অভিষেক ঝা
শিক্ষক, গল্পকার, অনুবাদক, প্রাবন্ধিক
সাম্প্রতিক সময়ে পশ্চিমবাংলার রাজ্য সরকার ও রাজ্যের ক্ষমতাসীন দল তৃণমূল কংগ্রেস যে বিষয়টি নিয়ে সবচেয়ে বেশি অস্বস্তি বোধ করছে তা নিশ্চিতভাবেই আমতায় নিজের বাড়িতেই পুলিশ প্রশাসনের উপস্থিতিতে এবং সম্ভবত পুলিশ প্রশাসনের দ্বারা ছাত্রনেতা আনিস খানের খুন। প্রশাসনকে ব্যবহার করে এবং অনেক ক্ষেত্রে প্রশাসনকে সরাসরি নির্দেশ দিয়েই রাজনৈতিক উদ্দেশ্য চরিতার্থ করতে খুন খুব একটা বিরল ব্যাপার ‘গণতন্ত্রে’ নয়। ভারতীয় ‘গণতন্ত্রে’ ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল পুলিশ ও প্রশাসনকে ব্যবহার করবে এবং দরকারে পুলিশ ও প্রশাসনকে ব্যবহার করে রাজনৈতিক খুন করাতেই পারে— এমন অগণতান্ত্রিক ধারণাও বিগত কয়েক দশক ধরে ভারতীয় ‘গণতন্ত্রে’র প্রায় অবিচ্ছেদ্য অংশ। এইদিক থেকে ভাবলে আনিস খানের খুনের কোনও আলাদা তাৎপর্য থাকার কথা নয়। শেষ পনেরো বছরে রিজওয়ানুর রহমান, সুদীপ্ত গুপ্ত, রাজকুমার রায় এদের মতোই একটি ঘটনা হিসাবে দেখা যেতে পারত আনিসের খুন। এমন সব ঘটনা যেখানে প্রশাসন, পুলিশ, তদন্তকারী সংস্থা, শাসকদল, এবং শেষতক বিচারব্যবস্থা ছাড়া প্রায় সবাই ধরতে পারে এই সব ‘আত্মহত্যা’ ও ‘দুর্ঘটনা’র পিছনে ক্ষমতাসীন শাসকদলের মদতপুষ্ট ব্যক্তি, পুলিশ, প্রশাসনের সর্বময় উপস্থিতি। পশ্চিমবাংলার সাম্প্রতিক অতীতের ভিত্তিতে তাই আনিসের খুন আপাতভাবে খুব অস্বাভাবিক কিছু নয়। পুলিশ ও প্রশাসন ব্যবহার করে রাজনৈতিক সন্ত্রাস চালানো তৃণমূল কংগ্রেস পরিচালিত সরকারের ক্ষেত্রে প্রায় নিয়মে পরিণত হয়েছে। কিন্তু এতসব কিছুর পরেও আনিসের খুনকে ‘স্বাভাবিক’ভাবে মেনে নিতে বেশ খানিক অস্বস্তি আসে। এই খুন পশ্চিমবাংলার রাজনীতিতে খুব টিপিক্যাল ‘প্রশাসনের অশরীরী উপস্থিতিতে অস্বাভাবিক মৃত্যু’র ‘স্বাভাবিক’ ধারণাকেও তছনছ করে দেয়।
‘গণতন্ত্রে’র পরিসরে দীর্ঘদিন ধরে বসবাস করতে করতে আমরা জেনে গেছি যে রাষ্ট্রক্ষমতা, আরও সোজা করে বললে, পুলিশ, প্রশাসন, সেনাবাহিনি, তদন্তকারী সংস্থা, বিচারব্যবস্থা ইত্যাদিকে ব্যবহার করে শাসনে থাকা রাজনৈতিক দল নিজের অন্যায় ও দুর্নীতির বিরুদ্ধ-স্বরকে চেপে দেওয়ার চেষ্টা করবে এবং নিজ প্রয়োজন অনুযায়ী সেই স্বরকে জেলে পাঠাবে, একের পর এক মামলা দিয়ে জীবন দুর্বিষহ করে তুলবে, এবং খুন করবে। এই ‘খুন’গুলি বেশিরভাগই হবে ‘অস্বাভাবিক’ মৃত্যু, আত্মহত্যা, দুর্ঘটনা, খুব জোর ‘এনকাউন্টার’ নাম দিয়ে। সাধারণত ভারতীয় সেনাবাহিনির মতো উদ্ধত মেশিনারিও নিজেদের খুনগুলি চেপে রাখার ভাণটি এখনও করে থাকে। গত বছর ডিসেম্বর মাসে নাগাল্যান্ডে সাধারণ নাগরিকদের খুন করে ভারতীয় সেনা সকলের অগোচরে পালাতেই গিয়েছিল, স্থানীয় মানুষ তাড়া করে ধরে ফেলায় সেই খুনে নিজেদের দায় অস্বীকার করা সম্ভবপর হয়নি। ‘গণতান্ত্রিক’ পরিসরে এই সমস্ত প্রোটোকল ও ভণিতা মেনে খুন করা না হলে আমাদের মতো ‘গণতন্ত্রপ্রেমী’ মানুষদের অস্বস্তি শুরু হয়। আমরা ভয় পেতে শুরু করি যে ভারতবর্ষের অংশ ‘সালওয়া জুড়ম’, কিংবা, ‘কুনান পোশপোড়া’ সেই ভারতবর্ষ ‘গণতান্ত্রিক’ভাবে এগিয়ে আসছে আমার পাড়ায়, আমার বাড়িতে। সেই সময় এই ‘গণতন্ত্র’ আমাদের মতো নিরাপদ দূরত্বে থাকা মানুষদের কাছেও তার প্রকৃত ফ্যাসিবাদী চেহারাটা নিয়ে স্পষ্ট হতে শুরু। আনিস খানের খুন আমাদের এই প্রবল অস্বস্তির সামনে দাঁড় করায়।
