শুভোদয় দাশগুপ্ত
অধ্যাপক, প্রাবন্ধিক, ওয়েবকুটার রাজ্য সভাপতি
রাজ্যে স্কুল-কলেজের শিক্ষক, শিক্ষাকর্মী নিয়োগ নিয়ে শাসকদলের সীমাহীন দুর্নীতি যখন প্রতিনিয়ত প্রকাশ্যে আসছে, অভিযুক্ত হচ্ছেন প্রাক্তন ও বর্তমান মন্ত্রী সহ বহু আমলা ও শাসকদলের অনুগামীরা— এমন এক সময়ে রাজ্য মন্ত্রীসভার বৈঠকে মুখ্যমন্ত্রীকে রাজ্যের সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলির আচার্য করার সিদ্ধান্ত রাজ্য সরকারের বর্তমানের চরম দেউলিয়া অবস্থারই প্রতিফলন। রাজ্যপাল ও রাজ্য সরকারের সংঘাত যা দীর্ঘদিন ধরে এ-রাজ্যে চলছে, তা কারও অজানা নয়। এই সংঘাত রাজনৈতিক। রাজ্যপালের ভূমিকা সংবিধানসম্মত কি না সে প্রশ্নও উঠে এসেছে। রাজ্যপাল-রাষ্ট্রপতিদের পদগুলি ভারতীয় সংবিধানে রাজনৈতিক পক্ষপাতহীন পদ হিসেবে গণ্য করা হয়। অতীতেও রাজ্যপালদের সঙ্গে রাজ্যের শাসকদলের সংঘাতের নজির আছে। বলা বাহুল্য, এই সব সংঘাতই রাজনৈতিক সংঘাত। কিন্তু রাজ্যপালকে রাজ্যের সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলির আচার্য পদ থেকে অপসারণ করে মুখ্যমন্ত্রীকে আচার্য করা রাজ্য সরকারের বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচালন ব্যবস্থায় আরও প্রত্যক্ষ রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণকেই সুনিশ্চিত করে যা কখনওই সমর্থনযোগ্য নয়।
প্রাপ্তবয়স্ক বৈধ মতদাতারাই গণতান্ত্রিক কাঠামোয় সরকার গঠন করে সংখ্যাগরিষ্ঠতার সংখ্যাতত্ত্বে। গণতন্ত্রের সারকথা এটাই। কিন্তু গণতান্ত্রিক কাঠামোর এটাও এক পূর্বশর্ত যে, নির্বাচিত সরকার কোনও নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দলের নয়, আপামর জনসাধারণের। কিন্তু এই পূর্বশর্ত লঙ্ঘিত হয় গণতান্ত্রিক কাঠামোতেও।
হয়তো এই সম্ভাবনার আশঙ্কাতেই ভারতীয় সংবিধানে রাষ্ট্রপতি, রাজ্যপালের ভূমিকা নির্ধারিত হয়েছে রাজনৈতিক পক্ষপাতিত্বের ঊর্ধ্বে সংবিধানের রক্ষাকর্তা হিসেবে। দল-মতের সঙ্কীর্ণতা হতে মুক্ত থেকে যাঁরা আপামর জনসাধারণের, তথা দেশের ঐতিহ্য রক্ষা করবেন। এই পদগুলি সংবিধানের ভাষায় নিয়মতান্ত্রিক প্রধানের পদ। রাজনৈতিকভাবে যাঁরা প্রভাবিত হবেন না। নিয়মতান্ত্রিক ও কার্যনির্বাহী প্রধানের ক্ষমতার ফারাক বিস্তর। কিন্তু নিয়মতান্ত্রিক প্রধানের মর্যাদা ও সম্মান সর্বোচ্চ। নিয়মতান্ত্রিক প্রধানরা সংবিধানের এই পবিত্রতা রক্ষা করবেন এটাই কাম্য।
উচ্চশিক্ষায় দেশের সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলির আচার্যের ভূমিকাও সমতুল। একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচালনব্যবস্থা, পঠন-পাঠন, মূল্যায়নের পবিত্রতা রক্ষার সর্বময় কর্তা আচার্য। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিবেক— এক অর্থে উপাচার্যেরও অভিভাবক।
তা এই অভিভাবকের শিক্ষাগত যোগ্যতা কি বিবেচ্য হবে না উপাচার্যকে পরামর্শ দেওয়ার প্রশ্নে? যে কোনও প্রধানমন্ত্রী, যে কোনও রাজ্যপাল বা মুখ্যমন্ত্রী কি উপযুক্ত হবেন এই ভূমিকা পালনে? তাই, আচার্য পদ যদি রাখতেই হয় তার যোগ্যতম দাবিদার কি একজন বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ হওয়া বাঞ্ছনীয় নয়?
