বিশ্বদীপ চক্রবর্তী
পূর্ব প্রকাশিতের পর
নোটন নোটন পায়রাগুলি
১.
সেকেন্ড সেমিস্টার শুরু হতে হতেই নিজেদেরকে বেশ সিনিয়ার মনে করছিল হীরকরা। কলেজের রোজদিনকার ছন্দে ঢুকে পড়েছে। পড়াশোনার চাপ নিলে চাপ, না হলে মৌসুমি বায়ু। অ্যানুয়াল ফেস্ট এসে পড়ায় যাও বা একটু আধটু পড়াশোনা চলছিল সেটাও মাথা উঠল। ইঞ্জিনিয়ারিং ফ্যাকাল্টির কালচারাল ফেস্টিভাল সংস্কৃতি। সেটা নিয়ে এখন খুব মাতামাতি। মনীষ সংস্কৃতির অর্গানাইজেশান কমিটিতে। ব্যাস্ত সমস্ত হয়ে সারা ক্যাম্পাস চষে বেরাচ্ছে। অবশ্য মনীষ তো শুধু নিজের কলেজের অনুষ্ঠান নয়, মোটামুটি অন্য সব কলেজের প্রোগ্রামেও হাজিরা দেয়। সে প্রেসিডেন্সি কলেজ হোক কিংবা ক্যালকাটা মেডিক্যাল। সেন্ট জেভিয়ার্সের জাভোৎসবে গিয়েও তো দুদিন পড়ে রইল। যদিও একই ঘরে থাকে, রাত দশটার আগে হীরক আর অনিকেতের সঙ্গে মনীষের মোলাকাত খুব কম।
কোথায় থাকিস তুই সারাদিন? সেই যে ফার্স্ট সেশানটা করলি সকাল বেলা, তারপর আর দেখাই পেলাম না তোর? পরের দিন ক্লাস টেস্ট আছে। হীরক টেবিলে মাথা গুঁজে পড়ছিল। মনীষ ফিরতে ঘাড় ঘুরিয়ে বলল।
আরেক টেবিল থেকে ল্যাম্পের হলুদ আলোর ঘেরাটোপের বাইরে এসে ফোঁড়ন কাটল অনিকেত। চোখের মোটা কাঁচের চশমার পিছনে জুলজুল করছে চোখ। ইদের চাঁদ। দেখা গেলে নিউজ চ্যানেলে ওটাই খবর।
খেয়েছিস? দশটা তো বেজে গেছে, মেস তো বন্ধ।
আমার তো স্ট্যান্ডিং ইন্সট্রাকশান আছে। আমার জন্য প্লেটে তুলে রাখে। এই তো আলুর ঘ্যাঁট আর চিকেনের নলি দিয়ে ভাত খেয়ে ঢেঁকুর তুলতে তুলতে আসছি।
তোর আর খাওয়ার কি দরকার? রোজ রোজ নতুন মাল নিয়ে ঘুরছিস, ওতেই তো পেট আঁইঢাঁই, বল? কি করে পারিস রে? অনিকেত অনেকক্ষণ ধরে ক্লাস টেস্টের প্রিপারেশান নিচ্ছিল। মনীষকে কাঠি মেরে মাথাটা হালকা করার ইচ্ছায় বই বন্ধ করে বিছানায় আস্তানা গাড়ল।
মনীষ খুব বিরক্ত হয় এসব কথায়। তোরা এত ফ্রাস্টো কেন বল তো? মেয়েদের সঙ্গে ঘুরছি মানেই মাল নিয়ে ঘুরছি। কোন ক্লাসে পড়িস বল তো তোরা?
সে তুই রাগ কর কি খিস্তি দে, ট্রুথ কান্ট বি হিডেন। দিন নেই রাত নেই খাপচু মেয়েরা এসে তোর জন্য গেস্ট রুমে তা দিচ্ছে, সবাই তো দেখছে বাবা।
গেস্ট রুমেই তো এসেছে, বেড রুমে তো আর না। অনিকেতের কথা উড়িয়ে দিয়ে নিজের দেরাজের পাল্লার আড়ালে জামা প্যান্ট ছাড়তে গেল মনীষ।
সব কিছুর জন্য কি বেড রুম লাগে? সত্যি করে বল, চুমু তো সিওর খেয়েছিস।
মুচকি হাসল মনীষ। হস্টেলের যা বাজে খাবার দেয়, কিছু তো খেতে হবে।
এবার হীরকের চোখ গোলগোল হয়ে গেল। সত্যি মনীষ, তুই চুমু খেয়েছিস? কাকে? প্রমিতাদি?
মনীষ একটু ইতস্তত করল। শর্টসে পা ঢুকাতে ঢুকাতে বলল, এরকম করে কি ঢাক পেটাবো না কি? তাছাড়া কতজনের নাম বলবো বল তো? চুমুতকার লাইফ!
মনীষ এই বড়াইটা না করলেও পারত। অনিকেত শুনেই এক লাফে হস্টেলের বারান্দায়। মনীষ চুমু খেয়েছে, মনীষ চুমু খেয়েছে।
যাত্তারা, এই মালটা তো পুরো খেপে গেল।
অনিকেতের এহেন ঘোষনায় সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন রুম থেকে পাজামা গুটাতে গুটাতে ছেলেরা হাজির। কি করেছো গুরু, যত্রতত্র মেয়েদের হামি খাচ্ছ।
পাশের রুমের সুবোধকান্তি সহায় মেকানিক্যাল সেকেন্ড ইয়ার। ওদের ব্র্যাঞ্চে কোন মেয়ে নেই বলে সব সময়ে একটা নেই নেই ভাব। সে একেবারে সাষ্টাঙ্গ প্রনাম। ও গুরু পায়ের ধুলো দাও, একটু জিভে লাগালে যদি ভাগ্য ফেরে।
হস্টেলে একটা হিড়িক উঠলে সবাই একবার চক্কর কেটে যায়। সবার সামনে মনীষ বিব্রত বোধ করছিল। ঘর ফাঁকা হাতে একটু রেগে গিয়েই হীরক আর অনিকেতকে বলল, তোদের যদি প্রেম করবার এত ইচ্ছা তাহলে কেন বসে বসে আঙ্গুল চুষছিস, ব্যাট করতে নেবে পড়। বাইরে সুবিধা করতে না পারলে ক্লাসের মধ্যেই তো আছে।
কে বিজু না সিমি? তুই ক্লাসে আসিস না বলে জানিস না। সেমন্তী তো শুরু থেকেই কুনালের সঙ্গে ফিট।
আর বিজু?
ওরেব্বাস, ওই খেপীর সঙ্গে কে লাইন মারবে? ও মেয়ে কোন কম্পানির সিইও হওয়ার আগে কোন ছেলের দিকে চোখ তুলে তাকাবে বলে মনে হয় তোর?
তার মানে অনিক, তোর বিজুর উপর একটা ব্যাথা আছে বল। ছিপ ফেলেছিলি, গাঁথেনি। তবুও ইঁট পেতে রেখেছিস। হীরক হাসতে হাসতে বলল।
আমার খেয়ে দেয়ে কাজ নেই, ওই খান্ডারনির সঙ্গে প্রেম করতে যাবো। প্রেম করতে হলে সোজা চলে যাবো ব্রিজের ওপারে।
আর্টসে? চলে যা না, একদিন কম্প্যারাটিভ লিটারেচারের ক্লাসে ঢুকে বসে পড়।
অভিমন্যুর মত সপ্তরথিনীর কাছে বধ হতে? পাগল না পায়জামা?
তুই তো শালা বধ হবার ইচ্ছায় অবলা ছাগশিশুর মত ঘুরে বেড়াচ্ছিস। তবে ওরকম করার দরকার নেই। তুই সংস্কৃতির ভলান্টিয়ার হয়ে যা। আমি তোদের ফিট করে দিচ্ছি গানের কম্পিটিশানে, করবি কি না বল।
এবার হীরক আর অনিকেতের পেছোবার পালা। আরে ধুর, তুই তো সিরিয়াস হয়ে গেলি একদম। ক্লাস কেটে এইসব করবো না কি? তাছাড়া আমরা গানের কি বুঝি?
আহা বোঝাবুঝির কি আছে? তোরা তো সবার নামটাম লিখবি, মার্ক্স ট্যালি করবি। দ্যাখ কিরকম একটা চান্স দিচ্ছি, প্রথমেই মেয়েদের নাম জেনে যাবি। তারপর শুধু খেলিয়ে তোলার যা অপেক্ষা।
হবে না। ক্লাস মিস হয়ে যাবে রে।
আহা, দুদিন ক্লাস কাটলে কি হয়? প্রেম করতে হলে এরকম কত ক্লাস কেটে মাঠে বসে ঘাসের শিষ চিবুতে হবে বল তো? আমাকে দ্যাখ। আমি কটা ক্লাস করেছি ফার্স্ট সেমিস্টারে? কোন সাবজেক্টে টপকালাম?
