সুমন কল্যাণ মৌলিক
শিক্ষক, প্রাবন্ধিক, মানবাধিকার কর্মী
আমাদের প্রতিবেশী দ্বীপরাষ্ট্র শ্রীলঙ্কার আর্থিক বিপর্যয় এই মুহূর্তে সারা পৃথিবীতে এক আলোচিত বিষয়। গগনচুম্বী মূল্যবৃদ্ধি, খাবার-জ্বালানি-বিদ্যুতের অভূতপূর্ব সঙ্কট, ভুখা মানুষের মিছিল, ক্রমবর্ধমান হিংসা, মন্ত্রিসভার সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের পদত্যাগ এই ক্ষুদ্র দেশটিকে ক্রমাগত অশান্ত করে তুলছে। পরিস্থিতি এতটাই খারাপ হয়েছে যে শ্রীলঙ্কা সরকার ১২ এপ্রিল (২০২২) আন্তর্জাতিক বাজারে নিজেকে দেউলিয়া ঘোষণা করে বিদেশি ঋণ শোধ করার দায় নিতে অস্বীকার করেছে। তবে এই দায় অস্বীকারে ঋণদাতাদের প্রতিক্রিয়া এখনও পর্যন্ত সহনশীল। সাধারণভাবে মনে করা হচ্ছে আইএমএফ ও সবথেকে বড় বেসরকারি ঋণদাতা এজেন্সি ব্ল্যাকরকের সঙ্গে কথা বলেই এই দায় অস্বীকারের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এক বিবৃতিতে সরকারের থেকে বলা হয়েছে বিকল্প ব্যবস্থা করতে পারলেই সুদ সহ তারা সমস্ত বকেয়া মিটিয়ে দেবে। যদিও দেশের একদল অর্থনীতিবিদের দাবি, এই ঋণের অনেকটাই অযৌক্তিক ও শোধ দেওয়ার কোনও দায় সরকারের থাকা উচিত নয়। স্বচ্ছতার জন্য তারা ঋণের অডিটের দাবিও রেখেছেন। এ কথা অস্বীকার করার কোনও কারণ নেই যে ১৯৪৭ সালে স্বাধীনতা লাভের পর এটা দ্বীপরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় আর্থিক সঙ্কট। এর আগে এই ধরনের সঙ্কট এসেছিল তিরিশের দশকে যখন পৃথিবী জোড়া মহামন্দা ও শ্রীলঙ্কায় ম্যালেরিয়া মহামারির আকার নেওয়ার পর সেদেশের আর্থিক স্থিতি দুর্বল হয়ে পড়ে।
এখন স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠছে এই সঙ্কটের কারণ কী! অর্থনীতির প্রেক্ষাপটে একাধিক কারণের কথা বলা হচ্ছে। অতি অবশ্যই করোনা অতিমারি শুধু স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা ক্ষেত্রেই বিপর্যয় ডেকে আনেনি, তা আর্থিক পরিস্থিতিকেও জটিল করেছে। অতিমারির কারণে পর্যটনব্যবসা থেকে আয় কমে যাওয়া, ঋণ বৃদ্ধি অবশ্যই বড় কারণ। ঋণের দায় মেটাতে দেশ আবার নতুন ঋণের জালে আটকা পড়েছে। চলমান রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধকেও একটা বড় কারণ হিসাবে চিহ্নিত করা হচ্ছে। একই সঙ্গে আতস কাচের তলায় ফেলা হচ্ছে রাজাপক্ষে ভ্রাতৃদ্বয়ের (রাষ্ট্রপতি গোতোবায়া রাজাপক্ষে ও প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা রাজাপক্ষে) আত্মঘাতী আর্থিক নীতিকেও। এই প্রত্যেকটি কারণই গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু একই সঙ্গে এটাও সত্যি যে করোনা অতিমারি ও যুদ্ধের