ক্ষমতার বিরুদ্ধে যারা স্বর তোলেন, তাদের মধ্যেও মাত্রাভেদ করে থাকে রাষ্ট্র। এই মাত্রাভেদ নির্ভর করে রাষ্ট্রের পক্ষে সেই বিরুদ্ধ-স্বরের বিপজ্জনক হওয়ার প্রকৃত ক্ষমতা, আর্থ-সামাজিক অবস্থান, ধর্ম ও বর্ণ ইত্যাদি অনুযায়ী। সেই মাত্রাভেদ অনুযায়ী বিরুদ্ধ-স্বরদের যার যা প্রাপ্য তাই জোটে। মাত্রা অনুযায়ীই নিজেদের প্রাপ্য বুঝে নেন প্রশান্ত ভূষণ, অরুন্ধতী রায় এবং শার্জিল ইমাম। আনিস খানের ক্ষমতার বিরুদ্ধে স্বর কখনওই শার্জিলসম ছিল না। ‘গণতান্ত্রিক’ পরিসরেই যতটা প্রতিবাদ করার সাহস ও ক্ষমতা রাখেন রাজনৈতিকভাবে সক্রিয় একজন সাধারণ মানুষ আনিস খানের প্রতিবাদের পরিসর ছিল ততটাই। এই পরিসরের মানুষরা ক্ষমতায় থাকা রাজনৈতিক দলের দ্বারা হত্যার হুমকি পেতে পারেন এবং খুনও হয়ে যেতে পারেন সেই রাজনৈতিক দলের খুন করার জন্য নিযুক্ত কর্মীদের হাতে। সেটাও আমাদের ‘গণতান্ত্রিক’ পরিসরে প্রোটোকল মেনেই রাজনৈতিক খুন, তাই এতটা বিপন্ন বোধ করতাম না আমরা যদি আনিসকে খুনের হুমকি দেওয়া তৃণমূল কংগ্রেস নিজেদের পতাকা, ব্যানার নিয়ে বা, না নিয়ে আনিসকে খুন করত। একুশের বিধানসভা নির্বাচনে জয়লাভ করে ক্ষমতায় আসার পর তৃণমূল কংগ্রেস এইভাবে বহু খুন করেছে, বহু খুন করবেও। ‘গণতান্ত্রিক’ প্রোটোকল তাতে বিপন্ন হয় না বলেই আমরা মেনে নিয়েছি। এত মেনে নেওয়ার পরেও আমরা বিপন্ন বোধ করি যখন দেখি ‘গণতান্ত্রিক’ভাবে রাজনৈতিক খুনের যাবতীয় রীতি ও ভণিতার তোয়াক্কা না করে পুলিশের ইউনিফর্ম পরে পুলিশই আনিসের বাড়িতে গিয়ে খুন করে আসে এবং তা এত স্পষ্টভাবে করে যে রাজ্য প্রশাসন দু-দিনের মধ্যে মেনেও নেয় যে পুলিশের আনিসের মৃত্যুর সঙ্গে খানিক সংযোগ রয়েছে।
এই ভণিতাহীন খুন স্পষ্টভাবে কিছু বার্তা দেয়:
- আজকের দিনে পশ্চিমবাংলায় দাঁড়িয়ে তৃণমূল কংগ্রেসের বিরোধিতা করলে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকারের মেশিনারি প্রত্যক্ষভাবে সেই বিরোধী-স্বরকে চেপে দেওয়ার চেষ্টা করবে।
- তৃণমূল কংগ্রেস-বিরোধিতা আটকাতে পুলিশ ও প্রশাসন দিয়ে সরাসরি চাপ তৈরি করবে রাজ্য সরকার।
- দরকার পড়লে সরকারিভাবেই পুলিশকে ভাড়াটে খুনির মতো ব্যবহার করা হবে।
- সামান্যতম তৃণমূল কংগ্রেস-বিরোধিতা করলে কেউ সরাসরি পুলিশ ও প্রশাসনের হাতেই খুন হয়ে যেতে পারেন, যদি তিনি আর্থ-সামাজিক, ধর্ম ও বর্ণগতভাবে ক্ষমতাশীল গোষ্ঠীর মানুষ না হন।
সুনির্দিষ্ট পদ্ধতিতে এবং সুনির্দিষ্ট ‘মোডাস অপেরান্ডি’ ব্যবহার করেই এই বার্তাগুলি আনিস খানের খুনের ভিতর দিয়ে দেওয়া সম্ভবপর হয়েছে। এই পদ্ধতি ও প্রকরণ মেনে যে ‘গণতান্ত্রিক’ সরকার চলে তাকেই ইতিহাসের ধারায় ফ্যাসিবাদী সরকার বলে চিহ্নিত করা হয়।