ভার্জিলিও পিনেরা: মৃত্যু দুবার, জন্মও দুবার

ভার্জিলিও পিনেরা: মৃত্যু দুবার, জন্মও দুবার -- নাহার তৃণা

নাহার তৃণা

 



গল্পকার, অনুবাদক

 

 

 

বাস্তবনির্ভর জীবনী ইতিহাসের অংশ হিসেবে স্বীকৃতি পায়। কিন্তু যে জীবনের পরতে পরতে শ্রুতিকথন কিংবা গুজব জুড়ে দেওয়া হয় ইতিহাস তাকে স্থান ছেড়ে দিতে গড়িমসি করে। এক্ষেত্রে কিউবান সাহিত্যিক ভার্জিলিও পিনেরার (Virgilio Pinera; স্প্যানিশ উচ্চারণে বারয়িলিও পিনেরা) কথা বলা যায়। সৃষ্টিশীল পিনেরা বন্ধুমহলে ‘ভার্জিলিও’ নামে পরিচিত হলেও বিরুদ্ধমহলের কাছে তাঁর পরিচয় ছিল কেবলমাত্র সমকামী হিসেবে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে তাঁর সৃষ্টিশীলতাকে অগ্রাহ্য করে ‘সমকামিতা’কে তাঁর সবচেয়ে ঘৃণ্য অপরাধ হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে। ব্যক্তিগত জীবনাচরণের পাশাপাশি ভার্জিলিওর রাজনৈতিক অবস্থান তাঁকে ঘিরে কুৎসা রটনার পথ তৈরি করে। পরিস্থিতি একটা পর্যায়ে এমন দাঁড়িয়েছিল যে তাঁকে কোণঠাসা করতে করতে ভার্জিলিও পিনেরা নামের ব্যক্তিটির অস্তিত্বকে পর্যন্ত অদৃশ্য মানবে পরিণত করা হয়। আর এর পেছনে তাঁকে অপছন্দ করা ব্যক্তিবর্গ, যাদের অনেকেই তৎকালীন কিউবান রাজনৈতিক উচ্চপদে আসীন ছিলেন, তাদের প্রভূত অবদান ছিল। ক্ষমতাসীনদের ইশারায় ব্যক্তি বা ঘটনা সম্পর্কে বিকৃতি ঘটানোও ইতিহাসের বিকৃতকরণ— ভার্জিলিও পিনেরার ক্ষেত্রে তেমনটা ঘটতে দেখা গেছে।

ক্যাথলিক পরিবারে জন্ম নেওয়া ভার্জিলিও পিনেরা নিজের সমকামী পরিচয় স্পষ্ট করতে লুকোছাপার আশ্রয় নিয়েছেন এমন প্রমাণ পাওয়া যায়নি। যা তাঁর জন্য কাল হয়ে দেখা দিয়েছিল। সেই সময়ে ওরকম বৈরি অবস্থানের ভেতর থেকে নিজের সম্পর্কে খুব কম মানুষ একবাক্যে উচ্চারণ করতে পারেন, “আমার জীবন একটি খোলা বইয়ের মতো, অথবা খোলা বইটিই আমার জীবনের প্রতিচ্ছবি।” ব্যক্তিগত ধ্যানধারণার বৃত্তে তাঁর বেঁচে থাকার প্রাণরস ছিল লেখালেখি— আর তার আশ্রয়েই তিনি বেঁচে ছিলেন। অথচ স্বদেশে নিজের সৃষ্টিকর্মের চর্চাহীনতা জীবদ্দশাতেই তাঁকে নিজের মৃত্যু প্রত্যক্ষ করিয়ে ছেড়েছে বলা চলে।

তাঁর অনবদ্য সৃষ্টিকর্মের ভাগ্যে যথাসময়ে জোটেনি যোগ্য সম্মান। তাঁর সাহিত্যকীর্তি নিয়ে আধুনা ব্যাপক আগ্রহের আবহ তৈরি হয়েছে। জন্মভূমি কিউবাসহ লাতিন আমেরিকান এবং পৃথিবীর অনেক দেশে ভার্জিলিও পাঠ এবং অনুবাদের তোড়জোড় চললেও— তাঁর জীবদ্দশার একটা পর্যায়ে সেগুলিকে ভীষণভাবে অগ্রাহ্য করা হয়েছিল। শুধু অগ্রাহ্য বললে বিষয়টা হয়ত স্পষ্ট হয় না, কিউবাতে ভার্জিলিও পিনেরাকে বাতিল হিসেবে গণ্যের রেওয়াজ চলেছে সুদীর্ঘ সময় ধরে।

