সোমনাথ মুখোপাধ্যায়
প্রাবন্ধিক, গদ্যকার, অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক
বরণীয় শিশুসাহিত্যিক যোগীন্দ্রনাথ সরকারের ‘মজার দেশ’ ছড়াটির কথা আজ হঠাৎ করে মনে পড়ে গেল। মূল প্রসঙ্গে যাওয়ার আগে স্টার্টার হিসেবে গোড়াতেই বরং ছেলেবেলায় পড়া সেই আশ্চর্য ছড়াটির রস একবার বেশ আয়েশ করে চেখে নেওয়া যাক। অসংখ্য ভুলে ভরা মজার দেশের কথা লিখতে গিয়ে কবি লিখেছেন—
এক যে আছে মজার দেশ, সব রকমে ভালো,
রাত্তিরেতে বেজায় রোদ, দিনে চাঁদের আলো।
আকাশ সেথায় সবুজবরণ, গাছের পাতা নীল,
ডাঙায় চরে রুইকাতলা, জলের মাঝে চিল।
…
মজার দেশের মজার কথা বলব কত আর,
চোখ খুললে যায় না দেখা, মুদলে পরিষ্কার।
ছোটবেলায় যতবার এই ছড়াটি পড়েছি, ততবারই মনে হয়েছে এমন সব কাণ্ড যদি চোখ খুললেই দেখতে পেতুম তাহলে কেমন হত! কবিরা তো প্রাগদর্শী হন, তাই কবি যোগীন্দ্রনাথও আগামী পৃথিবীর এমন উলটপুরাণের সম্ভাবনার কথা হয়তো আগাম টের পেয়েছিলেন। তাই তাঁর কল্পনার আকাশ সবুজ, গাছের পাতার রং নীল।
এবার মূল প্রসঙ্গে আসি। এই মুহূর্তে গোটা পৃথিবী জুড়েই প্রকৃতির রাজ্যে এমনই সব চোখ-উলটানো ঘটনা নিয়মিত ঘটে চলেছে। আইপিসিসি-র রিপোর্টে যাই লেখা হোক না, আমরা পৃথিবীর পরিবর্তিত বাতাবরণের অচেনা রূপ প্রায়ই প্রত্যক্ষ করছি। খুব সম্প্রতি মধ্যপ্রাচ্যের দেশ ইরাকে এমনই এক আজব ঘটনা ঘটেছে। মরুময় মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলিতে মরুঝড় কোনও অস্বাভাবিক ঘটনা নয়, কিন্তু যা অস্বাভাবিক তা হল কমলা রঙের ধূলিঝড়ের প্রকোপ বৃদ্ধি। বিগত প্রায় দেড় মাস সময়কালের মধ্যে ইরাকে মোট আটটি কমলা ধূলিঝড়ের প্রাদুর্ভাব ঘটেছে। তথ্যাভিজ্ঞ বিজ্ঞানীমহলের দাবি, সম্ভবত বিশ্ব-উষ্ণায়নের কারণে জলবায়ুর ব্যাপক পরিবর্তনই এমন ঘটনার জন্য দায়ী। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল এরোনটিক্স অ্যান্ড স্পেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের বিজ্ঞানীরা গত ৫ ও ১৬ মে, ২০২২-এ সংঘটিত দুটি বড়মাপের কমলা ধূলিঝড়ের ঘটনা নথিভুক্ত করেন। জনপ্রিয় সামাজিক মাধ্যম টুইটার এবং ইনস্টাগ্রাম-এর পাতা ভরে ওঠে এই কমলা ঝড়ের ‘আঁখো দেখা হাল’-এ।
কেন এমন ঘটনা? চ্যাপম্যান ইউনিভার্সিটির বিশিষ্ট অধ্যাপক রমেশ সিং-এর মতে— “ইরাক, ইরান বা সংলগ্ন মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলিতে প্রতি বছর গ্রীষ্ম ও শীতকালে এমন ধূলিঝড় দেখা যায়। এমনটা অস্বাভাবিক নয়, তবে যা আমাদের চিন্তার কারণ তা হল, সম্প্রতি এই ঝড়ের তীব্রতা ও পৌনঃপুনিকতা দুই-ই পূর্ববর্তী বছরের তুলনায় অনেকটাই বেড়ে গেছে।” এই ঝড়ের সঙ্গে সঙ্গে বেড়ে যায় শ্বাসযন্ত্রের অসুস্থতার সমস্যা। এটা অন্যতর বিপর্যয় ডেকে আনে স্বাস্থ্যপরিষেবার ক্ষেত্রে।
