পার্থ সারথি মৌলিক
সমাজকর্মী, নাট্যকর্মী
এই পশ্চিমবঙ্গে শিক্ষাপদ্ধতি ও ব্যবস্থা নিয়ে চর্চা কম হয় না। কিন্তু এই চর্চাতে কারিগরি শিক্ষা বরাবরই উপেক্ষিত। আবার তারমধ্যেও পলিটেকনিক অর্থাৎ ডিপ্লোমা স্তরের কারিগরি শিক্ষা নিয়ে কোনও আলোচনা একদমই হয় না। কারণ কারিগরি ডিগ্রি শিক্ষা এখন বেশিরভাগটাই বেসরকারি। ঝাঁ চকচকে ব্যপার আছে। এবং তার ভর্তি পরীক্ষার প্রস্তুতি পড়াশুনো এতটাই অর্থনির্ভর যে আর্থিকভাবে দুর্বল পরিবারের পক্ষে তা আকাশকুসুম স্বপ্ন। কিন্তু ডিপ্লোমা স্তরের সরকারি পলিটেকনিক কলেজ এখনও বেশ কিছু রয়েছে। সাধারণভাবে খরচাও অনেক কম। ফলে পলিটেকনিক শিক্ষা এখনও সাধারণ মানুষের সাধ্যের বাইরে যায়নি। সেইজন্যই ভোট আদায়ের জন্য পলিটেকনিক কলেজ নির্মানের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি এক হাতিয়ার। কিন্তু একটি কলেজের বাড়ি তৈরি আর প্রকৃত অর্থে শিক্ষাকেন্দ্র হয়ে ওঠা বিস্তর পার্থক্য। নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি বাস্তবে আর কবে গুরুত্ব পেয়েছে! কিন্তু অবাক লাগে শিল্পায়ন হচ্ছে কি না তা নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলি তরজা করে কিন্তু কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নিয়ে কথা বলতে তাদের বড্ড অনীহা। অবশ্য এই শ্রেণিবিভক্ত সমাজে নীতিই হচ্ছে ‘ফেলো কড়ি মাখো তেল’। মেধা-টেধা গুলি মারো। ট্রেনে বেশি পয়সা দিলে যেমন আরামে যাওয়া যায় তেমন বেশি পয়সা দিলে তুমি ভালো শিক্ষা পাবে। ঘুরিয়ে সমাজকে বাধ্য করা হচ্ছে বেসরকারিকরণ মেনে নিতে। এবং এই প্রশ্নে শাসক বাম-ডান বা কেন্দ্র-রাজ্য সরকারগুলির কোনও পার্থক্য নেই। এই পয়সার খেলাতে দরিদ্র পরিবারের সন্তানেরা আসলে শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এই ছোট্ট পরিসরে সেই আলোচনাটিই করতে চাইছি।
কারিগরি শিক্ষা বর্তমানে ত্রিস্তরীয়। প্রাথমিক স্তরে আইটিআই ও ভোকেশনাল, মধ্যম স্তরে ডিপ্লোমা, সর্বোচ্চ স্তর ডিগ্রি-ইঞ্জিনিয়ারিং। এবং আইটি আই ও ভোকেশনাল স্তর থেকে ধাপে ধাপে পলিটেকনিক হয়ে ডিগ্রি ইঞ্জিনিয়ারও হওয়া যায়। সুতরাং দক্ষ কারিগর ও ইঞ্জিনিয়ার গড়ে তুলবার ক্ষেত্রে ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিং খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলির অনুমোদক সংস্থা হল এআইসিটিই (All India Council for Technical Education)। ছাত্রসংখ্যা থেকে শিক্ষকদের বেতন সব নির্ধারণ করে তারা। পরিদর্শনের দায়িত্বটাও তাদের। কিন্তু এআইসিটিই বেতনকাঠামো