্যাশনাল বুক এজেন্সি বাসু-সম্পাদিত এই বইটি বিক্রয়ের জন্য রাখতে চায়নি। গত বছর ছিল রতনলাল ব্রাহ্মণেরও ১২০তম জন্মবর্ষপূর্তি। সে উপলক্ষে ২০২১-এর অক্টোবরের শেষে তাঁর জীবনী প্রকাশিত হয়। লেখিকা তাঁরই নাতনি প্রীতি ব্রাহ্মণ— ‘দি রেড লায়ন অফ দি হিলস’। দার্জিলিং-এর গোর্খা দুখ নিবারণী সম্মেলন প্রেক্ষাগৃহে প্রকাশ করেন প্রাক্তন ইন্সপেক্টর জেনারেল (জেল) ও লেখক কৃষাণ সিং মোক্তান। জেলার কোনও সিপিআই(এম) নেতা উপস্থিত ছিলেন না, কিন্তু প্রেক্ষাগৃহে ছিলেন পার্টির নীচের তলার কর্মীরা (বিক্ষুব্ধরা তো ছিলেনই) তাঁদের প্রিয় মাইলা বাজে-র জীবনীগ্রন্থ প্রকাশ সভায়। সিপিআই-তে যোগ দেওয়ার আগে রতনলাল ব্রাহ্মণ ও তাঁর বন্ধুরা গড়ে তুলেছিলেন গোর্খা দুখ নিবারণী সম্মেলন। তাদের প্রেক্ষাগৃহে এই বই প্রকাশ তাৎপর্যপূর্ণ।

জীবেশবাবু ছাড়াও এই সঙ্কলনে প্রণিধানযোগ্য স্মৃতিচারণ করেছেন অধ্যাপক শিবাণী কিঙ্কর চৌবে, কার্তিকচন্দ্র দাস, প্রবীর কুমার বসু, অর্ধেন্দুশেখর দাস বৈরাগ্য, কান্তি বসু, বিপুল রঞ্জন সরকার, নিতাইপদ সরকার, হরিসাধন ঘোষ ও কৃষ্ণচন্দ্র দাস। এঁদের সবাইকে নদীয়া জেলায় অবিভক্ত সিপিআই-এর সক্রিয় সদস্য করে গড়ে তুলেছিলেন সুশীলবাবুই। শিরোনামে ভানুদেব দত্তের ‘ভূমিকার পরিবর্তে’ ও ‘কমরেড সুশীল চট্টোপাধ্যায়— এক বিস্মৃতপ্রায় বিপ্লবী’ শিরোনামে বাসু আচার্যের নিবন্ধ দুটি ইতিহাসের সূত্র। জীবেশ সরকার ব্যতীত সবাই (বাসু আচার্য ছাড়া) সিপিআই-এর সদস্য। কাজেই সিপিআই-ভাবনা এঁদের লেখায় কিছুটা হলেও এসে গেছে। তবে একথাও ঠিক যে সুশীলবাবুর সঙ্গে যুক্ত-পার্টিতে কাজ করেছেন অত্থচ পার্টিভাগের পর সিপিআই(এম)-এ যোগ দিয়েছেন, এমন জীবিত কমরেড নদীয়া জেলাতেই পাওয়া মুশকিল, দার্জিলিং-এর কথা ছেড়েই দিলাম।