তুই বাড়া চোতা মারায় এক্সপার্ট, এছাড়া তোকে নোটস দেবার জন্য মেয়েদের লাইন লেগে আছে। আমাদের তো আর সেটা নেই।
আরে দুদিনে কি হয়ে যাবে? মিউজিকেরটায় আমার দায়িত্ব, যথেষ্ট ভলান্টিয়ার হয় নি। প্লীজ। প্রেম করতে হবে না, আমাকে হেল্প করার জন্য তো আয়।
অনিকেত তবু রাজী হল না। হীরক কিছুক্ষণ তানা নানা করে নিমরাজী হল। মনীষ কাঁধ চাপড়াল। দেখিস পস্তাবি না একদম, সারাক্ষণ ক্লাসে বসে থেকে কি হয়? কলেজে আসার আসল মজাই তো ক্লাস বাঙ্ক মারা। এবারে আমাকে কালকের টেস্টের ফান্ডাগুলো একটু বুঝিয়ে দেতো ছোট করে, তারপর কিছুক্ষণ বই নিয়ে বসবো। পুরোটা চোথা করতে ভাল লাগছে না আর।
রাজী হয়ে কাজটা ভাল হল কি খারাপ সেটা হীরক জানে না। হীরকের সঙ্গে রেজিস্ট্রেশান কাউন্টারে বসেছে আর একজন। পিয়ালিদি। আর্কিটেকচার, থার্ড ইয়ার। বেশ মজারু টাইপ। শুরুতেই জিজ্ঞেস করল, তুই গানটান গাস?
জানতে লাগবে নাকি? আমি মনীষকে বলেছিলাম আমি গান সেরকম বুঝি না, এই কাজে আমাকে লাগাস না।
আরে না, না। গান গাইতে না জানাটা তোর কোয়ালিফিকেশান। আমি একটু সিওর হয়ে নিতে চাইছিলাম। গতবারও আমি এই কাজে ছিলাম। আমার সঙ্গে একটা ছেলে ছিল, বিতান। ভিতরে উঁকি মেরে দুজনের গান শুনেই ওর বুক চিতিয়ে উঠল। হাম কিসিসে কম নাহি। আম্মো গানা গায়েগা। নিজের নাম রেজিস্টার করে ফিল্ডে নেবে গেল। তারপর আমাকে পুরো একা সামলাতে হয়েছে। হাসিতে ভেঙ্গে পড়ল পিয়ালিদি। হাসলে গালে টোল পড়ে পিয়ালিদির। বারবার হাসির কথা বলায় গালের টোলটা সেমি-পারমানেন্ট। কাজটা হীরকের ভাল লাগতে আরম্ভ করল।
পিয়ালিদি সোদপুরে থাকে। কাগজপত্র গুছিয়ে বসেই একটা টিফিন বাক্স খুলল। এরপর আর খাওয়ার সময় পাওয়া যাবে না, এই বেলা মেরে দিই। সকালে কিছু খেয়েছিস?
ব্রেড আর ডাবল ডিমের অমলেট।
তোদের মেসের রুটিন খাবার। খেয়ে নিশ্চয় পেটে চরা পড়ে গেছে। এইটা খা, ঝাল সুজি। হস্টেলে থাকিস তো, বাড়ির স্বাদ পাবি।
তাহলে তুমি কি খাবে?
আহা, আধাআধি খাবো। আমার আরও অনেককিছু স্টকে আছে। আমার মাটা খাওয়াতে হেব্বি ভালবাসে, রোজ ভোরবেলা উঠে আমার জন্য তিন রকমের টিফিন বাক্স বানিয়ে দেয়। দেখছিস না আমার চেহারাটা? নিজের মোটাসোটা চেহারার দিকে আঙ্গুল দেখিয়ে হা হা করে হাসল পিয়ালি।
যত দেখছিল মেয়েটাকে মনে ধরছিল হীরকের। রূপার থেকে বয়েসে একটু ছোট, কিন্তু সেইরকম দিদি দিদি ভাব। বলেও ফেলল সেটা। তোমাকে ঠিক আমার দিদির মত লাগছে পিয়ালিদি। আমাকে না দিয়ে দিদিও কিচ্ছু মুখে দেয় না।
পিয়ালিদি এবার ছদ্মরাগে ওর থুতনি ধরে নাড়িয়ে দিল। সোনাভাই আমার! দিলি তো প্রথমেই কেঁচিয়ে? তোদের এই বোন আর দিদি পাতানোর জ্বালায় পিয়ালি মিত্র এই তিন বছরে একটা লাইন মারতে পারল না। হয় বোন নয় দিদি। এই করে করে আমি এখন ভাইফোঁটায় সতরঞ্চি পেতে ফোঁটা দিই, অত আসন পাবো কোথায়?
পিয়ালিদির বলার স্টাইলটাই এমন। আর তেমনি রসিকতা বোধ। বোর হবার কোন চান্স নেই।
ছেলে মেয়েরা আসতে শুরু করেছিল। কলকাতার অনেক কলেজ থেকেই আসছে। সবার যে আগে থেকে নাম লেখান আছে তাও নয়। সুতরাং হীরক আর পিয়ালি খুব ব্যাস্ত হয়ে পড়ল। সবার নাম ঠিকানা কলেজের নাম লিখে একেকটা নাম্বার লেখা ট্যাগ হাতে ধরিয়ে দেওয়া। ঘাড় গুঁজে লিখছিল এইসব, হঠাত চিত্ররেখা ঘোষ নামটা শুনে চমকে উঠল। মুখ তুলে দ্যাখে কমলা রঙ্গের একটা শান্তিনিকেতনী ব্যাগ কাঁধে, সবুজ শাড়িতে রেখা দাঁড়িয়ে আছে পিয়ালিদির সামনে। বুকের কাছে জড়ো করা হাতে একটা ডায়েরী। রেখাকে ছোটবেলায় কখনো সখনো শাড়িতে দেখেছে হীরক। স্বরস্বতী পূজায় কিংবা রবীন্দ্র জয়ন্তীতে। কিন্তু বড় হবার পর আর না। আসলে রেখাকে গত দু বছরে আর দেখল কোথায়? চোখ ফেরাতে পারছিল না।
রেখা তুই?
আরে হীরু? অনাবিল হাসিতে মুখ ভরে গেল রেখার। কতদিন বাদে রে? তুই যেন আমাদের ভুলেই গেছিস, আর আসিস না তো আমাদের বাড়িতে।
আচ্ছা, তুই যেন দুর্গাপুরে ছিলি!
কেন আমি না থাকলে আমাদের বাড়িতে আসা যায় না? মা বলছিল। লেখাও তোর কথা বারবার জিজ্ঞেস করে।
হীরক এবার লজ্জা পেলো। আসলে এখন আমিও তো এইখানে।
সেটা মার কাছে শুনেছিলাম। তুই তো এখানে ইলেক্ট্রনিক্সে, তাই না? মনীষও আছে শুনেছিলাম। ইকনমিক্সে দেবাঞ্জন। তোরা অনেকেই এখানে। দেখছিস তো, সব খবরই রাখি।
তুই এখন কোথায় পড়ছিস রেখা?
বেথুন। ইংলিশ। তুই এখানে আছিস তো, শেষ হলে কথা বলবো। আবার হেসে নাম্বার ট্যাগ নিয়ে এগিয়ে গেল রেখা। ওর সঙ্গে আরও দুই বন্ধু। মেয়ে। তিনজনে হাহা হিহি করতে করতে চলে গেল।
রেখা হাসলে যেন চারদিকে পাঁচশো ওয়াটের আলো জ্বলে ওঠে। আর সেটা এসে পড়েছিল হীরকের মুখে। কিন্তু ও যে এমন উপর উপর কথা বলে চলে গেল সেটা ভেবে আবার দপ করে বুঁজেও গেল সেই আলো।
রেখা ভিতরে ঢুকে যাওয়ার পর সেটাই বলেছিল পিয়ালিদি। তোর মুখটা যেমন চমকাল, তারপরেই আমসি। কোন কেস আছে মনে হয়? লেঙ্গি খেয়েছিলি?