গবেষণায় দেখা গিয়েছে যে এই ধূলিঝড়ের কারণ হিসেবে এই অঞ্চলের ওপর দিয়ে প্রবহমান উষ্ণ ও শুষ্ক ‘শামাল’ বায়ুই মুখ্যত দায়ী। আরব উপদ্বীপের দেশগুলির ওপর দিয়ে এই বায়ু সাধারণত জুন-জুলাই মাসে উত্তর-উত্তরপশ্চিম দিক থেকে বয়ে যায়। সাধারণ পরিস্থিতিতে এর গতিবেগ থাকে ঘন্টাপিছু ৫০ কিলোমিটারের মতো। মূলত দিনের বেলাতেই এর প্রকোপ বাড়ে এবং রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাতাসের গতিবেগ ধীরে ধীরে প্রশমিত হয়। কখনও কখনও এই ঝড়ের দাপট তিন থেকে পাঁচদিন পর্যন্ত স্থায়ী হয়। আরব উপদ্বীপের ওপর ঘনীভূত প্রবল উচ্চচাপকেন্দ্র থেকে এই বায়ু পাকদণ্ডী পথ বেয়ে সংলগ্ন পাকিস্তানের ওপর কেন্দ্রীভূত নিম্নচাপকেন্দ্রের দিকে ছুটে যাওয়ার সময় সিরিয়া ও ইরাকের টাইগ্রিস ও ইউফ্রেটিস অববাহিকার মরুময় অংশ থেকে বিপুল পরিমাণে বালুকণা পারস্য উপসাগর ও আরব উপদ্বীপ অভিমুখে বয়ে নিয়ে যায়। ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ সায়েন্স-এর গবেষক প্রিয়াঙ্কা ব্যানার্জির মতে— “পারস্য উপসাগরের একেবারে শীর্ষবিন্দুতে অবস্থিত ইরাক এই বায়ুকে ছড়িয়ে পড়তে সাহায্য করে। এই বায়ুসঞ্চালনের পেছনে বহু কারণ নিহিত থাকলেও ‘লা নিনা’ (La Nina)-র প্রভাবেই এই ধূলিঝড় এ বছর অনেক বেশি সক্রিয়।”
এখন প্রশ্ন হল লা নিনা কী? যদিও এখানে লা নিনা বা এল নিনো প্রসঙ্গে আলোচনার সুযোগ নেই, তাও খুব সংক্ষেপে বলি— লা নিনা হল প্রশান্ত মহাসাগরের একটি বিশেষ আবহিক অবস্থা। লা নিনার প্রভাবে সমুদ্রজলের স্বাভাবিক তাপমাত্রা অনেকটাই হ্রাস পায়। লক্ষ করে দেখা গেছে লা নিনার প্রভাবে বাণিজ্যবায়ু স্বাভাবিকের তুলনায় অনেক বেশি শক্তিশালী হয়ে ওঠে এবং বিপুল পরিমাণে উষ্ণ জলরাশিকে এশীয় মহাদেশের দিকে ঠেলে দেয়, সংশ্লিষ্ট অঞ্চলে শুষ্ক আবহাওয়ার সৃষ্টি হয়, বাড়ে ঝড়ের প্রকোপ। এর প্রভাব বৈশ্বিক জলবায়ুর ওপর সুগভীর। পশ্চিম এশিয়ার মরুময় শুষ্ক অঞ্চলে খরা এবং ধূলিঝড়ের দাপট বেড়ে যায়। বিশেষজ্ঞদের মতে বিগত দুই বছর ধরে লা নিনার প্রভাব সক্রিয় রয়েছে এবং এই তৃতীয় বছরেও তা যথেষ্ট সক্রিয় থাকবে বলেই অনুমান।
অধ্যাপক সিং-এর মতে, লা নিনা ধারাবাহিকভাবে বেশ কিছুদিন সক্রিয় হলে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ কমে যায়, বিশেষত শীতকালে, ফলে শীত-পরবর্তী সময়ে ধূলিঝড়ের সম্ভাবনা অনেকটাই বেড়ে যায়। বৃষ্টি কম হলে মাটি তার আর্দ্রতা হারায়, সেই কারণে বায়ু দ্রুতগতিতে বয়ে যাওয়ার সময়ে বালুকণাকে উড়িয়ে নিয়ে গিয়ে প্রবল ধূলিঝড়ের সৃষ্টি করে। ধূলিঝড়ের ফলে দৃশ্যমানতা কমে যায়। বাড়ে পথদুর্ঘটনা। ঘটে প্রাণহানি।