নির্ধারণ করলেও যেহেতু কোনও আর্থিক দায়িত্ব নেয় না, সরকার বা কলেজ-কর্তৃপক্ষ পলিটেকনিক শিক্ষকদের উচ্চতর শিক্ষার সুযোগ থেকে সঠিক বেতন দিচ্ছে কিনা সেই নিয়ে মাথা ঘামায় না। তারা ভাবে খালি মনুষ্যবর্জিত পরিকাঠামো নিয়ে। শিক্ষকেরা ঠিকঠাক বেতন পাচ্ছেন কি না, গুণগত মান উন্নয়নের সুযোগ পাচ্ছেন কি না, আদৌ পর্যাপ্ত শিক্ষক আছে কিনা, পদ্ধতি মেনে শিক্ষক নিয়োগ হচ্ছে কি না, এই দেখার দায় কার? কোনও উত্তর নেই। কেন্দ্রীয় মানবসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রক যেন মৌনীবাবা।
আমাদের রাজ্যে প্রায় ১৪৬টির মতন পলিটেকনিক কলেজ আছে যার মধ্যে ৬৮টি রাজ্য সরকারি কলেজ। বাকি বেসরকারি। অধিকাংশ বেসরকারি কলেজেই শিক্ষক থেকে ল্যাব কিছুই নেই। এই কলেজগুলি খালি পয়সা নিয়ে সার্টিফিকেট দিচ্ছে। কিন্তু সরকারি কলেজ! তাদের কাছে তো মানুষের কিছু প্রত্যাশা থাকে। সেগুলি কেমন চলছে?
আমাদের ক্ষুদ্র জ্ঞানে বুঝি যেকোনও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ভালো হওয়া নির্ভর করে তার পঠনপাঠনের সিলেবাস, পরিকাঠামোসহ সর্বোপরি উপযুক্ত শিক্ষকের পর্যাপ্ত সংখ্যার উপর।
বরাবরই শিল্পায়নের উপযোগী মানবসম্পদের নিরিখে ডিপ্লোমা স্তরের কারিগরি শিক্ষার গুরুত্ব অপরিসীম। একজন ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার শ্রমিক ও ম্যানেজমেন্টের মধ্যেকার সেতু। সুতরাং একদিকে যেমন তার কারিগরি তাত্ত্বিক জ্ঞান দরকার তেমনি একটু বেশিমাত্রায় দরকার হাতেকলমের কারিগরি শিক্ষা। ফলে ডিপ্লোমা সিলেবাস অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই সিলেবাস তৈরি করে রাজ্য সংস্থা ওয়েস্টবেঙ্গল স্টেট কাউন্সিল ফর টেকনিক্যাল এডুকেশন। কিন্তু বর্তমানে দেখা যাচ্ছে হাতেকলমে কাজের গুরুত্ব কমিয়ে তাত্ত্বিক জ্ঞানের গুরুত্ব বাড়ানো হচ্ছে (প্রথম বর্ষে সপ্তাহে ৩৪ ঘণ্টার মধ্যে মাত্র ১৩ ঘণ্টা প্র্যাক্টিকাল)। এটার অন্যতম কারণ মনে হচ্ছে ছাত্রছাত্রীরা শিক্ষাশেষে চাকরি পাচ্ছে না, ফলে সবারই বিটেক ডিগ্রি কলেজে ভর্তি হওয়ার প্রবণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। যেহেতু ডিপ্লোমা পাশ করলে বিটেকে সরাসরি দ্বিতীয় বর্ষে ভর্তি হতে পারে ফলে তাদের ডিগ্রি কলেজের মতন তৈরি করে তোলাটাই লক্ষ্য হয়ে দাঁড়াচ্ছে। শিল্প উপযোগী নয়। সবারই লক্ষ্য হয়ে যাচ্ছে কোনও রকমে ডিপ্লোমা পাশ করে ডিগ্রি কলেজে ভর্তি হওয়া। এটা একদমই হওয়া উচিত ছিল না। যদিও এই বছর থেকে নতুন সিলেবাস আসছে। কিন্তু বাস্তবায়িত করবার মতন পরিকাঠামো কোথায়? বা বলা যায় সরকার ইচ্ছাকৃতভাবে পরিকাঠামো গড়তে রাজি নয়।