মতো আন্তর্জাতিক ঘটনার অভিঘাত সব দেশেই পড়েছে। কিন্তু কোনও দেশেরই অর্থনীতি এরকম তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়েনি। তাই এই অনুসন্ধান জরুরি হয়ে ওঠে যে শ্রীলঙ্কার অর্থনীতি কি আগে থেকেই ঘুণ ধরা অবস্থায় ছিল যা অতিমারি ও যুদ্ধের জোড়া আঘাতকে সহ্য করতে পারল না? বর্তমান নিবন্ধ অতীতের আলোকে বর্তমান সঙ্কটকে ধরার এক প্রয়াস মাত্র।
সঙ্কটের চালচিত্র
দ্বীপরাষ্ট্রের আর্থিক সঙ্কটের চালচিত্রটা বিগত দিনের আর্জেন্টিনা, গ্রিস বা ইকুয়েডরের অভিজ্ঞতা থেকে আলাদা কিছু নয়। এই সঙ্কটের মূল কথা হল দেশের আয়ের চেয়ে খরচের পরিমাণ অনেক বেশি। দেশের এক মন্ত্রীর বয়ান অনুযায়ী ১০০ ডলার আয় হলে ঋণ মেটাতে ব্যয় হয় ১১৫ ডলার। এই অবস্থার জন্য দায়ী আমদানি ও রপ্তানির মধ্যেকার বিপুল বৈষম্য। যে সমস্ত দেশে রপ্তানির পরিমাণের চেয়ে আমদানির পরিমাণ বেশি, সেখানে প্রথম ধাক্কাটা পড়ে বিদেশি মুদ্রা ভাণ্ডারের ওপর। গত দুবছরে শ্রীলঙ্কার বিদেশি মুদ্রা ভাণ্ডারের ৭০ শতাংশ নিঃশেষিত হয়ে গেছে আমদানির দাম মেটাতে। পরিস্থিতির চাপে বিদেশি মুদ্রা বাঁচাতে সরকার রাতারাতি ৩৫০টি পণ্যের আমদানির উপর বিধিনিষেধ আরোপ করেছে। এর ফল হয়েছে বিপরীত। যেহেতু সেদেশের সরকার বহু আগেই খাদ্যে স্বনির্ভরতার নীতিকে পরিত্যাগ করেছে তাই আম-আদমির খাওয়া-পরা, বেঁচে থাকার ওষুধ, জ্বালানি— সবটাই আমদানিজাত দ্রব্য নির্ভর। তাই মাত্র ২ কোটি ২২ লক্ষ মানুষের এই দেশে খাবারই মিলছে না। জানুয়ারি থেকেই চড়া দামে খাবার ও জ্বালানি বিক্রি হতে শুরু করে, মার্চ মাস থেকে বাজারে সেগুলো অমিল। সেখানকার মানুষের প্রধান খাদ্য ভাত, অথচ দেশের বাজারে চালও মিলছিল না। মায়ানমার এক লক্ষ টন, ভারত পাঁচ লক্ষ টন এবং চিন এক মিলিয়ন টন চাল দান করলে অবস্থার সাময়িক উন্নতি হয়। বাজারে খাদ্যদ্রব্যের জোগান না থাকার কারণে পাইকারি মূল্য সূচক বৃদ্ধি হয় রকেটের গতিতে। এই মুহূর্তে শ্রীলঙ্কায় মুদ্রাস্ফীতির হার ১৫ শতাংশ যা এশিয়া মহাদেশে সবচেয়ে বেশি। শুধুমাত্র খাদ্যদ্রব্যে মূল্যবৃদ্ধি ২৫ শতাংশ, জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি ৫০ শতাংশ। চার মাস আগে একটা রান্নার গ্যাসের সিলিন্ডারের দাম ছিল ৭.৫০ মার্কিন ডলার যা এখন ১৩.২৫ মার্কিন ডলার (৮৫ শতাংশ বৃদ্ধি)। গুড়ো দুধের দাম বেড়েছে ১২.৫ শতাংশ। ফলে শ্রীলঙ্কার জনপ্রিয় পানীয় দুধ-চা দোকানে বিক্রি হচ্ছে না। সরকার ব্যালেন্স অব পেমেন্টের সঙ্কট থেকে বাঁচতে তার জমানো সোনা বিক্রি করছে, বাধ্য হয়েছে দেশের মুদ্রার ১৫ শতাংশ অবমূল্যায়ন ঘটাতে। এক কথায় দেউলিয়া অর্থনীতির যাবতীয় চরিত্র লক্ষণ শ্রীলঙ্কার অর্থনীতিতে ফুটে উঠছে।
