রৌহিন ব্যানার্জি
প্রবন্ধকার, কলামনিস্ট, সমাজকর্মী
অল্প বয়সে একটি আর্থিক সংস্থায় চাকরি করার সময়ে আমরা শিখেছিলাম, একজন প্রাপ্তবয়স্ক রোজগেরে মানুষের (যে কোনও মানুষের) খরচ সাধারণত পাঁচ বছরে দ্বিগুণ হয়। তার কারণ শুধুমাত্র যে জিনিসপত্রের দাম বাড়া, সেটাই নয়, মানুষের প্রয়োজন এবং চাহিদাও বাড়ে, অপরিকল্পিত খাতে খরচ থাকে ইত্যাদি। কিন্তু অবশ্যই মূল্যবৃদ্ধি এর অন্যতম কারণ, এটা অস্বীকার করা যায় না। উল্টোদিক দিয়ে দেখলে, একই পরিমাণ জিনিস কিনতে আজ যে পরিমাণ টাকা লাগে, আজ থেকে তিন বছর বা চার বা পাঁচ বছর পরে তার থেকে অনেক বেশি পরিমাণ লাগবে। এই বাড়তি টাকা লাগার কারণে এই বিষয়টিকে আমরা মুদ্রাস্ফীতি বা ইংরেজিতে ইনফ্লেশন বলে থাকি। তা এই মুদ্রাস্ফীতির বহুবিধ কারণ থাকে এবং এটি একটি খুব সাধারণ ব্যপার। আমাদের ভালো লাগুক বা না লাগুক, জিনিসপত্রের দাম সময়ের সঙ্গে বাড়ে, এটা আমরা সবাই জানি, মেনেও নিই, কারণ আটকানোর ক্ষমতা আমাদের নেই। আমাদের মধ্যে যারা নিজেরা কিছু উৎপাদন করি, তারাও চাই যে আমাদের উৎপাদনের মূল্যবৃদ্ধি হোক। শুধু উৎপাদন খরচ বেড়েছে বলে নয়— উৎপাদনের মূল্যবৃদ্ধি মানে আমার শ্রম এবং মেধারও মূল্যবৃদ্ধি বটে।
মূল্যবৃদ্ধি অস্বাভাবিক ব্যপার না হলেও, তার একটা সীমা থাকা দরকার, এটাও আমরা সবাই জানি। ওপরে যে হিসাব দেখালাম, সেটা বজায় থাকে যদি বছরে মোটামুটি ২-৬ শতাংশ মূল্যবৃদ্ধি হয়— অর্থাৎ আজ যেটা আমি ১০০ টাকায় কিনছি, এক বছর পরে যদি সেটা ১০৪-১০৫ টাকা দাম হয়, সেটা আমরা স্বাভাবিক বলেই ধরে নেব। এর থেকে বেশি মূল্যবৃদ্ধি হলে তা আমাদের গায়ে লাগবে। এক বছর আগেও ৮০০ টাকায় কেনা গ্যাস সিলিন্ডার এই বছর ১০০০ টাকায় কিনতে হলে তা শুধু গায়ে লাগে না, ছ্যাঁকা দেয়। মুসুর ডালের দাম ৬০/৬৫ টাকা থেকে ১০০/১০৫ টাকায় পৌঁছে যেতে এক বছরও না লাগলে আমাদের পেটে টান পড়ে। শুধু বিগত এপ্রিল মাসে ভারতের মূল্যবৃদ্ধির হার ৭.৭৯ শতাংশে গিয়ে ঠেকেছে— যা নাকি তার আগের মাসেও ছিল ৬.৯৫ শতাংশ— এবং মনে রাখতে হবে, এই হিসাব কিন্তু খাদ্যপণ্যের হিসাব বাদ দিয়ে। খাদ্যপণ্যের ক্ষেত্রে এই মূল্যবৃদ্ধির হার গত এপ্রিল মাসে ৮.৩৮ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। যাতায়াত খরচ বেড়েছে প্রায় ১১ শতাংশ। পেট্রোলের পর ডিজেলও এসে দাঁড়িয়েছে লিটার প্রতি ১০০ টাকার কাছাকাছি মূল্যে। এই মূল্যবৃদ্ধির হার ২০১৪-র পরে সর্বোচ্চ।