শিল্প-সাহিত্যাঙ্গনে যখন রাজনীতি নাক গলাতে শুরু করে তখন ক্ষমতাসীনদের মনপসন্দ লেখনীসমূহকে বাহবা দেওয়ার রীতিই গ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠে। বিপ্লবোত্তর কিউবার ক্ষেত্রেও দুঃখজনকভাবে সেই মহড়ার পুনরাবৃত্তি চলতে দেখা যায়। যাদের রাজনৈতিক মতাদর্শের প্রতি একসময় পিনেরা আস্থা রেখেছিলেন সময়ে সেই আস্থার ভাসান ঘটবার কারণে তিনি ক্ষমতাসীনদের চক্ষুশূল হয়ে পড়েন। যার মাশুল হিসেবে নিজভূমে পরবাসী হয়ে তাঁকে প্রান্তিক নাগরিকের জীবন কাটাতে হয়। অথচ একজন ‘পলিম্যাথ’ স্রষ্টা হিসেবে ভার্জিলিও পিনেরার জীবদ্দশাতেই পাওয়ার কথা ছিল রাষ্ট্রীয় যোগ্য সম্মান। সেটি তিনি পেতেও পারতেন যদি রাজনৈতিক সতীর্থদের আদর্শকে নিজের আদর্শ ভাবতে সক্ষম হতেন। সে পথে তিনি হাঁটেননি। অন্যদিকে কিছু ক্ষেত্রে তাঁর স্ববিরোধী মানসিকতা তাঁকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। চল্লিশের দশকের শুরুর দিকে তিনি খ্যাতনামা লেখক, কবি, প্রাবন্ধিক হোসে লাযামা লিমা (José Lezama Lima)-র সঙ্গে একটি সাহিত্য পত্রিকা প্রকাশে জড়িত ছিলেন। পরবর্তীতে যখন তিনি ‘সিক্‌লোন’ সাহিত্য সাময়িকীতে জড়ান তখন হোসে লাযামা লিমাকে তীব্রভাবে আক্রমণ করতে দ্বিধা করেননি।

আজ তাঁকে কিউবান শিল্প-সাহিত্যের আধুনিকতার পথপ্রদর্শক হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে বটে, কিন্তু জীবদ্দশায় সে স্বীকৃতি উপভোগের যথাযথ সুযোগ তাঁকে দেওয়া হয়নি।

এক্ষেত্রে তাঁর একটি বিখ্যাত নাটকের প্রথম মঞ্চস্থের ঘটনাটির উল্লেখ অপ্রাসঙ্গিক হবে না হয়ত। ভার্জিলিও পিনেরা তাঁর ট্র্যাজিককমেডি নাটক ‘ইলেক্ট্রা গ্যারিগো (Electra Garrigó)’ রচনা করেন ১৯৪১ সালে। ১৯৪৮ সালে তিনি যখন ৩৬ বছর বয়স্ক, তখন তাঁর সেই নাটকটি প্রথমবারের মতো মঞ্চস্থের আয়োজন করা হয়। কিন্তু নাটক চলার এক পর্যায়ে দর্শকেরা রাগে ক্ষোভে দর্শক সারি থেকে বেরিয়ে যায়। যা ১৯১৩ সালের ২৩ মে প্যারিসের থিয়েটার হল ডেস্ চ্যাম্পস ইলিসিসে রাশিয়ান নির্মাতা ইগর স্ট্রাভিনস্কি (Igor Fyodorovich Stravinsky)-র ‘দ্য রাইট অফ স্প্রিং’ নাটকের প্রথম মঞ্চায়নের সময় সংঘটিত ঘটনার কথা মনে করিয়ে দেয়। ‘দ্য রাইট অফ স্প্রিং’ ঘিরে সংঘটিত দাঙ্গা-হাঙ্গামার মতো না হলেও পিনেরার নাটকটির প্রথম প্রদর্শনীতেই দর্শক চরমভাবে সেটির প্রতি নিজেদের বিতৃষ্ণার জানান দেয়। অপছন্দ করার পেছনে নির্দিষ্ট কারণও ছিল; তখন পর্যন্ত কিউবান মূলধারার নাট্যাঙ্গনে ঔপনিবেশিক ভাবধারার চর্চা অব্যাহত ছিল। তা নিয়ে বুদ্ধিজীবী শ্রেণির কোনও হেলদোলও ছিল না। সেই ভাবধারার মুখে থুথু ছিটানো ‘ইলেক্ট্রা গ্যারিগো’কে তাই হজমযোগ্য মনে হয়নি বিপুল শ্রেণির দর্শকের কাছে। নাটকটির তুমুল সমালোচনা করে পত্র-পত্রিকায় লেখাজোকা হয়। যদিও এখন পাশার দান উলটে গেছে। স্বদেশে ভার্জিলিও পিনেরা এখন যথেষ্ট আদৃত, এবং দ্বিধাহীনভাবে স্বীকার করা হচ্ছে যে, তাঁর এই নাটকটির হাত ধরেই কিউবান আধুনিকতার জন্ম। শুধু তাই নয়, অতীতে তাঁর বিরুদ্ধে সংঘটিত কিছু অন্যায়ের প্রতিকারের উপায়স্বরূপ, কিউবা তাঁর সম্মানে ২০১২-কে ‘এল অ্যানো ভার্জিলিও’ বা ভার্জিলিও বর্ষ (El Año Virgiliano) হিসেবে ঘোষণা করে। সেই বছরের ১৯ থেকে ২২ জুন পর্যন্ত, লাতিন আমেরিকার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এই লেখকের জীবন, কাজ এবং উত্তরাধিকার নিয়ে আলোচনা করতে স্পেন, মেক্সিকো, যুক্তরাজ্য এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশের ৩০ জন গবেষকের একটি দল হাভানায় একত্রিত হয়েছিলেন। তাঁর দুটি সুপরিচিত নাটক, ‘আইরে ফ্রিও’ (Aire Frío) এবং ‘ডস ভিয়েহোস প্যানিকস’ (Dos Viejos Pánicos) আবার মঞ্চে ফিরে আসে। কোরিওগ্রাফার ইভান টেনোরিও-র একটি ব্যালে ‘বারয়িলিন্দো’ (Virgiliando)-র একটি ওয়ার্ল্ড প্রিমিয়ারও এতে অন্তর্ভুক্ত ছিল। ভুলে যাওয়া ভার্জিলিও পিনেরার সৃষ্টিশীলতার প্রতি লাতিন আমেরিকানদের শ্রদ্ধাজ্ঞাপনের এই ঘটা ক্রমেই উজ্জীবিত হতে দেখা যাচ্ছে। এছাড়া কিউবা এবং লাতিন আমেরিকার নতুন প্রজন্মের কাছে তাঁর রচনাসমূ্হকে আদর্শ সাহিত্যের মডেল হিসেবে তুলে ধরা হচ্ছে।