এই চিন্তাভাবনার ছায়া নিয়োগের ক্ষেত্রেও পড়েছে। জানলে অবাক হবেন গত ১৫ বছরে সরকারি কোনও পলিটেকনিকে ল্যাবরেটারি বা ওয়ার্কশপে কোনও স্থায়ী ইন্সট্রাকটর নিয়োগ হয়নি। অতটা গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়নি নিশ্চয়ই। একটি সরকারি কলেজেও কোনও স্থায়ী টেকনিক্যাল অ্যাসিস্ট্যান্ট নেই। পুরোটাই অল্প কিছু আংশিক সময়ের এবং চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের মাধ্যমে চলছে। তারা যোগ্যতাহীন এমনটা নন কিন্তু চাপ এতটাই বেশি এবং তাদের সাম্মানিক এতটাই কম, শেখানোর উৎসাহ স্বাভাবিকভাবেই পান না।
আর অধ্যাপকদের অবস্থা কেমন? সংখ্যা চরম অপ্রতুল, গড়ে বিভাগ প্রতি তিনজন করে শিক্ষক (কলকাতা ও সন্নিহিত কলেজগুলি বাদ দিয়ে)। গত ছয় সাত বছর ধরে কোনও অধ্যাপককে নিয়মমাফিক পদ্ধতিতে উচ্চশিক্ষার সুযোগ দেওয়া হয়নি। যদিও মানোন্নয়নের সঙ্গে বেতনক্রম ও ছাত্রদের শিক্ষার উন্নতিও জড়িত। যদিও এই সুযোগ কেউ কেউ কোনও একভাবে পেয়েছেন। কীভাবে? অনুমান করা কঠিন নয়। সরকারি শাসকদলের বড় নেতার সুপারিশ থাকলে অসুবিধে নেই। তৃণমূল সরকার এসেই তদন্তের অজুহাতে দপ্তরের স্থায়ী ডিরেক্টর পার্মানেন্ট ওয়েটিঙে পাঠিয়েছিল। ফলে দপ্তরের আধিকারিক, শিক্ষক, কর্মচারীরা পরিষ্কার বুঝে গিয়েছিলেন আনুগাত্যে ঘাটতি থাকলে কী হতে পারে? তারাও বিশেষত স্থায়ী কর্মচারীরা অনুগত হতে বেশি দেরি করেননি। কিন্তু এই আনুগত্যের পরিনতি কী হয়েছে? স্থায়ী শিক্ষকদের অবসরের বয়স পঁয়ষট্টি হয়েছে। বাড়ির কাছে বেশিরভাগ শিক্ষক-কর্মচারীদের বদলি হয়েছে। কিন্তু আসল শিক্ষার জায়গায়? একটু আলোচনা করা যাক।
যেহেতু শিক্ষকের সংখ্যা কম প্রতি অধ্যাপককে গড়ে সপ্তাহে ২২ থেকে ২৫টি করে বা আরও বেশি ক্লাস নিতে হয়। বেশিরভাগ ক্লাসে ছাত্রসংখ্যা ৭০-এরও বেশি। প্রায় ৬০ জন ছাত্রপিছু একজন অধ্যাপক। ক্লাস ছাড়াও বহুবিধ অতিরিক্ত দায়িত্ব শিক্ষকের থাকেই। কারণ বেশিরভাগ জেলার পলিটেকনিক কলেজগুলিতে ল্যাবের দায়িত্ব থেকে করণিকের কাজ সব শিক্ষকদের সামলাতে হয়। কোনও কলেজে আলাদা প্লেসমেন্ট অফিসার নেই। এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যপার একটি বড় সংখ্যায় জেলার কলেজগুলি পুরোপুরিভাবে বাৎসরিকভাবে চুক্তিতে নিযুক্ত অধ্যাপকদের (সংখ্যায় মোট শিক্ষকের প্রায় ৪০ শতাংশ) ওপর নির্ভরশীল। গত ১০ বছর একটি পয়সাও মাইনে বাড়েনি তাদের। ২০২১ সালে মাইনে বেড়েছে তা হচ্ছে ২০১১ সালে একজন শিক্ষক নতুন চাকরিতে ঢুকলে