একটা ধারণা আছে (বিশেষ করে নদীয়া জেলায়) যে সুশীলবাবু সিপিআই-তে থেকে গিয়েছিলেন, কারণ তিনি দেউলি ডিটেনশ্যন ক্যাম্পে থাকাকালীন ভবানী সেনের প্রভাবেই সিপিআই-তে এসেছিলেন। ভানুদেব দত্ত লিখেছেন— “কমিউনিস্ট আন্দোলনের বিভাজন তিনি একেবারেই সহ্য করতে পারেননি। এই বিভাজন কমিউনিস্ট আন্দোলনকে শক্তিশালী করবে না বলেই মনে করতেন। সেই কারণে তিনি কমিউনিস্ট আন্দোলনের মুল অংশের সঙ্গে থেকে গিয়েছিলেন।” ঠিকই বলেছেন। পার্টিভাগের আগে জাতীয় পরিষদের সদস্য ও তাঁদের অনুগামীদের আন্তঃপার্টি মতাদর্শগত/রাজনৈতিক বিতর্কে (আমার মনে হয় বিতর্ক না বলে লড়াই বলাটা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। লড়াই তো ঐক্যবিরোধী, যাঁরা পার্টিভাগের জন্য তৈরি হচ্ছিলেন, তাঁদের মনপসন্দ) দুটি পরস্পরবিরোধী মত/ধারা ছিল। একটি ন্যাশনাল ফ্রন্ট (প্রধানত যাঁরা সিপিআইতেই থেকে গিয়েছিলেন)। অন্যটি ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (যাদের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ সিপিআই ছেড়ে সিপি আই-এম গড়েছিলেন— প্রথমে, অর্থাৎ নতুন পার্টির ১৯৬৪ সালে প্রথম কংগ্রেসে প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক পুচাপাল্লি সুন্দরাইয়া কংগ্রেসে প্রতিনিধি সম্মেলনে ও সাংবাদিক সম্মেলনে বলেছিলেন, “আমরাই আসল সিপিআই।” সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট পার্টির স্বীকৃতি চেয়ে প্রস্তাবও নেওয়া হয়েছিল)। ভূপেশ গুপ্ত, ডাঃ রণেন সেন ও সোহন সিং যোশ ডেমোক্রেটিক ফ্রন্টে ছিলেন, কিন্তু পার্টি বিভাজনে সামিল না হয়ে সিপিআই-তেই থেকে গিয়েছিলেন।

প্রবীর বসু সাফ সাফ লিখেছেন, “আপাতদৃষ্টিতে মনে হয় যেন সীমান্ত-বিরোধটাই পার্টিভাগের জন্যে দায়ী। কিন্তু এটা ছেঁদো যুক্তি… কোনো কোনো দেশের পার্টিনেতৃত্ব যে আমাদের পার্টির (অর্থাৎ অবিভক্ত সিপিআই— শ.রা) মধ্যে উপদলীয় কাজকর্ম বাড়াতে সাহায্য করেছিল, সে ব্যাপারে সন্দেহ নেই।” তাঁর ‘পার্টিভাগ ও সুশীল চ্যাটার্জি’ এক কৌতূহলোদ্দীপক স্মৃতিলেখা, যা বিতর্কিত হওয়াই স্বাভাবিক। তিনি অনেকদিন সিপিআই-এর নদীয়া জেলার সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য ছিলেন। সুশীলবাবুর প্রতি সিপিআই(এম)-এ যোগ দেওয়া জেলা নেতৃত্ব ও তার অনুগামীদের অসভ্য আচরণের (সুশীলবাবুকে পেছন থেকে গালাগালি, তাঁর দিকে ঢিল ছোড়াও) প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। নিজের পার্টিকেও রেয়াত করেননি। তিনি সখেদে জানিয়েছেন যে সুশীল চট্টোপাধ্যায়ের অনুলেখন-ভিত্তিক আত্মজীবনীর খসড়া পাণ্ডুলিপি সিপিআই-নিয়ন্ত্রিত মনীষা গ্রন্থালয়ের তদানীন্তন কর্ণধার দিলীপ বসু শুধু ছাপেননি তা নয়, পাণ্ডুলিপি ফেরত দেননি। চার ঘণ্টা সাক্ষাৎকার-ভিত্তিক ঐ পাণ্ডুলিপির অনুলিপি রাখেননি। যা হতে পারত একটি ঐতিহাসিক দলিল, তাকে এভাবে অঙ্কুরে বিনাশ কি ক্ষমার অযোগ্য দায়িত্বজ্ঞানহীনতার পরিচায়ক নয়?