প্রশ্ন উঠেছে বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে উপাচার্যের মতো প্রভূত শিক্ষিত অভিজ্ঞ ও যোগ্য ব্যক্তির মাথার ওপরে আচার্য পদের আদৌ কোনও প্রয়োজনীয়তা আছে কিনা। এই প্রশ্ন বিতর্কের অবকাশ রাখে, অমূলক বলে নস্যাৎ করা যায় না। আবার, রাষ্ট্রপতি-রাজ্যপালের মতোই বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য পদও হয়তো এক ঔপনিবেশিক পরম্পরা বহন করে, সাধারণ নাগরিকরা যাকে মান্যতা প্রদান করে সম্মান করে। দীর্ঘ দুশো বছরের ব্রিটিশ শাসনের প্রভাবও এই প্রথা নির্মাণে হয়তো পরোক্ষ ভূমিকা পালন করেছে। রাজতন্ত্রের প্রতি, রাজপরিবারের প্রতি ব্রিটিশদের আস্থা ও সম্মান, যা কার্যত শুধুই নিয়মতান্ত্রিক, তারই সাদৃশ্য হয়তো ভারতীয় সংবিধানে রাষ্ট্রপতি, রাজ্যপালের মতো পদগুলির মধ্যে পাওয়া যাবে এবং তারই এক বহুরূপতা উচ্চশিক্ষায় বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য পদ।
সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলির আচার্য পদে এ রাজ্যে মুখ্যমন্ত্রী আসীন হবেন— এই সিদ্ধান্ত শিক্ষাজগতে আলোড়ন ফেলেছে। বিতর্কে নানা প্রসঙ্গ উঠে আসছে। বিশ্বভারতীর আচার্যের উদাহরণ, তামিলনাড়ু ও কেরলের কিছু বিচ্ছিন্ন পরিস্থিতির উদাহরণ, ইত্যাদি। কিন্তু এই মুহূর্তে পশ্চিমবঙ্গে সমগ্র শিক্ষাব্যবস্থার যে শোচনীয় এবং উদ্বেগজনক পরিস্থিতি তাতে এই ঘোষণা সময়ের নিরিখে বড়ই নির্মম। রাজ্যে হাজার হাজার চাকুরিপ্রার্থী শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মী প্রতারিত। দিনরাত এক করে ঝড়-জল-দাবদাহ মাথায় নিয়ে বছরের পর বছর তারা রাজপথে আন্দোলনরত। আদালতে অসংখ্য মামলা বিচারাধীন শাসকদলের নেতা, মন্ত্রী, রাজ্য সরকারি আমলাদের শিক্ষক নিয়োগে অবাধ দুর্নীতি নিয়ে। সিবিআই প্রতিনিয়ত জেরা করছে প্রাক্তন, বর্তমান শিক্ষামন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী সহ শিক্ষাদপ্তরের সঙ্গে যুক্ত অসংখ্য আধিকারিককে। যোগ্যতানির্ণায়ক সমস্ত ধাপ পেরিয়ে নিয়োগপত্র পাননি চাকরিপ্রার্থীরা। সেইসব চাকরি লাখ লাখ টাকায় বিক্রি হয়ে গেছে অন্যদের কাছে— যাদের কেউ যোগ্যতানির্ণায়ক পরীক্ষায় কৃতকার্য হয়নি, এমনকি অনেকে সেই পরীক্ষাতেই বসেনি। লজ্জার বিষয়, এই নিয়ে এখনও কোনও মন্ত্রী, আমলা, প্রতিমন্ত্রী বা অন্যান্য অভিযুক্ত পদাধিকারীদের পদত্যাগ নেই। এই বিষয়ে রাজ্য সরকারের তথা মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী বা শিক্ষামন্ত্রীর কোনও সুস্পষ্ট বয়ান নেই, অথচ শিক্ষাব্যবস্থায় আরও প্রত্যক্ষ দলীয় নিয়ন্ত্রণ কায়েমের জন্য সক্রিয়তা জারি আছে।
মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রীকে রাজ্য সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য করার সিদ্ধান্ত রাজ্যের শিক্ষাব্যবস্থার এই কদর্য এবং বেহাল অবস্থায় সরকারের অপরিসীম নির্লিপ্তি এবং ঔদ্ধত্যেরই এক নিদর্শন। এইখানেই শেষ নয়। এই সিদ্ধান্তের অব্যবহিত পরে রাজ্যের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে ভিজিটরের পদেও রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রীকে বসানোর প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।
