তারান্তিনো, সিজন দুই — কুড়ি

প্রিয়ক মিত্র

 

পূর্ব প্রকাশিতের পর

গলিটার বাঁকজুড়ে বিরাট এলাকা দখল করে ছিল পোড়ো বাড়িটা। একটা খবরের কাগজের অফিস ছিল এককালে। কালক্রমে সেই কাগজ বন্ধ হয়ে গিয়েছে। এখন সেখানে বিরাট হাউজিং কমপ্লেক্স হবে নাকি‌। ফলে, এতদিনের যে পোড়ো বাড়িটা এই পাড়ার সকলের চোখ সয়ে গিয়েছিল, সেই বাড়িটার জায়গায় এখন ধ্বংসস্তূপ। দুদিকে ভাঙা পাঁচিলের মাঝবরাবর একটা ঢোকার রাস্তা তৈরি হয়েছে এই ইট-রাবিশে ভর্তি ধু ধু মাঠে। গাঁজা খেতে, ডেনড্রাইট করতে, চুম্মাচাটি করতে— কত কারণে যে পাড়ার ছেলেমেয়েরা সন্ধের পর এই অন্ধকারে ঢুকত। কিন্তু সেসব এখন বন্ধ। দুদিন হল প্রোমোটারের লোকজন দখল নিয়ে নিয়েছে এই খণ্ডহরের।

একটা বিপুল লরি বাঁক নিয়ে ঢুকে পড়ল এই ভাঙা হাটের মাঝখানে, সদর্পে। লরির একপাশ থেকে নামল খালাসিরা। পেছন থেকে ধপাধপ করে লেবাররা লাফিয়ে পড়ল। এই সময় কোনও দর্শক যদি থাকত লরির পিছনে, সে দেখতে পেত, লরির সামনের দরজা খুলে গেল। দশ সেকেন্ড কেউ দেখা দিল না। শুধু ভেতর থেকে কেউ সিগারেটের ধোঁয়া ছেড়ে গেল টানা। তারপর প্রায় চিতাবাঘের ক্ষিপ্রতায় লরি থেকে লাফিয়ে নেমে সাউথ ইন্ডিয়ান নায়কদের মতো সিগারেট ঠোঁটের একপাশে ঝুলিয়ে সানগ্লাস পরা মুখটা অন্যদিকে ঘুরিয়ে প্যান্টটা হালকা ঠিক করে নিয়ে তারপর অবশেষে যেন হলভর্তি দর্শকদের দিকে মুখ ফিরিয়ে হাত দিয়ে লম্বা সিগারেটটা ঠোঁট থেকে নামিয়ে কালোচশমাটা মাথায় তুলে সরু চোখটাকে ধোঁয়ায় ভরিয়ে তুলে এন্ট্রি নিল যে, তার নামটাও জম্পেশ। ভগা। প্রোমোটারদের নয়নের মণি। তারা কোনও সমস্যায় পড়লে, কেউ যদি তাদের জিজ্ঞেস করে, সেই সমস্যা থেকে কী করে উদ্ধার পাবে, তারা নিশ্চিন্তে বলে, ভগা জানে।

লরি ভর্তি করে রাবিশ তোলা হচ্ছিল। একটা কালো টি-শার্ট হাতা গুটিয়ে পরা, টাইট জিনসের প্যান্ট পরা, হাতে নানাবিধ চেন ও ভারী ঘড়ি পরা ভগা কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে দেখল কিছুক্ষণ কাজ। তারপর মাথা নিচু করে দু আঙুলের ফাঁক দিয়ে সিগারেটের বাডটা হাওয়ায় ভাসিয়ে দিল। সেটা পড়ল মাটিতে। পা দিয়ে সেটার শেষ আগুনটুকু মাটিতে মিশিয়ে দিয়ে ভগা একটা তুড়ি মেরে একজন বামন লেবার, যে এদের হোতাগোত্রের, তাকে বলল, ওয়ে বাচ্চা, আমি মুতে আসছি।

বামনটি তাকিয়ে নির্লিপ্ত মাথা নেড়ে আবার শ্যেনদৃষ্টিতে কাজের তদারকি করতে লাগল।

গুনগুন করতে করতে এককোণে গিয়ে প্যান্টের চেন নামাল ভগা। সবে হালকা হতে শুরু করেছে, এমন সময় জিনসের বাঁ পকেটে থাকা ছোট্ট মোবাইলে ধুমের রিংটোন বেজে উঠল।

কাজ সেরে, প্যান্টের চেন আটকে, সানগ্লাস আবার মাথায় তুলে সরু বিরক্ত চোখে ফোনটা দেখল ভগা।

রাইটুর ফোন!