ভার্জিলিও পিনেরা নামের এই মানুষটিকে জীবন কতটা নাকাল করে ছাড়বে, কিংবা ‘সময়’ মৃত্যু পরবর্তীতে তাঁকে খ্যাতির কোন শীর্ষে পৌঁছে দেবে, এমন আভাস তাঁর আড়ম্বরহীন শৈশবে মোটেও বোঝা যায়নি। অন্যান্য বহু যশস্বী ব্যক্তির ক্ষেত্রে ‘মর্নিং শোজ দ্য ডে’র ছিটেফোঁটা যেমন আমরা জানতে পারি, সেরকম কিছুর আগাম আভাস তাঁর শৈশব থেকে জানা যায়নি। যদিও কৈশোর থেকেই তাঁর লেখালিখির পর্ব শুরু হয়েছিল। এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকার তথ্যমতে পিনেরার বাবা ছিলেন রেলওয়ের প্রকৌশলী। অন্য তথ্যসূত্র থেকে জানা যাচ্ছে তাঁর বাবা একজন সরকারি কর্মচারী ছিলেন। যিনি কারদেনাস শিক্ষাবোর্ডের সেক্রেটারি হিসেবে প্রথম জীবনে কাজ করেন। পরে কারদেনাস একোইডাক্ট (aqueduct) বিভাগের প্রশাসক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