লেঙ্গি না অন্য কিছু জানে না হীরক। শুধু জানে যার সঙ্গে একসময় অনায়াসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা টুকিটাকি কথা বলে কাটিয়ে দেওয়া যেতো, আজ তার সঙ্গে কি করে আবার কথা শুরু করা যায় সেই পথটাই যেন হারিয়ে গেছে। মুখে বলল, ধ্যাত কি যে বলো। ছোটবেলা থেকে এক পাড়ায় থাকি। ও কলকাতায় পড়তে চলে এসেছিল বছর দুয়েক আগে, তারপর আর দেখা ছিল না।
হ্যাঁ হ্যাঁ বুঝেছি মনু। আমরা দুজন একটি গাঁয়ে থাকি, এই আমাদের একটি মাত্র সুখ, তাদের গাছে গায় যে দোয়েল পাখি তাহার গানে আমার নাচে বুক। তুমি পিয়ালির চোখকে ফাঁকি দেবে অত বড় ডুব সাঁতারু এখনো হওনি চাঁদু।
সত্যি বলছি, সেসব কিচ্ছু না। ওর জন্য অন্য কেউ আছে। তবে দোয়েল পাখি না, ওর নিজের গলাই খুব ভাল।
বুঝেছি, তাতেই তোর বুক নেচে ওঠে। শোন মেয়েটা চাবুক। একটা কেন, ওর জন্য দশটা ছেলেও থাকতে পারে। তাই তোকে পাত্তা দেবে কি না জানিনা, কিন্তু লজ্জা শরমের তোয়াক্কা না রেখে বডি ফেলে দে। বেশীরভাগ রেজিস্ট্রেশান তো হয়ে গেছে, কম্পিটিশান শুরু হল বলে। তুই ভিতরে গিয়ে একটু লাইন মারার চেষ্টা কর, আমি এদিকটা সামলে নেবো।
হীরকের খুব ইচ্ছা করছিল। কিন্তু লজ্জা লাগছিল। এইভাবে পিয়ালিদিকে ফেলে ঢুকে যাবে?
যা না, তোকে ভাই ফোঁটা যখন দেবোই ঠিক করেছি তাহলে আমি এখানে বসে দিদির কাজটা করি, তুই নিজের তদ্বির কর গিয়ে।
পিয়ালিদিটা সত্যিই খুব সুইট। ভাবতে ভাবতে আর লজ্জা না করে ওদিকেই হাঁটা দিল হীরক।
ভিতরে বেশ ভিড়। মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিঙের একেকটা ঘরে প্রায় দুশো স্টুডেন্ট এঁটে যায়। সেটাও টইটম্বুর। অবশ্য এর মধ্যে অনেকেই প্রতিযোগী। বিচারক তিনজনকে চেনে না হীরক। একেকজন গাইবার আগে যেভাবে তাদের দিকে তাকিয়ে প্রনাম ঠুকছে, নামজাদা কেউ থাকতে পারে। মনীষ এর মধ্যে ব্যাস্ত সমস্ত হয়ে ঘুরে বেরাচ্ছে। মাঝে মাঝে বিচারকদের কানের কাছে গিয়ে ফুসুর ফুসুর করে আসছে। কিন্তু হীরকের চোখ খুঁজছিল রেখাকে। তিন নম্বর সারির একদম কোনায় বসে থাকতে দেখল রেখাকে। খুঁজে পেতেই বুকটা ধক করে উঠল হীরকের। একমনে গান শুনছে। কিংবা এভাবেই হয়তো ফোকাস করছে নিজেকে। মাথা নীচু করে সামনের সারিটা ক্রস করতে পারলেই রেখার কাছে পৌঁছে যাওয়া যায়। কিন্তু এখন যাবে না হীরক। বরং দূর থেকেই দেখবে এখন। ওর নাম কখন আসবে কে জানে। দুম করে এখন কথা বলতে গিয়ে ওর মনঃসংযোগ নষ্ট করে লাভ নেই। আর এইখানে তো সেভাবে কথা বলাও যাবে না। রেখার পাশে ওর সেই দুই বন্ধু। নিশ্চয় ওর কলেজের। ওদের সামনে হুট করে কিই বা বলা যাবে। গান হয়ে গেলে না হয় একবার চেষ্টা করবে।
কেউ টানা তাকিয়ে থাকলে মেয়েরা ঠিক বুঝতে পারে। রেখা হঠাত চমকে চোখ তুলে তাকাল। চোখ একদম সোজা দরজার কাছে দাঁড়ানো হীরকের উপর। চোখে প্রশ্ন। ভুরুটা কুঁচকে উঠতে গিয়েও আবার সমান হয়ে গেল। কি করবে হীরক? হাসবে? ও থতমত খেয়ে নিজের বুড়ো আঙ্গুল উপরে তুলে থাম্বস আপ দেখাল।
রেখার মুখ এবার হাসিতে ভরে গেল। চারিদিকে আবার পাঁচশ ওয়াটের আলো।
রেখা ওর হাত দেখাল, তর্জনী ঘুরিয়ে কিছু একটা বোঝাতে চাইছে। কি বলছে রেখা? এবার ঠোঁট সরু করে কি একটা নিঃশব্দে বলল। সেটাও মাথায় ঢুকল না। কিছু একটা বলতে চাইছে। কি করবে এখন হীরক? যা থাকে কপালে ভেবে পিঠ বেঁকিয়ে ঘাড় নিচু করে সামনের সারির সকলের হই হই উপেক্ষা করতে করতে এক ছুটে তিন নম্বর সারিতে লাফ দিয়ে উঠে এলো। ভাগ্যিস রেখা একদম কোনায় বসেছে। আসলে গাইতে যেতে সুবিধা হবে বলেই বোধহয়। রেখা হাসছিল। হীরক হ্যা হ্যা করে হাঁফাচ্ছিল। রেখা ওর বাঁ হাতের পাতা দিয়ে ওকে নিচু হতে বলল। হলুদ রঙ্গের নেলপলিশ লাগানো রেখার আঙ্গুলগুলো যেন শিল্পীর একগোছা তুলি। হীরকের বুকে রং মাখিয়ে দিচ্ছে। হীরক মাথা নীচু করে কানটা একদম নিয়ে গেল রেখার মুখের কাছাকাছি। এখন ও রেখার শরীরের গন্ধ পাচ্ছে। কি পারফিউম মেখেছে কে জানে? মাথাটা কেমন ঝিম ঝিম করছিল হীরকের। রেখা ফিসফিস করে বলল, তুই কি গরু রে। তখন থেকে বলছি গানের পরে থাকিস, কথা বলবো!
শুধু তর্জনী দিয়ে কি করে এতগুলো কথা বলে থাকবে হীরক জানে না। অন্তত এরকম সাঙ্কেতিক কথা বোঝার ক্ষমতা তার নেই। তার জন্য যদি সে রেখার গরু হয়, মন্দ কি। পিয়ালিদির বলা কবিতার লাইনদুটো মাথায় ফিরে এলো- আমরা দুজন একটি গাঁয়ে থাকি, সেই আমাদের একটি মাত্র সুখ।
সুখ বোধহয় এরকমই হয়। রেখার সঙ্গে কথা বলার সুযোগ হয়েছে পিয়ালিদিকে এই সুখসংবাদটা দেবার জন্য ছটফট করতে করতে আবার গুঁড়ি মেরে সবার গালি খেতে খেতে সামনের রো-টা পার করল হীরক।
২.
দরজা পার করার আগেই শুনল চিত্ররেখা ঘোষের নামের ঘোষণা। ওখানেই দাঁড়িয়ে পড়ল হীরক। রেখা গ্যালারি দিয়ে এক এক ধাপ করে নেবে আসছে, হীরকের চোখ ওর প্রতিটা পদক্ষেপ অনুসরণ করছে। ভালবাসায় এতো কষ্ট! এতো আনন্দ!
রেখা মঞ্চে এসে হাঁটু গেড়ে বসল। আলগোছে নমস্কার করে হারমোনিয়ামটা টেনে নিল। চোখ বুঁজে গাইতে শুরু করতেই হীরকের চতুর্দিক রেখাময়।
আমার হিয়ার মাঝে লুকিয়েছিলে দেখতে আমি পাইনি।
তোমায় দেখতে আমি পাই নি।
বাহির-পানে চোখ মেলেছি, আমার হৃদয় পানে চাই নি।
প্রতিটা শব্দ যেন তাকে উদ্দেশ্য করেই গাওয়া, এরকমটা মনে করতে ভাল লাগল হীরকের। রেখা কি তাদের কথাই বলছে এখানে? হীরক জানে এটা একটা কম্পিটিশান, রেখা এই গানটা আগের থেকে বেছে নিয়েই এসেছে। ও তো জানতোও না যে হীরক এখানে থাকবে। তবু, এটা নেহাতই একটা কোইন্সিডেন্স হতে পারে না। আর হলেও এতো ভাল কোইন্সিডেন্স হোক বারবার। কি এক অদ্ভুত আবেগে ভেসে যাচ্ছিল হীরক। রেখার সুরের আবেশ ওকে জড়িয়ে ধরেছিল।
আমার হিয়ার মাঝে লুকিয়েছিলে দেখতে আমি পাইনি।
তোমায় দেখতে আমি পাই নি।
আমার সকল ভালবাসায় সকল আঘাত সকল আশায়
তুমি ছিলে আমার কাছে, তোমার কাছে যাই নি।
মাই গড! এই গানটা আগেও তো কতবার শুনেছে! অথচ আজ যেন মনে হচ্ছে এই গানটা তাদের কথা ভেবেই লেখা। রেখা কি বলতে চাইছে? যখন শানুর সঙ্গে ওর ছাড়াছাড়ি হয়ে গেল, সবাই রেখার নামে নোংরা কথা বলছিল রেখা তাকেই পাশে পেতে চেয়েছিল? কেন একবার বললি না রেখা?