ভগা তড়িঘড়ি এককোণে চলে গেল ফোনটা ধরার জন্য।

–কোথায়?

ফ্যাসফ্যাসে গম্ভীর গলা ভেসে এল।

–কাঁটাপুকুর। বসের মাল লোড করছি।
–অর্ডার আছে। ডেলিভারি নিতে হবে।
–ডেলিভারি আমরা নেব কেন?

একটু উদ্ধতভাবেই জানতে চাইল ভগা। অপরাধমূলক কাজেও প্রোমোশন বলে একটা ব্যাপার থাকে, যা অনেকদিন আগেই ভগার হয়ে গেছে। সব কাজ সে করবে কেন?

রাইটুর গলা এবার কর্কশ আর চাপা‌।

–ডেলিভারি বেহাত হয়েছে। রেসকিউ করতে হবে।

ভগা ওরফে ভগবান নির্বিকারচিত্তে বলল, ও! কখন কোথায় মিট করব?

–আমার বাড়ি আয়। বাইক নিয়ে আসবি না। গাড়ি নিয়ে আয়।
–শালা বাইকে তো তাড়াতাড়ি হবে! তোমার বেফালতু ভয়ের জন্য মাইরি বেকার পেট্রোল পোড়াতে হবে। এত চাপ খাও কেন? আমার হাতে কোনও দিন অ্যাকসিডেন্ট হয়েছে?
–যা বলছি শোন।

ফোনটা রেখে দিল রাইটু।

ভগা একবার তাকাল লেবারদের দিকে। তারপর মুখ ছুঁচলো করে একটা চু চু আওয়াজ করে ডাকল বামন লোকটিকে।

–আমার কাজ এসেছে। বেরোচ্ছি। একটা ইধার কা মাল উধার যেন না হয়। হলে এখানেই পুঁতে চুনচাপা দিয়ে দেব।

বামন লোকটি সব বুঝতে পেরেছে ভাব দেখিয়ে মাথা নেড়ে চলে গেল।

শিস দিতে দিতে কালো চশমাটা চোখে সেঁটে ভগা প্লট থেকে বেরিয়ে হাঁটতে লাগল নিজের বাড়ির দিকে। কাছেই একটা বস্তির পাশে একটা নতুন কনস্ট্রাকশন উঠছে, সেখানে একটা ঘর নিয়ে এখন থাকছে ভগা। বসই দিয়েছে ঘরটা। সেখানে তার বাইকটা পার্ক করানো। সেই বাইকে করে কাশী মিত্রর দিকে যাবে ভগা। ওর বাড়িতে। গাড়িটা ওখানেই। মারুতি এইট হান্ড্রেড। লঝঝড়ে, বসের দেওয়া। সেটা বের করে যেতে হবে আহিরীটোলা থেকে রাইটুকে তুলতে। রাইটু, আফতাব মল্লিক, বসের আত্মীয়ের মতো প্রায়। অকুতোভয়, মিশমিশে কালো ভয়ার্ত চেহারার রাইটুদা বাইকে চড়তে ভয় পায়। ডেয়ারডেভিল অপারেশনেও সে কোনওদিন বাইকে চড়ে যায় না। তার জন্য গাড়ি বের করতে হবে এখন।

হঠাৎ ভগার শিস থেমে গেল। রিনিদির বাড়ির পাশ দিয়ে যাচ্ছে সে। নির্লিপ্তভাবে হাঁটতে হাঁটতেও একবার তার চোখ চলে গেল ছাদে।

তার হৃৎপিণ্ড লাফিয়ে উঠল গলার কাছে।

রিনিদি দাঁড়িয়ে ছাদে। ঘরোয়া শাড়ি, স্লিভলেস ব্লাউজ। ভগাকে দেখে ইচ্ছে করে দু হাত মাথার ওপর তুলে খোঁপা ঠিক করতে লাগল। রিনিদির ফরসা, মখমলের মতো বাহুদ্বয়ের দিকে, রিনিদির কাতিল তাকানো, আলতো ঠোঁট কামড়ানোর দিকে, স্পষ্ট হয়ে ওঠা বুকের খাঁজের দিকে তাকিয়ে ভগার বুক দুরুদুরু করে উঠল।

রিনিদি বিবাহিত। রিনিদি ডায়না। কিন্তু রিনিদির বর, ওই হুমদো দেবাশিস অরণ্যদেব? আদৌ না। বর‌ং ফ্যান্টম যদি কেউ হয়ে থাকে, তবে তা ভগা, ওরফে ভগবান ভটচাজ! কিন্তু আঠাশ বছরের ভগার ভাবতে ভালো লাগে, সে অরণ্যদেবকে টপকে চুপিচুপি খুলিগুহায় যায় দুপুরবেলা। রিনিদির সামনে ল্যাংটো হওয়ার কথা ভাবলেই আরামে চোখ বুজে আসে ভগার।

