অশোক মুখোপাধ্যায়
প্রাবন্ধিক, সেস্টাস-এর সম্পাদক
বিজেপিশাসিত ভারত হঠাৎই ধর্মীয় সহিষ্ণুতার মঞ্চ হয়ে উঠছে, সমস্ত ধর্মের প্রতি এবং ধর্মগুরুদের প্রতি শ্রদ্ধাশীল বলে দাবিপত্র পেশ করতে লেগেছে। কেউ যদি এই সহিষ্ণুতা ও শ্রদ্ধাবোধের বিরুদ্ধে যায়? আমরা তাকে দূর করে তাড়িয়ে দেব। এই যেমন নূপুর শর্মা এবং নবীন জিন্দালকে দল থেকে বহিষ্কার করা দেওয়া হল।
কী ব্যাপার? এমন হল কী করে? হিন্দুরাষ্ট্র স্থাপন প্রায় হয় হয়, গরু (মাতা) জাতীয় পশু হিসাবে ঘোষিত হয়ে গেল বলে, হেনকালে কী এমন ঘটেছে যার জন্য অন্য ধর্মের প্রতিও শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করতে হচ্ছে? দেশবাসী অবাক। বিজেপি সমর্থকবৃন্দ অবাক। সঙ্ঘ পরিবারের সদস্যকুল অবাক। আমরা মন্থরাপুঞ্জ কেন এমন উলটো বকছি?
তারপরই বেজে উঠল এক মোহন বাঁশি। নাগপুর থেকে নির্দেশ এল, জ্ঞানবাপীর পরে আর নয়। সমস্ত মসজিদের তলায় শিবলিঙ্গ খোঁজার দরকার নেই। মুসলমানরা আমাদের ভাই। হিন্দুদের সঙ্গে তাদের রক্তের সম্পর্ক। তারা এই হিন্দুস্তানেরই বাসিন্দা। আরে আরে, এইসব তো মোহনদাস গান্ধির কথা ছিল। লোকটাকে আমাদের পূজ্য লোকেরা সেই পুরাকালে পথের কাঁটা জ্ঞানে সরিয়েই দিল। নাথুরাম মন্দিরে এইজন্যই আমরা বছর বছর পুজো দিই, মালা চাপাই। সেই মোহনের কথা এই মোহনও বলছেন? কী দিনকাল এল রে ভাই। এনআরসি, সিএএ— ইত্যাকার সদ্য তৈরি যন্ত্রপাতিগুলির তাহলে কী হবে? কোথায়, কাদের উপর প্রয়োগ হবে? ডিটেনশন ক্যাম্পগুলিরই কী হবে?
ব্যাপারটা বুঝতে গিয়ে হিমসিম খাচ্ছিলাম। তারপরই খেয়াল হল, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে কেন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক পড়ানো হয়। সব জিনিস জাতীয় লেন্সে ধরা পড়ে না। কিছু জিনিস বুঝতে হলে আন্তর্জাতিক টেলিস্কোপ লাগে। সেরকম টেলিস্কোপে চোখ রেখে তবে ধরতে পারলাম, কীসের থেকে কী হল।
এযাবতকাল ভারতে মুসলমানদের উপরে যতই নির্যাতন হোক, দাঙ্গা বা গণহত্যা হোক, আরব দেশগুলি তা খুব একটা গায়ে মাখত না। নির্জলা সত্যটা হচ্ছে, পবিত্র ধর্মভূমি পাকিস্তানে না গিয়ে ভারতে পড়ে থাকার জন্য এদেরকে তারা সহি মুসলমান বলে আদৌ গণ্য করত না। বাংলাদেশের মুসলমানদেরও ওরা মুসলিম বিশ্ববেরাদরিতে রাখেনি, কেন না, তারা লড়াই ঝগড়া করে ধর্মের উপরে ভাষাকে জায়গা দিয়ে পাকিস্তান ছেড়ে বেরিয়ে গেছে।
তথ্যটা আগেকার কংগ্রেস এবং এখনকার বিজেপি-র জানা ছিল বলে এতদিন সংখ্যালঘু পেটাইতে কোনও অসুবিধা বা কিসসা হয়নি। ওসব দেশে হিন্দু পার্শিদের ব্যবসাও ভালোই হচ্ছিল। নেলি বা গুজরাতে গণ-মুসলিমহত্যার পরে আরব দুনিয়ায় এক ডলারের ব্যবসাও মার খায়নি। এনআরসি, সিএএ ইত্যাদি ঘোষণার পরেও সৌদি আরব, আরব আমিরশাহি, কিংবা ইরান বা ইরাক তাতে কোনও গুরুত্বই দেয়নি। ভারতের দু-দশ লক্ষ মুসলমান ডিটেনশন ক্যাম্পে যাবে, যাক না। ওদের তো এমনিতেই ইন্তেকালের পরে দোজখে যাওয়ার কথা। সে দোজখ না হয় জীবনকালেই ঘুরে এল!