যাইহোক, সরকারি চাকুরে বাবা এবং শিক্ষক মায়ের সন্তান ভার্জিলিও পিনেরার জন্ম ১৯১২ সালের ৪ আগস্ট, পশ্চিম কুবা বা কিউবার কারদেনাসে। ১৯২৩ সালে পিনেরা যখন এগারো বছরের, তখন তাঁরা হাভানার গুয়ানাবাকোয়াতে চলে যান। সেখানে বছর দুই থাকার পর ১৯২৫ সালে তিনি তাঁর পরিবারের সঙ্গে মধ্য-পূর্ব কিউবার কামাগুয়েতে পাড়ি জমান। সেখানেই তিনি তাঁর হাইস্কুলের পাঠ সমাপ্ত করেন। ১৯৩৭ সালে হাভানা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দর্শনশাস্ত্রে মাস্টার্স সম্পন্ন করেন। একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডির গবেষণাপত্র “একদল গর্দভ (অধ্যাপকবৃন্দ)”-এর সামনে উপস্থাপনে তিনি অস্বীকৃতি জানান। পরবর্তীতে যে কারণে উপযুক্ত কর্মসংস্থান তাঁর পক্ষে কঠিন হয়ে পড়ে। ফলে কখনও কখনও আর্থিক সহায়তার জন্য পরিবার এবং বন্ধুদের উপর নির্ভর করতে তিনি বাধ্য হন। তরুণ ভার্জিলিও কামাগুয়েতে বসবাসকালে লেখালিখির জগতে প্রবেশ করেন। তাঁর প্রথম প্রকাশিত কবিতা, ‘এল গ্রিটো মুডো’ (দ্য মিউট স্ক্রিম বা নিঃশব্দ চিৎকার), যেটি ১৯৩৬ সালে কিউবান কবিতা সঙ্কলনে অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ের পর্ব সমাপ্তির পর অর্থাৎ ১৯৩৭ সালে তিনি তাঁর প্রথম নাটক ‘ক্ল্যামার এন এল পেনাল’ (Clamor en el Penal, Noise in the Penitentiary) রচনা করেন। আর এর মধ্যে দিয়েই ভার্জিলিও পিনেরার লেখকজীবনের যাত্রা শুরু হয়।

যাঁরা তাঁকে ভালোভাবে জানতেন তাঁদের মতে, সাহিত্য নিয়ে ভার্জিলিও পিনেরার মনোভাব ছিল লেখালেখির জন্যই তাঁর বেঁচে থাকা। যা মোটেও আত্মকেন্দ্রিক নয় বরং পৃথিবীর সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। লেখালেখি ছিল তাঁর কাছে ধর্মের মতো পবিত্র কিছু। বাকি সব যেন ধর্মহীন। তিনি মনে করতেন একজন লেখকের নৈতিক দায়িত্ব হল তার লিখিত বিষয়ের প্রতি সৎ থাকা। আর একজন লেখকের সবচেয়ে বড় আকাঙ্খা হওয়া উচিত ‘স্বাধীনতা’। সত্যের জন্ম দেওয়ার স্বাধীনতা; যা বৌদ্ধিক প্রশ্নের মাধ্যমে অবচেতনে লুক্কায়িত সত্যকে টেনে বের করে আনতে সক্ষম। সেই দৃষ্টিকোণ থেকে তিনি তাঁর অনেক কবিতা, নাটক এবং গল্পের ভেতর একধরনের ধাঁধা সৃষ্টি করেছেন যা পাঠ করে তার উত্তর খুঁজতে পাঠককে বাধ্য হতে হয়।

বহুবছর আগে পোলিশ ঔপন্যাসিক উইটোল্ড গোমব্রোইজের (Witold Marian Gombrowicz) সঙ্গে আলাপের সময় তাঁর গল্পগুলো কীভাবে কিউবান গল্প হল সে বিষয়ে ভার্জিলিও বলেছিলেন:

ড্যাম…. ওটা একটা দুর্বোধ্য প্রশ্ন। ওই গল্পগুলোর কিউবান না হয়ে উপায় কী? সেগুলো তো কোনও ফরাসি কিংবা জাপানি লেখক লেখেনি। গল্পগুলো লিখছে ভার্জিলিও পিনেরা, তাছাড়া সেগুলো লিখিত হয়েছে কিউবান ভাষায়, কাস্তিলিয়ান ভাষায় লেখা হয়নি যেটা পড়তে গিয়ে চোখের মাথা ক্ষয়ে যায়। এ ছাড়া এই কিউবান গল্পগুলো যখন লিখছিলাম তখন আমি কিউবার মাঠেঘাটে ঘুরে বেড়াচ্ছিলাম, রাস্তা, বস্তি, বাড়িঘর অতিথিশালা, পাব, বাজার ইত্যাদি জায়গায় বিচরণ করছিলাম যেখানে নিখাদ কিউবান নির্যাস নিসৃত হয়। এই যে নিঃসরণের কথা বললাম তার কারণ হল সাহিত্য আসলে বিভিন্ন সামাজিক উপাদানের নির্যাস।

