চার নম্বর নিউজডেস্ক
সত্যনারায়ণের গল্প। দুশরলা সত্যনারায়ণ। তেলেঙ্গানার এক ট্রি-ম্যানের গল্প। একটা একটা করে গাছ, ক্রমশ এক অরণ্য তৈরির গল্প। যার প্রেক্ষিত তেলেঙ্গানার রাঘবপুরম। নালগোন্ডা জেলার এক অখ্যাত গ্রাম। ৭০ একর জমির লাখ লাখ ফলের গাছ। এবং এর নেতৃত্বে, পরিবেশবন্ধু এক আটষট্টি বছরের যুবক— দুশরলা সত্যনারায়ণ। তাঁর গল্পতেই আসি…
দুশরলার পৈতৃক ভিটের ওই ৭০ একর জমিতে চার বছর বয়স থেকেই গাছ লাগানো শুরু করেছিলেন এই মানুষটি। প্রধানত তেঁতুল, এবং পাশাপাশি অন্যান্য গাছের বীজ। নিজাম অধ্যুষিত তেলেঙ্গানার এই অঞ্চলে দুশরলার পরিবারের একটা সময়ে ৩০০ একর জমি ছিল, যা পরে প্রতিপত্তি হারিয়ে ৭০ একরে এসে থামে। শরিকি বিবাদ, জমির মামলা ইত্যাদিতে জর্জরিত দুশরলার পরিবার ক্রমশ ওই ৭০-এই অভ্যস্ত হয়ে যায়। যদিও এই ৭০ একর বাঁচাতেও কম সমস্যায় পড়তে হয়নি তাঁদের, সে অন্য গল্প।
এবং ওই ৭০ একরেই স্বপ্ন প্রতিষ্ঠার শুরু দুশরলার। পাশে পেলেন গোটা পরিবারকে। পাশাপাশি সহায়তায় এলেন কিছু সহপাঠী, সহকর্মী। বীজ সংরক্ষণ এবং বড় বড় গাছের বীজ আনতে বহু দূরের জেলা, সদর শহরে পা রেখেছিলেন কিশোর দুশরলা। নিজেই খুঁড়েছিলেন ছোট ছোট খাল। সেচের জলের জোগান, বৃষ্টির জল সংরক্ষণের মতো ভাবনা তাঁকে টেনে নিয়ে চলছিল একধরনের ঘোরের মধ্যে। ওই জলেই পদ্মের পাশাপাশি রাখলেন মাছ, কচ্ছপ। এর মধ্যে ১৯৮০ সালে তেলেঙ্গানার জয়শঙ্কর কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কৃষিবিজ্ঞানে স্নাতক হয়ে ইউনিয়ন ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়ার ফিল্ড অফিসারের পদে যোগদান করলেন তিনি। পেশাকে নেশার সঙ্গে মিশিয়ে দিলেন। বেতনের প্রায় পুরোটাই অরণ্য সংরক্ষণে নিয়োজিত করা শুরু করেন এই সময় থেকেই।
আজকে এই অরণ্যের কী অবস্থা? এবং বিশেষত্বটাই বা কী? পেয়ারা, কুল, ডুমুর, জাম, আম, বাঁশ, লিচু ইত্যাদি অসংখ্য ফল ভর্তি দুশরলার রঙিন অরণ্য এক অন্য কারণে অনন্য। এই ফলের বাগান দুশরলার পরিবারের জন্য বা সামগ্রিক বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হয় না। দুশরলা বলছেন, ফলগুলি প্রাণীদের জন্য। সাপ, খরগোশ, বুনো শুয়োর, শেয়াল, কাঠবেড়ালি, বাঁদর, ময়ূর, হরিণ— এরাই ভরে রেখেছে ফলের বাগান। যেটুকু পড়ে থাকছে, মাটিতে মিশে, পচে বাড়িয়ে দিচ্ছে মাটির জৈব গুণ। এবং এই ফলের গাছের সঙ্গে মিশে গেছে অসংখ্য ওষধি গাছ— দুশরলার দীর্ঘ পড়াশোনা এবং গবেষণায় যাদের বেঁচে ওঠা, রক্ষণাবেক্ষণ।
সংখ্যায় কটা গাছ আছে এখন? প্রিয় পাঠক, অবিশ্বাস করবেন না। পাঁচ কোটি— হ্যাঁ, একর প্রতি ১০ লক্ষ গাছ, অর্থাৎ ৭০ একরের হিসেবে মোট পাঁচ কোটি গাছ। এবং পাশাপাশি ১৩টি পুকুর। এক প্রাকৃতিক প্রাসাদ।
কিন্তু এই প্রাসাদ নির্মাণে কোথাও কি বাধা পাননি? দুশরলা মনে করতে পারেন অসংখ্য টোপ, টাকার লোভ। পড়শি বেশ কিছু জমি-মাফিয়ার কাছ থেকে মোটা অঙ্কের লোভ দেখানো হয়েছিল দুশরলাকে। কংক্রিটের জঙ্গল? ফুৎকারে উড়িয়ে দিয়েছেন এই মানুষটি। পরিবারের কিছু সদস্যই ১০০ কোটির বিনিময়ে জায়গাটিকে বাণিজ্যিকীকরণের কথা তুলেছিলেন। পাত্তা দেননি দুশরলা।
অরণ্যের পাশাপাশি ব্যক্তিগত জীবনে এরও অনেক পরিবেশ আন্দোলনের হোতা এই মানুষটি। রাজ্যের নালগোন্দা জেলার জলদূষণ এবং জল অপচয় এবং তা থেকে ফ্লুরোসিসের ঘটনা বাড়ার ফলে প্রতিবাদে দুশরলা ১৯৮০ সালে শুরু করেছিলেন জল সাধনা সমিতি। নিজের রাজ্যে এমনকি দেশের রাজধানী শহর দিল্লিতেও পদযাত্রা এবং জল সংরক্ষণ ক্যাম্পেন করে বিষয়টিকে প্রচারের আলোয় এনেছিলেন। বহুকালের শ্রীশৈলম টানেল সিস্টেমকে শেষ করেছিলেন প্রায় একার নেতৃত্বে।
বাকিটা জীবন দুশরলার লক্ষ্য এই হাতিয়ারকে আরও দৃঢ় করতে। বাণিজ্যিক অরণ্যের কমতি নেই এদেশে। দুশরলার জমি যেন সেই আওতায় না পড়ে। খরগোশের জন্য, পাখির জন্য, কচ্ছপের জন্য রাঘবপাড়ার দুশরলা সত্যনারায়ণের ৭০ একর গোটা পৃথিবীতে এক অনন্যতা স্থাপন করুক। জল সংরক্ষণের আরও অনেক আলো দেখাক তেলেঙ্গানা। দেখিয়ে দিক, সত্যি সত্যি কাকে বলে পরিবেশ সংরক্ষণ, কাকে বলে ‘ট্রি ম্যান’…