অভিষেক ঝা
শিক্ষক, গল্পকার, অনুবাদক, প্রাবন্ধিক
ব্যক্তিগত পরিসরে মোলাকাত হওয়া দুই মানুষকে দিয়েই শুরু করা যাক। দুইজন মধ্যতিরিশ যুবকের গল্প। আমি যেখানে কাজ করি সেখানের অস্থায়ী কর্মী হিসাবে নামমাত্র বেতনে কাজ করেন আমারই কাছাকাছি বয়সের স্থানীয় এক যুবক। শিক্ষাগত যোগ্যতা স্নাতকোত্তর। রোজকার জীবনে পড়াশোনা করেন না। প্রাথমিক, উচ্চপ্রাথমিক, নবম থেকে দ্বাদশ, শেষ দশ বছরে দিয়েছেন সমস্ত স্তরের শিক্ষক নিয়োগের পরীক্ষাই। একটাতেও পাশ করতে পারেননি। যুবক স্থানীয় তৃণমূলের মাসলম্যান হিসাবে কাজ করেন, দাপট রয়েছে তার। রয়েছে অল্পবিস্তর পৈতৃক জমিজমা। নিজেই গল্প করে জানিয়েছেন যে এই দশ বছরে সেইগুলির অনেকটাই বিক্রিবাট্টা করে চাকরি পেতে ব্লক ও জেলাস্তরের নেতাদের দিয়েছেন প্রায় লাখ পনেরো-বিশ টাকা। চাকরি হয়নি। টাকারও পঞ্চাশ শতাংশ ফেরত পাননি। এখন থেকেই পরবর্তী চাকরির পরীক্ষার জন্য কাকে টাকা দিতে হবে তার খোঁজখবর নিতে শুরু করেছেন। আরেকজনের গল্প এই গল্প থেকে আপাতভাবে অনেক দূরের। চিনে পদার্থবিদ্যায় পোস্ট-ডক করতে করতে দুই বছরে ভারতীয় মুদ্রায় পঁচিশ থেকে তিরিশ লাখ টাকা জমাতে মরিয়া হয়ে উঠেছে সে। আগাগোড়া খুবই ঝকঝকে অ্যাকাডেমিক কেরিয়ার, গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়েছে যেসব জার্নালে তাদের ইম্প্যাক্ট ফ্যাক্টর খুবই উঁচু। তারপরেও দুইবার কলেজ সার্ভিস কমিশনের ভাইভার গণ্ডি পেরোতে পারেননি। হাল্কা হিন্দুত্ববাদী যুবকটির ‘রাজনৈতিক’ কোনও দলের সঙ্গেই কোনওকালে কোনও সম্পর্কই নেই। কেবল কানাঘুষোয় শুনেছেন যে দর চলছে বিশ-পঁচিশ লাখ। তাই তিরিশ লাখ জমাতে চান পরবর্তী ইন্টারভিউয়ের আগে। এইরকম অজস্র গল্প পশ্চিমবাংলার সমস্ত স্তরের সরকারি শিক্ষক সংক্রান্ত নিয়োগের পরিসরে ঘুরপাক খেয়ে চলেছে বছর আট-নয় ধরেই। গল্পগুলি কি সত্যি? গল্পগুলি কি প্রমাণ করা সম্ভব? যাঁরা গল্পগুলি বলছেন ও শুনছেন তাঁরা সবাই আইনি ব্যবস্থায় যান না কেন? এই প্রশ্নগুলি উঠতেই পারে। এটাও প্রায় নিশ্চিত যে যারা গল্পগুলি বলেছেন এবং শুনেছেন তাঁদের বেশিরভাগই জনপরিসরে এইগুলি প্রমাণ করতে পারবেন না। তাহলে গল্পগুলির গুরুত্ব আদৌ আছে কিছু?