অশীতিপর কান্তি বসু লিখেছেন আঠেরো বছরে পড়ার অনেক আগেই পার্টির সংস্পর্শে আসার কথা, ১৯৬২ সালে চিন-ভারত সংঘর্ষের পরে অবিভক্ত পার্টির আড়ংঘাটায় জেলা সম্মেলনে “সুশীলদা ভোটাভুটির মাধ্যমে গদাদাকে (অমৃতেন্দু মুখার্জি— শ.রা) হারিয়ে জেলা সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছিলেন। আড়ংঘাটা কনফারেন্সে চিন-সোভিয়েত বিতর্ক ও বুখারেস্ট ডকুমেন্ট নিয়ে প্রচুর বাকবিতণ্ডা চলে সারারাত ধরে। সুশীলদা কমরেড দেবীপ্রসাদ বসুকে নিজের পক্ষে এনে গদাদাকে পরাজিত করেন। সেই সম্মেলনে (১৯৬১) জ্যোতি বসু উপস্থিত ছিলেন। … (পরে— শ.রা) সুশীলদা ছাড়া জেলার সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ নেতা সেদিন দল ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন নতুন দল সিপিআই(এম)-এ।… যে মানুষগুলো অবিভক্ত পার্টিতে দিবারাত্রি তাঁর সঙ্গে ঘুরে বেড়াত, তাঁকে ঘিরে রাখত, তারা পার্টিভাগের পর আর সিপিআই-তে থাকেনি।” অমৃতেন্দু মুখার্জি ও দেবী বসু তো সিপিআই(এম)-এর বিধায়ক হয়েছিলেন, প্রথমজন মন্ত্রীও, পার্টি ভাগ হলে তাঁরা সিপিআই(এম)-এ যোগ দেন। অবশ্য তিনজনেই ভারত রক্ষা আইনে সেই সময় গ্রেপ্তার হন। কান্তিবাবুর মতে দার্জিলিং জেলায় পার্টি সংগঠনে যে অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছিলেন, নদীয়ায় তা পারেননি। “আরেকটা ব্যাপার। শেষ অব্দি সিপিআই-তে থেকে গেলেও সুশীলদা মনেপ্রাণে ছিলেন নকশাল ঘরানার লোক।”— কান্তিবাবুর এই মত সিপিআই-এ থেকে যাওয়া অন্য কারও লেখায়/কথায় পাইনি।

এখন সিপিআই-এর নদীয়া জেলা সম্পাদক কার্তিক চন্দ্র দাসের লেখায় ফুটে উঠেছে বিপ্লবী সন্ত্রাসবাদী থেক্কে বিপ্লবী কমিউনিস্ট হয়ে ওঠা সুশীল চট্টোপাধ্যায়ের কথা। তিনি ছিলেন সুশীলবাবুর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ক্যাডার। কীভাবে প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যে নদীয়া জেলায় (অধুনা বাংলাদেশে কুষ্টিয়ার মোহিনী মিলে, দর্শনায় চিনিকল মজুরদের মধ্যেও) সংগঠন গড়ার সঙ্গে সঙ্গে মার্ক্স-লেনিনের লেখার সঙ্গে কর্মীদের পরিচয় করিয়ে দেওয়ার কথা লিখেছেন, অসমের তিব্বত-সীমানায় এক পাহাড়ি দুর্গে মিলিটারি পাহাড়া সত্ত্বেও পালিয়ে এসেছিলেন (সরকারি ডাক ও তার বিভাগের চাকরি খোয়াতে হয়েছিল)। কার্তিকবাবু দুই পার্টিকেই দুষে লিখেছেন, “পার্টি ভাগের পর দুই দলের একে অপরকে গালিগালাজ করা, মারামারি ইত্যদি অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেছিল। চলছিল খুনখারাপি। বিশুদ্ধ মতাদর্শগত বিরোধকে শ্রেণী হিংসার তত্ত্বে তত্ত্বায়িত করা হচ্ছিল।” কিন্তু তাঁর সমালোচনা জেলার সিপিআই(এম)-এর বিরুদ্ধেই বেশি। বড়জালিয়ার জমিদারসন্তানের বৈভব ছেড়ে কমিউনিস্ট পার্টির কাজে পূর্ণ নিয়োজিত কাকদ্বীপের কিংবদন্তী নেতা অশোক বসু (যিনি আত্মগোপন করে মধ্যপ্রদেশে প্রকাশ রায় নামে পার্টি গড়ার কাজ করছিলেন)। “সিপিআই(এম) প্রকাশ্যে লিফলেট বিলি করে সাধারণ মানুষকে জানায় প্রকাশ রায় একজন খতরনাক ক্রিমিনাল।” প্রয়াত অশোক বসু ১৯৭৩-৭৪ সালে হরিণঘাটা পার্টি অফিসে একথা জানান।