স্বাধীনতা-উত্তর শ্রীলঙ্কা
শ্রীলঙ্কার আয়তন মোটের ওপর ৬৫,০০০ বর্গ কিমি। স্বাধীন দেশ হিসাবে যাত্রা শুরু করার সময় জনসংখ্যার ৭৫ শতাংশ গ্রামীণ এলাকায় বাস করত ও কৃষিই ছিল তাদের প্রধান জীবিকা। ম্যালেরিয়া প্রতিরোধী কর্মসূচির সাফল্য, খাদ্যে ভর্তুকি, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যে সরকারি খরচ বৃদ্ধি নাগরিকদের গড় আয়ু বৃদ্ধি করে, শিশুমৃত্যুর হার কমায়, সাক্ষরতার হার বাড়ে। ১৯৪৬-৫৩ পর্বে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ছিল ২২ শতাংশ এবং ১৯৫৩-৬৩ সময়পর্বে ৩৭ শতাংশ। সামাজিক ক্ষেত্রে ব্যয়-বরাদ্দ ছিল জিডিপির ১০ শতাংশ। সেই সময় নিম্ন ও মধ্য আয়ের দেশগুলির মধ্যে মানব উন্নয়ন সূচকে শ্রীলঙ্কার স্থান ছিল প্রথম সারিতে। একই সঙ্গে যে কোনও উন্নয়নশীল দেশের মতো বেকারি ও দারিদ্রের সঙ্কট, ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য ছিল প্রকট। প্রশাসনে কেন্দ্রিকতা, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, দুর্নীতি, রাজনৈতিক নেতৃত্বের অসততার মতো বিষয়গুলিও ছিল। কৃষিতে জমি-উদ্বৃত্ত অর্থনীতি থেকে শ্রম-উদ্বৃত্ত অর্থনীতির যাত্রা শুরু হয়। পঞ্চাশের দশকে বেকারত্বের হার ছিল ১০ শতাংশ যা সত্তরের দশকে বেড়ে হয় ২৪ শতাংশ। সব মিলিয়ে সত্তরের দশকে শ্রীলঙ্কার অর্থনীতিতে একটা স্থবিরতা দেখা দিতে শুরু করে।
নয়া-উদারবাদী অর্থনীতির আলিঙ্গনে শ্রীলঙ্কা
পূর্বে উল্লিখিত স্থবিরতা থেকে মুক্তি পেতে সেদেশের সরকার আর দশটা তৃতীয় বিশ্বের দেশের মতো নয়া-উপনিবেশবাদী রাজনীতির প্রতিভূ আন্তর্জাতিক অর্থলগ্নি সংস্থাগুলি, যেমন আইএমএফ ও বিশ্বব্যাঙ্কের শরণাপন্ন হয়। দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে শ্রীলঙ্কাই সর্বপ্রথম (সত্তর দশকের মাঝামাঝি) জয়বর্ধনের নেতৃত্বে কাঠামোগত সংস্কারের কাজ হাতে নেয় এবং নয়া-উদারবাদী অর্থনীতির রাস্তাকে একমাত্র বিকল্প হিসাবে ঘোষণা করে। এই বিষয়ে আইএমএফ ‘structural adjustment facility’ এবং বিশ্বব্যাঙ্ক ‘economic restructuring credit’-এর বিশেষ সুবিধা শ্রীলঙ্কাকে দেয়। সরকার ঘোষণা করে খাদ্য উৎপাদনে ভর্তুকি কমাতে হবে এবং শিল্প সংস্থাগুলির জন্য ঋণ ও অনুদানের বিশাল প্যাকেজ দেওয়া হবে। আশির দশকের সূচনালগ্নে কর্পোরেট ও মালিকবান্ধব শ্রম আইন কার্যকর করা হয়। ট্রেড ইউনিয়নগুলিকে ধ্বংস করা হয়, ইচ্ছেমতো ‘হায়ার অ্যান্ড ফায়ার’ প্রয়োগ করে প্রচুর সংখ্যক কর্মী ছাঁটাই করা হয়। কিন্তু একই সঙ্গে একথাও সত্য যে, দ্বীপরাষ্ট্রের রাজনৈতিক সঙ্কটের