রাজ্যের সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে শাসকদলের নিয়ন্ত্রণ সুনিশ্চিত করার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে বহুবছর আগেই। বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালন ব্যবস্থার গণতান্ত্রিক কাঠামো ভেঙে দেওয়া হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালন ব্যবস্থায় আন্ডারগ্র্যাজুয়েট শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মীদের কোনও প্রতিনিধিত্ব নেই, নির্বাচন হয় না। শাসকদলের স্তাবকরাই দণ্ডমুণ্ডের কর্তা। মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে উচ্চশিক্ষার যোগাযোগ নিবিড়। তিনি এ রাজ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনে দীক্ষান্ত-ভাষণও দিয়েছেন। আজ সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলির আচার্য মুখ্যমন্ত্রী যদি হন তো, এই প্রথম বিশ্ববিদ্যালয়গুলির পরিচালন ব্যবস্থায় শাসক দলের হস্তক্ষেপের ক্ষেত্র প্রস্তুত হবে তা কিন্তু নয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্তশাসনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশগুলি হরণ করা হয়েছে ‘পশ্চিমবঙ্গ উচ্চশিক্ষা প্রশাসন ও নিয়ন্ত্রণ আইন ২০১৭’ বলবৎ করে। এই আইন বলবৎ হওয়ার দিন থেকেই রাজ্যের সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সহ সমস্ত সরকারি উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের যাবতীয় নিয়ন্ত্রণ হস্তগত করেছে রাজ্য সরকার তথা শাসক দল। এ রাজ্যে বিগত পাঁচ বছরে বিকাশ ভবন থেকে যত শিক্ষকস্বার্থের পরিপন্থী আদেশনামা তৈরি হয়েছে, তাতে উল্লেখ করা হয়েছে উচ্চশিক্ষার এই নয়া আইনকে।
তাই, মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রীকে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলির আচার্য করার সিদ্ধান্ত উচ্চশিক্ষায় সরকারি তথা শাসকদলের নিয়ন্ত্রণ কায়েম করার কোনও আকস্মিক পদক্ষেপ নয়। বলা যেতে পারে, ‘পশ্চিমবঙ্গ উচ্চশিক্ষা নিয়ন্ত্রণ ও প্রশাসন আইন ২০১৭’ কার্যকর করার মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাধিকার হরণের তথা শাসক দলের নিয়ন্ত্রণ কায়েমের যে প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল, তারই এক কাঠামো-বদল মাননীয় মুখ্যমন্ত্রীকে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলির আচার্য করার সিদ্ধান্ত।
আর বিশ্ববিদ্যালয়গুলির আচার্য পদ থাকার আদৌ প্রয়োজন আছে কিনা সেই বিতর্ক প্রসঙ্গে বলা যায়, আচার্য পদ যদি বহাল থাকে তবে কোনও বিশিষ্ট শিক্ষাবিদই সেই পদের একমাত্র যোগ্য দাবিদার। আর সেই প্রকৃত শিক্ষাবিদকে সর্বান্তঃকরণে মুক্ত থাকতে হবে কোনওরকম রাজনৈতিক দলের সংস্রব থেকে। আর আচার্য পদ যদি আদৌ না থাকে, তবে ‘উপাচার্য’ এই শব্দবন্ধটির পরিবর্তন অবশ্যম্ভাবী।