আবার ফোনটা বেজে উঠে ভগার ঘোর কাটায়। ভগা ওপরে তাকায় চকিতে। ছাদ থেকে সরে গেছে রিনিদি। তার জায়গায় ওর হারামি বর দেবা স্যান্ডো গেঞ্জি পরে।

ও কি উদ্ধার করে আনবে ডায়নাকে? খুলিগুহা থেকে? না, ভগার এই ঝটিতি দুপুর-অভিযানই ভাল লাগে। সেদিন কোন একটা আনসান ছেলে পাড়ার আড্ডায় রিনিদিকে রেন্ডি বলল। ভগার গায়ে লাগেনি। কারণ এসব ছুটকো কথায় রিনিদির কিছু যায় আসে না। ভগার তো ওই ছেলেটার ধড়-মাথা আলাদা করে দেওয়ার কথা। কিন্তু না। ভগা তাও করেনি। রিনিদিকে বিছানায় সিগারেট খেতে খেতে শুধু বলেছিল। পরেরদিন সন্ধেবেলা একটা পাতলা ফিনফিনে গোলাপি ম্যাক্সি পরে ছেলেটার সামনে এসে দাঁড়াল রিনিদি, সন্ধেবেলা। তারপর কানের গোড়ায় একটা ঝনঝন বাজিয়ে দিল। ছেলেটা হতভম্ব হয়ে গিয়েছিল। তারপর আর মুখ খোলেনি। রিনিদি এটা ইচ্ছে করে অফিসফেরত দেবার সামনে করেছিল। দেবা দেখে অবাক হল, তারপর মাথা নিচু করে বাড়ি ঢুকে গেল। দেবা বউয়ের গায়ে হাত তোলা দূরস্থান, গলা তোলার সাহস পর্যন্ত দেখায় না। রিনিদি বলে সাপের মতো, কখন ছোবল দেবে বোঝা যায় না। তাই রিনিদিও সাবধান থাকে, তবে পাত্তা দেয় না। বিয়ের রাতেই রিনিদি বলেছিল দেবাকে, ও মদ খায়, গাঁজা খায়, নতুন নতুন ছেলের সঙ্গে সেক্স করে। ভগাকে বলেছিল, কী বলে ওর এই ব্যাপারটাকে, নিম্ফোম্যানিয়া। ভগা জন্মেও উচ্চারণ করে উঠতে পারেনি। রিনিদি বলেছে, এভাবেই ও জীবন কাটাবে। দেবার না পোষালে ওর ‘বালটাও যায় আসে না’।

এসব ভাবনার ফাঁকেই অচেনা নম্বরের ফোনটা ধরল ভগা।

–কে?

খুব বিরক্ত হয়ে জানতে চাইল।

–তোর বাপ।

ভগা থামল হাঁটতে হাঁটতে।

বস ফোন করছে। গলায় রাগ ডগমগ করছে। কী কেস?

–বস, বলো।
–রাইটু অপেক্ষা করছে। তাড়াতাড়ি যাস। আজকের অপারেশন ক্রুশিয়াল।

ফোনটা ঝট করে কেটে গেল।

বস মানে এলাকার দোর্দণ্ডপ্রতাপ প্রোমোটার মানিক তরফদার। যাকে এই তল্লাটে সকলে চেনে ‘বেগুনিবাবু’ নামে।

ভগা তাড়াতাড়ি পা চালাল।

বিল্ডিংয়ের তলায় একচালা ঘর থেকে বাইকের চাবি নিয়ে বাইক নিয়ে ঝড়ের গতিতে কাশী মিত্রতে বাড়ি পৌঁছে অসুস্থ বাবা আর রুগ্ন মায়ের নির্লিপ্ত দৃষ্টি এড়িয়ে চাবি নিয়ে গাড়ি চালু করে আরও ঝড়ের গতিতে পৌঁছল আহিরীটোলাতে একটা ভাঙা বাড়ির একতলায় লেদের কারখানার পাশে আরও ভাঙা ঘরে থাকা রাইটুদাকে তুলতে।

কোঁকড়ানো চুলের কালোপানা রাইটুদা বাড়ির বাইরে বসে বিড়ি খাচ্ছিল। একটা টাইট টিশার্ট আর জিনস পরে। বিড়িটা ফেলে পায়ে পিষে গাড়ির দরজা খুলে উঠে দরজাটা ধড়াস করে বন্ধ করে চাপা গলায় বলল, মেশিন নিয়েছিস?

