সুকান্তি ভট্টাচার্য্য
শিক্ষক, চিকিৎসক
সম্প্রতি ন্যাশনাল মেডিকেল কমিশন (এনএমসি) এমবিবিএস পড়ুয়া ও চিকিৎসকদের হিপোক্রেটিক ওথের বদলে “চরক-শপথ” নেওয়ার কথা প্রস্তাব করেছে। এই নিয়ে বিভিন্ন স্তরে বহু আলোচনা ও বিতর্ক দেখা যাচ্ছে। বর্তমান নিবন্ধে চরক সংহিতা থেকে উপযুক্ত ও আলোচ্য অংশটিকে বিবেচনা করা হবে। চরক একজন ব্যক্তি না ভ্রাম্যমান (বিচরণশীল) লোকচিকিৎসকসমুদয় তা এই নিবন্ধের প্রতিপাদ্য নয়। তবে “চরকসংহিতা” নামক গ্রন্থটি অগ্নিবেশ-কৃত ও চরক-প্রতিসংস্কৃত বলে উল্লেখ রয়েছে। প্রতিসংস্কারকের নামে কোনও সংহিতার নামকরণ বিরল বৈকি! অগ্নিবেশ/বহ্নিবেশ/হুতাশবেশ-কৃত এই গ্রন্থটি বহুলাংশেই অবলুপ্ত হয়। খ্রিস্টীয় অষ্টম/নবম শতকে কাশ্মিরের খ্যাতকীর্তি বৈদ্য কপিলবলের সুযোগ্য পুত্র বহু সূত্র থেকে এই লুপ্ত অংশ উদ্ধার করে চরকসংহিতাকে নবরূপে প্রকাশ করেন; এবং বহু শাস্ত্রান্তর থেকে মতবাদও সম্বলিত করেন। এই নবরূপায়িত গ্রন্থটিই অধুনা প্রচলিত রয়েছে। তবে “চরক-শপথ” নামক কোনও নির্দিষ্ট অন্তর্ভুক্তি এতে নেই; যদিও সুশ্রুতসংহিতায় সুশ্রুত-শপথের উল্লেখ আমরা পাই। যেহেতু, এনএমসি চরক-শপথের কথাই বলেছে, তাই সুশ্রুত-শপথ এখানে আলোচনা করা হবে না।
চরকসংহিতার প্রাসঙ্গিক পরিচয়
চরক সংহিতা মোট আটটি স্থানে বিভক্ত: সূত্রস্থান, নিদানস্থান, বিমানস্থান, শারীরস্থান, ইন্দ্রিয়স্থান, চিকিৎসাস্থান, সিদ্ধিস্থান, ও কল্পস্থান। এরমধ্যে বিমানস্থানে আলোচিত হয়েছে বিভিন্ন মাপন বা মানের। বিমানস্থানে রয়েছে আটটি অধ্যায়: রস বিমান, ত্রিবিধ কুক্ষীয় বিমান, জনপদোদ্ধংসনীয় বিমান, রোগবিশেষবিজ্ঞানীয় বিমান, স্রোতোবিমান, রোগানীক বিমান, ব্যাধিতরূপীয় বিমান, রোগভিষগজীতিয় বিমান। এই অষ্টম অধ্যায়টির কিছু অংশই আজকের আলোচ্য।
বর্তমান প্রেক্ষিতেও এই অধ্যায়টি যথেষ্ট আধুনিক বলা চলে। ভগবন্ পুনর্বসু আত্রেয় তাঁর অন্যতম প্রধান শিষ্য অগ্নিবেশকে বললেন, চিকিৎসাশাস্ত্রের অধ্যেষুমাত্রই চিকিৎসক নহে। নির্দিষ্ট মান্যতাপ্রদানের জন্য বহুবিধ পরীক্ষা প্রয়োজন: শাস্ত্রপরীক্ষা, আচার্যপরীক্ষা, বিদ্যার্থিপরীক্ষা,ও তদ্বিদ্যসম্ভাষ্য। কোনও কোনও অধুনাতন আয়ুর্বেদাচার্য মনে করেন, অষ্টাঙ্গ আয়ুর্বেদের কোন অঙ্গে কার কেমন ব্যূৎপত্তি তার নির্ধারণ হল শাস্ত্রপরীক্ষা। এই অঙ্গগুলি হল: শল্যতন্ত্র, শালাক্যতন্ত্র, কায়চিকিৎসাতন্ত্র, ভূতবিদ্যাতন্ত্র, কৌমারভৃত্যতন্ত্র, অগদতন্ত্র, রসায়নতন্ত্র, ও বাজীকরণতন্ত্র। অনেকটা স্নাতকোত্তর প্রবেশিকা পরীক্ষার