কারণে নয়া-উদারবাদী অর্থনীতির সার্বিক প্রয়োগ সম্ভব হয়নি। শ্রীলঙ্কার পরিচিতিসত্তার রাজনীতি সংখ্যাগরিষ্ঠ সিংহলি জনগোষ্ঠী ও সংখ্যালঘু তামিল জনগোষ্ঠীর মধ্যে এক রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধের জন্ম দেয়। সরকার ১৯৭৯ সালে কুখ্যাত ‘prevention of terrorism act’ পাশ করে পাইকারি হারে তামিলনিধন শুরু করে এবং তামিলদের একটা বড় অংশ এলটিটিই-র নেতৃত্বে সশস্ত্র সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়। এই গৃহযুদ্ধের দিকেই যেহেতু সবার নজর কেন্দ্রীভূত ছিল তাই শ্রীলঙ্কার অর্থনীতির ক্রমিক অধোগতির বিষয়টি সেভাবে আলোচিত হয়নি। ছাব্বিশ বছর ধরে এই গৃহযুদ্ধ চলার পর সেদেশে সম্পূর্ণভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠ সিংহলি শাসন ও কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়। এই সঙ্কট শ্রীলঙ্কার রাজনীতিতে ও প্রশাসনিক কাঠামোর গণতান্ত্রিক উপাদানগুলিকে দুর্বল করে সেখানে কর্তৃত্ববাদী শাসন মজবুত করে। সংবিধান সংশোধন করে রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা বাড়ানো হয়। এই রাজনৈতিক পরিবর্তনকে কাজে লাগিয়ে ২০০৮ সালে সেখানে অর্থনৈতিক সংস্কারের দ্বিতীয় পর্ব শুরু হয়। আন্তর্জাতিক মহলে শ্রীলঙ্কা এক উদীয়মান বাজার ও যুদ্ধোত্তর নবীন অর্থনীতি বলে পরিচিত হতে শুরু করে। বিভিন্ন দেশ (প্রধান উল্লেখ্য চিন ও ভারত) ও কর্পোরেট সংস্থাগুলি এই ছোট দেশে লগ্নি করতে শুরু করে। দ্বিতীয় পর্বে কলম্বো শেয়ারবাজারের আয়তন আঠারো মাসে চারগুণ বৃদ্ধি পায়। সংস্কার অর্থনীতির এই পঞ্চাশ বছরের যাত্রাপথকে আমাদের অবশ্যই মনে রাখতে হবে, কারণ আজকে শ্রীলঙ্কার এই দেউলিয়া হয়ে যাওয়ার সঙ্গে এই সংস্কার অর্থনীতির সম্পর্ক ওতপ্রোতভাবে জড়িত।
আজকের শ্রীলঙ্কা: পলিসি বিপর্যয়
আজকে দ্বীপরাষ্ট্রের আর্থিক সঙ্কট উদারবাদী অর্থনীতির ধারাবাহিক বিপর্যয়ের ফসল। কোভিড অতিমারি ও রুশ-ইউক্রেনের যুদ্ধ তাতে অনুঘটকের ভূমিকা পালন করেছে মাত্র।
প্রথমত, আমরা সবাই দেখতে পাচ্ছি আজ শ্রীলঙ্কার সাধারণ মানুষ তাদের প্রয়োজনীয় খাদ্যবস্তু সংগ্রহ করতে পারছেন না, কারণ তাদের অগ্নিমূল্য। এই অবস্থা তৈরি করা হয়েছে। আর্থিক সংস্কারের প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার পর থেকে সেদেশে কৃষিক্ষেত্রে রাষ্ট্রের ব্যয় ধীরে ধীরে কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। বলা হয়েছে খাদ্যশস্যের চাষ লাভজনক নয় বরং বিশ্ববাজারে খাদ্যের জোগান প্রচুর। তাই সেগুলো আমদানি করে নিলেই চলবে। অর্থকরী ফসলের নামে চা ও রবারের মতো বাগিচা ফসলের