ছোটবেলা থেকে ভার্জিলিও পড়তে ভীষণ ভালোবাসতেন। নানা বিষয়কেন্দ্রিক পড়াশোনার ঝোঁক বয়সের সঙ্গে সঙ্গে আরও গভীর হয়। ১৯৬০ সালে সাহিত্য সাময়িকী ‘Lunes de Revolución’-এর জুলাই সংখ্যায়, লেখক ভার্জিলিও পিনেরাকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল যে কোনও বিপর্যয় ঘটলে তিনি তাঁর সংগ্রহশালা থেকে কোন বইগুলি সংরক্ষণ করতে চাইবেন? তিনি দশটি বই তালিকাভুক্ত করেন, যার মধ্যে ছিল চার্লস ডিকেন্সের ‘ডোম্বে অ্যান্ড সন’ (Dombey and Son), ফ্রাঞ্জ কাফকার ‘আমেরিকা’ (Amerika), শার্ল বোদলেয়ারের কবিতাসমগ্র ‘দ্য ফ্লাওয়ারস অফ ইভিল’ (The Flowers of Evil), এবং পাবলো নেরুদার ‘এস্ট্রাভাগারিও’ (Estravagario) কাব্যগ্রন্থ। বলাই বাহুল্য এ থেকে পিনেরার সারগ্রাহী পছন্দের একটি আভাস পাওয়া যায়, যা তাঁর বিস্তৃত, সৃজনশীল এবং বহুমুখী সৃষ্টিশীলতার পেছনের রসদ হিসেবে অবদান রেখেছিল।

সৃষ্টিশীলতার ভেতরও ভার্জিলিও পিনেরার প্রায় গোটা জীবনটাই ছিল অঘটন আর ঘটনার জমজমাট মেলবন্ধন। সুদীর্ঘ নির্বাসিত জীবন কাটানোর পাশাপাশি স্বদেশে তাঁকে জেলজীবনের দুর্ভোগও পোহাতে হয়েছে। ১৯৪৬ সাল থেকে ১৯৫৮ পর্যন্ত তিনি আর্জেন্টিনায় নির্বাসিত জীবন কাটান। সেখানে তিনি হোর্হে লুইস বোর্হেস, মাসেদোনিয় ফারনান্দেজ, সান্তিয়াগো দাবোবে এবং অন্যান্য মুক্তচিন্তার লেখকদের সঙ্গে পরিচিত হন যাঁরা তাঁর কাজকে ব্যাপক মাত্রায় প্রভাবিত করেছিলেন। তাঁদের মধ্যে আর্জেন্টিনার সাহিত্যিক হোর্হে লুইস বোর্হেস ছিলেন অন্যতম। সেসময় বোর্হেস পিনেরার সাহিত্যকর্ম নিয়ে যথেষ্ট প্রশংসা করেন। পিনেরার সৃষ্টিশীলতাকে তিনি সহজাত প্রতিভার অংশ বলে বিবেচনা করতেন। যদিও পরে তিনি তাঁর পূর্বতন লিখনশৈলীকে অপরিণত বলে সমালোচনা করেন। ১৯৫৫ সালে বোর্হেস ভার্জিলিওর ছোট গল্প ‘এন এল ইনসনমিও’ (নিদ্রাহীন), ‘কুয়েন্তোস ব্রেভস ওয়াই এক্সট্রাঅর্ডিনারি’-কে তাঁর সম্পাদিত সঙ্কলনে অন্তর্ভুক্ত করেন। বোর্হেসের সাহিত্য সাময়িকী ‘সুর’ (Sur)-এ পিনেরার লেখা প্রকাশিত হয়। নির্বাসিত জীবনে বহুবিধ লেখালেখির পাশাপাশি তিনি অনুবাদক হিসেবে পোলিশ সাহিত্যিক উইটোল্ড গোমব্রোইজের (Witold Gombrowicz)-এর উপন্যাস ‘ফার্ডিডার্ক’ (Ferdydurke) অনুবাদ করেন।

১৯৫৮ সালের শেষদিকে নির্বাসিত জীবনের ইতি টেনে তিনি কিউবায় ফিরে আসেন, সময়মত বাতিস্তার পলায়ন এবং ফিদেল কাস্ত্রোর বিপ্লবের বিজয় দেখতে। প্রথমদিকে তিনি ফিদেল এবং তাঁর সতীর্থদের একজন প্রবল সমর্থক ছিলেন। দেশে ফেরার পরপরই তিনি ‘Revolución’ পত্রিকায় কাজ শুরু করেন এবং দ্য রাইটার ছদ্মনামে একটি নিয়মিত কলাম লিখতেন। ততদিনে একজন নাট্যকার, প্রাবন্ধিক, কবি এবং ছোটগল্পকার হিসেবে তাঁর খ্যাতি বেড়েছে। এই সময়ে তাঁর নাটক, ‘Aire Frío’ (ঠান্ডা বাতাস), মঞ্চস্থ হলে ব্যাপকভাবে প্রশংসিত হয়। কাস্ত্রো সরকার এক পর্যায়ে এমন শিল্পীদের সমালোচনা করতে শুরু করে। যাদের কাজ স্পষ্ট, বাস্তবসম্মত এবং সহজলভ্য ছিল না। কিউবার বুদ্ধিজীবীদের উদ্দেশ্যে কাস্ত্রো তাঁর বিখ্যাত (যা বর্তমানে সমালোচিত) বক্তব্যটি রাখেন— “বিপ্লবের পক্ষে যাবতীয় কিছু, বিপ্লবের বিরুদ্ধে কিছুই নয়।” (within the Revolution, everything, against the revolution, nothing.)