হীরক আপ্লুত হয়ে দাঁড়িয়েছিল। গান শেষ হয়ে গেছে, অথচ একটুও নড়তে পারে নি। ওর সামনে এই হলঘর, গ্যালারি, চারদিকে এতো লোকজন। সব যেন থেকেও নেই। চোখের সামনে এখন ছোটবেলার হীরক আর রেখা খেলছে, হাসছে, ছুটছে। এটা কি কোন সংকেত? রেখা কি তাকে কিছু বলতে চাইছে? ওর কি রেখাকে কিছু বলা উচিত?
অ্যাই! পিঠে রেখার এক চাপড়।
হীরকের তখনো ঘোর কাটেনি। ফ্যালফ্যাল করে চেয়েছিল।
একি রে? কি এমন ভ্যাবলার মত দাঁড়িয়ে আছিস আসা যাওয়ার পথের মাঝখানে? রেখার গলার হালকা চালে বলা কথাগুলো হীরকের মনের স্বপ্নকল্পনা একদম চুরচুর করে ভেঙ্গে দিল।
তুই কি এখন চলে যাবি না কি?
না,না। এখুনি যাবো না। এতদিন বাদে তোকে হাতের কাছে পেয়েছি, একটুতো পিছনে লাগা পাওনা আছে তোর।
বড্ড ভাল গেয়েছিস রেখা। বলেই কথা হারিয়ে গেল হীরকের। বলতে চেয়েছিল, মনে হচ্ছিল যেন আমাদের কথা বলছিস। তুই কি আমার কথা ভাবছিলি রেখা? তুই কি আমার কথা ভাবিস? এখনো?
রেখা ওর গভীর কালো চোখের ছায়া হীরকের মুখে ফেলে দাঁড়িয়েছিল। দেখাবি না তোর ক্যাম্পাস?
হ্যাঁ, হ্যাঁ নিশ্চয়। কোথায় যাবি বল? কিন্তু তোদের একটা ফাইনাল হবে তো। সেটা কখন?
আহা আগে দ্যাখ, আমাকে ফাইনালে তোলে কি না। কত ভাল ভাল গাইয়ে এসেছে।
তোর চাইতে ভাল কেউ গাইছে না রেখা। তুই ফার্স্ট হবি।
হাসির কলস্রোত বয়ে গেল। বাঁ হাতের তিনটে আঙ্গুল ঠোঁটের সামনে এনে হাসি আড়াল করার ব্যার্থ চেষ্টার কোন ত্রুটি ছিল না। ভাগ্যিস তোকে জাজ বানায় নি। নেপোটিজম আটকান যেতো না।
দাঁড়া, আমি এক মিনিট দেখে আসছি, ফাইনাল কখন হবে।
রেজিস্ট্রেশান টেবিলে পিয়ালিদি তখনো বসে। এতক্ষণে পাশে আর একজনকে জুটিয়ে নিয়েছে। হীরককে দেখেই একগাল হাসল। হাঁটার কায়দা দেখেই মনে হচ্ছে কেল্লা ফতে করে দিয়েছিস। ঠিক কি না বল।
পাশের মেয়েটি জিজ্ঞাসু চোখে ঘুরে তাকাল পিয়ালিদির দিকে। আহা, এসব আমাদের দিদি ভাইয়ের খবর, তোকে দেওয়া যাবে না। তারপর হীরক, বল সেই মক্কেল কোথায়? এখুনি তো দেখলাম হাতে হাত দিয়ে যুগলে বেরিয়ে যাচ্ছিলি।
হাতে হাত মোটেই ছিল না। কিন্তু হীরক সেই কথার প্রতিবাদে গেল না। আসলে ভাবছিলাম ওকে একটু ক্যাম্পাসটা দেখিয়ে আনবো। ফাইনাল কখন জানো?
তার এখনো দেরী আছে তো। অন্তত আরও জনা পঁচিশ গাইয়ে আছে। ঘণ্টা দেড়েক লাগবে। তার মধ্যে চলে আসবি তো? ওই সময়ে আমাদের তিন বিচারকের মার্ক্স ট্যালি করিয়ে পাঁচজন ফাইনালিস্টের লিস্ট বানিয়ে দিতে হবে।
নো প্রবলেম। অতক্ষন লাগবেই না আমার।
লাগবে না! মুখ ভেঙ্গানোর ভঙ্গি করল পিয়ালি। মজা করেই। জানি না যেন। এখন তোকে চব্বিশ ঘণ্টা সঙ্গে থাকতে বললেও পিয়ালিদির কথা মনে থাকবে না তোর। পিয়ালি এমন ভাবে কথা বলে যেন কত যুগের চেনা। পাশের মেয়েটিকে দেখিয়ে পিয়ালিদি বলল, সুভদ্রাকে বসিয়ে রেখেছি এখন, কিন্তু ওকে আবার একটু বাদেই যেতে হবে। আমার কপাল দ্যাখ সুভদ্রা। গতবার আমার সঙ্গে যার বসার কথা ছিল, সে নিজেই বুক ঠুকে গান গাইতে নেবে গেল। এবার প্রথমেই হীরককে জিজ্ঞেস করলাম তুই গানটান গাস না তো? এখন দ্যাখ, এক গায়িকা জুটিয়ে উনি চললেন।
সুভদ্রা খিলখিল করে হেসে উঠতেই লজ্জায় কান লাল করে হীরক সেখান থেকে হাওয়া।
ফিরতে ফিরতে দেখতে পেলো রেখার সঙ্গে মনীষ। মনীষ হাত পা নেড়ে নেড়ে কথা বলছিল। হীরককে আসতে দেখেই সোল্লাসে চেঁচিয়ে উঠল। দেখেছিস হীরু, এখানে আজ দুর্গাপুরের জয় জয়কার। রেখা কি ফাটাফাটি গাইল ভাবতে পারবি না। তুই তো রেজিস্ট্রেশানে বসেছিলি, মিস করে গেলি।
রেখা লাজুক হেসে বলল, মনীষ তুই এমন ভাবে বলছিস যেন আমি ফাইনালে পৌঁছে গেছি।
যাবিই তো। এত ভাল গেয়েছিস। হাসতে হাসতে চোখ টিপল মনীষ। তাছাড়া আমি এটা রান করছি, হীরক মার্ক্স ট্যালি করবে। দরকার হলে একটু জল মিশিয়ে দেবো না হয়।
কক্ষনো না। ফুঁসে উঠল রেখা। এরকম একদম করবি না হীরু। আমি তাহলে কোনদিন তোদের সঙ্গে কথা বলবো না।
আরে আরে তুই তো একদম সিরিয়াস হয়ে গেলি রেখা। I was simply joking. সত্যিই তুই খুব ভাল গেয়েছিস, কোন কথা হবে না। একদম সুপার্ব। আমি তো গাইবো ভেবেছিলাম, নাম উইথড্র করে নিলাম তোর গান শোনার পর। গলতার কোন দরকারই হবে না। মেয়েদের কিভাবে কথার ফাঁকে তোল্লাই দিতে হয় সেটা মনীষের থেকে কেউ বেশী জানে না। কিন্তু এবার ব্যাস্ত হয়ে পড়ল মনীষ। তোরা কথা বল, আমাকে আবার ভিতরে যেতে হবে।
উফ মনীষটা না! খুব ভাট বকে। সব সময় বারফাট্টাই।
কেন কি করেছে? তোর গুণগান করছিল দেখলাম খুব। কোন কারনে রেখা মনীষকে সহ্য করতে পারে না। সাধারণত মেয়েমহলে মনীষের খুব খাতির। রেখা ব্যাতিক্রম মনে হচ্ছে।
দ্যাখ না, এতদিন বাদে দেখা। শুধু নিজের কথা। এই কদিনেই ও কেমন পুরো যাদবপুর জিতে নিয়েছে, ওকে ছাড়া তোদের সংস্কৃতি অন্ধকার এই সব কথা দু মিনিটে বুঝিয়ে দিল। এসব ছেলেদের আমি একদম নিতে পারি না। রেখার বিরক্তিটা খুব একটা চাপা ছিল না।
ও তো এখন আবার আমার রুমমেট। হাসতে হাসতে বলল হীরক।
ওরে বাবা! সহ্য করিস কি করে?
খুব একটা দেখা পাই না ওর। যাকগে কোথায় যাবি বল? ফাইনাল হতে এখনো ঘণ্টা দেড়েক আছে।
আহা, এটা তো আর তাজমহল বেড়াতে আসি নি! তোদের ক্যাম্পাসে কি দ্রষ্টব্য আমি কি করে জানব। আর যাই করিস তোদের মেনফ্রেম কম্পিউটার দেখাতে নিয়ে যাস না আবার। আমার ওসবে একবিন্দু ইন্টারেস্ট নেই।
সেটা তো আমরাই দেখতে পাই না রে। সকাল বিকাল শুধু পাঞ্চ কার্ড জমা করে দিই, ওইভাবেই রেজাল্ট হাতে পাই। দরজা থেকেই নগদ বিদায়। চল, বরং আমার ক্লাসটা দেখবি? অবশ্য তোর যদি কোন ইন্টারেস্ট থাকে তো।
এখন কি তোদের ক্লাস চলছে নাকি?