২০২৪ সালের বড় ভোটের দিকে তাকিয়ে গোটা বিজেপি যন্ত্র যখন ঘৃণা-বিদ্বেষের চাষ শুরু করে দিয়েছে, কাশ্মির ফাইলস, পৃথ্বীরাজ ফোল্ডার নেমে গেছে, বুলডোজার নামিয়ে দেওয়া হয়েছে মুসলমান বস্তি ধরে ধরে, যার সঙ্গে তাল দিয়ে নূপুর শর্মা বা নবীন জিন্দাল প্রমুখ হিন্দুবীরের দল তাঁদের বাক্যশর, টুইট হ্যান্ডল ইত্যাদি ব্যবহার করতে ঝাঁপিয়ে পড়েছে, আইটি সেল বত্রিশ হাজার নতুন ভিডিও স্ক্রিনশট নিয়ে তৈরি, এমন সময়…
ঠিক এরকম মাহেন্দ্রক্ষণে কেস্টা পুরো বিগড়ে গেল হজরত মহম্মদকে ধরে একটা সামান্য কটূক্তি করার ফলে।
এইসব কচিকাচা গেরুয়াদের তো আর জানা ছিল না, ভারতের মুসলমানরা যে হজরত মহম্মদের কথা বলে, কাতার ওমান বা সৌদিতেও তিনিই নবী হিসাবে শ্রদ্ধেয়। মানে, এটা সঙ্ঘের বা বিজেপি-র সাম্প্রতিক চিন্তন শিবিরগুলিতে কখনও বলা হয়নি। বুলডোজার সংস্কৃতিতে অভ্যস্ত হয়ে গেলে সামনে সব কিছুই সেকুলার পত্থর বলে ভ্রম হতে থাকে!
ফলে ঝানু গেরুয়া নেতারা এখন পড়েছেন গভীর বিপাকে।
বিপদের ছোটখাটো সিগন্যাল আসছিল এদিকওদিক থেকে। অক্সফোর্ডে বিবেক অগ্নিহোত্রীর বক্তৃতার প্রোগ্রাম বাতিল করতে হয় ছাত্রদের চাপে। মেলবোর্ন বিশ্ববিদ্যালয়েও আর এক বিজেপি ধুরন্ধরের অনুষ্ঠান বাতিল হয়ে গেছে। এর পর কবে যে সারা বিশ্বের সর্বত্র নানা প্রতিষ্ঠানে বিজেপি-কে বয়কটের ডাক শোনা যাবে বলা যাচ্ছে না!
তার উপর, ভারতের উপরাষ্ট্রপতিকে আমন্ত্রণ করে খেতে ডেকে সেই দাওয়াত আচমকা বাতিল করে দিয়েছে কাতার সরকার। যে দেশটার আয়তন ভারতের একটা জেলার মতো। ওদিকে আর এক দেশে কচেরাদানির গায়ে দাড়িওয়ালা মুখচ্ছবি লাগিয়ে তাতে জুতোর ছাপ মারা হয়েছে।
এও বাহ্য! আরও এক মহা খাতরা হয়েছে এই যে হিন্দু লুটেরা বানিয়াদের ৮৭০০,০০,০০,০০০ ডলারের বাণিজ্য সেইসব আরব দেশে কার্যত বন্ধ হয়ে যেতে বসেছে! ভারতীয় পুঁজি ও পণ্যকে ওরা বয়কটের ডাক দিয়ে বসে আছে।
বহুকাল আগের দাড়িওয়ালা এক ইহুদিকুলে জাত প্রখ্যাত চিন্তাবিদ কার্ল হাইনরিখ মার্ক্স বলেছিলেন, আর্থসামাজিক ভিত্তিই সামাজিক রাজনৈতিক নীতি নির্ধারণ করে। এটা যে ভুল তা কত লোক দেড়শো বছর ধরে কতভাবে প্রমাণ করে ফেলেছিল। কিন্তু ভারতীয় পণ্য বয়কটের আওয়াজ শোনার ঘন্টাখানেকের মধ্যেই উপরে যে মন্থরাসুলভ বাণীগুলির কথা বলেছি, তা প্রকট হল। দিল্লির ভিস্তার ঘর থেকে আওয়াজ উঠল— “আমরা সব ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাশীল।” নাগপুরম থেকে সুগম সঙ্গীত ভেসে এল— “আর মসজিদের তলায় শিবলিঙ্গ খোঁজার দরকার নেই।”
“ওই মহাসিন্ধুর ওপার হতে (এসব) কী সঙ্গীত ভেসে আ(স)ছে!”