চাষের ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। পরিকল্পিতভাবে বাজার অর্থনীতির দায় মেনে গণবণ্টন ব্যবস্থা ধ্বংস করা হয়েছে। ফলে খাদ্যে স্বনির্ভরতার বদলে পরদেশনির্ভর খাদ্যনীতি চালু হয়েছে। এতদসত্ত্বেও যেটুকু কৃষিব্যবস্থা চালু ছিল তাকে জৈব চাষ করার তাড়াহুড়োতে রাসায়ানিক সার আমদানি নিষিদ্ধ করা হয়েছে। পূর্বপরিকল্পনা ছাড়া এই ধরনের তুঘলকি সিদ্ধান্ত বুমেরাং হয়েছে। কৃষি উৎপাদন আরও কমেছে। আজ যখন বিদেশি মুদ্রা বাঁচাতে একাধিক পণ্য (এর মধ্যে একটা বড় অংশ প্রক্রিয়াজাত খাদ্য) আমদানিতে নিষেধাজ্ঞা বসানো হয়েছে, তখন স্বাভাবিকভাবেই সেদেশে এক তীব্র খাদ্যসঙ্কট তৈরি হয়েছে।
দ্বিতীয়ত, সেদেশের সরকার কর্তৃক প্রকাশিত পরিসংখ্যান অনুসারে আমদানি বাণিজ্যের পরিমাণ রপ্তানি বাণিজ্যের পরিমাণের থেকে আশি শতাংশ বেশি। এটাই শ্রীলঙ্কার বিদেশি মুদ্রার ভাণ্ডার শূন্য হয়ে যাওয়ার বড় কারণ। পরিসংখ্যান দেখাচ্ছে শুধুমাত্র অতি-প্রয়োজনীয় নয় এমন সব দ্রব্য (চিজ, মাখন, শাক-সবজি, ফল, আইসক্রিম, কেচাপ) আমদানিতে গতবছর ৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ব্যয় করা হয়েছে, মোবাইল ফোন আমদানি করা হয়েছে ৩৮৬ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের। এই অবস্থা একদিনে হয়নি। প্রকৃত অর্থে বিদেশি বহুজাতিক সংস্থাগুলি উৎপাদিত পণ্যের বাজারে শ্রীলঙ্কাকে রূপান্তরিত করার লক্ষ্যে সেদেশে অতি ক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের বিকাশ ঘটতেই দেয়নি। সেদেশে যে পোশাকশিল্প রয়েছে তার বোতাম, সুতো পর্যন্ত বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়। আজ তাই যখন ৩৭৫টি অ-জরুরি দ্রব্যের আমদানির ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি হয়েছে তখন সেখানে পোশাকশিল্পের নাভিশ্বাস উঠে গেছে।
তৃতীয়ত, নয়া-উদারনীতি পর্বে শ্রীলঙ্কার অর্থনীতি হয়ে উঠেছে পর্যটন ও রিয়েল এস্টেট-নির্ভর। মজার কথা হল এই অর্থনীতি যেহেতু আন্তর্জাতিক বাজারের ওপর নির্ভরশীল তাই আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে যে কোনও ওঠানামা এই অর্থনীতির ওপর প্রভাব ফেলে। সেদেশের সরকার বেশ কিছু দিন ধরে আন্তর্জাতিক বাজার থেকে যথেচ্ছ ঋণ নিয়ে বৃহদাকার প্রকল্প তৈরি করছে যেগুলির আর্থিক ভবিষ্যৎ যথেষ্ট সন্দেহজনক। উদাহরণস্বরূপ হাম্বানটোটা বন্দর তৈরির কথা বলা যায়। চিনের থেকে ১২৬ কোটি মার্কিন ডলার ঋণ নিয়ে ২০১০ সালে এই বন্দর চালু হয়। কিন্তু কলম্বো বন্দরের সঙ্গে নৈকট্যের কারণে প্রকল্পটি কখনও লাভের মুখ দেখেনি। শেষে ১১২ কোটি মার্কিন ডলারের বিনিময়ে