মত। তবে, মনে হয়, এটা প্রলম্বিত দাবি। চিকিৎসাশাস্ত্রের প্রাথমিক শিক্ষার্থীর পক্ষে এইরূপ নির্বাচন সম্ভব নয়। বরং, বুনিয়াদি শাস্ত্র বিষয়ে শিক্ষার্থীর জ্ঞান, বোধ, ও বিবেচনার মূল্যায়নই শাস্ত্রবিচার হওয়া সঙ্গত। এরপরে অনেকটা প্রি-অ্যাডমিশন কাউন্সেলিংয়ের বিদ্যায়তন নির্বাচনের মতো আচার্যপরীক্ষা— কোন আচার্যের নিকট অধ্যয়ন, সাধন প্রভৃতি করা হবে তাঁকে নির্বাচন। তবে, ভ্রাম্যমাণ লোকচিকিৎসকগণের মধ্যে নির্দিষ্ট আচার্যের সন্ধানই হয়ত রীতি ছিল। এবারে বিদ্যার্থিপরীক্ষা— ইচ্ছুক ছাত্রটিকে যাচাই করে তবেই শিষ্যত্বে বরণ করা। এই যাচাইয়ের বিষয়টি বলার আগে তদ্বিদ্যসম্ভাষ্য বিষয়টি অতি সংক্ষেপে বলা যাক। সহাধ্যায়ী (সমকালে একই আচার্যের কাছে পাঠরত) ও সমাধ্যায়ী (একই বিষয়ে পাঠরত) বিদ্যার্থীদের মধ্যে সন্ধায়সম্ভাষ্য (আলোচনা) ও বিগৃহ্যসম্ভাষ্য (বিতর্ক) প্রভৃতির মাধ্যমে অ্যান্ড্রাগগি পদ্ধতিতে অনুপুঙ্খ জ্ঞানলাভের রীতি-নীতির বিবরণ রয়েছে এতে।
বিদ্যার্থীর যে যে অভিপ্রেত গুণ আছে কিনা আচার্য দেখে নেবেন, সেগুলির বিস্তৃত বিবরণ রয়েছে অথাধ্যাপনবিধিঃ অংশে।
অথ অধ্যাপনবিধিঃ
প্রশান্তস্বভাব আর্যপ্রকৃতির শিষ্যটির টিকালো নাক, সরল চোখমুখ, পাতলা রক্তাভ অমলিন জিহ্বা, অবিকৃত দাঁত ও ঠোঁট থাকতে হবে। নাকি বা খোনা স্বর, বিকল অঙ্গ, বিকল ইন্দ্রিয় থাকলে চলবে না। কোনও ছোটকাজ(?) করলেও চলবে না। ধৈর্যশীল, অহঙ্কারহীন, মেধাবী, যুক্তিপ্রবণ, স্মৃতিধর, উদারচেতা, শান্তিপ্রিয়, ঔদ্ধত্যহীন, লোভহীন, আলস্যহীন শিষ্যটি চিকিৎসকের বংশোদ্ভূত বা চিকিৎসাজীবিকায় জড়িত হতে হবে। আচার্যের আজ্ঞাবহ হতে হবে। ইত্যাদি ইত্যাদি। Casteism, racism-এর এই ভাবনা আজকের সময়ে কতটা প্রাসঙ্গিক ভাবা দরকার।
বিদ্যার্থীকে শিষ্যত্বে গ্রহণ করা হলে তাকে পূর্ব বা উত্তরমুখে বসে অগ্নি ও প্রাজ্ঞজনের সমীপে হোমযজ্ঞাদির মাধ্যমে কীভাবে বরণ করা হবে তার বিস্তৃত বর্ণনা রয়েছে; ও বলা হয়েছে আচার্য শিষ্যকে কী কী নির্দেশ দেবেন। যেমন: ব্রহ্মচারী জীবনচারণ, দাড়িগোঁফ রাখা, সত্যকথা বলা, মাংস না খাওয়া, পবিত্র আহার করা, শস্ত্রধারণ না করা (শল্যতন্ত্রশিক্ষা কীভাবে সম্ভব?), গুরুকে সমস্ত অর্পণ করা, পুত্রের মতো ও দাসের মতো অনুগত হয়ে থাকা, এবং আদেশ না দেওয়া হলেও গুরুর প্রয়োজনসাধনের জন্য যথাসাধ্য যত্ন নেওয়া, ইত্যাদি। (হোমযজ্ঞাদি সংস্কার ও দেবদ্বিজের পূজন সকল ধর্মাবলম্বীর আচরণীয় নয়; কৃপাণধারণ শিখদের ধর্মাচরণের অঙ্গ। তাদের জন্য চরক-শপথের বিকল্প কী?)