‘উইচ হান্টে’র রূপকে কাস্ত্রো সরকার শুরু করে লেখক-শিল্পীদের হয়রানির পর্ব। যার প্রধান শিকার ছিলেন ভার্জিলিও। কেননা তাঁর কাজগুলো সরকার বর্ণিত আওতার মধ্যেই পড়ে। তবে প্রথমে কাস্ত্রো সরকার সরাসরি তাঁর কাজগুলোকে অভিযুক্ত না করে পরিবর্তে তাঁর সমকামী পরিচয়টি নিয়ে ঝামেলা তৈরি করে। ফলাফল হিসেবে ১৯৬১ সালের ১১ অক্টোবর পিনেরার বিচ কটেজ থেকে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়। জেলের সংক্ষিপ্ত অবস্থান ভার্জিলিওকে মানসিকভাবে ভয়ানক বিপর্যন্ত করে তোলে, অতীতের শতেক ভোগান্তিও তাঁকে অতটা ভাঙতে পারেনি। ভেতরের ভাঙচুর নিয়ে যখন জেল থেকে মুক্ত হলেন তখন যেন তিনি সম্পূর্ণ অন্য মানুষ। দেশের ভেতর তাঁর সৃষ্টিকে পুরোপুরি অগ্রাহ্যের হাওয়া বইতে শুরু করেছে। যার অভূতপূর্ব এক নজির প্রত্যক্ষ করেন স্প্যানিশ লেখক হুয়ান গয়েটিসোলো। ১৯৬৪ সালে চে গুয়েভারা আলজিয়ার্সের কিউবান এম্ব্যাসির ছোট্ট লাইব্রেরিটি পরিদর্শনের সময় ভার্জিলিও পিনেরার খান দুয়েক বই দেখে অগ্নিশর্মা হয়ে ওঠেন। রাগে গরগর করতে করতে সেগুলো ছুড়ে মারেন এবং চিৎকার করে জানতে চান, “এই ফালতু সমকামীর বই এখানে রাখার সাহস হয় কীভাবে?” সেখানে উপস্থিত হুয়ান গয়েটিসোলো চে-র আচরণে এতটাই বিস্মিত হন যে সেই পরিস্থিতিতে একটা শব্দও তাঁর পক্ষে উচ্চারণ করা সম্ভব হয়নি। ভার্জিলিও পিনেরার সৃষ্টিগুলিকে আড়ালে সরিয়ে রাখার এই অধ্যায়টিকে তাঁর এক জীবনীকার ‘উইচ হান্ট’ বলে অভিহিত করেছেন। বিরুদ্ধমতামত পোষণকারীদের শায়েস্তা করতে পৃথিবীর বহু দেশের ক্ষমতাসীনদের পক্ষে মধ্যযুগীয় এই পদ্ধতিটির প্রয়োগ একটি কার্যকরী হাতিয়ার।

চাইলে হয়ত পিনেরা কিউবার বাইরে ইউরোপিয়ান কোনও দেশে আশ্রয় নিয়ে বাকি জীবন কাটাতে পারতেন। আর্জেন্টিনায় দীর্ঘ বারো বছর নির্বাসনে থাকার পর তিনি ঠিকই দেশে ফিরেছেন। কিউবার মাটি তাঁকে টেনেছে। ১৯৬৫ সালে প্যারিসে যখন শেষবারের মতো মিরিয়ম গোমেজের সঙ্গে তাঁর দেখা হয়, তাঁকে দেখে মিরিয়মের তখন মনে হয়েছিল, ‘বাতাসে ভেসে বেড়ানো দিগভ্রান্ত ছোট্ট এক চড়ুই যেন!’ ঘনিষ্ঠ এক বন্ধু তাঁকে পরামর্শ দিয়েছিলেন, তিনি যেন কিউবায় না ফেরেন। কারণ দেশে ফিরলে তাঁকেও অনেক সমকামীর মতো বন্দিশিবিরে চালান করা হবে। পিনেরা বন্ধুর কথায় কান দেননি। দেশে ফিরেছেন। তাঁর খুব ইচ্ছে ছিল কিউবায় ফিরে তিনি দেশপ্রেমিকের মতো স্বদেশের মাটিকে চুমু খাবেন। নিয়তির কী পরিহাস, চুমু তিনি খেয়েছিলেন ঠিকই, কিন্তু সেটা জন্মভূমির মাটিতে নয়, রাশিয়ার তৈরি আলকাতরা মেশানো নুড়িপাথরে— গিয়েরমো কাবরেরা ইনফানটে যাকে চমৎকার রূপকের মাধ্যমে প্রকাশ করেন, “দ্য রানওয়ে মিটস্ দ্য রানওয়ে।”