সুশীল চট্টোপাধ্যায় কীভাবে প্রান্তিক কৃষক ও ক্ষেতমজুরদের আস্থা অর্জন করতেন, সে কথা লিখেছেন অর্ধেন্দুশেখর দাসবৈরাগ্য। “তাঁর স্পষ্ট নির্দেশ ছিল যাতে গ্রামে গিয়ে পাকা বাড়িতে না উঠি। যত অসুবিধেই হোক না কেন, গরিব কৃষক ও ক্ষেতমজুরদের ঘরেই উঠি। গরিব মানুষের সঙ্গে একাত্ম না হলে যে কমিউনিস্ট পার্টি তার নির্দিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছতে পারবে না, এটাই ছিল তাঁর বক্তব্য। এই দৃষ্টির কারণেই সুশীলদাকে গরিব কৃষক ও ক্ষেতমজুরেরা দেবতার মতো শ্রদ্ধা করত। কী বিপুল রেস্পেক্ট তিনি অর্জন করেছিলেন তা আমি নিজের চোখে দেখেছি।” অর্ধেন্দুবাবুই কার্তিক চন্দ্র দাসকে নকশালপন্থী রাজনীতি থেকে সিপিআইতে আনেন।

বগুলার শ্রীচৈতন্য কলেজে ১৯৫৭ সালে শেষ অবিভক্ত সিপিআই-এর ছাত্র সংগঠন ছাত্র ফেডারেশ্যনের ইউনিয়ন জয়লাভ একটা টার্নিং পয়েন্ট। সেখানে সহকারী সম্পাদক নির্বাচিত হন নিতাইপদ সরকার, সিজিত বিশ্বাস হলেন সাধারণ সম্পাদক। সেকথা লিখেছেন নিতাইবাবু (রাণাঘাট পূর্ব কেন্দ্র থেকে ১৯৬৭, ১৯৬৯ ও ১৯৭২-এ সিপিআই টিকিটে নির্বাচিত বিধায়ক)। “আড়ংঘাটা এলাকায় পূর্ববঙ্গ থেকে আসা নমঃশূদ্রদের প্রাধান্য ছিল। নতুন তৈরি হওয়া এই কলেজে তাই তপশীলী সমাজের ইউনিয়ন ছিল শক্তিশালী। সুশীলদা প্রায় হাঁসখালি আসতেন। কমরেড মুকুন্দ ঘোষ, কমরেড কন্তি বসুদের বাড়িতেই খাওয়া-দাওয়া করতেন। থাকতেন কমরেড অশ্বিনী মন্ডলের বাড়িতে। তাঁদের কাছ থেকে বগুলা কলেজ থেকে সমস্ত জানতে পেরে আমাকে সেখানে ভর্তি হবার কথা বলেছিলেন। সুশীলদার দূরদৃষ্টি প্রমাণিত হয়েছিল। শ্রীচৈতন্য কলেজে স্টুডেন্ট ফেডারেশ্যন আমিই প্রথম করি এসএফ প্রার্থী হিসাবে।” তিনি সুশীলবাবুর উদ্যোগে ও নেতৃত্বে চাকদহের চোওগাছা, হুমনিয়াপোতা (যেখানে যুক্তফ্রন্ট আমলে জমি দখল আন্দোলনে পুলিশ গুলি চালিয়েছিল, ছুটে এসেছিলেন সেচমন্ত্রী ও রাজ্য সিপিআই নেতা বিশ্বনাথ মুখোপাধ্যায়) ইত্যাদি অঞ্চলে আদিবাসীদের মধ্যে পার্টি ও কৃষকসভার সংগঠন গড়ে তুলেছিলেন।