কৃতবিদ্য শিষ্য চিকিৎসকের বৃত্তি গ্রহণের প্রাক্কালে আচার্য শিষ্যের ভবিষ্যৎ জীবনচারণ নিয়ে কিছু গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ দিয়েছেন।
কৃতবিদ্য শিষ্যের প্রতি অনুজ্ঞা
বলা হয়েছে, চিকিৎসক হিসেবে কার্যসিদ্ধি, অর্থোপার্জন, যশোলাভ ও লোকান্তরে স্বর্গলাভে ইচ্ছুক হলেও গো-ব্রাহ্মণ এবং অতঃপর সকল প্রাণীর সুখকামনা করবে; রোগের নিরাময়ে সর্বান্তঃকরণে যত্নশীল হবে; নিজের জীবনরক্ষার স্বার্থে রোগীর অনিষ্ট সাধন করবে না; মনে মনেও পরস্ত্রী অভিগমন ও পরধনে লোভ করবে না; মার্জিত বেশ ও পরিচ্ছদ পরবে; মদ্যপান করবে না; পাপ-আচরণ করবে না ও পাপের সহায় হবে না; মনোরম, নির্দোষ, ধর্মসঙ্গত, প্রশংসনীয়, সত্য, হিতকর ও পরিমিত কথা বলবে; দেশ ও কাল বিচার করে কাজ করবে; স্মৃতিধর হবে, ও জ্ঞানার্জনের জন্য সব বিষয়ে ঔৎকর্ষ সাধন করবে। অতঃপর আরও বলা হয়েছে, রাজদ্বেষী, মহাজনদ্বেষী, বিকৃত আচরণকারী, দুষ্টস্বভাব, দুঃশীল, অন্যায় আচরণকারী, ও মুমূর্ষু ব্যক্তির চিকিৎসা করবে না। এবং স্বামী বা অধ্যক্ষের অনুপস্থিতিতে কোনও স্ত্রীলোককে ঔষধ দেবে না বা চিকিৎসা করবে না; তাদের অনুমতি ছাড়া স্ত্রীলোকের থেকে কখনও ভোগ্যবস্তু নেবে না। (রাজদ্বেষী থেকে মুমূর্ষু ব্যক্তিকে বা স্বামীর অনুপস্থিতিতে স্ত্রীলোককে চিকিৎসা না করা কতখানি মানবিক ও যুক্তিসঙ্গত?)
এরপরে আরও বলা হয়েছে, রোগীর অবস্থা জানা আছে ও রোগীর বাড়িতে ঢোকার অনুমতি আছে এমন ব্যক্তির সঙ্গে এবং পরিচ্ছন্ন পোশাকে, অবনত শিরে স্থির চিত্তে সবকিছু দেখতে দেখতে ও নিজের মনে সবটা বিচার করতে করতে রোগীর বাড়িতে প্রবেশ করতে হবে; কিন্তু, সেখানে রোগীর ব্যাধি ভিন্ন অন্য বিষয়ে মনোনিবেশ করবে না; রোগীর কুল বিষয়ে অন্যত্র কিছু বলবে না; রোগীর বা তার কোনও আত্মীয়ের প্রাণসংশয় থাকলেও তা সেখানে জানাবে না; নিজের জ্ঞান বিষয়ে অহঙ্কার প্রকাশ করবে না। আরও বলা হয়েছে, স্থিরচিত্তে আয়ুর্বেদে অভিনিবেশ করবে; অপরের প্রতি ঈর্ষাপরায়ণ না হয়ে সফল ব্যক্তির পরামর্শ নেবে; বোধসম্পন্ন মানুষ সকলকেই আচার্য মনে করেন ও মূর্খজনেই অপরকে শত্রু ভাবে তাই বুদ্ধিমান মানুষ শত্রুরও হিতকর উপযোগী উপদেশ মান্য ও পালন করে।
চরক-শপথ
এই অধ্যাপনবিধি অংশটুকুর বহুতর পরিবর্তন ও পরিমার্জন করে “চরক-শপথ” নামে সম্প্রতি এনএমসি প্রচার করেছে। যদিও একই শপথসমূহ গত কয়েক বছর ধরে ন্যাশনাল মেডিকোস অর্গানাইজেশন (এনএমও) নামে একটি আরএসএস-অনুমোদিত চিকিৎসা-ছাত্র সংগঠন প্রচার করে চলেছে। দেখা যাক সেই শপথবাক্যে কী কী বলা হয়েছে।
