কুন্তলা বন্দ্যোপাধ্যায়
ফেরিঘাট। সদ্য বৃষ্টি থেমেছে। ইতস্তত জমা জল আকাশের আয়না। কোণে দাঁড়ানো একজন জামা খুলে জোরে জোরে মাথা ঘষছে। স্টিমার ভিড়েছে কিছুক্ষণ আগে। ভিড় পাতলা। শেষ যাত্রীদের কেউ কেউ ব্যস্ত বেরিয়ে যাচ্ছে সীমানা ছাড়িয়ে। তাদের চলন্ত পা, মাথা ঘষটানো লোকটার হাতের মতো ঝাপসা। ছত্রাকার লটবহরের মধ্যে স্থির হয়ে বসে আছে কেউ। হয়তো আবিষ্কার হয়েছে যে বাড়ির দলিলখানা আনতে ভুল হয়ে গেছে, পিঁড়িখানা সঙ্গে এসেছে পরিপাটি।
ক্যামেরার দিকে সোজা তাকানোর প্ল্যান বানচাল হয়েছে দুটি রোগা মেয়ের। বাঁশপাতা শরীর পেঁচানো সুতির শাড়িব্লাউজ। শাড়ির রং দূরঅস্ত, মেয়েরা দুধে আলতা না উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ, ব্ল্যাক অ্যান্ড হোয়াইট ছবি সে রহস্যও ভাঙেনি। এক রোগা মেয়ের মাথায় মোটা বিনুনি, অন্যজনের প্রকাণ্ড খোঁপা। একজনের নাম গীতা চৌধুরী, অন্যজনের নাম নমিতা। বিনুনি গীতা, খোঁপা নমিতা। বা নমিতা বিনুনি, গীতা খোঁপা। এতদিন পর এতদূর থেকে নিশ্চিত হওয়া মুশকিল।
যেটা নিশ্চিত সেটা হচ্ছে এরা দুই বোন। দুজনেরই শিরদাঁড়া টানটান, উদ্ধত গালের হাড়। আরেকটু ক্লোজ আপে স্পষ্ট হত সামান্য উঁচু দাঁত, চোখের দীর্ঘ পলক। পলকের আড়াল সরিয়ে দৃষ্টিতে দৃষ্টি ফেললে, উল্টোদিকের লোক ঠোক্কর খায়। ফস করে কিছু বলে বসার আগে ভাবে, থাক, কী দরকার।
মেয়েদের মনোযোগ ক্যামেরার প্রতি পড়তে পড়তেও নড়ে যাওয়ার কারণ ধরা আছে গীতার ডান ও নমিতার বাম, নাকি গীতার বাম ও নমিতার ডান হাতের মাঝে। ঢোলা হাফপ্যান্ট, হাফশার্ট বালক। কদমছাঁট চুল বৃষ্টিতে ভিজে খাড়া। মুখব্যাদানের মাত্রা চিৎকারের তীব্রতা ফুটিয়ে তুলেছে। হয়তো ঠান্ডা লাগছে, কিংবা খিদে পেয়েছে। কিংবা কিছুই না, স্রেফ নষ্টামি। দিদিরা মুখভঙ্গি করে ভাইয়ের মন ভোলানোর চেষ্টা করছে। হ্যাঁ, ভাই। বয়সে বেশ কয়েকবছর পিছোনো। কাছে গেলে দেখা যাবে এ বালকেরও গালের হাড় উঁচু, দীর্ঘ আঁখিপল্লব। বংশের ধারা বাইগুন চারা।
গীতানমিতার কাছে এ বালক গাবু। বাকিদের কাছে সুপর্ণ চৌধুরী। কীর্তিনাশা নদীতীরে বিশ্বম্ভরপুর গ্রামের জমিদারবংশের বাতি।
বাংলাদেশ থেকে যারাই এসেছে তারাই যেমন জমিদার নয় তেমন সত্যিকারের কিছু জমিদারও নিশ্চয় এসেছে বাংলাদেশ থেকে। না হলে তারা সব গেল কোথায়?