একটা সমাজের আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক ও নৈতিক অবস্থা বোঝার ক্ষেত্রে পরিসংখ্যান খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু পরিসংখ্যান সেই সমাজের হিমশৈলের দৃশ্যমান চূড়া মাত্র। প্রমাণাদি, দৃশ্যমান যা কিছু তা দিয়ে খানিক আভাস অবশ্যই সেই সমাজের পাওয়া যায়, কিন্তু যা দেখা যাচ্ছে না তা সেই সমাজের বিশালতর অংশ। এতটাই বিশাল ব্যপ্তি তার যে একটা সামাজিক ব্যবস্থাকে যেকোনও সময়ে ডুবাবার ক্ষমতা রাখে সেই না দেখতে পাওয়া অংশই। এই অংশেরই অংশ জনশ্রুতি, জোকস, কানাঘুষো গল্প, গুজব। আজকের পশ্চিমবঙ্গেরই অংশ প্রমাণ না দিতে পারা এই গল্পগুলি যেগুলির কোনও তদন্ত হবে না, নেওয়া হবে না কোনও আইনি ব্যবস্থা, এমনকি যদি কোনও মন্ত্রী শাস্তিও পান তবুও এই গল্পগুলির পরিসর কমে আসার কোনও আশু সম্ভাবনা নেই। ডিগ্রি-শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষিত উচ্চমধ্যবিত্ত, মধ্যবিত্ত ও নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিসর তৃণমূল সরকার পরিচালিত পশ্চিমবঙ্গে চূড়ান্ত হতাশ একটি শ্রেণিতে পরিণত হয়েছিল— তার দলিল হিসাবে থাকবে এই না প্রমাণ করতে পারা গল্পগুলি। পশ্চিমবঙ্গের সরকারি শিক্ষব্যবস্থা গত এক দশকে যে বিপর্যয়ের ভিতর দিয়ে যাচ্ছে তার নথি হিসাবে থাকবে এই নথিবিহীন গল্পগুলি। পশ্চিমবঙ্গ সরকার খুব সুকৌশলে সরকারি শিক্ষাব্যবস্থাকে যেভাবে গুরুত্বহীন করে দিতে চাইছে তার প্রমাণ হিসাবে থাকবে এই গল্পগুলি।
শিক্ষক নিয়োগ সংক্রান্ত দুর্নীতি খুব বাইরে থেকে দেখলে দুইভাবে শিক্ষাব্যবস্থার ক্ষতি করেছে। প্রথমত শিক্ষক হওয়ার তথাকথিত যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও অজস্র যুবক যুবতী শিক্ষক শিক্ষিকা হতে পারেননি। এর ফলে ‘মেধার’ অগ্রাধিকারের প্রেক্ষিত থেকে সেই সমস্ত মানুষকে জীবিকার অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে। বৃহত্তরভাবে এটি অবশ্যই জীবনের অধিকার থেকে মানুষকে বঞ্চিত করার মতোই ঘৃণ্য একটি কাজ যার জন্য তৃণমূল পরিচালিত পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকারই এক ও একমাত্র দোষী। শিক্ষক নিয়োগ সংক্রান্ত দুর্নীতির জন্যই বেশ কিছু মানুষ আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয়েছেন, বেশ কিছু মানুষ মানসিক অস্থিরতা থেকে ধীরে ধীরে দীর্ঘমেয়াদি শারীরিক রোগের কবলে পড়েছেন। এদের জীবনের অধিকার থেকে বঞ্চনা করা অবশ্যই একটি পরিকল্পিত সংঘটিত হিংসা। তলিয়ে ভাবলে সমাজের একটি নির্দিষ্ট শ্রেণির মানুষের পক্ষে এটি রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসেরই সামিল। এই সরাসরি হিংসার শিকার যারা হননি, তারাও পরোক্ষে এই দুর্নীতির বলি হয়েছেন। এই এক দশক জুড়ে অজস্র শিক্ষক হতে চাওয়া তরুণ তরুণী তাদের ঠিক অগ্রজদের অবস্থা দেখে খুব অল্প বয়সেই আগাম সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছেন কোনওমতেই শিক্ষকতাকে পেশা হিসাবে না বাছার। ফলত অনেকেই বাধ্য হলেন অপছন্দের পেশাদারি ক্ষেত্রের জন্য নিজেকে উপযুক্ত করে তোলার প্রস্তুতিতে। মানবসম্পদের প্রেক্ষিত থেকে দেখলে এই সিদ্ধান্ত একইসঙ্গে তিনটি ক্ষেত্রকে ক্ষতিগ্রস্ত করল: যে ক্ষেত্রে সেই তরুণ তরুণী অনিচ্ছা সত্ত্বেও গেলেন, যে ক্ষেত্রে যাওয়ার কথা সেই তরুণ তরুণী যাওয়ার ইচ্ছে থাকলেও ভাবার পরিসরই তৈরি হল না, সেই তরুণ তরুণীর পেশাদার হিসাবে অবচেতন হতাশা যা শুধু পেশাদারি ক্ষেত্রই নয় সেই তরুণ তরুণীর পারিবারিক ও একান্ত ব্যক্তিগত পরিসরকেও প্রভাবিত করবে। এই দুর্নীতিতে দ্বিতীয় ক্ষতিগ্রস্ত আরেকটি শ্রেণি রয়েছে। যারা দুর্নীতিতে অংশ নিয়ে শিক্ষক নিযুক্ত হতে চাইলেন তাদের প্রত্যেকেই তো আর অঙ্কিতা অধিকারী নন, রাজনৈতিক ক্ষমতাহীন অজস্র মধ্যবিত্ত ও নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তানরাও টাকা দিয়ে অনেকে চাকরি পেয়েছেন, আবার এদের চেয়েও অনেক অনেক বেশি মানুষ টাকা দিয়েও চাকরি পাননি। জমানো পুঁজি ঘুষ হিসাবে ব্যবহার করতে হবে এই ভাবনা ভাবতে বাধ্য হয়েছে এই সমস্ত পরিবার। এই দুর্নীতি তাদের অর্থনৈতিক কাঠামোর উপর ভয়ঙ্কর আঘাত এনেছে, যে আঘাতের সামাজিক প্রভাব হয়তো সারদা কেলেঙ্কারির চেয়েও বেশি। সারদা কেলেঙ্কারিতে যাঁদের টাকা লুঠ হয়েছিল, তাঁরা গলা ফাটিয়ে নিজের দাবি জানাতে পেরেছিলেন রাজপথে, পাশে পেয়েছিলেন জনসমর্থন। এই ক্ষেত্রে যে নিম্ন-মধ্যবিত্ত তরুণ তরুণীটি ঘুষ না দিলে যোগ্যতা থাকলেও শিক্ষকতা পাওয়া যাবে না, এই মডেলের স্বাভাবিকায়ন দেখেই ঘুষ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, সামাজিক নৈতিকতার চাপের হেতুই তিনি তার টাকা জোর গলায় ফেরত চাইতে পারবেন না। তিনি কোনও সামাজিক সহানুভূতিও পাবেন না এই দুর্নীতির একজন ক্ষতিগ্রস্ত মানুষ হিসাবে। এই অংশের মানুষের হতাশা, মানসিক অসুস্থতার হেতু শারীরিক অসুস্থতা, আত্মহত্যা এইগুলির বেশিরভাগটাই অজানা থেকে যাবে। পশ্চিমবঙ্গের সেই প্রজন্ম যাদের বয়স এখন মোটামুটিভাবে ধরলে পঁচিশ থেকে চল্লিশ বছরের ভিতর তাদের একটি অংশকে বিবিধভাবে খুন করেছে শিক্ষক নিয়োগ সংক্রান্ত দুর্নীতি।