ইতিহাসের কেবিনে শুয়ে মার্ক্স আর একবার হেসে উঠলেন এরকম বাতচিত শুনে। ঘনিষ্ঠ বন্ধুকে ডেকে নিয়ে বললেন, দেখেছ ফ্রেডি, আমাদের সেই গালিভোজী ফরমুলা ভারতের মতো একটা পবিত্র রামানুরাগী দেশেও কেমন চলল!
৮৭০০ কোটি ডলার হারানোর ভয়ে কী না হয়! শিলা জলে ভাসতে শুরু করে। আরএসএস হজরত নবীর প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধায় নুয়ে পড়ে।
লক্ষ লক্ষ সেবক কর্মীরা পড়েছে বিপাকে। তারা নুপূর শর্মার সমর্থনে কয়েকশো ভিডিও বানিয়ে ফেলেছিল। নবীন জিন্দালকে বীর কিশোর বানাবে বলে তৈরি হচ্ছিল। মহম্মদ জুবেরের মুন্ডু কেটে ফেলতে ঝাঁপিয়ে পড়বে বলে ভাবছিল। সেই সময় কিনা হাইকম্যান্ড থেকে নির্দেশ আসছে, এগারো দিন একদম চুপ থাক। আশুতোষের লিঙ্গদর্শনে ফুল স্টপ। চল্লিশ হাজার নয়, একটাও মসজিদ নিয়ে এখন কথা পেড়ো না। গৌতম মুকেশ আদি আদির পকেটে হাত পড়লে এবং ওরা খচে গেলে তোমাদের মাইনে দেওয়া বন্ধ করতে হবে।
নুপূর আর নবীন তুরন্ত দল থেকেই ছাঁটাই। দলের নির্দেশিত কথাই বলে। শুধু একটু ছোট ভুল করে দুইকে পাঁচ দিয়ে ভাগ করে ভাগফল সতেরো লিখে ফেলেছিল বলে। ওরা কী করে জানবে, গুজরাতে ২০০০ মুসলমান খুন করার পরও যারা মুখে রা কাড়েনি, সেই তারাই একটা সামান্য আরবি নামের জন্য এমন মরিয়া হয়ে উঠবে। কেউ তো আগে থেকে বলে দেয়নি। বিজেপি-র কোরের নেতারা এখন মধ্যপ্রাচ্যে বোঝাচ্ছেন, ওরা ফ্রিঞ্জ এলিমেন্টস। ওদের কথায় কান দেবেন না!
তবে বাঁচোয়া এই যে দিল্লির সেই দলিত অধ্যাপককে যেমন শিবলিঙ্গ নিয়ে তির্যক মন্তব্য করায় দিল্লির পুলিশ গ্রেপ্তার করেছিল, বামুনের মেয়ে বিজেপি-র সম্পদকে সেই একই ধারায় গ্রেপ্তার করে আর বড় কোনও পাপ করে বসেনি। আইন সকলের জন্যই সমান— হেঁ হেঁ, তা নয়। দলিত আর বামুনের জন্য এক আইন হয় না। শাসক দল আর বিরোধী সমালোচকের জন্য এক আইন হয় না। এক দেশ হলেও এক আইন হয় না। আইনের বই আর পুলিশের খাতা এক আইনে চলে না। নূপুরজি এখন দিল্লি পুলিশের সাদর সুরক্ষায় আছেন।
ভারতীয় মুসলমানদের একটা অংশ এই আন্তর্জাতিক সম্পর্কের মানেটা বুঝে উঠতে পারেননি। তাঁরা ভেবেছেন, এত দিনে বুঝি আরব বিশ্ব আমাদের দিকে মুখ তুলে তাকাল। একেবারেই নয়। হজরত মহম্মদ নিয়ে কুকথায় ওরা ক্ষুব্ধ হয়েছে ঠিকই, তাই বলে ভারতের মুসলিম সম্প্রদায় সম্পর্কে ওদের মনোভাব বদলে যায়নি। পাকিস্তানে না যাওয়া এবং পাকিস্তান থেকে বেরিয়ে যাওয়া মুসলমানদের ওরা কোনওদিনই ক্ষমা করবে না। ধর্মীয় গোঁড়ামি ওদেরও বিজেপি-আরএসএস-এর তুলনায় এক ফোঁটাও কম নয়। মহম্মদের নামে কুকথায় ওদের যতটা লেগেছে, পাকিস্তানকেন্দ্রিক মুসলিম-সত্তা বিচারেও ওরা এখনও ঠিক ততটাই কট্টর। ভারত একটু ঘায়েল হয়ে ক্ষমাটমা চেয়ে নিলেই ব্যাপারটা মিটে যাবে। আবার ব্যবসাবাণিজ্য শুরু হয়ে যাবে। আবার ওরা ভারতে তেল বেচবে। আখলাক বা পহলু খানের নৃশংস হত্যায় বা হত্যালীলায় ওদের কপালে একটুও ভাঁজ পড়বে না। ওরা আপনাদের বন্ধু নয়। কোনওমতেই।