এই চৌধুরীরা সেরকম খাঁটি, গব্য জমিদার। কাগজপত্র পথে ছিটকে গেছে, কিন্তু গীতানমিতার হাতে ধরা দুই মক্কেল, বেয়াদব বালক ব্যতিরেকে, ইশারা করছে এরা আমজনতা নয়। খেয়াল করুন। হয়তো করেছেন এতক্ষণ। সাদাকালো দৃশ্যটিতে গীতা নমিতা গাবু বৃষ্টি… সকলের আগে হয়তো চোখ টেনেছে ওই দুই মক্কেল।
একটি মক্কেল সেতার। আবার নয়ও। তাজমহলকে কি বাড়ি বলে কেউ? শিকারি বাজকে বিহঙ্গ? কালবৈশাখীকে বাতাস? তেমনি তেরো তরফের তরফদারি সেতারকে সেতার বলা পাপ। বার্মাটিকের তীব্র দণ্ডে গাঁথা গোলাপকাঠের অলঙ্কৃত কানে বাঁধা নায়কী ও চিকারি তার, মেজরাব আঘাত করবে যেই, শিউরে উঠবে হরিণের ফটফটে হাড়ের ঘোড়াজের ওপর টানটান সমদূরত্বে শুয়ে থাকা তেরো তরফ। শীৎকার শোনা যাবে গোটা গ্রামে।
অন্য মেয়েটির হাতে একটা লম্বা নলের বন্দুক। এখন প্রায় মানুষের অ্যাপেন্ডিক্সের সমান কার্যকরী, তখন ওই একখানাই ছিল অনেক। ডাকাত পড়লে, জমিদারবাড়ির বিস্তৃত ছাদে উঠে, যে ছাদ থেকে কীর্তিনাশার ওপারে সূর্যাস্ত দেখা যায়, দুএক ছররা চালালে অব্যর্থ কাজ দিত।
ওই গাদাবন্দুকের ভরসায় দুটো প্যাংলা মেয়ে আর একটা ব্যাঙাচিসুলভ বালক এসে ভিড়েছে নতুন দেশে? অভিভাবকহীন? উঁহু। কর্তামশাই সঙ্গে এসেছেন। শ্রীযুক্ত বাবু সুবর্ণ চৌধুরী স্বয়ং। ছেলেমেয়েকে মালপত্রের পাহারায় রেখে গেছেন অফিসঘরের দিকে। গাত্রোত্থিত করে যদি ওইদিকটায় যান, দেখতে পাবেন। চিনবেন কী করে? পারবেন পারবেন। চেষ্টা করুন।
ঠিক। ঠেলাঠেলি মারামারির তফাতে যিনি দাঁড়িয়ে আছেন, তিনিই। সাড়ে ছ ফুট ছুঁইছুঁই, সিধে, এক চামচ বাড়তি চর্বি নেই শরীরে। গড়নে মেয়েদের ধাত পেয়েছেন। ভিড়ে মিশে না যেতে পারার চলনবলনেরও। হয়তো ফুরিয়ে যাবে সব, তবু ঠেলাঠেলি করবেন না। দূরে দাঁড়িয়ে থাকবেন। ফুরোলে ফুরোবে, অথবা ফুরোবে না। কর্তৃপক্ষের কেউ নজর করবে। এমন কেউ, যে জানে ধাক্কাধাক্কির প্রাবল্যের সঙ্গে প্রয়োজনের সামঞ্জস্য অধিকাংশ সময়েই থাকে না। নিঃশব্দে উঠে আসবে। উঠে এসে মানুষ যেভাবে মানুষের সঙ্গে কথা বলে, বা বলা উচিত, সেভাবে বলবে, এই স্টিমারে নামলেন? এদিকে আসুন।