এই দুদিন কোন ক্লাস নেই, ফাঁকা। দাঁত বের করে হাসল হীরক। না হলে ওদিকের ধারকাছ দিয়েও মারাতাম না। আমাদের ক্লাসে বিজু বলে একটা মেয়ে আছে জানিস। খুব ডাকসাঁইটে। দেখলেই হিড়হিড় করে ক্লাসে টেনে নিয়ে যাবে। চাই কি তোকেও নিতে পারে, ক্লাসে লোক বাড়ানোর জন্যে।
ওরে বাবা, তাহলে তো গেছি। তা এই বিজু না কে, তোর খুব বন্ধু বুঝি?
বন্ধু, হ্যাঁ বন্ধুই তো। এক ক্লাসে পড়ি।
ভাল, দুই ইঞ্জিনিয়ারে প্রেমটা ভাল জমবে।
ধ্যাত, সেরকম বন্ধু নাকি? ওরে বাবা, তুই তো দেখিস নি ওকে। এমনিতে খুব ভালো, কিন্তু পড়াশোনা নিয়ে ভীষন সিরিয়াস।
আর তুই? তুই বুঝি সিরিয়াস নোস? বইয়ে নাক গুঁজে কাটিয়ে দিলি সারাটা জীবন। তোকে চিনি না আমি?
এখন আর না। মনে মনে বলল, এতই চিনিস যদি তুই, তাহলে জানতিস আমার মনের কথা। সেটা বুঝে নিয়ে হ্যাঁ বলে দে না রে রেখা।
তার মানে এখানে এসে পড়াশোনা লাটে তুলেছিস। ছদ্মকোপে ভুরু কুঁচকাল রেখা।
এবার তুই সত্যি চাটছিস। সব মেয়ের মধ্যেই যদি একটা বিজু ঘাপটি মেরে বসে থাকে তাহলে তো মহা মুশকিল।
না রে তোর মধ্যে একটা বয়ে যাওয়ার টেন্ডেন্সি আছে। হস্টেলে আছিস, যাদবপুরের ছেলেমেয়েদের এমনিতেই বেশ দুর্নাম। সবার সঙ্গে বসে গাঁজা চরস খেতে শুরু করে দিলি হয়তো। কাকু কাকিমার কি দশা হবে বল তো?
এগুলো ফালতু কথা। এরকম কেউ অতসব খায় না।
তুই কি হাবা রে? তোদের গেট পেরোনোর পরেই গাঁজার গন্ধ আমার নাকে এসেছে। সিঁড়িতে বসে দুজন সিগারেটে গাঁজা বাঁধছিল আমি দেখেছি।
রেখা প্রায় জেরা করছে যেন। ছোটবেলা থেকেই হীরকের উপর ছড়ি ঘোরাতো। কথায় ওর সঙ্গে পেরে ওঠা মুশকিল। ছোটবেলায় খুব রেগে গেলে হীরক ওর লম্বা বেনী টেনে দিয়ে পালাত। বেনী ধরে টানার কথা ভাবতেই রেখার পাড়ায় প্রথম আসার সময়টা মনে পড়ে গেল। তখন ওর মাথা ন্যাড়া হয়েছিল, ওরা নেড়ী বলে খেপাত। ফিক করে হেসে ফেলল হীরক।
তোকে হাসির কি বললাম? চলতে চলতে দাঁড়িয়ে পড়ল রেখা।
মনে আছে রেখা, তোকে আমরা নেড়ী ডাকতাম?
দেখেছিস কথা ঘুরাচ্ছিস। আমি ঠিক জানি পড়াশোনা ডকে তুলে তুই রোজ সন্ধ্যাবেলা গাঁজা নিয়ে বসছিস। তাই ভাবি ছেলের চোখটা এমন উড়ুউড়ু কেন!
হো হো করে হাসল হীরক। সন্ধ্যাবেলা গাঁজা না খেলেও পড়ার চাপ নিই না। আমরা পড়ি রাত্রে খাবার পরে। পড়াশোনার ব্যাপারে আমাকে মধ্যমপন্থী বলতে পারিস। এখন পারসেন্টেজে খেলছি। ঠিক যতটুকু দরকার, ব্যাস। মনীষের মতন নয় তাই বলে। ওকে তো ক্লাসেই দেখা যায় না একদম।
ওর পদাঙ্ক অনুসরন করিস না। চোখ পাকিয়ে শাসাল রেখা। ঠিক ছোটবেলার মতন। হীরককে সুযোগ পেলেই শাসন করত, না হলে পিছনে লাগত। ওর ব্যাপারে এরকম ইন্টারেস্ট নিচ্ছে ভেবেই হীরকের মনে খুশির বুদ্বুদ।
তোর হস্টেল লাইফ কেমন যাচ্ছে রে? খুব র্যাগিং হয়?
ধুর, সে তো একদম শুরুতে। এখন আমরাই রাজা। আনন্দের হাসি ঝুলল হীরকের ঠোঁটে। তুই কোথায় থাকিস? বেথুনের হস্টেল আছে?
আমি কেন হস্টেলে থাকব? আমার মাসির বাড়ি আছে না? তবে হস্টেলে থাকলে খুব মজা হত তাই না রে? আমিও তো ভেবেছিলাম যাদবপুরে আসব। মার জেদ, মেয়েদের কলেজে ছাড়া পড়তে দেবে না।
ইস, তুই এখানে থাকলে কি দারুন হত না রে রেখা?
কেন আমি থাকলে দারুন হত কেন? রেখা নিজের চোখ হীরকের চোখে গেঁথে জিজ্ঞেস করল। এমন চাহনি বুকে কাঁপন তোলে।
রোজ রোজ দেখা হত। আমি বেশ ব্রিজ পেরিয়ে তোর সঙ্গে দেখা করতে যেতাম।
ব্রিজ মানে?
আমাদের ইঞ্জিনিয়ারিং ফ্যাকাল্টি আর আর্টসের ব্লকের মধ্যে একটা ছোট্ট নালা আছে, তার উপর দিয়ে ব্রিজ। এই পারে আমি আর ওই পারে তুমি, মাঝে ওই নালা বয়ে যায়!
খুব যে ফুর্তি! রোজ দেখা হলে কি লাভ হত? আমি বরং তোকে বেশি বেশি জ্বালাতাম।
সেটা একটু ভাববার কথা অবশ্য। তুই এতক্ষণ যেরকম পুলিশি জেরা করছিলি –
হীরক নিজেদের বিল্ডিঙ্গে এসে গেছিল প্রায়। রেখা থমকে দাঁড়াল। তোর খুব রাগ হচ্ছে তাই না?
সেকথা কখন বললাম?
এখন বলে না, তোর রাগ আছে আমার উপর।
যাব্বাবা, আমি কবে রাগ করলাম?
তাহলে আমাদের বাড়িতে আসা বন্ধ করে দিলি কেন?
কি বলবে হীরক? দ্যাখ, তোর সঙ্গে শানুর- মুখ ফসকে বলেই থমকে গেল হীরক।
আমার সঙ্গে শানুর কি?
কানাঘুষোয় কিছু কথা হীরক শুনেছিল। কিন্তু নিজের চোখে তো কিছু দেখেনি, কত কিছু বদলে গেছে তারপর। কিছু হলেও এতদিন বাদে সেসবের সত্যি মিথ্যে জানাটাও তার কি সত্যিই আর দরকার? হয়তো অবচেতনে প্রশ্নটা ছিল কোথাও। অমনি বেরিয়ে এসেছে। সেটাই রেখার কাছে তার আসাটা আটকে রেখেছিল, রেখা কি বোঝে না?
কিন্তু যা বলে ফেলেছে সেটাকে ফেরাবে কেমন করে? ছুঁড়ে দেওয়া তীর কোন এক কোমল ক্ষতকে জাগিয়ে তুলেছে। হীরকের আর কিছু হাতে নেই। সেইভাবেই দাঁড়িয়ে রইল স্থানুর মত।
তার মানেটা কি? পেটে অর্ধেক মুখে অর্ধেক কথা আমার পছন্দ হয় না। আমার সঙ্গে শানুর যদি কোনদিন বন্ধুত্ব থেকে থাকে তার মানে আমার আর কোন বন্ধু থাকবে না? রেখার কণ্ঠস্বর তীক্ষ্ণতা পাচ্ছিল।
না মানে তোর সঙ্গে শানুর বন্ধুত্বটা তো সেরকম ছিল না। আমতা আমতা করছিল হীরক। তাছাড়া শানু আমারও বন্ধু। আমি মাঝখানে পড়তে চাইনি।
তোর সঙ্গে আমার কিরকম বন্ধুত্ব হীরক? রাগে নাকের পাটা ফুলে উঠেছিল রেখার। শানু কোনদিন আমার বন্ধু ছিল বলে তুই আমার সঙ্গে কোন যোগাযোগ রাখবি না?