বিপুল চন্দ্র সরকার জানিয়েছেন সুশীল চট্টোপাধ্যায়ের দুর্নীতি-বিরোধী অবস্থানে আপসহীনতা। সুশীলবাবুর প্রিয়পাত্র এক বিধায়কের বিরুদ্ধে নির্দিষ্ট অভিযোগ আছে। সঙ্গে সঙ্গে সুনীল মিত্র, গুরুদাস শিকদার ও বিপুলবাবুকে নিয়ে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে সেই বিধায়কের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেন। সেই বিধায়ক তখন প্রতিদ্বন্দ্বী বাম দলে যোগ দেন। বিপুলবাবু লিখেছেন, “পার্টির কলেবর ছোট হওয়াতে ঐ আমলে কোনও বিধায়কের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে যে কোনও নেতৃত্বই দুবার ভাবতেন, কেন না তাতে অভিযুক্ত ব্যক্তির প্রতিদ্বন্দ্বী বাম দলে চলে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকত।” তাই হয়েছিল। মনে পড়ছে ১৯৮২-৮৩ সালে সিএমডিএ-র একটি মাটি কাটা প্রকল্পে (বিশ্বব্যাঙ্কের ঋণে) চুক্তিবহির্ভূতভাবে দুই ঠিকাদারের মাটি কাটার হার (রেট) বাড়িয়ে দেওয়ার কথা বিধানসভায় ফাঁস হয়ে যাওয়ায় কিছুটা টালবাহানা করায় সিপিআই(এম)-এর প্রভাবশালী মন্ত্রী প্রশান্ত শূরের বিরুদ্ধে অবসরপ্রাপ্ত হাইকোর্টের বিচারপতি সলিল গাঙ্গুলির নেতৃত্বে একটি তদন্ত কমিশন গঠন করা হয়, কিন্তু তদন্ত চলাকালীন প্রশান্তবাবুকে সাময়িকভাবে ঐ দপ্তর থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়নি। গাঙ্গুলি কমিশনকে শেষ মুহূর্তে রিপোর্ট দিতে দেওয়া হয়নি কীভাবে, সে সব নিয়ে লেখার অবকাশ নেই এই লেখায়। কল্যাণীতে সেন র‍্যালে, অ্যান্ড্রু ইউল প্রভৃতি কারখানায় ও বাসকর্মীদের এআইটিইউসি ইউনিয়ন গড়তে সুশীলবাবুর উজ্জ্বল নেতৃত্বের কথা বিপুলবাবু লিখেছেন।

হরিসাধন ঘোষ লিখেছেন পার্টিভাগের পরে সুশীলবাবু কীভাবে আবার দার্জিলিং জেলায় গিয়ে সিপিআই-কে নতুনভাবে গড়ে তোলেন, কারণ সিংহভাগ সদস্য সিপিআই(এম)-এ যোগ দিয়েছিলেন। “আদিবাসীদের ঘরে বসে নুন দিয়ে চা খেতে খেতে তাদের পারিবারিক সমস্যা, জীবনধারণের সমস্যা… এইসব নিয়ে আলোচনা করতেন। কখনওই প্রথমে পার্টির কথা বলতেন না।… খেটে খাওয়া মানুষের ওপর নির্ভর করেই সুশীলদা রাজনীতি করতেন।”