এভাবে হয়তো চৌধুরীমশাই কিছু পাবেন। সস্তায় জমি, উদ্বাস্তু কোটায়। বাড়ি তুলবেন। দু কামরার একতলা বাড়ি নদীপারের অট্টালিকার স্মৃতি ভাসিয়ে আনবে যেই, সে বন্যার মুখে বাঁধ দিতে গীতানমিতা উচ্ছ্বসিত দৃষ্টিতে বাবার দিকে তাকাবে। কী নাম রাখবে বাবা? রিফিউজি পাড়ার বাড়িদের বাহারের নাম। পথের শেষে, ইচ্ছামতী, পিতামাতার আশীর্বাদ। এ পাড়ায় যারা বাড়ি তুলেছে তারা কল্পনা করার সাহস পর্যন্ত করেনি আবার এক টুকরো ছাদের সংস্থানের। মির্যাকল যখন সত্যি হয়েছে, আদিখ্যেতার সীমা রাখেনি। গীতানমিতা জল্পনা করবে। মল্লার না আশাবরী। বাগানে পুঁতবে ঘোড়ানিমের চারা, দেশের বাড়িতে জঙ্গল ছিল যার। হলুদ ফুলের ছায়ায় গেটের পিলারের সাদা মার্বেলে পেঁচানো অক্ষরে বইবে ‘কীর্তিনাশা’।
চৌধুরীমশাই ক্রমশ রোগা হবেন। তিনি ততদিনে চৌধুরীবাবু। দশটা পাঁচটার অফিসে পিঠ চাপড়ে ইয়ার্কিতে হেসে ওঠে কেউ কেউ। কেউ অকারণে কণ্ঠ কঠিন করে। বেশি উপার্জন করে বলে, কিংবা পদাধিকারবলে। চৌধুরীমশাই সয়ে নেন। না করলে চিৎকার করতে হয়, অসন্তোষ প্রকাশ করতে হয়। এক, ওসব তিনি পারেন না। দুই, পারলেও করতেন না। কারণ তাতে যন্ত্রণা বাড়ে বই কমে না।
তা বলে কি প্রতিশোধ নেন না? গাবু বোঝে না, গীতানমিতা টের পায়। সবার থেকে বেশি পায় তরফদার। ছুটির দ্বিপ্রহরে একা পেলে বলে, কী খটখটে রোদ উঠেছে দেখেছ? একবার সারংটা নিয়ে বসবে নাকি?
চৌধুরীমশাই ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যান।
গীতানমিতা যত্ন নেয় তরফদারের। মোছে, ঝাড়ে। কান মুলে সুর বাঁধে। চাতক তারে মেজরাব ছোঁয়ায়। বিচ্যুতিতে জিভ কাটে। তরফদার হাঁ হাঁ করে। আরে দারুণ হচ্ছে, ভুল করতে করতেই শিখবে তো। এমন পালটা এইটুকু মেয়ের হাতে কবে কোথায় খেলেছে দেখাও আমাকে?
কলেজফেরত গীতা, বা নমিতা, মুচকি হাসে। বলে, মনে আছে, সেবার শীতে অমুক ওস্তাদ এসেছিলেন বাড়িতে, তোমাকে বাজিয়েছিলেন? কী যেন? উত্তরটা জানা সত্ত্বেও গল্পের সুতো তরফদারের আঙুলে জড়িয়ে দেয়।
রামদাসী মল্লার। তরফদার ঝলমল করে। কোমল নি হয়ে এসে পা-এ থমকে কোমল গা বেয়ে নেমে আসছেন, তোমাদের লালনীল কাঁচের জানালার ওপারে অঝোর বৃষ্টি নামছে মাঘের শেষে। মনে আছে?
দিদিরা গাবুর কান ধরে গান শেখানোর চেষ্টা করে, তবলায় চাঁটি মারতে বসায় সকালবিকেল। চোখমুখ লাল করে গাবু ধাঁই ধাঁই তবলা পেটায়, ষোলোমাত্রার তিনতাল বা সাড়ে নয়ের কলাবতী, অব্যর্থ টিপে সমে এসে মেশে। যেই শোনে চমকে যায়। ছেলে তো প্রতিভাবান। ওস্তাদের কাছে পাঠাচ্ছেন না কেন?