এই মুহূর্তে গোটা পৃথিবী জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে নানান দুর্যোগের সম্মুখীন। ইরাকের এই ঘটনার সঙ্গে জলবায়ু রদবদলের বিষয়টি যুক্ত কিনা তা খতিয়ে দেখছেন বিজ্ঞানীরা। তাঁদের মতে অপেক্ষাকৃত দীর্ঘ সময় ধরে বায়ুর উষ্ণতার পরিবর্তন, বৃষ্টিপাতের চরিত্র বদলে যাওয়া, বাতাসের গতিবেগের পরিবর্তন, মাটির আর্দ্রতা হ্রাস পাওয়া এবং বায়ুর আপেক্ষিক আর্দ্রতার হেরফের ঘটলে তা জলবায়ুর পরিবর্তনের ইঙ্গিত দেয়। এইসব ঘটনাই হয়তো ইরাকের সাম্প্রতিক ধূলিঝড় ও কমলা রঙের আকাশের মূল কারণ।
এর পাশাপাশি পরিবেশগত কারণ, যেমন জলাভূমিগুলো শুকিয়ে যাওয়া, ভূমির চরিত্রের ব্যাপক অবনমন এবং মরুভূমির সম্প্রসারণের বিষয়গুলিও এমন ঘটনার কারণ বলে মনে করা হচ্ছে এক সমীক্ষায়। ইরানের ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর ইরানিয়ান স্টাডিজের গবেষক বানাতশেহ কেনুশ (Banatsheh Keynoush) দীর্ঘমেয়াদি খরা পরিস্থিতিকেই ধূলিঝড়ের প্রাবল্যের অন্যতম কারণ বলে মনে করেন। পাশাপাশি মানুষের নানান উন্নয়নমুখী কর্মপ্রয়াস, যেমন বাধ নির্মাণ, পরোক্ষে এমন বিপর্যয় ডেকে আনছে বলে মনে করছেন তিনি। নদীতে বাধ দিলে সমস্ত অঞ্চলে জল ছড়িয়ে পড়তে পারে না যার ফলে শুষ্কতার মাত্রা বাড়তে থাকে। এর ফলে ভৌমজলের সঞ্চয়নমাত্রা কমে যায়, যা মাটিকে আলগা করে ধূলিঝড়কে তীব্রতর করে। এছাড়া জলসম্পদের অপরিকল্পিত ব্যবহার, জলাভূমিগুলিকে অকার্যকর করে রাখাও এর অন্যতম কারণ বলে মনে করা হচ্ছে।
ভারতের ওপর এর প্রভাব
ইরাকের ধূলিঝড় ভারতের ওপর কী প্রভাব ফেলবে তা নিয়েও মুখ খুলেছেন বিজ্ঞানীরা। মনে রাখতে হবে আমরা এক বিশ্বায়িত পৃথিবীতে বাস করছি— তা সে পণ্যের ক্ষেত্রে হোক বা প্রকৃতি। পৃথিবীর প্রকৃতি-পরিমণ্ডল এক অবিচ্ছিন্ন প্রাকৃতিক তন্ত্রের অধীন। আর তাই ইরাকের ধূলিঝড়ের প্রভাব ভারতে পড়বে না এমনটা কখনওই নয়। কী বলছেন বিজ্ঞানীরা এ প্রসঙ্গে? অধ্যাপক রমেশ সিংয়ের অভিমত— বায়ুবাহিত ধূলিকণা কয়েক হাজার কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে ইরান, ইরাক, আফগানিস্তান ও প্রতিবেশী পাকিস্তানের ভূখণ্ডের ওপর দিয়ে উড়ে এসে রাজস্থানের ওপর জুড়ে বসতে পারে। আরব সাগরের পথ বেয়ে গুজরাট রাজ্যেও এই বালুকণার পৌঁছে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। ভারতের পশ্চিমাংশের খরাপ্রবণ পরিস্থিতি এই ধূলিঝড়ের প্রভাবকে টেনে আনতে পারে হিমালয় পর্বত পর্যন্ত। সিন্ধু-গঙ্গার