যে মাইনে পেতেন তাই। এআইসিটিই বেতন কাঠামো তো দূর অস্ত। কোনও সামাজিক সুরক্ষা নেই। মাইনের অঙ্ক বললে লজ্জা লাগবে বলে বলছি না। মাননীয় মুখ্যমন্ত্রী প্রস্তাবিত ‘২০০০ টাকার শিক্ষক’-এর অনুপ্রেরণা বোধহয় এদের কাছ থেকেই পেয়েছেন। মনে রাখতে হবে আমরা শিক্ষাব্যবস্থার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ নিয়ে কথা বলছি। অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ, সামাজিক সুরক্ষাহীন, সন্তানের শিক্ষা ও পথ্য জোগাতে অপারগ শিক্ষককুল তার ছাত্রছাত্রীদের শিক্ষার প্রতি কতটা মনোযোগ দিতে পারেন? এক চরম সামাজিক অপমানের বোঝা নিয়ে এরা কাজ করে চলেছেন। তবে দীর্ঘদিন কম বেতনে কাজ করিয়ে স্থায়ী না করে শোষণ করাটা বিচারবিভাগ-সরকার-মন্ত্রী-দপ্তরের আধিকারিকদের সমন্বয়ে এটি একটি সামাজিক ন্যায্যতা পেয়েছে। এবং সবচেয়ে দুঃখজনক যে ঘটনাটি লক্ষ করা যাচ্ছে যে সারাদিন একসঙ্গে কাজ করা স্থায়ী কর্মীরা অস্থায়ীদের বিরোধীপক্ষ হয়ে উঠছেন। অবস্থা এমন যে অধ্যাপকদের ইউনিয়ন অস্থায়ী অধ্যাপকদের স্থায়ীকরণের ব্যপারে বিরোধী অবস্থান নিচ্ছে। এবং অস্থায়ীদের মুল বিরোধীপক্ষ হয়ে দাঁড়ায় দপ্তরের স্থায়ী কর্মীরা। এমনকি স্থায়ী কর্মীদের সংগঠন তাদের বেতন বাড়ানোরও বিরোধিতা করে। কিন্তু স্বচ্ছতার সঙ্গে কর্মচারী নিয়োগের প্রশ্নে এরা চুপ। প্রকৃতপক্ষে সরকারি উচ্চবেতনের শিক্ষককুল তাঁদের শ্রেণিঅবস্থানের জায়গা থেকে সরকারের সঙ্গে একযোগে সরকারি কারিগরি শিক্ষার মূল জায়গাটিকে ধ্বংস করছেন।
সরকারের এই নির্লিপ্ত উদাসীনতা সত্ত্বেও জেলার ছাত্ররা এই চুক্তিশিক্ষকদের কাছ থেকেই যতটুকু শেখার শিখছেন। পড়ানোর মান নিয়েও ছাত্রবিক্ষোভের খবর নেই। তবে এই সর্বনাশা ঐতিহ্য কিন্তু বাম সরকারের উত্তরাধিকার যা এই সরকারের আমলে আরও বিকশিত হয়েছে।
আসলে এই পলিটেকনিক শিক্ষা নিয়ে আমরা আলোচনা করতে চাই না কারণ এর মধ্যে কোনও এলিটিজম নেই। এই স্তরের ছাত্রছাত্রীরা মূলত দরিদ্র ঘর থেকে আসে। কারণ তাদের ডিগ্রি-ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার মতন অর্থ নেই। অথচ এইখানে অল্প কিছু হলেও চাকরির সুযোগ আছে। আর ডিপ্লোমা ‘পাশ’ দিয়ে যদি কোনওরকমে ছোটখাটো চাকরি জুটিয়ে সংসারের হাল ধরতে পারে। প্রকৃতপক্ষে এটি গরিবদের জন্য গরিবি শিক্ষাব্যবস্থা। এর দিকে নজর না দিলেও চলবে!
কিন্তু দরিদ্র পরিবারের ছেলেমেয়েদের শিক্ষার সংগ্রাম আর ততোধিক দরিদ্র অপমানিত শিক্ষকদের নিয়ে আলোচনা সংস্কৃতিমনা শিক্ষিত বাঙালিদের ভালো না লাগলেও ভবিষ্যতের কথা ভেবে করতে হবেই।