কিন্তু এ প্রতিভায় গাবুর মন নেই, বংশপরম্পরার আরেক প্রতিভাতেও তার টিপ খুলেছে। কাল্পনিক যুদ্ধে মেতে থাকে সারা দুপুর, এয়ারগান ছুঁড়ে টিয়াপাখির বংশ ধ্বংস করে। কাঁচের আলমারির ভেতর থেকে লম্বাগলা বন্দুক তরফদারকে চোখ মটকায়।
যৌবন আসে। বান্ধবী পরিবৃত হয়ে ক্লাসে ঢোকে সরসী। হাসিতে ভেঙে পড়তে পড়তে চকিত দৃষ্টিতে ছুঁয়ে দেয় সুপর্ণকে।
গাবু তেরিয়া হয়। জাতধর্ম না মিলুক, গোত্রগণ চুলোয় যাক। ওপক্ষ উদ্বাস্তু হলে ভালো হত-র অযৌক্তিক আফসোসে আকাশ থেকে পড়ে। চন্দনচর্চিত হয়ে টোপর মাথায় দিয়ে, দুই দিদির মাঝখানে, বরযাত্রীর মিছিলের পুরোভাগে গটগটিয়ে বিবাহমণ্ডপে প্রবেশ করে। নহবতে মধুবন্তী দুই হাত বাড়িয়ে জড়ায় অতিথিদের। উৎসব জমাট বাঁধে, উল্লাস তুঙ্গ ছোঁয়, গীতানমিতার মুখে অস্বস্তির মেঘ ঘন হয়। দক্ষ লৌকিকতা সামলানোর ফাঁকে ফাঁকে পুনঃপুনঃ উদ্বিগ্ন দৃষ্টিপাত করে বাবার দিকে।
সারা সন্ধে আরোহ অবরোহ বিস্তার পকড়ে মধুবন্তীর কোমল গা একটিবারও লাগছে না, বারংবার পিছলে যাচ্ছে, কদর্য করছে রাগরূপ, মাটি করছে সমস্ত আমেজ। আর হয়তো বয়ে আনছে কোনও আশঙ্কাবাণী।
সামরিক বাহিনিতে সুপর্ণ চৌধুরীর কেরিয়ার হইহই চড়ে। সুবর্ণসরসীর সংসার বেসুরে বাজতে বাজতে অবশেষে মৌন হয়। কীর্তিনাশা জেগে থাকে আরেক কচি চৌধুরীর কলকাকলিতে। স্কুলের নাম সুস্নাত। পিসিরা ডাকেন বুকুল। জন্মদিনে বাবা কিনে দেন এয়ারগান, পিসিরা হাতে করে নিয়ে আসেন কাঠের সেতার, বুকুলের মাপমতো। গোটা বিকেল ধরে ভাইপোর আঙুল স্থিত করেন, স্বরস্থান নিখুঁত করেন। চর্চা শুরু হয়। বুকুলের মগ্ন আলাপে, নিমীলিত দৃষ্টির নিষ্ঠায় পিসিরা মুখে আলতো আঁচল চাপেন। তরফদারও চেনে নির্ভুল।
নীরবে তিনজন স্মৃতি হাতড়ায়। বছরকয়েক আগে ডাক্তার জবাব দিয়ে যাওয়ার পর অসাড় আঙুলে কেমন চলাচল, কত কত বছরের ছায়া নিমেষে উধাও, বিষাদমুখোশ খুলে চিরচেনা দীপ্তির আত্মপ্রকাশ। বাবা? এতদিন কেন এলে না, কার ওপর রাগ করে আমাদের ভুলে রইলে?
চৌধুরীমশাইয়ের ঠোঁট নড়ে। গীতানমিতা ঝুঁকে পড়ে।
ম প দ নি দ প দ . . . দুই বোন একে অপরের দিকে ভুরু কুঁচকে তাকায় যেই, ভৈরব? অমনি প গ-র পথ ধরে নির্ভুল কড়ি মা ছোঁয় ক্ষীণ কণ্ঠ, সালঙ্কারা দাঁড়ায় রামকলি। মন্দরওয়া মোরে আয়ে মিতওয়া।
অবশেষে পরম মিত্র এসে দাঁড়িয়েছেন দু হাত বাড়িয়ে। গীতা নমিতা গাবুর হাত ছাড়িয়ে চৌধুরীমশাই রওনা দেন।
কয়েক বছর পর মাঝরাতে ঘুম ভাঙে সুপর্ণ চৌধুরীর। শরীর ধরে কেউ জোরে জোরে ঝাঁকাচ্ছে। চোখ খুলে সিঙ্গল খাটের পাশে স্ত্রীকে অপেক্ষারত পেয়ে প্রথমটা অবিশ্বাস, তারপর স্ত্রীর কঠিন মুখ, চাপা ঠোঁট এবং সর্বাঙ্গ ঢাকা সুসংহত কাফতানের আশ্বাস। তিনি স্বপ্ন দেখছেন না।