এরপর স্বদেশ কিউবায় শুরু হয় জীবিত পিনেরার মৃত্যুর পর্ব। ১৯৭১ সালের শুরুতে, পিনেরাকে ভিন্ন মতাদর্শগত বিশ্বাস এবং তাঁর সমকামিতার কারণে কিউবার সরকার এবং সাহিত্যিক প্রতিষ্ঠান কর্তৃক বহিষ্কৃত করা হয়। যদিও তাঁকে আর কখনও জেলবাস করতে হয়নি, কিন্তু এরপর থেকে একজন চরম নিন্দিত মানুষ হিসেবে তিনি জীবনযাপনে বাধ্য হন। পরবর্তী বছরগুলিতে তাঁর কাজগুলোকে নিদারুণভাবে উপেক্ষা করা হয়। তাঁকে সামাজিকভাবে যতই হেয় প্রতিপন্ন করা হোক না কেন পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠ সম্পর্কে চিড় ধরেনি কখনও। নিজের পছন্দে বিয়ে করা বোনের পক্ষ নিয়ে অসন্তুষ্ট মাকে বোঝাতে যেমন পিছপা হননি, একইভাবে বাবার দৃষ্টিশক্তি যখন ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছিল সুযোগ পেলেই তিনি তখন বাবাকে সঙ্গ দিয়েছেন। বাবার সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক ছিল বেশ আন্তরিক। বাইরের সমাজ যখন তাঁকে প্রায় নিষিদ্ধ করল, সেই বিষাদের কালে তিনি তাঁর বাবাকে হারান। ব্যক্তিগত এই বিপর্যয় ভুলতে লেখালেখির জগতে আশ্রয় নেন। বাইরে-ভেতরের কোনও বিপর্যয়ই তাঁর লেখালেখির রুটিনে দাঁত বসাতে পারেনি। চারপাশে যাই ঘটে যাক, তিনি প্রতিদিন সকালে লেখার টেবিলে বসতেন। যদিও জানতেন লেখাগুলো ছাপার অক্ষরে আর কেউ প্রকাশ করবে না। পাঠক পর্যন্ত পৌঁছাবে না তাঁর নতুন লেখালেখি! তাঁকে ধ্বংসের যাবতীয় প্রক্রিয়াকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে নিজেকে সৃষ্টিশীল রাখার মন ভোলানো এক প্রাণান্তকর খেলায় মেতে ওঠেন।