–ও তো সঙ্গেই থাকে।
–সবসময় রাখবি না। যাই হোক, চল‌!
–কাকে নামাতে হবে?

গাড়ি স্টার্ট দিয়ে ঘোরাতে ঘোরাতে জানতে চাইল ভগা।

ওর দিকে না তাকিয়েই চোখটা হালকা বুজে মাথাটা সিটে এলিয়ে দিয়ে রাইটু ওরফে আফতাব দাঁতে দাঁত পিষে বলল, শুয়োরের বাচ্চা বিল্ডারটা বসের বউকে নিয়ে আলফাল বকছিল!

ভুরু কুঁচকে গেল ভগার। বসের বউ না কি দুর্দান্ত সুন্দরী, ডবকাও বলে কেউ কেউ। কিন্তু সারাদিন গাঁজা খায় আর ড্রাগ নেয়। উঠতে পারে না বিছানা থেকে। তাই তাকে দেখা যায় না। কিন্তু তার সম্পর্কে খারাপ কথা বলেছে বলে একটা বিল্ডারকে নামাতে হবে বলে বস তাদের, বসের অ্যাসেটদের পাঠাবে? কেন বলবে, অপারেশনটা ‘ক্রুশিয়াল’? আর রাইটুদা যে তখন বলল, ডেলিভারি বেহাত হয়েছে?

ভগা এক সেকেন্ডের মধ্যে বুঝে গেল, কেসটা অন্য কিছু, ওকে রাইটুদা বলছে না এখনই। ও চুপচাপ একটা জয়েন্ট ধরাল পকেট থেকে বের করে, তারপর গাড়ি চালাতে লাগল। মেন রোডে বেরিয়ে শুধু বলল, যাব কোথায়?

রাইটু এবার একটু হেসে বলল, গঙ্গার ধারে চ! হাওয়া খাব!

ভগা আর থাকতে পারল না।

–ঠিক করে বলো রাইটুদা। পেট্রোল পোড়ানোর পয়সা নেই।

রাইটু এবার ওর দিকে তাকাল লাল চোখে। তারপর ঝুঁকে এসে ওর কলার চেপে ধরে বলল—

–একটা চুতিয়া বিল্ডার বসের দশ কিলো রাবিশ সরিয়ে কুমোরটুলির কাছে রেললাইনের ধারে জমা করছে। প্রথমে ওর লরিটাকে ধরব। তারপর যদি দেখা যায়, বসের সন্দেহ সত্যি, তাহলে মালটাকে নামাতে হবে। বজবজের পোর্ট এরিয়ায় থাকবে মালটা!

ভগা একটু হেসে বলল, বসের বউকে কী বলেছে মালটা?

রাইটু মুখটা স্বাভাবিক করে বলল, খানকি!

ভগা চুপচাপ গাড়ি চালাতে গেল।

রাইটু ওর দিকে আবার তাকিয়ে বলল, বলেনি। আমি বসের কানে তুলেছি ইচ্ছে করে। যাতে মালটাকে জবাই করার ব্যাপারে ফুল লাইসেন্স দেয় বস।

ভগা হাসতে লাগল হো হো করে। হাসতে লাগল রাইটুদাও।

কিন্তু ভগার মন থেকে সন্দেহ গেল না। ভগার মন বলল, ওদের এই কাজটায় বিশেষ উদ্দেশ্যে পাঠানো হচ্ছে। বড় কোনও কারণ অবশ্যই আছে। একেই সিঙ্গুর আর নন্দীগ্রামের পর পলিটিকাল সিচুয়েশন গোলমেলে। বেগুনিবাবুকে চেপে থাকতে বলেছে লোকাল কমিটি থেকে, এর মধ্যে এমন ছুটকো ক্রাইম করাবে বস?

ভগাকে ওদেরই কয়েকজন বলছিল, কিছু একটা জিনিসের পেছনে পড়ে রয়েছে বেগুনিবাবু, তার জন্য দুনিয়া ভুলে গেছে!