এসব অঙ্ক যতই জটিল মনে হোক, আমরা এখন প্রায় সবাই এইসব জটিল অঙ্কে পারদর্শী হয়ে উঠেছি— বলা যায়, হয়ে উঠতে বাধ্য হয়েছি— কারণ পকেটটা তো আমাদের। পুরো ভারতবর্ষে মুষ্টিমেয় কয়েকজনই আছেন, যাঁরা এখনও টের পাননি যে বাজারে আগুন লেগেছে— যেমন ধরুন মুকেশ আম্বানি— তাঁর পকেটে পার্সও থাকে না, কোনও ক্রেডিট কার্ডও নেই— তাই তিনি হয়তো জানেন না। কিংবা ধরুন নির্মলা সীতারামন— যিনি অ্যাভোকাডো খান, তাই পেঁয়াজের দাম বাড়ার খবর তাঁর কাছে থাকে না। তো এরকম কয়েকজন ক্ষণজন্মা ছাড়া সকলেই জানেন যে মূল্যবৃদ্ধি এই মুহূর্তে ভারত নামক দেশটির সবচেয়ে বড় সমস্যা, তাজমহলের নিচে মন্দির ছিল কি না, সেটা নয়। কিন্তু তার চেয়েও বড় কথা, এই মূল্যবৃদ্ধি সাময়িক এবং অদূর ভবিষ্যতে এতে রাশ পড়ার সম্ভাবনা আছে— এমন কোনও কথা জোর দিয়ে বলাই যাচ্ছে না।
এই মুহূর্তে মূল্যবৃদ্ধি ভারতের একার সমস্যা নয়। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধপরিস্থিতির কারণে ক্রুড অয়েলের দাম বেড়ে যাওয়ার প্রভাব বিশ্ব-অর্থনীতিতে অবশ্যই পড়েছে। মূল্যবৃদ্ধির স্বীকৃত সহ্যসীমা ২ থেকে ৬ শতাংশ হয়ে থাকলে চিন, জাপান, সৌদি আরব, সুইটজারল্যান্ড প্রভৃতি মুষ্টিমেয় কয়েকটি দেশ বাদ দিলে প্রায় প্রত্যেকেই রয়েছে সেই সহ্যসীমার ওপরে। কিন্তু ভারতের সমস্যাটা শুধু মূল্যবৃদ্ধির নয়। ফলত, আজ বাদে কাল যুদ্ধ থেমে গেলে পরশু কি তার পরদিন বিশ্বজুড়ে এই মূল্যবৃদ্ধির হার আবার যখন স্বাভাবিকের স্তরে নেমে আসবে, তখন ভারতেও তা স্বাভাবিক হয়ে যাবে— এই ভরসা প্রায় কারও নেই। কারণ সামগ্রিকভাবে ভারতের অর্থনীতি এক বিপুল অবক্ষয়ের পথে চলেছে— ২০১৬ সালে বিমুদ্রাকরণ বা ডিমনিটাইজেশন যে অর্থনীতির কোমর ভেঙে দিয়েছিল, বাস্তববোধহীন জিএসটি নীতি, ব্যাঙ্ক সংযুক্তকরণ, অত্যাবশ্যকীয় পণ্যতালিকা বিলুপ্তিকরণের মতো একের পর এক তুঘলকি (তুঘলকবাবু লজ্জাই পাবেন) সিদ্ধান্ত সেই মরার ওপর খাঁড়ার ঘা মেরেই চলেছে। সেইসঙ্গে বিশ্বজোড়া অতিমারি, মাসের পর মাস অপরিকল্পিত লকডাউন, শ্রম-আইনের শিথিলীকরণ, ন্যুনতম সহায়ক মূল্য নিয়ে টালবাহানা, রাজ্যগুলিকে বকেয়া জিএসটি না দেওয়া, রাজ্যগুলির প্রতি প্রবল অর্থনৈতিক অবহেলা— এরকম অজস্র উপসর্গে আক্রান্ত এদেশের অর্থনীতির আরোগ্য যে দূর অস্ত, একথা বুঝতে অর্থনীতিবিদ হওয়ার প্রয়োজন পড়ে না।