হিন্দি ও ইংরেজিতে প্রচারিত সেই শপথলিপিতে যা লেখা রয়েছে, তা বাংলাভাষায় তর্জমা করে বলা যাক।
বাংলায় অনূদিত চরক-শপথ
হে দ্বিজ (ব্রাহ্মণ), পূর্বমুখে বসে অগ্নি ও পণ্ডিতদিগের সমীপে আমি এই সঙ্কল্প করছি যে,
- বিদ্যার্জনকালে আমি সংযত, পবিত্র ও সুশৃঙ্খল জীবন যাপন করব। গুরুর সেবায় পূর্ণ আত্মনিবেদনের মাধ্যমে নিজেকে নিয়োজিত করব। আমার ক্রিয়াকর্ম সংরক্ষক, সেবামূলক, বিশৃঙ্খলারহিত ও অসূয়াহীন হবে। আমার আচরণ সতত ধৈর্যশীল, অনুগত, বিনীত, সুচিন্তিত, শান্ত প্রকৃতির হবে। আমার যাবতীয় প্রচেষ্টা ও সামর্থ্য কেবলমাত্র গুরুর অভীষ্ট অর্জনের লক্ষ্যেই নিবিষ্ট হবে। চিকিৎসক হিসেবে, সাফল্য-খ্যাতি-অর্থলাভে অভিলাষী হলেও, আমার অধীত বিদ্যা সর্বদা মানবহিতেই নিয়োজিত হবে।
- আমি সর্বদা, এমনকি অতীব ব্যস্ত ও অতিশয় ক্লান্ত অবস্থাতেও, রোগীদের সহায়তা প্রদানে স্বতঃপ্রবৃত্ত থাকব। কদাপি অর্থস্পৃহায় বা ব্যক্তিস্বার্থে কোনও রোগীর অহিত করব না; কোনও স্ত্রীলোক/পুরুষের প্রতি বা অপরের সম্পদের প্রতি অভিলাষ মনেও আনব না। অনৈতিকতা যেন কখনও আমার অন্তরে না আসে।
- আমার বেশভূষা মার্জিত অথচ আকর্ষণীয় হবে; ব্যক্তিত্ব হবে আত্মবিশ্বাসী ও উৎসাহব্যঞ্জক। আমি কথোপকথনে সর্বদা মিষ্ট, অবিমিশ্র, যথাযথ, মনোরম, সত্যনিষ্ঠ, হিতকর ও নম্র বাক্য ব্যবহার করব। স্থান ও কাল বিচার করে আমার পূর্বলব্ধ অভিজ্ঞতা ব্যক্ত করব।
- জ্ঞানরাজির নবতর বিকাশসমূহ আত্মীকরণে সদাপ্রয়াসী থাকব।
- আমি (বিশেষত পুরুষ চিকিৎসক হলে) কোনও রোগিনীকে তার স্বামী বা নিকটজনের উপস্থিতিতেই চিকিৎসা করব।
- কোনও রোগীকে পরীক্ষণের সময়ে আমার সিদ্ধান্ত, মনোযোগ, অনুভব কেবলমাত্র রোগনিরাময়েই নিবিষ্ট থাকবে। রোগী বা পরিজনের কোনও গোপন বিষয় প্রচার করব না।
- চিকিৎসার বিষয়ে আমার স্বাভাবিক কর্তৃত্ব থাকলেও কখনও দম্ভের সঙ্গে প্রকাশ করব না; কেননা, এর ফলে আমার নিকটজনও আঘাত পেতে পারেন।
দেখা যাচ্ছে, চরকসংহিতার মূল নির্দেশগুলিকে অনেকাংশে পরিবর্তন করে এই “চরক-শপথ” প্রণয়ন করা হয়েছে। রাজদ্বেষী থেকে মুমূর্ষু রোগীর চিকিৎসা না করার নির্দেশ অংশটি অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। এই অংশটি মানবাধিকার লঙ্ঘন করে বলে প্রবল বিতর্কের বিষয় হতে পারত। স্বামী বা নিকটজনের উপস্থিতিতেই কেবলমাত্র স্ত্রীলোকের চিকিৎসা করার নির্দেশ ও/বা শপথ সবসময়ে প্রযোজ্য কি? অনন্যোপায় হলে বিকল্প কী তার উল্লেখ নেই। ব্রাহ্মণ্যবাদী আচার-অনুষ্ঠান সকল ধর্মাবলম্বীর পক্ষে পালনীয় হতে