লেতিসিয়া মার্তিনেজ-হেরনান্দেজ
শুনেছি, তাঁর হত্যাকারীরা না কি ভয়ে বিবর্ণ হয়ে শুনেছিল – আহত, রুগ্ন আর দুর্বল চে বলছেন – “গুলি চালাও কাপুরুষের দল! একটা মানুষকেই তো মারবে!” কয়েক মুহূর্ত পর ধীরে ধীরে চে-র নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে এলে জন্ম নিল বিশ্বের বৃহত্তম দৃষ্টান্তগুলোর একটা – বিপ্লব আর অঙ্গীকারের, বিশ্বস্ততা আর নির্ভীকতার, অদম্য সাহসের, সর্বহারার প্রতি আনুগত্যের। হত্যাকারী তাঁকে খুন করেছে বটে, কিন্তু গেরিলা জীবিত। আজও।
আমায় কেউ বলে নি। নিজের অভিজ্ঞতাতেই বুঝেছিলাম – কুড়ি বছর আগে যখন সান্তা ক্লারার অলিগলি ডুবে গিয়েছিল নিঃসীম নৈঃশব্দ্যে। বাতাসও সসম্ভ্রমে স্তব্ধ হয়ে ছিল, যখন রাস্তায় হেঁটে যাচ্ছিল মৌন শোকমিছিল। আমি ছিলাম হলুদ ইউনিফর্মে। সকাল থেকে সেন্ট্রাল হাইওয়ের ধারে একটা জায়গায় আমাদের দাঁড় করানো হয়েছিল। মানুষের মিছিলের হাত থেকে হাতে সেদিন পৌঁছে যাচ্ছিল চে-র দেহাবশেষ। ছাই। সারা দেশ জুড়ে।
এর ক’দিন আগে, আমাদের স্কুলের শিক্ষিকা ব্ল্যাকবোর্ডে একটা গানের কয়েক পংক্তি লিখলেন। গানটা ছিল – গেরারদো আলফন্সো রচিত সন লো সুয়েনিওস তোদাভিয়া (এখনও তারা স্বপ্নরাশি)। গানটার প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত আমরা গাইলাম, কেমন একটা ঘোরের মধ্যে, যেন সারাজীবন ধরেই গানটা আমাদের জানা। আমার এখনও মনে আছে, চে-র দেহাবশেষবাহী গাড়িটা আমাদের সামনে দিয়ে যে কয়েক সেকেন্ডে চলে গেছিল, আমাদের মনে হয়েছিল যেন কয়েক ঘন্টা অতিক্রান্ত হল। মনে আছে, সান্তা ক্লারার যেখানে তাঁর ছাই রেখে দেওয়া হয়েছিল – যেন বা নতুন করে তাঁকে স্বাগত জানাতে – তার চারপাশে আমার পায়ে-পায়ে ঘোরা।
এরপর এরনেস্তো গেভারা ভোকেশনাল স্কুলে পড়তে গেলে চে হয়ে উঠলেন সত্যিকারের অনুপ্রেরণা, আমার প্রতিদিনের হিরো। স্কুল ছাড়ার পর চে-র পায়ের ছাপ ধরে ধরে আমরা পৌঁছে গেছি এস্কাম্ব্রে পাহাড়ের কাবায়েতে দে কাসাস-এ। আমাদের মতন শহুরে বাচ্চাদের পক্ষে সে-জায়গা, বা যাত্রাপথ, মোটেও খুব আরামের ছিল না। তবু, শৈশব থেকে হাঁপানিতে ভোগা মানুষটা কী করে যে দীর্ঘ পথ পার করে ওইখানে এবং আরও অনেক পাহাড়ি আস্তানায় পৌঁছলেন, তা ভেবে সে-বয়েসেই যথেষ্ট রোমাঞ্চিত বোধ করতাম। শ্রদ্ধায় মাতা নত হয়ে আসত।
সে জন্যেই, গত রবিবার, অক্টোবরের আট তারিখ সূর্য ওঠার সঙ্গে সঙ্গে সান্তা ক্লারার প্লাজা যখন লোকে- লোকারণ্য, আমার মনে হচ্ছিল উনি এখনও ভীষণভাবে বেঁচে আছেন। ওঁকে দেখলাম, বসেছেন এক প্রাক্তন যোদ্ধার পাশে, যাঁর পুরোনো জলপাই পোষাকে লাগানো রয়েছে কর্মজীবনের সমস্ত পদক। যোদ্ধা ঈষৎ ঝুঁকে কথা বলছেন একটি ছেলের সঙ্গে, যে উৎকণ্ঠিত হয়ে বারবার মনে করছে মঙ্কাদা পায়োনিয়ারদের অবশ্যকর্তব্য। সান্তা ক্লারাতে ডাক্তারি পড়তে আসা লাতিন আমেরিকান যুবক-যুবতীদের মধ্যে ওঁকে দেখলাম। আলেইদাকে সঙ্গে করে রাউলের সঙ্গে হেঁটে যেতে দেখলাম। সেইসব মানুষেরা, যাঁরা চে-র মৃত্যুর পঞ্চাশ বছর পরেও ১৯৬৭-র সেই দিনটার কথা স্মরণ করে একই রকম শোকাকুল হন – কুবার সেই সাধারণ মানুষ – যাঁদের কথা চে লিখেছেন ফিদেলকে লেখা তাঁর শেষ চিঠিতে – আজীবন কুবার আপন মানুষদের আর ফিদেলকে ভুলতে না-পারার কথা – তাঁদের মধ্যেও দেখলাম আমার নায়ক এরনেস্তো গেভারাকে।
পাঁচ দশক পার করেও আমি তাঁকে দেখি লা ইগেরাতে – এই দ্বীপের কত দূরের লা ইগেরা, তাঁর স্ত্রী, সন্তানদের থেকে কত দূরের লা ইগেরা – যেখানে মাথা উঁচু করে মৃত্যুকে বরণ করলেন চে, ঘাতকের উদ্দেশ্যে শেষতম শ্লেষোক্তি ছুঁড়ে দিয়ে – “গুলি চালাও কাপুরুষের দল! একটা মানুষকেই তো মারবে!”
চে আছেন। আজও। সান্তা ক্লারার মানুষ তা হৃদয় দিয়ে জানে।
লেখিকা ‘গ্রানমা’-র সাংবাদিক। মূল রচনাটি গ্রানমা পত্রিকায় প্রকাশিত। http://en.granma.cu/cuba/2017-10-11/che-lives-on