নিয়মিতই তিনি লিখে গেছেন কিন্তু কেউ তাঁর নাটক মঞ্চস্থ করতে চায়নি। ফলে ভার্জিলিওর নাটক মঞ্চায়ন বিরল হয়ে ওঠে। এত মন্দের ভেতরেও ১৯৬৮ সালে পিনেরার নাটক ‘ডস ভিয়েহোস প্যানিকস্’ মর্যাদাপূর্ণ কাসা দে লাস আমেরিকাস পুরস্কারে সম্মানিত হওয়ার খবরটি ছিল প্রশান্তিদায়ক। বিচ্ছিন্নতা সত্ত্বেও তাঁর বইগুলো বিদেশের পাঠকের কাছে যথেষ্ট সমাদৃত হয়েছিল। ১৯৭১ সালে তাঁর ‘Cuentos Fríos’ (Cold Tales) ফ্রান্সে ‘Comtes Froids’ শিরোনামে প্রকাশিত হয়। ১৯৭২ সালে ‘Pequeñas Maniobras’ রোমানিয়ান ভাষায় অনূদিত হয়। নিজদেশে পরবাসী পিনেরার কাছে বিদেশি পাঠকের উচ্ছ্বাস কতটা পৌঁছেছিল জানা নেই। জীবদ্দশায় নিজের সৃষ্টির অবহেলা ভেতরে ভেতরে তাঁকে  নিঃসঙ্গ করে তুলছিল সন্দেহ নেই। ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের একান্ত আড্ডায় সৃষ্টিশীলতায় পারঙ্গম লেখক প্রায় হতাশা প্রকাশ করতেন। বিপ্লবোত্তর কিউবা শিল্পকে স্বচ্ছ, বাস্তবসম্মত এবং সহজলোভ্য, মোটকথা নিজের মনপসন্দভাবে দেখতে চেয়েছিল। সেখানে পিনেরার সৃষ্টিগুলো তাদের জন্য ছিল একেবারেই বিপরীত ঘরোনার। তিনি দুহাত ভরে লিখলেও সেসব যেন কিউবার কোনও কাজেই লাগছে না— এই বোধ পিনেরাকে ভীষণভাবে ব্যথিত আর হতাশ করে তুলেছিল। ঘনিষ্ঠ অনেক বন্ধু তখন সমকামিতার অপরাধে বন্দিশিবিরে আটক। চারপাশের ঘটনার অভিঘাতে তাঁর ভেতরের ক্ষয়টা হয়ত তাঁকে ভালোই ধরাশায়ী করেছিল। তিনি মোটেও প্যারানয়েড ছিলেন না, কিন্তু এক প্যারানোয়া পরিস্থিতির জুজু নিরন্তর তাঁকে আষ্টেপৃষ্টে বেঁধে রাখত। যার বাঁধন ছিঁড়ে মুক্ত জীবনের স্বাদ তাঁর ভাগ্যে আর জুটবে না, এই সত্যিটাও বুঝি তিনি টের পেয়েছিলেন। ১৯৭৯ সালের ১৮ অক্টোবর তাঁর সুস্থ-সচল হৃদযন্ত্র হঠাৎই থেমে যায় চিরদিনের মতো। তাঁকে ঘিরে তৈরি খাঁচার বাঁধন কেটে উড়ে যান সেই মুক্ত দিগন্তে, যেখানে চিন্তার স্বাধীনতায় কেউ বাধা দেওয়ার ক্ষমতা রাখে না।

একাধারে কবি, নাট্যকার, প্রাবন্ধিক, গল্পকার এবং ঔপন্যাসিক ভার্জিলিও পিনেরা একটি সমৃদ্ধ সৃষ্টির জগৎ রেখে গেছেন। যার মধ্যে রয়েছে বিশটিরও বেশি নাটক, প্রায় শতাধিক ছোটগল্প, সমান পরিমাণ কবিতা, সাহিত্য সম্পর্কিত প্রবন্ধগুচ্ছ, সাহিত্য সমালোচনা। এবং ‘লাকার্নেদেরেনে’, ‘প্রেসিওনেসইদিয়ামেন্টেস’ ও ‘লাসপেকিয়িসমানিওব্রাস’ শিরোনামে তিনটি উপন্যাস। তাঁর সবচেয়ে বিখ্যাত কবিতা হল ‘লা ইসলা এন পেসো’ (La isla en peso, The Island in Weight) ১৯৪৩ সালে প্রকাশিত হয়। পিনেরার গল্পে উদ্ভট আর ধাঁধাময়তার কেমন একটা মেলবন্ধন চোখে পড়ে যা কাফকাসুলভ বলে অনেক বোদ্ধার মতামত। পিনেরার সাহিত্য যতবেশি অনূদিত হচ্ছে ততই তা বিংশ শতকের স্বৈরশাসন ব্যবস্থার বিরুদ্ধে তাঁর প্রতিবাদের খতিয়ান হিসেবে পাঠকের সামনে উপস্থিত হচ্ছে। ধাঁধা এবং রূপকের আড়ালে প্রশ্ন ছুড়ে দেওয়ার এই ভঙ্গিই ছিল ভার্জিলিও পিনেরার শক্তি এবং একই সঙ্গে ভোগান্তিরও কারণ।

ভার্জিলিও পিনেরা সেই বিরলদের একজন, আক্ষরিক অর্থে যাঁর দুবার মৃত্যু— জন্মও দুবার।

 

ঋণ স্বীকার:

  1. “The Death of Virgilio” By Guillermo Cabrera- Infante
  2. “Virgilio Piñera, forgotten master of Cuban literatur” by Mario López-Goicoechea
  3. “A hundred-and-five years of Virgilio Piñera, l’enfant terrible of Cuban literature” by Mario López-Goicoechea
  4. “Virgilio Piñera” by René’s Flesh
  5. “Virgilio Piñera(Britannica.com)” by Roberto González Echevarría
  6. কুলদা রায়

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4879 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

1 Comment

  1. পড়লাম অর্ধেকটা। পরে পড়ে নিবো, এখন উঠতে হচ্ছে… সত্যি তুমি পরিশ্রমী। তোমার জন্য কতজনকে জানতে পারি, কত দূরদেশের মানুষেরা নিকটে চলে আসে!

আপনার মতামত...