পারে কি? চরকসংহিতায় রোগীর কুল বা বংশপরিচয় গোপন রাখার নির্দেশ রয়েছে; “চরক-শপথে” পরিমার্জন করে ব্যাপ্তি দিয়ে বলা হয়েছে রোগী ও তার পরিজনের কোনও গোপন বিষয় প্রচার না করার কথা। এইভাবে নির্দেশাত্মক অনুজ্ঞাকে সময়োপযোগী সংস্কার করে শপথবাক্য রচিত হয়েছে। কিন্তু, কেন? দীর্ঘকাল যাবৎ প্রচলিত হিপোক্রেটিক ওথ পরিহার করার কী প্রয়োজন রয়েছে? এই ওথটি সম্পর্কে আলোচনা করা যাক। তাই আগে আরেক প্রাসঙ্গিক জিজ্ঞাসা: প্রচারিত শপথলিপিতে স্বামী বিবেকানন্দের ছবি মুদ্রণের ব্যাখ্যা কী? তাঁর ভাবমূর্তির কৌশলী প্রয়োগের কারণেই?
এবার হিপোক্রেটিক ওথ নিয়ে আলোচনা করা যাক। কী ছিল তার প্রাথমিক বয়ানে? খ্রিস্টপূর্ব শেষভাগে গ্রিস দেশের কোসের অধিবাসী হিপোক্রেটেসকে আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানের জনক বলা হয়। তাঁর নামে প্রচলিত মূল শপথলিপি, কারও মতে এটি তাঁর জনৈক শিষ্যের রচিত, কেউ বলেন কোন পিথাগোরীয় পণ্ডিতের রচনা। সেই প্রসঙ্গ বর্তমান নিবন্ধের আলোচ্য নয়। মূল শপথলিপিতে বলা ছিল:
হিপোক্রেটিক শপথ: আদিরূপ
আমি নিরাময়কারী অ্যাপোলোর নামে, শল্যের দেবতা এস্ক্লেপিয়াসের নামে, তৎসহ হাইজিয়া ও প্যানাশিয়ার নামে, স্বাস্থ্যের নামে ও আরোগ্যকারী সকল ক্ষমতার নামে শপথ করছি। সকল দেব-দেবীকে সাক্ষী রেখে শপথ করছি যে,
- আমি এ শপথ ও প্রতিজ্ঞাবাণী আমার সকল সামর্থ্য ও বিচারক্ষমতা প্রয়োগ করে রক্ষা করতে প্রয়াস পাব।
- আমি আমার শাস্ত্রের শিক্ষককে (গুরুকে) সব ধরনের সম্মান প্রদর্শন করব, যেমন আমার পিতামাতাকে করে থাকি। আমি আমার জীবনকে তাঁর সঙ্গে ভাগ করে নেব এবং তাঁর সব দেনা শোধ করব। আমি তাঁর সন্তানদেরকে আমার ভাই বলে মনে করব এবং যদি তাঁরা ইচ্ছা করেন, তাদেরকে বিনা পারিশ্রমিকে এ শাস্ত্র শিক্ষা দেব। আমি আমার গুরুর কাছে যে সব বিধান, বক্তৃতা ও অন্যান্য শিক্ষা লাভ করেছি, তা সব আমার পুত্রদেরকে দান করব। আর দান করব গুরুর পুত্রদেরকে, আর যারা যথাযথভাবে শিক্ষানবিশি গ্রহণ করবে ও শপথ করবে তাদেরকে। এছাড়া আমি আর কাউকে তা দান করব না।
- আমি আমার সামর্থ্য ও বিচারক্ষমতার সব শক্তি রোগীদের সাহায্য করার ব্যাপারে প্রয়োগ করব। আমি আমার জ্ঞান প্রয়োগ করে কারও কোনও ক্ষতিসাধন করব না।
- কেউ চাইলেও আমি কাউকে প্রাণনাশক ওষুধ দেব না। আমি ও ধরনের কোনও সংবাদ পরিবেশন করব না। আমি কোনও মহিলাকে গর্ভপাত করানোর উপায় জানাব না।
- আমি আমার জীবনে ও পেশায় চরিত্রবান ও ধর্মপরায়ণ হব।
- আমি আমার শাস্ত্রের বাইরে অন্য কোনও পেশা থেকে বিরত থাকব।