এই সরাসরি ক্ষতিগ্রস্তদের বাইরে এই দুর্নীতির অভিঘাত মাশরুমের ছাতা হয়ে যাদের মৌলিক অধিকার কেড়ে নিল, সেই অংশটির সবচেয়ে বড় অংশটিই মূলত বয়সের কারণে নিজের অধিকারের কথা গলা ফাটিয়ে বলতে পারেন না: ছয় থেকে আঠারো বছর বয়সী নাগরিকদের চোদ্দো বছর বয়স অবধি শিক্ষা ভারতীয় সংবিধানের দ্বারা স্বীকৃত মৌলিক অধিকার। ভুলে গেলে হবে না যে সংবিধানে ‘শিক্ষা’র কথা রয়েছে, শুধুমাত্র ‘স্কুল যাওয়া’কে মৌলিক অধিকার বলে মেনে নেওয়া হয়নি। এই এক দশকে শিক্ষক নিয়োগে দুর্নীতি এবং সেই দুর্নীতির জন্যই একের পর এক দায়ের হওয়া মামলায় সরকারি ক্ষেত্রগুলিতে শিক্ষক নিয়োগ হয়েছে প্রয়োজনের তুলনায় নগণ্য। মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা হিসাবে নেমে এসেছে ‘উৎসশ্রী’ হেতু গ্রামের স্কুলগুলির, বিশেষ করে বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক প্রায় শূন্য হয়ে আসা। করোনার দুই বছর বাদ দিলেও বাকি বছরগুলিতে সরকারি স্কুলগুলি মূলত ধুঁকেছে শিক্ষকের অভাবে। সরকারি ইস্কুলের শিক্ষকদের সুকৌশলে গণশত্রু বানিয়ে তোলার প্রচেষ্টা রাজ্য সরকার করে গেছে নিজের দুর্নীতি ঢাকতে। শেষ তিরিশ চল্লিশ বছর সরকারি স্কুলগুলিকে কাজে লাগিয়েছে মূলত দলিত, মুসলিম ও আদিবাসী মানুষ। মূলত সরকারি স্কুলগুলি থেকেই শিক্ষা পেয়ে দলিত, মুসলিম ও আদিবাসীদের ভিতর একটি চাকরিজীবি শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণি তৈরি হয়েছে যাঁরা নিজেদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন, যাঁরা ব্রাহ্মণ্যবাদের বিরুদ্ধে গলা তুলে কথা বলতে পারেন। শক্তিশালী সরকারি শিক্ষাব্যবস্থা না থাকলে উচ্চমধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্ত সাবর্ণ হিন্দুর শ্রেণি হিসাবে তেমন কোনও ক্ষতিই নেই কারণ উনিশশো বিরানব্বইয়ের পরে এই শ্রেণিটি মূলত বেসরকারি শিক্ষাব্যবস্থাতেই নিজেদের পরবর্তী প্রজন্মকে অভ্যস্ত করে তুলেছে। অপরপক্ষে সরকারি শিক্ষাব্যবস্থা ভেঙে পড়লে ভয়াবহ ক্ষতির সম্মুখীন শ্রেণি হিসাবে হতে হবে দলিত, মুসলমান ও আদিবাসীকে। সরকারি স্কুলের পরিকাঠামো ভেঙে গেলে উল্লেখিত সম্প্রদায়গুলির ভিতর যে মধ্যবিত্ত প্রতিবাদী স্বরের একটি প্রবাহমান স্রোত তৈরি হয়েছে তা আটকে যাবে। যে মধ্যবিত্তশ্রেণিটি তৈরি হয়েছে তা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে নিজ নিজ সম্প্রদায় থেকে। সেই বিচ্ছিন্ন স্বরকে সমাজের সবক্ষেত্রেই অপর করে তোলা এখনকার চেয়ে সহজতর হয়ে উঠবে ব্রাহ্মণ্যবাদের পক্ষে। শিক্ষক নিয়োগে দুর্নীতি তাই দিনের শেষে একটি হিন্দুত্ববাদী ও ব্রাহ্মণ্যবাদী অপরাধও।
NICE
বাহ সম্পূর্ণ পৃথক দৃষ্টিকোণ! চমৎকার লেখা।
হীরক সেনগুপ্ত