শানু তোর শুধু বন্ধু ছিল না। সেটা তুই ভাল করেই জানিস। এবার হীরকও ফোঁস করে উঠল। এখন শানু ভাল নেই, তুই হয়তো আর ঘুরেও তাকাস না।
আমি তাকাই কি তাকাই না সেটা তুই কি করে জানবি?
তুই শানুর সঙ্গে যোগাযোগ রেখেছিস রেখা? এই যে শানু এমন আধপাগলা হয়ে ঘুরে বেড়ায় সেটা কার জন্য?
মানে? চোখ বিস্ফারিত হয়ে গেল রেখার। শানু পাগল হওয়ার জন্য দোষ কি আমার? তুই কি জানিস আমার সঙ্গে কি হয়েছিল।
দোষ না হলেও ওর পাশে গিয়ে তো দাঁড়াতে পারতিস? এরকম সময়ে?
অনেকক্ষণ স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল রেখা। চোখের কোলে জল টলটল করছে, কিন্তু তাকে বাইরে না বের হতে দেবার আপ্রান চেষ্টা। তুই আমার কি ধরনের বন্ধু রে হীরক? ঠিক বাইরের লোক যেরকম ভাবে বলে তুই সেই ভাবে ভাবছিস, বলছিস। শানুর কারনে আমি দুর্গাপুর ছাড়া হলাম। সবাই যখন আমাকে টিটিকিরি দিত, তখন তো তুই কিছু বলতে পারিস নি কাউকে। তখন কি শানু পাগল হয়েছিল? বরং আমি দুর্গাপুরে থাকলে পাগল হয়ে যেতাম। রেখা গটগট করে হাঁটা দিল এবার। সোজা চলেছে মেন গেটের দিকে।
কোথায় যাচ্ছিস রেখা?
আমি যেখানেই যাই, তোর তাতে কি?
হীরক বুঝতে পারছিল না কিভাবে রেখাকে থামাবে। কি সুন্দর মজার কথা হচ্ছিল, কোথার থেকে কি হয়ে গেল। আর কিছু না পেয়ে পিছন থেকে চেঁচিয়ে উঠল, তোর গানের কম্পিটিশান, ফাইনাল। এখন চলে যাচ্ছিস।
এক্ষুনি এত বড় একটা ফাইনাল হয়ে গেল, তারপরেও গানের ফাইনাল? তুই কি রে হীরক।
হীরক পিছন পিছন ছুটছিল। আবার থামল রেখা। ঘুরে দাঁড়াল। তুই পিছনে আসবি না হীরু। আজকে যা বললি তারপর তোর সঙ্গে আমার আর কোন সম্পর্ক থাকল না। আর কোনদিন আমার সঙ্গে কথা বলিস না। দুর্গাপুরেও না।
৩.
গরমকালে সন্ধ্যার আগে দুর্গাপুরের রাস্তায় বেরোনই ঝকমারি। যা রোদের তাপ। পিচের রাস্তা যেন গলে গলে পড়ছে। ষ্টীল প্ল্যান্টের জন্য গরমটা আরও বেশী। দুপুরের দিকে লু বইতে থাকে। রাস্তায় লোকের হাঁটাচলা তাই কম। পুজোর ছুটিতে যখন বাড়িতে আসে একটার পর একটা পূজো লেগে থাকে। ছুটিটা বেশ তাড়াতাড়ি কেটে যায়। কিন্তু এখন এই চাঁদিফাটা গরমে কিছু করার তো নেই, হস্টেল খুব মিস করছিল হীরক।
বেলা এগারোটার আগে কোনদিন সকালে ঘুম থেকে ওঠে না। উঠে করবেটা কি? গেল শীতে রূপারও বিয়ে হয়ে গেল। চিনুটা বড্ড ছোট, ওর সঙ্গে খোশগল্প জমে না অত। কিন্তু কাঁহাতক আর ঘুমান যায়? বিভিন্ন হস্টেল থেকে ছুটিতে আসা দুর্গাপুরের বন্ধুরা অনেকে মিলে দার্জিলিং বেড়াতে গেল। হীরক যায় নি। আবার গুচ্ছের পয়সা খরচ, বাবার কাছে হাত পাততে ইচ্ছা করছিল না। দিদির বিয়ের বছর ঘোরেনি, সংসারে এমনিতেই টানাটানি। মনীষ, দেবাঞ্জনরা যা করতে পারে, হীরক পারে না।
কি মনে হল, ভাবল এক ফাঁকে একবার শানুর সঙ্গে দেখা করে আসা যাক। সেই যে সেদিন ট্রেনে একবার দেখা হল, তারপর আর শানুর সঙ্গে দেখা হয়নি। দুর্গাপুরে কতই বা আসা হয়। এলেও শানুর সঙ্গে দেখা করাটা প্রয়োজনের তালিকায় নিচের দিকে চলে গেছে।
শানুর খবর কিছু জানো মা?
শানু? ভাল নয় অত। তুই না থাকতে বার কয়েক এসেছিল।
এসেছিল? তুমি বলো নি তো আমায়।
নিলীমাকে খুব চিন্তিত দেখাল। কেমন উসকো খুসকো চেহারা। ছেলেটা কি এবার পুরোপুরোই পাগল হয়ে গেল রে হীরু?
ধ্যাত, এরকম কেন বলছো?
আর কি বলবো? ও ছেলে এখন রাস্তাঘাটে উদভ্রান্তের মত ঘুরে বেড়ায়। কেন তার না আছে ঠিক, না কোন ঠিকানা।
ইস, এতবার বাড়ি আসি, একবার দেখা করা হয় না। অপরাধবোধ জাগছিল হীরকের।
তুই যাবি নাকি ওর কাছে? নিলীমা একটু চিন্তিত দৃষ্টিতে ছেলের দিকে তাকাল।
কেন যাবো না?
না যাবি তো বটেই। ছোটবেলার বন্ধু। আমতা আমতা করে নিলীমা। কিন্তু একটু সাবধানে। শুনেছি সে ছেলে আজকাল যখন তখন খেপে যায়। মারপিট করে।
মারপিট করে? কেন? কার সঙ্গে? চমকে ওঠার মত কথা।
রাস্তাঘাটে। শুনেছি তো সেইরকমই। মাথার ঠিক নেই না। শুনলাম ওরই ছোটবেলার এক বন্ধু, সুরজিত না কি তার নাম। মেরে নাকেমুখে রক্তারক্তি। একটু আলগোছে থাকিস। বেশী কথা না বলাই ভাল।
খুব অবাক লাগল হীরকের। শানু তো ওরকম মারপিট করার ছেলে না। স্কুলে থাকতে ওর পিছনে লাগার লোকের অভাব ছিল না। যেহেতু ওর ভাবসাব শুরু থেকেই একটু আলাদা, ওকে অনেকেই টণ্ট করত নানান ভাবে। কিছু টিচারও শুরু শুরুতে। পরে আর অতটা নয়। ভাল রেজাল্ট করছিল, তাই টিচারদেরও প্রিয়পাত্র হয়ে উঠেছিল শেষের দিকে। স্কুল ফাইনালের অত ভাল রেজাল্টের পর তো বেশ সম্ভ্রমের চোখেই দেখত সবাই।
সেই শানুর এখন এই দশা! না হয় একটা পরীক্ষায় খারাপ করেছে। তার ধারনা ছিল ডিপ্রেশান, ডাক্তারের ওষুধপত্র পড়লে দুদিনে ঠিক হয়ে যাবে। যেরকম মাথা ওর, রিকভার করে নেবে ঠিক। ব্যাপারটা যে এতো দূর গড়িয়েছে ভাবতে পারে নি।
শানু আছে কাকিমা? জলখাবার খেয়েই শানুদের রিকল পার্কের বাড়িতে পৌঁছে গেছিল সকাল সকাল। শানুদের বাড়িতে আসলেই অন্যরকম লাগত হীরকের। ছিমছাম সাজানো বাড়ি, কোথাও কোন চেয়ারের মাথার থেকে গামছা ঝুলছে না, টেবিলে চুলের অবশিষ্ট দাঁড়ায় জড়িয়ে চিরুনি। শানুদের বসার ঘরে যামিনী রায়ের রমণীরা দীঘল চোখে তাকিয়ে থাকে, ফুলদানিতে রজনীগন্ধার স্টিক স্কুল ড্রিলের সময় নিশ্বাস চেপে দাঁড়িয়ে থাকার মত সোজা। কোনভাবেই তাদের বাড়ীর মত নয়।
শুধু তাদের কেন। পাড়ার সব বন্ধুর বাড়িই ছিল থাকার আস্তানা। প্রয়োজনের জিনিসে ঠাসা। দেওয়ালে শুকিয়ে যাওয়া চন্দনের ফোঁটা চড়ানো দাদু দিদিমার ছবি, ঠিক তার পাশেই ক্রশটিচের লাল সবুজের বুনোটে কালো ফ্রেমে বন্দী ঘোষনা সুখে থেকো। পরিবার বেড়েছে, সঙ্গে সঙ্গে বাড়িও বেড়েছে কলেবরে।
শানুদের ব্যাপার অন্য রকম। ওরা প্রথমে অন্য একটা বাড়িতে থাকতো। সেটাও খারাপ কোথায় ছিল? হয়তো ভাড়ায় ছিল তখন। দুর্গাপুরে আসার বছর তিনেক পরে ওরা উঠে আসল রিকল পার্কের এই বাড়িটায়। বোধহয় কোন আর্কিটেক্ট দিয়ে ডিজাইন করানো। ঢোকার মুখেই এই পেল্লাই কাঠের দরজা। ঘরের মাঝখান থেকে সিঁড়ি উঠে গেছে। দেওয়ালে দেওয়ালে ছবির ফ্রেম, আর্ট ওয়ার্ক। সেসব কিছুই বদলায়নি। কিংবা থমকে দাঁড়িয়ে আছে এখন।
সুতপার মুখে পরিচয়ের হাসি বিস্তৃত হতে সময় লাগল। সকালবেলা একটু আলুথালু লাগছিল। মুখের উপর থেকে চুল্ টেনে সরাতে সরাতে বলল, আছে তো। সে ছেলে আর কোথায় যাবে। যাওয়ার কোন জায়গাটা রেখেছে? সুতপার গলায় বিরক্তি চাপা ছিল না মোটেই। আসলে শানুর ছেলেবেলার বন্ধুদের দেখলে তার রাগ আর দুঃখ ভিতরে ভিতরে আরও চারিয়ে ওঠে। তার ছেলেরও তো এমনি হওয়ার কথা ছিল। আরও ভালো, সবার থেকে ভালো।
এই কথার কি উত্তর দেবে আর। দরজা ধরে দাঁড়িয়ে ইতসস্ত করছিল হীরক।
নিজেকে একটু সামলে নিয়ে কুশল প্রশ্নে চলে এলো সুতপা। তুই কেমন আছিস? ছুটিতে এসেছিস বুঝি?