সাধারণ বুদ্ধি বলে, অর্থনীতির যে কোনও সঙ্কট থেকে বেরিয়ে আসার প্রাথমিক শর্ত, নিম্নবিত্ত মানুষের হাতে খরচযোগ্য টাকার জোগান বৃদ্ধি। এই কারণে সঙ্কটের সময়ে সাধারণত বিভিন্ন ঋণ ছাড়, স্বল্পসঞ্চয়ে সুদের হার বৃদ্ধি, সরকারি প্রকল্পের মাধ্যমে নগদ টাকার জোগান, প্রভৃতি পদক্ষেপ নেওয়া হয়ে থাকে। অদ্ভুতভাবে, অতিমারি ও তজ্জনিত লকডাউনের পর থেকে আমাদের সরকার হেঁটেছেন ঠিক উলটো পথে। যুদ্ধ শুরুর তো বটেই, তার আঁচ পাওয়ারও অনেক আগে থেকেই ভারতে মূল্যবৃদ্ধি চলছে। পেট্রল, ডিজেলের মতো জ্বালানিতে সরকারি করের বোঝা কমেনি, এমনকি অতিমারির সময়ে যখন ক্রুড অয়েল প্রায় জলের দরে বিকোচ্ছিল, তখনও একদিনের জন্যেও কমেনি জ্বালানি তেলের দাম। প্রভিডেন্ট ফান্ড, সেভিংস ব্যাঙ্কে সুদের হার কমেছে। জিএসটি বাড়ানো হয়েছে ওষুধের মতো অত্যাবশ্যকীয় পণ্য সহ প্রায় সর্বক্ষেত্রে। কমেছে বিভিন্ন কল্যাণমূলক প্রকল্পে সরকারি অনুদানের পরিমাণ। সরকারি ঋণ পাওয়া কঠিনতর হয়েছে। এনরেগার মত গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প প্রায় হিমঘরে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। স্কুলে স্কুলে মিড ডে মিল প্রায় বন্ধ— যেখানে চলছে সেখানেও ডিম দেব না, আমিষ দেব না ইত্যাদি কু-নাটক চলছে। অসংগঠিত ক্ষেত্রে বিপুল হারে কমেছে কর্মসংস্থান। ভারতে বেকারত্বের হার এই মুহূর্তে স্বাধীনতার পরে সর্বোচ্চ। অতিমারির সময়ে যে সমস্ত অভিবাসী শ্রমিক নিজের গ্রামে ফিরে যেতে কার্যত বাধ্য হয়েছিলেন, তাঁদের বিরাট অংশ আর কাজে ফেরত আসেননি। এসবের নিট ফল, অতিমারির দুই বছরে দরিদ্র মানুষ আরও দরিদ্রতর হয়েছেন। সেই হিসেব ধরলে এই মূল্যবৃদ্ধির হার যে কোথায় গিয়ে দাঁড়াচ্ছে, তা ভাবলেও আতঙ্ক হয়। অথচ এ কিন্তু নিছক ভাবনা নয়— অবস্থা সত্যিই এতটা খারাপ।