আর সবচাইতে বড় কথা হল, ধর্মীয় চশমা পরে বসে থাকলে এইসব বাস্তব কারণ-কার্য বোঝাই সম্ভব হবে না।
আমাদের খাদ্য বস্ত্র শিক্ষা স্বাস্থ্যের দাবিতে লড়াইটা নিজেদের কোমরের জোরেই করতে হবে। সিএএ কিংবা এনআরসি-র বিরুদ্ধে লড়াইও চালিয়ে যেতে হবে। ধর্মের প্রতি আপনার যে আবেগ তাকে ঘরে রাখুন। সামাজিক লড়াইটা ধর্মের পতাকায় ধর্মীয় স্লোগানে করতে গেলে মারাত্মক ভুল হয়ে যাবে। সামাজিক লড়াইয়ের মঞ্চ ছেড়ে ধর্মীয় লড়াই করতে গেলেও ভোটবাজ রাজনৈতিক কুচক্রীদেরই হাতে খেলতে হবে। ধর্মীয় আবেগ থেকে পথ অবরোধ করতে গিয়ে আপনি নিজের অজান্তেই বিজেপি-র হিঁদু ভোট আর টিএমসি-র মুসলিম ভোটের অঙ্কের সিঁড়ি ভাঙতে থাকবেন। কেন না, আপনারা এমন একটি মুদ্দায় অবরোধ করতে যাচ্ছেন, যার প্রতি অধিকাংশ অমুসলমান মানুষের (তারাই সংখ্যায় বেশি) কোনও আবেগ নেই।
বাংলার তথা ভারতের মুসলিম সমাজ এ পর্যন্ত অসংখ্য প্ররোচনামূলক ঘটনায় অসাধারণ সংযম এবং বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিয়েছেন। ধুলাগড় কিংবা বসিরহাটে সঙ্ঘী চক্রান্তকে তাঁরা স্রেফ সংযম ও বুদ্ধির জোরেই পরাস্ত করে দিয়েছেন। বাবরি মসজিদ হাতবদলের ঘটনার পরেও তাঁরা এমন কিছুই করেননি যা সঙ্ঘকে আরও অক্সিজেন দিতে পারে। এবারের প্রতিক্রিয়ায় কিন্তু সেই মাত্রাবোধের অভাব দেখা যাচ্ছে।
হাওড়ায় গত কয়েকদিন ধরে যে বিক্ষোভ চলছে, তা ভারতীয় মুসলমানদের কোনও অধিকারের পক্ষেই যাচ্ছে না। এই বিক্ষোভ তাদেরই সাহায্য করছে যারা আপনাদের অত্যুগ্র কট্টর ধর্মান্ধ প্রমাণ করতে চায়, আপনারা মিলেমিশে থাকতে পারেন না—এটা প্রমাণ করতে চায়। আর এই বিক্ষোভ সাহায্য করছে তাদের যারা আপনাদের কট্টরতার কারণে বিরুদ্ধ শিবিরের আরও জঙ্গি উগ্র হিন্দু প্রতিক্রিয়ার শিকার বানিয়ে সেই অসহায় মুহূর্তে বন্ধু সেজে পাশে দাঁড়িয়ে ভোট ভিক্ষায় নেমে পড়বে। এই আন্দোলন হজরত মহম্মদের সম্মান পুনরুদ্ধারে সক্ষম তো হবেই না, উলটে নূপুর শর্মাদের বক্তব্যের সমর্থক সংখ্যা বাড়িয়ে তুলবে। বিজেপি-র ধর্মের নামে বাড়াবাড়ি যে কারণে শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ অপছন্দ করে, ধর্মের নামে আপনাদের বাড়াবাড়িও সেই একই ভাবে নিন্দিত হবে। মাত্র তিনদিন আগে আপনারা সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের এক বিরাট অংশের তরফে যে সহানুভূতির হাওয়ার পরশ পাচ্ছিলেন, তা নিজেদের দোষেই হারিয়ে ফেলতে চলেছেন। মনে রাখবেন, বিজেপি এখন সারা বিশ্বের দরজায় ব্যাকফুটে। এমন কিছু এখন আমাদের করা উচিত হবে না, যাতে সে আবার ঘাড় উঁচু করার সুযোগ পেয়ে যায়।
সঠিক মূল্যায়ন