হ্যাঁ কাকিমা। আমাদের এখন গরমের ছুটি চলছে। ভাবলাম শানুর সঙ্গে একটু দেখা করে যাই।
তোর ক বছর হল রে? আর কদিন বাদেই পাশ করে চাকরি করবি তো।
মোটে তো এক বছর কমপ্লিট করলাম কাকিমা। দিল্লী এখনো অনেক দূর। হীরক প্রাণপণ চেষ্টা করছিল কথাবার্তা হালকা চালে রাখার।
আমার বোনের ছেলে ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করেছে, জানিস? অংশুমান, ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট হয়েছিল। চিনিস তুই?
হীরকের চেনা ছিল না। কে কবে কোথা থেকে পাশ করেছে, কে তার খবর রাখে।
তোরা সব একেকটা হীরের টুকরো ছেলে। জীবনে কোথায় কোথায় চলে যাবি। অংশুও তো এখন বিশাল চাকরি করছে একটা, বম্বে না কোথায় যেন। কদিন বাদে বিয়ে করবে, সংসার হবে। সবাই নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে যাবে। শেষের কথাগুলো যেন সুতপা নিজেই নিজেকে বলছিল। আমারটাই কেমন ঝুটো মুক্তো বেরিয়ে গেল।
এইসব কথা শুনে এত অস্বস্তি লাগে। কি বলা যায় এইরকম কথায়। হীরক কোনমতে বলল, এইভাবে বলছেন কেন কাকিমা। ওর শরীরটা কদিন ভাল নেই। একবার ঠিক হয়ে গেলে, ও এত ব্রিলিয়ান্ট। আবার কোথার থেকে কোথায় উঠে যাবে।
শুরুতে আমরাও তাই ভেবেছিলাম হীরক। কিন্তু দেখ না, দেখতে দেখতে বছর তিনেক কেটে গেল। ওর বাবা কি কোন চিকিৎসার ত্রুটি রেখেছে? কত ডাক্তারের কাছেই তো নিয়ে যাওয়া হল। কিছুতে কি কিছু হল?
তার মানে ওর হায়ার সেকেন্ডারি দেওয়ার আগে থেকেই অমনি হয়েছিল। কোন অসুখ থেকে হল কি কাকিমা?
কিসের থেকে যে কি হল সেটাই তো বুঝলাম না রে। মাথায় একটু চোট লেগেছিল। কিন্তু সেরকম তো কিছু বোঝা যায়নি বাইরে থেকে। কথা ভুলে যেতে শুরু করল তারপর। একটা বললে আর একটা ধরে বসে। ওর বাবাকে তো জানিস। শানু তো ওর বাবার কাছে পড়ত। দিন দিন কিরকম একটা হতে থাকল, পড়ায় মন বসে না, পড়তে বসলে ভুলে যায়। এই নিয়ে বাবায় ছেলেতে কত কাণ্ডই যে হয়। ওর রাগটা তো খুব বেশী। এখন ছেলেরও অমনি রাগ হয়েছে। এই বাড়িতে আমি যেন একটা জাঁতাকলে আটকে গেছি একদম!
এই সময় সিঁড়ি দিয়ে শানু নেবে এলো।
হীরু? তুই এসেছিস? একমুখ হাসিতে ভরে গেল শানুর মুখ। এদের কথা একদম শুনবি না হীরু। সবাই মিলে আমায় শুধু মারার চক্রান্ত করছে। কেউ চায় না আমি ভাল হয়ে উঠি।
একবছর আগে লাস্ট দেখেছিল শানুকে, সেই ট্রেনের কামরায়। আরও যেন রোগা হয়ে গেছে। চোখদুটো কোটরে ঢুকে গেছে। মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি। গালের উপর একটা কাটা দাগ।
তোর গালে কি হয়েছে রে শানু?
দ্যাখ না, বাবা মেরেছে। এইজন্যেই তো বললাম তোকে। এই বাড়িতে কেউ চায় না আমি ভাল হই।
শানু, কেন বাজে কথা বলছিস? সুতপা ফুঁসে উঠল এবার। রাস্তায় ঘাটে মারপিট করে আসিস। সেদিন জানো হীরক, আমাদের পাড়ার একটা ছেলেকে ধরে পিটিয়েছে। সে ছেলে আবার পার্টি করে। ওরা যদি এবার দলবল নিয়ে এসে হামলা করে আমরা কি করবো বলো দেখি বাবা? ওদের চোখের সামনে তোর বাবা যদি দুটো চাপর মেরে থাকে সেটা তোর ভালর জন্যেই। ওরা অন্তত দেখল বাড়িতে শাসন আছে।
গালের দাগটা শুধু চাপরে তো হয় না। কিন্তু হীরক সেটা আর বলল না। শানুর সঙ্গে সিঁড়ি দিয়ে উপরের ঘরে চলে এলো। এই ঘরটা সেরকম গোছান নয়। শানুর ঢলঢলে পাজামার মতই যত্নের অভাব ঘরের কোনায় কোনায়।
কিরে তুই কাকিমাকে ঘরে ঢুকতে দিস না নাকি?
কেন? মা কিছু বলেছে তোকে? ভুরু কুঁচকে তাকাল শানু। ওর দাঁড়ানোর মধ্যে একটা যুদ্ধং দেহি ভাব যেন। হীরক একটু সাবধান হয়ে গেল। কি বলতে কি বলে ফেলবে, ব্যাস এই পাগল ঝাঁপিয়ে পড়ল আর কি। এই কথাটা ভেবেই হীরকের নিজের উপর রাগ হয়ে গেল। ছি ছি, সেই যদি শানুকে পাগল ভেবে কুঁকড়ে যায়, অন্য সবার কি দোষ? মুখে তাড়াতাড়ি হাসি টেনে বলল, না, না সেটা নয়। কাকিমা কিছুই বলেনি আমায়। তোদের বাড়িটা কেমন সুন্দর সাজানো থাকে তো। অথচ তোর ঘরে ঢুকলে মনে হচ্ছে যেন একটা ঝড় বয়ে গেছে।
এবার হা হা করে হেসে উঠল শানু। একদম ঠিক বলেছিস তুই। আসলে আমি মাকে একদম হাত লাগাতে দিই না। কোথাকার জিনিষ কোথায় রেখে দেবে, আমি খুঁজে পাবো না। এমনিতেই আমার আজকাল কিছু মনে থাকে না। সেইজন্য সব বাইরে রেখে দিই। চোখের সামনে। হারাবার ভয় নেই একদম।
বেশ স্বাভাবিক ভাবেই তো কথা বলছে শানু। কেন তবে লোকে ওকে পাগল বলছে?