- আমি যখন কোনও বাড়িতে যাব, তখন কেবলমাত্র কোনও রোগীকে চিকিৎসার উদ্দেশ্যে যাব এবং কখনওই কারও কোনও ক্ষতি করার উদ্দেশ্যে যাব না। আমি আমার সুযোগ-সুবিধাকে নারী বা পুরুষ কারও সঙ্গেই যৌন-সংযোগ ঘটানোর কাজে ব্যবহার করব না, হোক সে ব্যক্তি স্বাধীন কিংবা ক্রীতদাস।
- আমি পেশাগত বা ব্যক্তিগতভাবে যাই দেখি বা শুনি না কেন, উক্ত বিষয় প্রকাশ করব না; আমি উহার সব গোপন রাখব এবং কাউকে জানাব না।
- আমি যদি এ শপথবাণী মেনে চলি এবং এর ব্যতিক্রম ঘটতে না দিই, তবে আমি আশা করব, আমি জীবনে ও পেশায় যেন উন্নতি লাভ করি এবং সবকালের সবার মধ্যে সুনাম অর্জন করতে পারি। আমি যদি এ শপথ না মানি ও লঙ্ঘন করি, তবে আমার পরিণাম যেন অন্যরকম হয়।
এই শপথবাক্যে চিকিৎসাশাস্ত্র শিক্ষাদানের বিষয়টি নিজ ও গুরুর সন্তানের মধ্যে সীমাবদ্ধ করা হয়েছে, এবং দেবদেবীদের নামে অঙ্গীকার গ্রহণ করা হয়েছে। গর্ভপাতের উপায় না জানানোর কথা বলা হয়েছে। এ কারণে বিশ্বজুড়ে বহু বিতর্কও হয়েছে। হিপোক্রেটিক ওথ সামান্যত পরিমার্জন করে বর্তমান রূপটি প্রচলিত হয়েছে। ভারতে পূর্বতন এমসিআই ও অধুনাতন এনএমসি পরিমার্জিত হিপোক্রেটিক ওথকেই মান্যতা দিয়েছে। সেটি এখানে আলোচনা করা হচ্ছে না। কারণ, চরকসংহিতায় প্রাপ্ত অনুজ্ঞা ও হিপোক্রেটিক অঙ্গীকারের মৌলিকরূপের ভাবনা ও প্রাসঙ্গিকতাই এখানে বিবেচ্য।
যদিও মূলগতভাবে হিপোক্রেটিক ওথ ওই তিনটি বিষয়ের বিতর্ক পেরিয়ে আজও প্রাসঙ্গিক বলা চলে। চরক-নির্দেশিকার বহু অংশই তর্কাতীত নয়। আর তাই বহুল পরিমার্জনের মাধ্যমে তাকে গ্রহণযোগ্য করার প্রয়াস হয়েছে। উপরন্তু, পরিমার্জিত নির্দেশিকাগুলিকে শপথের রূপ দেওয়া হয়েছে। তার পরেও দ্বিজ, অগ্নি, পূর্বমুখী অবস্থান, হোমের উল্লেখে এই প্রচেষ্টা— হিপোক্রেটিক ওথের পরিবর্তন করে চরক-শপথ আরোপের প্রচেষ্টা— চিকিৎসাশিক্ষায় উগ্র জাতীয়তাবাদের নামে কাল্ট অফ ট্র্যাডিশনের ফ্যাসিস্ট অ্যাজেন্ডায় গৈরিকীকরণ কর্মসূচির অঙ্গ মাত্র।
সহায়ক তথ্যসূত্র:
- চরক সংহিতা, কবিরাজ ব্রজেন্দ্রচন্দ্র নাগ সম্পাদিত, নবপত্র প্রকাশন, কলকাতা, চতুর্থ মুদ্রণ, ২০১৬, খণ্ড ২, পৃঃ ১৩২-১৪৪।
- প্রাচীন ভারতে চিকিৎসাবিজ্ঞান, দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়, পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি, কলকাতা, ১৯৯৯, পৃঃ ৩০-৩৩।
- Textbook of Medical Bioethics, Attitude and Communication for Medical Students, Motilal C Tayade, CBSPD , 2020, p. 149-153.
- www.wikipedia.com