শব্দটা আবার হয়।
যে শব্দটা শুনে নিজের সিঙ্গল খাট ছেড়ে সরসী চৌধুরী উঠে এসেছেন স্বামীকে জাগাতে। দুজনে পা টিপে টিপে হাঁটেন চিলেকোঠার ঘরের দিকে, বুকুলের ঘর, রহস্যময় শব্দের সম্ভাব্য উৎস। দরজার বাইরে রুদ্ধশ্বাস অপেক্ষা। চাপা হাসির সঙ্গে সঙ্গে দরজায় লাথি মেরে ঘরে ঢুকে পড়েন সুপর্ণ ও সরসী।
খাটের ওপর থেকে তাঁদের দিকে নির্বাক তাকিয়ে থাকে বুকুল আর আরেকটা ছেলে। ওপাড়ার বস্তির। রোজ বিকেলে ফুটবল খেলে বুকুলের সঙ্গে। হিলহিলে গাছের মতো শরীর, তেলতেলে কাঠের মতো রং।
দাম্পত্যের নিখুঁত যুগলবন্দিত্বে ছেলেকে বাড়িছাড়া করেন সুপর্ণ ও সরসী, জমা করে আসেন বিদ্যালয় কাম সংশোধনাগারের বোর্ডিঙে। মাস্টারমশাই কাম গুরুরা মিলে বুকুলকে সারিয়ে তোলেন, ইঞ্জিনিয়ার হয়ে বুকুল বিদেশে চলে যায়। বাড়ি হয় গাড়ি হয়। সংসার হয়, সন্ততিও।
কাঠের সেতারে ঝুল পড়ে।
সফল বাবামায়ের রোলে একশোয় একশো পেয়ে সাতদিনের এমাথা-ওমাথায় যখন মরে যান সুপর্ণ- সরসী, আত্মীয়পরিজন পাড়াপ্রতিবেশী রোমাঞ্চিত ও চমৎকৃত হয়। সুস্নাত চৌধুরী অতলান্তিক পার হয়ে আসে পিতৃমাতৃদায় থেকে মুক্ত হতে। সাদা ম্যারাপের ছায়ায় ফুলমালাসজ্জিত ছবির সাজানো হাসি, মৃত দৃষ্টির দিকে তাকিয়ে থাকে।
–কেমন আছিস বুকুল?
বুকুল ঝুঁকে পিসিদের প্রণাম করে। হাসে। ভালো আছি পিসি।
চিবুক ছুঁয়ে চুমু খেতে খেতে গাবুর ছেলের চোখের কোলে কালি দেখেন গীতা, অথবা নমিতা। গালের অলরেডি উঁচু হাড় আরও ঠেলে বেরিয়ে এসেছে। খুব স্ট্রেস? না রে?
অন্যজন জিজ্ঞাসা করেন, হ্যাঁ রে, ফিরবি না বুকুল? বাড়িটা কে দেখবে?
বাড়ি ফাঁকা হলে, চিলেকোঠায় ঢোকে বুকুল। জন্মজন্মান্তর পর। তরফদারখানা বার করে বসে সূর্যাস্তের দিকে মুখ করে। কতদিন বাজায়নি। বেজে ওঠেনি। দুজনে মিলে বাঁধে একে অপরকে। তারে আঙুল ছুঁইয়ে কয়েকমুহূর্ত থমকে থাকে বুকুল। জানালার বাইরে ফ্ল্যাটের ছাদের শিকের মাথায় একফালি মেঘ এসে বসে।
অব আ মিলো কন্ত হামারে, উমড ঘির আই ছাই বদরিয়া। কেদারায় কেঁদে মরে বুকুল আর তরফদার। কোথায় কোন বিশ্বম্ভরপুরের মাঠের ওপর মেঘ জমে, ফেরিঘাট ভেসে যায়, কীর্তিনাশা ফুলে ওঠে।
অনভ্যস্ত আঙুল ছিঁড়ে যায়। রক্তাক্ত তারে কপাল ঠেকিয়ে কাঁদে বুকুল। তরফদার বলে ষাট ষাট, কাঁচের আলমারি থেকে লম্বানল বন্দুক অপ্রস্তুত তাকিয়ে থাকে। প্রতিবেশীরা শোনে সুস্নাত চৌধুরীর হাহাকার। বলে, বাবামা যাওয়ার শোক, বেরিয়ে যাওয়াই ভালো।
ওদেশে ফিরে, বেসমেন্টের সেফ থেকে আগ্নেয়াস্ত্র বার করে, উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত নির্ভুল টিপে দামি দেওয়ালে নিজের ঘিলু ছিটিয়ে মরে যায় বুকুল।