চিনের একটি সরকারি কোম্পানিকে বন্দরটি লিজ দেওয়া হয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে সেদেশের সবচেয়ে আলোচিত প্রকল্পটি হল কলম্বো পোর্ট সিটি। ক্যাসিনো, গলফ কোর্স, সুপারমার্কেট, আবাসন সহ এই প্রকল্পটির জন্য সরকার কোটি কোটি টাকা বিদেশি ঋণ নিয়েছে। অতিমারি পরিস্থিতিতে এই প্রকল্পের ভবিষ্যৎ এখন বিশ বাঁও জলে। এছাড়া শিক্ষার বেসরকারিকরণ ও সামরিকীকরণের লক্ষ্যে তৈরি হচ্ছে কোটেওয়ালা ন্যাশানাল ডিফেন্স ইউনিভার্সিটি। এই ধরনের বাস্তবতারহিত উচ্চাকাঙ্খী প্রকল্পগুলি দেশকে আরও দেউলিয়া হয়ে যাওয়ার দিকে এগিয়ে দিচ্ছে।
চতুর্থত, এই সার্বিক আর্থিক পলিসি শ্রীলঙ্কাকে এমন ঋণের জালে জড়িয়ে ফেলেছে যে একটা ঋণ শোধ করতে তাকে আরেকটা ঋণ নিতে হচ্ছে। একদিকে বাণিজ্য ঘাটতি, অন্যদিকে নতুন নতুন প্রকল্পের জন্য ঋণ তার বিদেশি মুদ্রার ভাণ্ডারকে নিঃস্ব করে দিয়েছে। ২০১৯ সালে বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয় ছিল ৭৬৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার যা ২০২২ সালে হয়ে দাঁড়িয়েছে ২০২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। এক্ষেত্রে একটা কথা বলা দরকার। যেভাবে মিডিয়ার একটা অংশে প্রচার করা হচ্ছে শ্রীলঙ্কাকে ঋণের জালে চিন জড়িয়ে ফেলেছে, বিষয়টা এমন নয়। সেদেশের ঋণের ৩৬ শতাংশ আন্তর্জাতিক সার্বভৌম বন্ড, যার দায় মেটাতে শ্রীলঙ্কা সরকার বাধ্য। বিগত সময়ে বিভিন্ন সময়ে আন্তর্জাতিক অর্থলগ্নি সংস্থা আইএমএফ চোদ্দবার সেদেশের আর্থিক সমীক্ষা করে তার জন্য নতুন নতুন ঋণের ব্যবস্থা করেছে। এর পর আসছে চিনের প্রশ্ন। সেদেশের সরকার বিভিন্ন প্রকল্পে চিনকে ডেকেছে। চিন তার আঞ্চলিক আধিপত্য ও শ্রীলঙ্কার বাজার দখলের লক্ষ্যে ঋণ দিয়েছে। ২০১৮ সালে শ্রীলঙ্কা চিন থেকে পায় ‘Foreign Currency Term Financing Facility’ যার মূল্য ছিল এক বিলিয়ন মার্কিন ডলার। এছাড়া হ্যামিলটন বন্দর সহ বিভিন্ন পরিকাঠামো প্রকল্পে চিনের বিভিন্ন কোম্পানি সেদেশে বিনিয়োগ করেছে। আর্থিক বিশেষজ্ঞদের মতে শ্রীলঙ্কার মোট ঋণের ১৪ শতাংশ চিনের কাছে। ভারত সরকারও নানাভাবে শ্রীলঙ্কাকে ঋণ দিয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে উল্লেখযোগ্য ৫০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার জ্বালানি আমদানির জন্য এবং এক বিলিয়ন মার্কিন ডলার আবশ্যক দ্রব্য কেনার জন্য। আসল বিষয়টি হল নয়া-উদারবাদী অর্থনীতি যে পরনির্ভরশীল অর্থনীতি শ্রীলঙ্কায় গড়ে তুলেছে তাতে এই দেউলিয়া হয়ে ওঠা অনিবার্য ছিল।