তুই কি ভুলে ভুলে যাস শানু? তোর কি হয় ঠিক? বলেই মনে হল এমন প্রশ্ন করা কি উচিত! কিছু মনে করিস না শানু, বুঝতে চাইছিলাম তোর কি কষ্ট হচ্ছে। যদি কোনভাবে হেল্প করতে পারি।
করবি হীরু? আমার একটা খুব বেশী হেল্পের দরকার। হয়তো তুই পারবি।
আমি পারব? নিজের বিস্ময় গোপন করে উতসাহে মাথা দোলাল হীরক। আমি পারলে নিশ্চয় করবো রে শানু। কোন প্রবলেম নেই।
এই দ্যাখ না আমি কত দরকারি কথা ভুলে ভুলে যাই। গেছি। পুরোন বইয়ের দোকানে দেখবি অনেক পাতাছেঁড়া বই পাওয়া যায়। সামনে পিছন আছে। মাঝে মাঝে কিছু পাতা ছিঁড়ে নিয়েছে। আচ্ছা বল, এরকম ভাবে কেউ বই পড়ে, মাঝখান থেকে পাতা ছিঁড়ে। যেন আর কেউ ওই পাতাগুলো পড়ুক সেটা চায়না।
আমি এরকম লোক জানি রে। ফিক করে হাসল হীরক। টেস্টের সময় দেখি তো মনীষকে। জেরক্স করার সময় না পেলে বেমালুম বইয়ের পাতা ছিঁড়ে পকেটে ঢুকিয়ে নেয়।
শানু হাসিতে যোগ দিল না। ওর মন ডুবে আছে এক গভীর দুঃখে। আমি এখন ওরকম একটা বই হীরু। কিছু কিছু পাতা ছিঁড়ে কেউ পকেটে পুরে চলে গেছে আর আমি সেই হারানো পাতাগুলো খুঁজে বেরাচ্ছি।
শানুকে পাগল কম, দার্শনিক বেশি মনে হচ্ছিল হীরকের। বেশ তো গুছিয়ে কথা বলছে। নিজের প্রবলেমটাও বেশ ভাল করে জানে। ভুলে যাওয়াটা একটা অসুখ। বুড়ো বয়সে তো লোকে কত কিছু ভুলে যায়। শানু না হয় কম বয়সেই কিছু কথা ভুলে গেছে।
আমায় ডাক্তার সেন বললেন। সিলেক্টিভ মেমরি লস। আমাকে সেটা নিয়ে ভাবতেও বারন করেছেন, তাতে নাকি আমার ক্ষতি। কিন্তু বল, তুই কিভাবে নিজের মনকে ভাবনা থেকে আটকাবি?
যেটা তোর মনে নেই সেই ভাবনা তোর মনে আসবে কি করে সেটা তো আমি বুঝে উঠতে পারছি না।
সেটা আমিও জানি না হীরু। কিন্তু কোন ঘটনায় হয়তো কিছু মনে পড়ে গেল। কোন চেনা গন্ধে। গন্ধ বলেই গুম হয়ে গেল শানু।
কি হল? আবার কিছু মনে পড়ল?
আবার শানুর চোখ দূরে হারিয়ে গেছে। কাছে থেকেও এখন ও অনেক দূরে। ওর কন্ঠনালিতে হালকা কাঁপন টের পাচ্ছিল হীরক। আস্তে আস্তে যেন নিজেকে শোনাবার তাগিদে পাহারের ফাটল থেকে বেরোন জলধারার মত শানুর ভিতর থেকে কবিতা চুঁইয়ে চুঁইয়ে বেরিয়ে আসল।
আমাকে খোঁজো না তুমি বহুদিন-কতদিন আমিও তোমাকে
খুঁজি নাকো;- এক নক্ষত্রের নিচে তবু – একই আলো পৃথিবীর পারে
আমরা দুজনে আছি; পৃথিবীর পুরনো পথের রেখা হয়ে যায় ক্ষয়,
প্রেম ধীরে মুছে যায়, নক্ষত্রেরও একদিন মরে যেতে হয়,
হয় নাকি?- বলে সে তাকাল তার সঙ্গিনীর দিকে;
আজ এই মাঠ সূর্য সহমর্মী অঘ্রাণ কার্তিকে
প্রাণ তার ভরে গেছে।
হীরক ভাবছিল শানু একদম ভুলে না গিয়ে এমন আপ্লুত হয়ে কবিতা বলছে, তাহলে মনে না থাকার অসুখটা কোথায়?
শানু হঠাত থমকে দাঁড়িয়ে গেল। খপ করে ধরল হীরকের হাত। চোখদুটো উত্তেজনায় জ্বলজ্বল করছে। আমি কিছুতেই মনে করতে পারি না রে হীরক। কে সেই মেয়েটি যার চুলের গন্ধ উড়ে উড়ে এসে আমাকে উদ্ভ্রান্ত করে দেয়। স্থির হয়ে বসতে দেয় না। গোলাপের কথা মনে করে যাকে আমি মাথা থেকে সরাতে পারি না। তুই জানিস হীরু? বলতে পারিস আমাকে?
হীরক দোটানায় পড়ে গেল। কি বলবে সে শানুকে? বলবে সেই মেয়েটা রেখা, তোর মনে নেই? কিন্তু বললে ও যদি সটান রেখার কাছে পৌঁছে যায়? পাগলের মন কখন কিভাবে চলে তার ঠিক কি আছে! যদি রেখার এতে কোন ক্ষতি হয়ে যায়? শানুর না হয় মনে নেই। কিন্তু রেখার তো মনে আছে। ইচ্ছা থাকলে রেখা কি শানুর সঙ্গে এসে দেখা করে যেতো না? হীরক কথা ঘোরাবার চেষ্টা করল। তুই কি কবিতা লিখিস নাকি শানু?
শানুর চিন্তিত মুখের থেকে মেধ ফাটা রোদের মত হাসি ছিটকে বেরোল। আমি লিখি তো। তাই বলে এই কবিতাটা আমার নাকি? ধ্যাত! এটা তো জীবনান্দের কবিতা। তুই কবিতার কিছুই খবর রাখিস না দেখছি হীরু।
হীরক একটু লজ্জা পেলো। একসময় সেও তো আবৃত্তি করত। কিন্তু এই কবিতাটা কক্ষনো পড়েনি। আমি না হয় খবর রাখি না, কিন্তু তুই কি করে এমন ঝরঝরে মুখস্থ বললি? তোর নাকি কিছু মনে থাকে না। কোন কিছু মাথায় রাখতে পারিস না।
ওটাই তো মুস্কিল। যে পাতাগুলো ছেঁড়েনি, সেগুলো তো ঝরঝরে মনে আছে আমার। ছোটবেলার কথা বেশ ভাল করে মনে আছে। আবার কি হয় জানিস? কথাগুলো হঠাৎ হঠাৎ করে মাথায় আসে, কিভাবে আসে বলতে পারব না। কিন্তু এলে বুঝতে পারি। এই যেমন এই যে কবিতাটা বললাম, আমাকে যদি বলতিস জীবনান্দের দুজনে কবিতাটা বল তো হীরু, আমি কিছুতেই পারতাম না। বরং ভয় পেয়ে যেতাম। কেউ কোন প্রশ্ন করলে যাওবা কিছু মনে থাকে সেটাও ভুলে যাই। এমন অদ্ভূত একটা প্যানিক হয় জানিস, মনের মধ্যে একটা পারব না পারব না ভাব। তখন আমার শুধু পালাতে ইচ্ছে করে।
শানুর বিস্ফারিত দুচোখে সততার অভাব ছিল না। তবু হীরকের এখনো বিশ্বাস হয় না শানুর মত এরকম মেধাবী ছেলে একদিন হঠাত সব কিছু ভুলতে শুরু করতে পারে। এমনি এমনি। সেটাই জিজ্ঞেস করল।
তুই কক্ষনো বলিস নি এমন হল কি করে? হঠাত তুই একদিন সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে দেখলি তোর কিছু মনে পড়ছে না?
না সেরকম না। আমি কেমনভাবে যেন পড়ে টরে গেছিলাম। বাড়িতেই। মাথায় চোট পেয়ে অজ্ঞান হয়ে যাই। মার মুখেই শোনা। তার পর ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেল, ভাল হলাম। কিন্তু ঠিক হলাম না। আমার জীবন থেকে অনেকটা সময় আলটপকা হারিয়ে গেল। দ্যাখ না, আমাকে বলে আমি নাকি মাধ্যমিকে খুব ভাল রেজাল্ট করেছিলাম। বল, আমি তো মনেই করতে পারি না আমি কবে মাধ্যমিক দিলাম, কি দিলাম আর কি পেলাম!
এরকম আবার হয় নাকি? তাহলে তুই তোর মার্কশীট খুলে দেখলেই তো পারিস। আর কোন কনফিউশান থাকবে না।
দেখিনি ভেবেছিস। কিন্তু বিশ্বাস হয় নি। সেটা অন্য কোন শান্তায়ন রে হীরু। আমি নই।
ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে ছিল শানু। চোখের দৃষ্টিতে না আছে সেই বিশ্বাস, না খুঁজে পাওয়া যাবে সেই বুদ্ধিদীপ্ত চাহনি। হীরকের মনে হল, শানু ঠিকই বলছে। এ অন্য এক শান্তায়ন।
[ক্রমশ]