প্রোমোটার আসে। বুলডোজার প্রস্তুত হয়। গীতানমিতা কাঁপা কাঁপা হাতে বার করে আনেন তরফদার আর লম্বাগলা বন্দুক। গীতা নেন তরফদার, নমিতা বন্দুক। কিংবা উল্টোটা। হুইলচেয়ারে বসে দুই বোন সোজা তাকিয়ে থাকেন। শিরদাঁড়া ব্যাপারটা যেহেতু কতগুলো হাড়ের সমষ্টি নয়, দুজনের তা এখনও টানটান।
ঘোড়ানিমে কোপ পড়ে। চিলেকোঠা ঝুরঝুর ঝরে যায়।
কীর্তিনাশার কাহিনি আরও একবার ফুরোয়, গীতানমিতার খটখটে চোখের সামনে।
***
না, পার্টিশন মিউজিয়ামের দেওয়ালের সাদাকালো ছবিটার নিচে এত ব্যাখ্যান লিখে রাখেনি কেউ। ভেজা ফেরিঘাটের ছবিটায় শুধু ইতিউতি লোক, কেউ ছুটছে, কেউ বসে আছে মাথায় হাত দিয়ে। দুটো রোগা মেয়ে একখানা তরফদার সেতার, একখানা রাইফেল আর ক্রন্দনরত একটি বালককে ধারণ করে দাঁড়িয়ে আছে। মুখভঙ্গি করে বালকের মনোরঞ্জনের চেষ্টা করছে। ছবির নিচে সরু লেবেলে খুদি খুদি অক্ষরে শুধু ‘রিফিউজিস অ্যারাইভিং’। হাজার হাজার লাখ লাখ অ্যারাইভিং। অহোরাত্র। কে জানতে গেছে তারা গীতা না নমিতা না গাবু। চৌধুরী হলেও যা, চক্রবর্তী হলেও তাই। মোদ্দা কথা, রিফিউজি। ব্যস।
লেখা নেই বলেই গালগল্প ধরে নেওয়ার কারণ নেই অবশ্য। ছবির দুপাশের দুই কাচের শোকেসে দুই মক্কেলকে দেখুন। বাঁদিকে তরফদারি সেতার। ডানদিকে লম্বাগলা বন্দুক। ফোটোগ্রাফ অ্যান্ড স্যুভেনিরস কাইন্ডলি ডোনেটেড বাই রিলেটিভস।
প্রমাণ চাইলে অপেক্ষা করুন। ভিড় সরে যেতে দিন। চারপাশ নীরব হতে দিন। তাড়াহুড়ো করবেন না। এদিক সেদিক থেকে হাসি বা নাম ধরে ডেকে ওঠা ছিটকে উঠতে পারে যখন তখন। মানুষের আনন্দ অফুরান।
নিন, এবার সব চুপচাপ। এগিয়ে যান। কান পাতুন। শুনুন। তরফদার বাজছে। সকালে পরজে, নিজের গরজে। দুপুর গরমে, গৌড় সারঙে। জমজমাট ঝালা শেষ করে থামছে যখন, বন্দুক সেলাম করছে গর্জে উঠে। কেয়া বাত। দিলখুশ তরফদার ফিরিয়ে দিচ্ছে প্রশংসা। মনে আছে, উড়ন্ত পায়রা কেমন নির্ভুল বিঁধতে তুমি? আর সেই যেবার ডাকাত পড়ল, বড়কর্তা ছাদে উঠে তোমাকে আকাশের দিকে তাক করে গুড়ুম গুড়ুম, অমনি সব ছত্রাকার। আহা, কত পঁহুছা হুয়া ওস্তাদ তো তোমারও কান মুলে ছিল, ফুলস্পিড ট্রেনের চাকার সঙ্গে রেওয়াজ করা তবলিয়ার সঙ্গে কেমন পাল্লা দিয়ে যুগলবন্দি লড়তে তুমি?
রোজ যদি নিয়ম করে আসেন, ভিড় ফাঁকা হয়ে গেলে কান পেতে শোনেন টুকরো কথোপকথন, খণ্ড জলসা, চিলতে স্মৃতিচারণ, সে সব জুড়ে জুড়ে একটা গল্প হলেও হতে পারে। আমার গল্পটার সঙ্গে আপনার গল্পটা মিলবে তার মানে নেই। না মেলার সম্ভাবনাই বেশি। হয়তো তরফদার আর বন্দুক সম্পূর্ণ নতুন একটা গল্প শোনাল আপনাকে। যদি শোনায়, আমাকে শোনাবেন। অপেক্ষায় থাকব।