বিস্তীর্ণ সমভূমিতেও পড়বে এর প্রভাব। অবশ্য সবটাই নির্ভর করবে এই অঞ্চলের আবহমণ্ডলের সামগ্রিক আবহাওয়ার ওপর। এই বছর করা এক সমীক্ষায় দেখা গেছে যে, পশ্চিম এশিয়া থেকে আগত এই অনাহুত ধূলিঝড় আমাদের মৌসুমী বৃষ্টিপাতের ওপরেও নেতিপ্রভাব ফেলতে পারে। এমনটা হলে এই ধূলিঝড় নিয়ে ভারতবাসী হিসেবে আমাদের আশঙ্কিত হওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে বইকি।
ইউনিভার্সিটি অফ মেরিল্যান্ডের আবহবিজ্ঞানী রঘু মুর্তুগুড্ডের মতে আরব উপদ্বীপ থেকে ধেয়ে আসা এমন শুষ্ক বায়ু ও ধূলিঝড় ভারতে গ্রীষ্মকালীন তাপপ্রবাহের অন্যতম কারণ। উত্তর-পশ্চিম ভারতে এবছরের দীর্ঘস্থায়ী তাপপ্রবাহের ঘটনা বিজ্ঞানী মহোদয়ের আশঙ্কিত ভাবনাতেই যেন সিলমোহর দিল।
এখানেই উদ্বেগ শেষ হচ্ছে না। বিজ্ঞানী সিংয়ের মতে, ধূলিঝড় হল ধীর কার্যকর বিষের মতো। তাঁর মতে ভূপৃষ্ঠের ওপর দিয়ে বায়ু বয়ে আসার সময় কেবল যে বালুকণাকেই উড়িয়ে নিয়ে আসে তা নয়, পাশাপাশি বয়ে নিয়ে আসে কীটনাশক, ভারী ধাতুকণা, অতি ক্ষুদ্র কণিকাসমূহ, ব্যাকটেরিয়া ফাঙ্গাই বা স্পোরের মতো জৈবিক উপাদানসমূহ, বিভিন্ন অ্যালার্জিকারক উপাদান, এবং অবশ্যই নানান গ্যাসীয় পদার্থকে। এইসব অবাঞ্ছিত উপাদান আমাদের স্বাস্থ্য ও সুস্থতার ওপর যে গভীর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে তা বলাই বাহুল্য।
হিমালয়ের হিমবাহরা দ্রুত ক্ষইছে। তার ওপর হিমালয়ের ওপর এই ধূলিকণার উপস্থিতি হিমবাহের গলনমাত্রা আরও বাড়িয়ে দেবে। খুব সম্প্রতি পাকিস্তানে বরফগলা জলের প্রভাবে সৃষ্ট প্রবল হড়পা বান এক ভয়ঙ্কর বিপদ ডেকে এনেছে। এমনটা এখানেও যে ঘটবে না তার নিশ্চয়তা কোথায়?
আতঙ্কের এখানেই যে ইতি, এমনটা নয়। সিন্ধু-গঙ্গা সমভূমির বুক উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা শিল্প-কারখানার বর্জ্য গ্যাসের সঙ্গে ধূলিঝড়ের ধূলিকণার রাসায়নিক সংযোগ ঘটাতে পারে নতুন বিপর্যয়, তাপমান বাজেটে ঘটতে পারে অনিবার্য পরিবর্তন।
এতসব লেখার পর মনে হচ্ছে, এই সময়ের পৃথিবীর মানুষেরা বোধহয় এক আশঙ্কিত যাপনে ক্রমশ অভ্যস্ত হয়ে পড়ছি। পৃথিবী জুড়ে যে প্রবল রদবদলের পালা চলছে, সে বিষয়ে আমরা খুব বেশি সচেতন এমনটা নয়। ইতিমধ্যেই বিজ্ঞানীরা হলোসিন এক্সটিঙ্কশন বা ষষ্ঠ গণবিলুপ্তির কথা বলেছেন। এই বিলুপ্তির ঘটনা পৃথিবীর ইতিহাসে হয়তো নতুন নয়, কেননা পূর্ববর্তী পাঁচটি বিলুপ্তির পর্বের সাক্ষী থেকেছে ধরিত্রী। কিন্তু এবারের গণবিলুপ্তি জনবিলুপ্তির কারণ হয়ে উঠবে। আমরা আভাস পাচ্ছি। এখন সময় অনুধাবনের। আকাশটা আবার নীল হবে এই আশাটুকু অন্তত বেঁচে থাক— গভীর বিশ্বাস হয়ে।