তাহলে বিষয়টা দাঁড়াল এই যে অর্থনীতির সঙ্কট, যার প্রত্যক্ষ ফল আজকের এই অগ্নিমূল্য বাজার— এ কোনও সাময়িক বা হঠাৎ আসা সঙ্কট নয়। এটি মনুষ্যকৃত এবং এটি দীর্ঘমেয়াদি। এর হাত থেকে উদ্ধার পেতে হলে আমাদের শুধু অর্থনীতিবিদদের ওপর বা সরকার বা রিজার্ভ ব্যাঙ্কের ভরসায় বসে থাকলে আর চলছে না— চাই দৃষ্টিভঙ্গির, চিন্তাধারার আমূল পরিবর্তন— প্যারাডাইম শিফট। মনে রাখা দরকার, এর আগে ২০০৮ সালে যখন বিশ্বজোড়া অর্থনৈতিক মন্দা এসেছিল, ভারতীয় অর্থনীতিকে তা কিন্তু তুলনামূলকভাবে কম প্রভাবিত করেছিল। কারণ, ভারতীয় অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি তখনও নিহিত ছিল অসংগঠিত ক্ষেত্রে— কর্পোরেট বাণিজ্যনির্ভর অর্থনীতির থেকে যার মূল সুর সম্পূর্ণ আলাদা। পরবর্তী এক যুগেরও বেশি সময় ধরে এই অর্থনীতির কর্পোরেট-নির্ভরতা আরও বেড়েছে, কিন্তু তার বাইরের অসংগঠিত ক্ষেত্রকে বারবার আঘাত করেও এখনও পুরোপুরি ধরাশায়ী করা যায়নি। বস্তুত ২০১৬ সালের বিমুদ্রাকরণ নামক রাক্ষুসে নীতির মূল লক্ষ্যই ছিল এই অসংগঠিত অর্থনীতিকে ধ্বংস করে সেই বাজার কর্পোরেটের হাতে তুলে দেওয়া। সে উদ্দেশ্য আংশিক সফল হলেও পুরোপুরি হয়নি অবশ্যই। ক্ষুদ্র প্রযুক্তি, ক্ষুদ্র কিন্তু স্বাধীন উৎপাদন, স্থানীয় বাজার, স্থানীয় উৎকর্ষভিত্তিক বাণিজ্য, স্থানভেদে মানুষ এবং বাজারের বৈচিত্র— এগুলিকে ধ্বংস করা এখনও রাষ্ট্রক্ষমতার প্রধান লক্ষ্য। এসবের পুনরুজ্জীবনের মধ্যেই লুকিয়ে আছে আমাদের নিঃশ্বাসটুকু ফেলে বাঁচার চাবিকাঠি। যে অর্থনীতি বারবার ব্যর্থ হয়েছে, তাকে জোর করে টিঁকিয়ে এবং বাড়িয়ে নিয়ে চলার পিছনে রাষ্ট্রের উদ্দেশ্য খুব পরিষ্কার— আমাদের দৈনন্দিন জীবনযাত্রায় আরও বেশি নিয়ন্ত্রণ কায়েম করা। তাই আমাদেরই ঠিক করতে হবে, আমরা আমাদের আগামী প্রজন্মের জন্য কোন জীবন রেখে যাব।
অল্প শব্দে খুব জরুরি লেখা। মূল রোগটি সহজ ভাষায় বুঝিয়ে বলা গেছে। যদিও এই সঙ্কট থেকে বেরিয়ে আসার সদিচ্ছে বর্তমান সরকারের আছে বলে মনে হয় না। কারণ বড় পুঁজির নির্লজ্জ তাঁবেদারি আর স্থানীয় বাজার, শিল্প, কারিগরি ও অর্থনীতিতে সবল করার কাজ একসঙ্গে করা যায় না। বাম-প্রভাবিত ইউপিএ এক সরকারের পর সেইধরনের জনমুখী উদ্যোগ বড় একটা দেখা যায়নি, বরং চালু উদ্যোগগুলিকেও রক্তশূন্য করে তোলা হচ্ছে। যাই হোক, প্রাসঙ্গিক লেখাটির জন্য লেখককে ধন্যবাদ।