পঞ্চমত, সাম্প্রতিক সময়ে রাজাপক্ষে সরকারের সবচেয়ে আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত হল ব্যাপক কর হ্রাস। ২০১৯ সালের নির্বাচনে শাসক দলের নির্বাচনী স্লোগান ছিল ‘Vistas of prosperity and Splendour’। এই সমৃদ্ধির তাড়নায় সেদেশের উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্তদের ব্যাপক কর ছাড় দেওয়া হয়। এতদিন জিডিপির ৯ শতাংশ ছিল কর বাবদ আয়। কিন্তু নতুন আইনে সেই আয় ৩৫ শতাংশ কমে যায়। এই ভঙ্গুর অর্থনীতিতে দরকার ছিল ধনীদের ওপর আরও বেশি করে ‘সম্পদ কর’ বসানো, কিন্তু ঘটনা ঘটে তার উল্টো। এক্ষেত্রে মনে রাখতে হবে এই করছাড়ের ফলে শুধুমাত্র উচ্চবিত্তরাই উপকৃত হয়েছে। ২০১৬ সালের হিসাবে দেখা যাচ্ছে শ্রীলঙ্কায় প্রত্যক্ষ কর ১৫ শতাংশ। বাকিটা পণ্য ও পরিষেবা কেনার সময় দেয় অপ্রত্যক্ষ কর। এই ৮৫ শতাংশ করের চাপে সেদেশের শ্রমজীবী জনতা প্রতিনিয়ত পিষ্ট হচ্ছে।
ষষ্ঠত, ইতিমধ্যেই ভঙ্গুর আর্থিক অবস্থার উপর চূড়ান্ত আঘাত হেনেছে দুটি আন্তর্জাতিক বিষয়। প্রথমটি অবশ্যই কোভিড অতিমারি। এই অতিমারি শ্রীলঙ্কার পর্যটনশিল্পকে প্রায় দুবছর ধরে ধ্বংস করে দিয়েছে। অন্যদিকে রেমিট্যান্স বাবদ আয়ও কমিয়েছে। রপ্তানি বাণিজ্যেও তার প্রভাব পড়েছে। অন্যদিকে কোভিডজনিত স্বাস্থ্যবিপর্যয়ের ফলে সরকারকে সামাজিক ক্ষেত্রে ব্যয়বরাদ্দ বৃদ্ধি করতে হয়েছে। ফলে আবারও আয়ের তুলনায় ব্যয় বেড়েছে। একইভাবে রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধ দ্বীপরাষ্ট্রের জন্য সঙ্কট ডেকে এনেছে। বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির ফলে সেই খাতে সরকারের ব্যয় দ্বিগুণ হয়েছে। এছাড়া শ্রীলঙ্কা তার ৪৫ শতাংশ গম, ৫০ শতাংশ সয়াবিন, ৪০ শতাংশ সূর্যমুখী তেল ও মটরশুটি আমদানি করে রাশিয়া ও ইউক্রেন থেকে। এছাড়া এই দুটো দেশ আবার শ্রীলঙ্কার চায়ের অন্যতম ক্রেতা। একই সঙ্গে এটাও মনে রাখা দরকার যে সমস্ত দেশ তাদের নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য মূলত আমদানি করে, তাদের ক্ষেত্রে জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি আরও মুদ্রাস্ফীতি তৈরি করে। আন্তর্জাতিক সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে ২০২০ সালে একটি প্রমাণ সাইজেট কন্টেনারে ইউরোপ থেকে এশিয়ায় পণ্য আমদানির খরচ ছিল ২০০০ মার্কিন ডলার যা ২০২১ সালে হয়েছে ১০,০০০ মার্কিন ডলার। এই বৃদ্ধির মূল্যও আজ শ্রীলঙ্কাকে চোকাতে হচ্ছে।