মুজফফর আহমদের একটি লেখা এই বইতে আছে। সেটা একটা দলিল হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। অবিভক্ত পরাধীন ভারতে গণপরিষদে দার্জিলিং জেলা কমিটি স্বাধীন গোর্খাস্তানের দাবিতে একটি স্মারকপত্র পেশ করে, যার মুসাবিদা করেছিলেন সুশীল চট্টোপাধ্যায়। এ নিয়ে কুৎসা করা হয় যে সিপিআই বিচ্ছিন্নতাবাদী। সেখানে বলা হয়েছিল যে এই সিদ্ধান্ত মেনে নিলে স্বাধীন গোর্খাস্তান স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে ভারতীয় ইউনিয়নে যোগ দেবে। পার্টির কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব এতে সায় না দিলেও ঐ স্মারকপত্র দার্জিলিং-কে বিচ্ছিন্ন করার ইঙ্গ-মার্কিন চক্রান্ত ব্যর্থ করেছিল। দেবাঞ্জন দাস সেই স্মারকলিপির স্বচ্ছ অনুবাদ করেছেন, ও তা নিয়ে মুক্ত আলোচনা করেছেন আলোক মুখোপাধ্যায়। ডঃ শুভজিৎ বিশ্বাস ও অমিতায়ুধ-এর লেখা দুটি অবশ্যপাঠ্য।

বাসু আচার্যের লেখাটি এই বইয়ের সম্পদ। সত্যেন্দ্র নারায়ণ মজুমদার (যিনি ছিলেন মহাপণ্ডিত; জলিমোহন কল মনে করতেন ভাষা সমস্যা তো বটেই, জাতীয়তার প্রশ্নে সত্যেন্দ্র নারায়ণ মজুমদারকে নাম্বুদিরিপাদের ওপরে রাখা উচিত) সুশীল চট্টোপাদ্যায়কে পথপ্রদর্শক ভাবতেন কেন বাসুর লেখায় ফূটে ঊঠেছে। দার্জিলিং-এর শ্রমিক সংরক্ষিত কেন্দ্র থেকে ১৯৪৬ সালে বঙ্গীয় আইনসভায় রতনলাল ব্রাহ্মণের জয়লাভ সম্পর্কে সত্যেনবাবুর উক্তি প্রণিধানযোগ্য: “রতনলাল ব্রাহ্মণের জয়লাভের পেছনে প্রধান কারণ ছিল দার্জিলিং জেলার প্রাদেশিক পার্টি সংগঠক সুশীল চ্যাটার্জির সংগঠন-ক্ষমতা ও খানিকটা পরিমাণে রতনলাল ব্রাহ্মণের ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তা।” এ কথাটা গুরুত্বপূর্ণ এইজন্যে যে ১৯৫২ সালে বিধানসভা নির্বাচনে রতনলাল ব্রাহ্মণ হেরে গিয়েছিলেন, যার সম্ভাব্য কারণ প্রচারের কালে সুশীলবাবুর কারারুদ্ধ থাকা। পার্টি নীরব থাকলেও সত্যেনবাবু আত্মসমালোচনার সুরে লিখেছেন, “অনেকদিন পর ভেবে দেখেছি সুশীলদার উপর খানিকটা অবিচার করেছি। তাঁর যেসব দোষত্রুটির সমালোচনা করেছি, সেগুলিকে প্রাদেশিক নেতাদের অনেকের মধ্যে প্রবলভাবে বিদ্যমান দেখেছি। সুশীলদা তবু চুয়ান্ন বছর বয়সে দুর্গম চড়াই-উৎরাই ভেঙে চা বাগানে বাগানে ঘুরেছেন। কোনও কোনও সময়ে আমিও সঙ্গে থেকেছি। পার্বত্য অঞ্চলের ভৌগোলিক পরিবেশ, এখানকার জনসাধারণের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য, গোপন সংগঠনের সামনের বাস্তব সমস্যা ইত্যাদি সম্পর্কে নেতাদের কোনও ধারণাই নেই।”

সুশীলদা সম্পর্কে এ কথা লিখতে পারতেন সত্যেনদাই। দুজনেই ছিলেন বিরল মেধাসম্পন্ন। বাসুর কাছে এজন্যেই আমরা কৃতজ্ঞ।

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4879 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...