কী সেই জিনিস, তাও ঠিক করে কেউ বলতে পারছে না। শুধু এটুকু জানে সকলে, হঠাৎ বস্তির এক বুড়ো সাধুবাবামার্কা লোকের কাছে মালটা আছে।

 

সেই জন্টির জিম, এই নামেই সবাই চেনে জিমটাকে। সেখানেই দুটো ডাম্বেল হাতে অন্যমনস্কভাবে বসেছিল সাহেব। ভাল নাম সপ্তর্ষি রায়।

আজ সকালের ফোনটা ওর মাথা ঘুরিয়ে দিয়েছে।

সদ্য কলেজে পা দেওয়া সাহেব বা সপ্তর্ষি বড় হয়েছে অন্য পাড়ায়। ঠনঠনিয়া কালীবাড়ির পাশের ঝামাপুকুর স্ট্রিটে। ছোট থেকেই শুনত, শোভাবাজারে ওদের একটা বাড়ি ছিল, যেটা বেচে দেওয়া হয়েছিল। ওর বাবার সারাজীবনের ইচ্ছে ছিল, শোভাবাজারে একটা বাড়ি করার। অবশেষে ঝামাপুকুরে ওদের বহু বছরের পুরনো বাড়িটা যখন বিক্রি হল, তখন সেই টাকায় শোভাবাজারে গঙ্গার ধারের ফ্ল্যাটটায় এসে উঠল ওরা।

ঠনঠনিয়ার বাড়িতে থাকতেই কয়েকবার ওর এক জেঠুর কথা শুনেছিল ও। বলত ওর মা, বাবা, কাকারা। বাবার চেয়ে বয়সে বেশ কিছুটা বড় জেঠু না কি নকশাল করত। এসব ফিসফিস করে নয়, বরং বেশ লোক জানিয়েই বলার বিষয় হয়ে গেছে এখন। ওর জেঠু বীরপুরুষ, স্বাধীনতা সংগ্রামীদের মতো, না কি বাজে লোক, গুন্ডা-বদমাশের মতো— এই প্রশ্নের মীমাংসা হতে অনেকদিন সময় লেগেছে ওর মনের ভেতর। শেষত ও বুঝেছিল, ওর বাবা যতই ওদের জমিদারি শেকড়ের কাছে ফিরতে চাক, মনে মনে তার দাদাকে বেশ কিছুটা সমীহই করে সে। আর সাহেবও মনে মনে বুঝতে শিখেছে, ওর বাবারা মাঝেমধ্যে যতই ওর সেই জেঠুকে ফেলিওর বলুক না কেন, আসলে হয়তো ওর বাবারা নিজেদেরও ফেলিওর বলেই মনে করে ভেতরে ভেতরে। বিপ্লবী বিপ্লবী ভাব, বিপ্লবের অভাব— ওদের স্কুলের এক স্যার বলতেন, সেটাই মনে পড়ে সাহেবের, ওর বাবা-কাকার কথা ভাবলে।

ওর চিন্তায় ছেদ পড়ল।

মোবাইলটা বেজে উঠেছে। সকালের নম্বর।

–বলুন!

ফোনটা ধরল সাহেব।

–আমি গঙ্গার ঘাটে আছি। তুমি কি আসবে?
–হ্যাঁ, যাচ্ছি।

জিমের ব্যাগ গুছিয়ে, জামাকাপড় পরে সাহেব রওনা দিল। হাঁটা পথে দু’মিনিট। একটু এগোতেই একটা কাঁচাপাকা চুল-দাড়ির হ্যান্ডসাম, হালকা বয়স্ক একটা লোককে দেখতে পেল সাহেব।

–আপনি… কি…

সাহেবের দিকে ফিরল লোকটা। তারপর সাহেবকে আপাদমস্তক দেখে স্মিত হেসে বলল, হ্যাঁ, আমার নামই রোহিতাশ্ব মজুমদার।

 

অদূরে বসে থাকা মারুতি গাড়িটাতে স্টিয়ারিংয়ে রাখা ভগার হাত থেকে জয়েন্টটা নিল রাইটু। একটা টান দিয়ে অনেকক্ষণ ধোঁয়াটা ধরে রাখল। তারপর সেটা ছাড়তে ছাড়তে বলল, বিল্ডারটার কল্লা নামানোর জন্য গোটা সন্ধে পড়ে রয়েছে। আপাতত আমাদের কাজ এই আধবুড়ো ললিপপটাকে একটু চোখে চোখে রাখা।

ভগার চোখ সোজা ছিল একটু দূরে দাঁড়ানো স্টাইলিশ লোকটার দিকে। লোকটার মাঞ্জাটা দেখছিল মন দিয়ে। এসব আঁতেলমার্কা সাজ হেভি লাগে ভগার। এখন, রাইটুর কথাটা শুনে চমকে উঠল সে।

ঠিকই ধরেছিল সে তার মানে। বিল্ডারের হিসেব নেওয়া বোনাস কাজ। এটাই আসল।

 

[ক্রমশ]

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4880 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

1 Trackback / Pingback

  1. তারান্তিনো, সিজন দুই — একুশ – ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

আপনার মতামত...