সপ্তমত, এই পলিসি বিপর্যয় নিয়ে সেদেশে আলোচনা থাকলেও সেভাবে কোনও প্রতিরোধ গড়ে ওঠেনি। এর কারণ সংখ্যাগরিষ্ঠ সিংহলিরা গৃহযুদ্ধের সময় তামিল সংখ্যালঘুদের নিকেশের দাবিকে মান্যতা দিতে গিয়ে এক অগণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থাকে মেনে নিয়েছিল। তথাকথিত কঠোর রাষ্ট্রের স্লোগানের আড়ালে রাষ্ট্রপতির হাতে যথেচ্ছ ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হওয়ার ফলে গণতন্ত্র আক্রান্ত হয়, উপর্যুপরি সরকার নয়া-উদারবাদী অর্থনীতির আগ্রাসন জারি রাখে, যার ফল আজ সেদেশের মানুষ হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছেন।
সঙ্কটমুক্তির উপায়
এই সঙ্কটমুক্তির পথ কী? এখনও পর্যন্ত যা পরিস্থিতি তাতে সরকার আইনিভাবেই ঋণশোধের বিষয়টি স্থগিত রাখতে পারে। এক্ষেত্রে আইনের ধারা ‘পরিস্থিতির মৌলিক পরিবর্তন না হওয়া পর্যন্ত’ বিষয়টিকে কাজে লাগানো হবে। কিন্তু তাতে সমস্যার মূলগত সমাধান হবে না। রাষ্ট্রপরিচালকবৃন্দ যথারীতি আরও বেশি ধার করে পুরনো ঋণ শোধের পরিকল্পনা করছেন। এক্ষেত্রে প্রথম মতটি ছিল চিন, ভারত সহ কিছু দেশের কাছ থেকে বিশেষ শর্তে আর্থিক সাহায্য নেওয়া। কিন্তু সঙ্কটের চরিত্র যে ধরনের তাতে এইভাবে যথেষ্ট ঋণ পাওয়া যাবে না। বিকল্প মতটি হল সঙ্কটের মোকাবিলা করতে শ্রীলঙ্কা সরকারের একটি প্রতিনিধি দল আইএমএফের কাছে ৪০০ কোটি মার্কিন ডলারের আর্জি জানাবে যাতে তারা ঋণ শোধ করতে পারে। কিন্তু এই পথ আসলে এক মরণফাঁদ যার থেকে বেরিয়ে আসা প্রায় অসম্ভব। সাম্প্রতিক অতীতে আইএমএফের ঋণের জাল কী ধরনের সঙ্কট জনগণের জীবনযাত্রায় নিয়ে আসতে পারে তার আদর্শ উদাহরণ গ্রিস, আর্জেন্টিনা ও সেনেগাল।
এই সঙ্কট থেকে মুক্তি পেতে হলে বিকল্প অর্থনীতির সন্ধান করতে হবে। যেহেতু শ্রীলঙ্কার গৃহীত অর্থনীতির মধ্যেই এই সঙ্কট লুকিয়ে আছে তাই পরিবর্তন জরুরি। এই জন্য শুধু শোধ স্থগিত করলে চলবে না, একই সঙ্গে ঋণ অডিট করে ঋণের পরিমাণ পুনর্গঠন করতে হবে। অপ্রয়োজনীয়, অস্বচ্ছ যে সমস্ত ঋণ নেওয়া হয়েছে তা সরকার শোধ করবে না— এই কথা স্পষ্ট ভাষায় ঘোষণা করতে হবে। প্রয়োজনীয়তাভিত্তিক অর্থনীতি গ্রহণ করতে হবে। এই সঙ্কটের মধ্যেও সেদেশের সরকার সম্পূর্ণ অনাবশ্যকভাবে ২৪০ বিলিয়ন ডলার অ্যাকসেস ইঞ্জিনিয়ারিং নামে এক সংস্থাকে দিয়েছে নতুন রাস্তা নির্মাণের জন্য। আমদানি-রপ্তানির ঘাটতি মেটানোর জন্য অতিক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের বিকাশের দিকে নজর দিতে হবে। আত্মনির্ভরশীল অর্থনীতি হবে মূল মন্ত্র। আর সেই অর্থনীতি কার্যকর হওয়া তখনই সম্ভব, যখন দেশের রাজনৈতিক পরিবর্তন হবে। শ্রীলঙ্কার শ্রমজীবী মানুষের চলমান আন্দোলন সেই লক্ষ্যে পরিচালিত হবে কি না তার ওপরেই সঙ্কটমুক্তির ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে।