অহনা গাঙ্গুলি
রাজনৈতিক কর্মী, প্রবন্ধকার
অনলাইনে পরীক্ষা হলে ভালো, নাকি অফলাইনে? প্রায় সবাই আলোচনা করছি। প্রসঙ্গটা আরও তলিয়ে বুঝতে চেষ্টা করার আগে খুব জরুরি কয়েকটা তথ্য দেওয়া দরকার। আমরা অনেকেই অনলাইনে পড়াশুনার রমরমাটাকে শুধুই কোভিড অতিমারির সময়কাল দিয়ে দেখি। নিঃসন্দেহে স্কুল-কলেজ পৃথিবী জুড়ে বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর থেকে এই চর্চা বেড়েছে, কিন্তু এটাই তার শুরুয়াত না। ২০১৯ সালের মে মাসে, পুঁজির দালালেরা পূর্বাভাস[1] দিয়ে রেখেছিল, ২০২৫ সালের মধ্যে অনলাইনে শিক্ষাসংক্রান্ত ব্যবসা ৩৫০ বিলিয়ন ডলার ছোঁবে[2]। লকডাউন-পূর্ববর্তী সময়ে এমন আভাস কীভাবে দেওয়া যায়? যেভাবে পুঁজিবাদী ব্যবস্থা তার ক্রোনি রূপ ধরে তীব্র অনিশ্চিত একটা তরতাজা শ্রমভাণ্ডার তৈরি করেছে, ১৪ থেকে ৩০ বছর বয়সি টাটকা ছেলেমেয়েদের একটা বিপর্যস্ত অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় লেখাপড়া ছাড়তে হয়ে চলেছে, সামান্য অর্থের বিনিময়ে দিনরাত এক করে খেটে যেতে হচ্ছে, তাদের উপর ভর করেই এই পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে। যে ব্যবস্থা এদের লেখাপড়ার অধিকারকে স্বল্পমূল্যে শ্রমের বাজারে বিকিয়ে দিয়েছে, সেই অর্থনৈতিক ব্যবস্থাই এই অংশের জন্য আরও সুবিশাল ফাঁদ পেতেছে; “কাজ করতে করতে অনলাইনে ডিগ্রি নাও”, “ঘরে বসে ডিগ্রি অর্জন করো”, “সপ্তাহ শেষে ২-৩ ঘন্টা প্রচণ্ড দক্ষ প্রশিক্ষকের সাহায্যে এমবিএ করে মাসিক রোজগারকে ৬ অঙ্কের ঘরে নিয়ে চলো”— এসব মুখরোচক কথার আড়ালে লুকিয়ে থাকে অস্বাভাবিক মূল্যের সাবস্ক্রিপশন, ইএমআইয়ের চক্কর, আর এসবের থেকে অনেক অনেক বড় এক অদৃশ্য শত্রু— হতাশা।
যে তর্ক প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করছি, তার প্রস্তাবে বা ভিত্তিতে ‘প্রযুক্তি-বিমুখ’ কোনও ভাবনা বা প্রবণতা নেই। আছে, প্রযুক্তির অসম বণ্টনের প্রতি অসন্তোষ। এই অসাম্য, প্রযুক্তির ফলানো সোনার ফসল থেকে বিরাট অংশের মানুষকে চিরকাল বঞ্চিত করে এসেছে, এই বঞ্চনার ইতিহাসের প্রতি রাগ আছে, ক্ষোভ আছে। ইতিহাসের থেকে নেওয়া এই শিক্ষাই আমাদের বারবার ডিজিটাল ডিভাইড নিয়ে প্রতিবাদে সামিল করে। আমার দেশে আমাদের স্বাক্ষরতা আন্দোলন করতে হয়, স্কুল চলো স্লোগান দিয়ে সমগ্র শিক্ষার কাজে যুক্ত হতে হয়, মিড ডে মিলের জন্য সংগ্রাম চালানোর সময়ে বহুতলে পরিকল্পনা করতে হয়; এই দেশে বাসস্থানের কাছাকাছি একটা ইট-কাঠ-পাথরের স্কুলবাড়ির আঙিনায় ছাত্রছাত্রীদের টেনে আনতে হয়, এরকম একটা আর্থ-সামাজিক পরিবেশে ডিজিটাল আঙিনায় আসতে বাধ্য করা একটা ভয়ানক অপরাধ। সরাসরি মানবাধিকার খর্ব করার কল।
এমন সব নানারকম ছবি, প্রতিচ্ছবির মাঝে একটা খাপছাড়া প্রশ্ন এসেছে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষা পদ্ধতি নিয়ে, খাপছাড়া কারণ পশ্চিমবঙ্গের প্রেক্ষিতে দেখলে ফেব্রুয়ারি মাসে বেশিরভাগ কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় খুলেছে, ক্লাসরুমে পড়াশুনো শুরু হয়েছে। প্রায় ২২ মাস পরে পুরনো লেখাপড়ার অভ্যাসে ফিরে কীভাবে ক্লাস হবে, কীভাবে পরীক্ষা হবে, কীভাবে ছাত্রছাত্রীরা আবার সাবলীল হয়ে উঠবে— এসব বিষয় টপকে, খাপছাড়াভাবে অফলাইন বনাম অনলাইন ব্যাপারটা হাজির হল। এপ্রিল মাসের শেষ নাগাদ প্রশ্নটা আবছা দেখা দিল এবং এখন প্রকট হয়ে উঠেছে। একটা অংশের ছেলেমেয়েরা অনলাইন পদ্ধতিতে পরীক্ষা দেওয়ার জেদ নিয়ে জড়ো হয়ে নানান প্রশাসনিক দপ্তরে বিক্ষোভ প্রদর্শন করছে, তৃণমূল ছাত্র পরিষদ যেখানে ভীষণ সক্রিয় সেখানে অভব্যতা দেখা গিয়েছে, যথারীতি। তৃণমূল ছাত্র পরিষদের পরীক্ষা, পদ্ধতি, লেখাপড়ার সাথে সংযুক্ত কোনও বিষয় নিয়ে দায়বদ্ধ থাকার কথা না, অযথা তাদের অনলাইন পরীক্ষার পক্ষে মতামত দেওয়ার কারণ খুঁজতে গেলে তাদের উপর অকারণ চাপ সৃষ্টি হবে। আগে তারা অধ্যক্ষের দরজায় লাথি মারা, ভর্তির সময়ে লক্ষ লক্ষ টাকা ঘুষ নেওয়া, শিক্ষাঙ্গনে মহিলাদের সঙ্গে অসভ্যতা করার মতন বিষয়গুলির দায় নিতে অভ্যস্ত হোক, তারপর উন্নততর কিছু দায় নিয়ে ভাবা যাবে।
প্রশ্নটা হচ্ছে—
এত এত ছাত্রছাত্রী অনলাইনে পরীক্ষা দিতে চাইছে কেন?
পরীক্ষার মাঝে, পরীক্ষার খাতা স্ক্যান করার সময়ে, নির্ধারিত সময়ে উত্তরপত্র আপলোড করার ক্ষেত্রে এবং সর্বোপরি স্থিতিশীল নেট সংযোগের সুবিধা ইত্যাদি একাধিক গুরুতর বিষয়ে প্রচুর প্রচুর অনিশ্চয়তা সত্ত্বেও—
শুধুই দেখে দেখে লিখবে বলে, পরিশ্রম করে পড়াশুনা করবে না বলে অনলাইনে পরীক্ষা চাইছে?
এতটা সরলীকৃত করে দেখলে আজকের ১৮-২৫ বছরের প্রতি ন্যায্যতা রাখা যাবে না। অর্থনৈতিক ব্যবস্থা, রাজ্য সরকারের গভর্নেন্সের অভিমুখ একটা বিনা পরিশ্রমে, শর্ট কাটে জীবন-যাপনের আরাম-আনন্দ উপভোগ করার দিকে ঠেলে দেয়। প্রশাসনিক প্রধান মনে করেন, “চাকরি না দিলেও লক্ষ্মী ভাণ্ডার তো দিচ্ছি”। এই বাতাবরণের প্রভাব সমাজের সবথেকে সংবেদনশীল মননে পড়বেই, পড়েছেও। এর সঙ্গে সঙ্গে যেটা না বললে আমাদের ছাত্রছাত্রীদের প্রতি অন্যায় হবে তা হল, বেশিরভাগ কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে পড়াশোনাটা পুরোপুরি উঠে যাওয়া। অনলাইন ক্লাসের সমস্ত সময় জুড়ে পড়াশোনার বাইরে চলে যাওয়া একটা বিপুল সংখ্যা তো আছেই, যারা অফলাইন অথবা অনলাইন সম্পর্কে মতামত দেওয়ার অধিকারটুকুও হারাতে বাধ্য হয়েছে; যারা পড়াশোনা চালিয়ে গেছে কোনওভাবে, তাদের লেখাপড়া বোঝা, নিজের অনুশীলন, নিজের সৃষ্টিশীল মনের বিকাশ এক্কেবারে শূন্য করে দেওয়া হয়েছে এই সময়ে। কিচ্ছু লেখাপড়া হয়নি অনলাইন পদ্ধতিতে। বেশিরভাগ ছেলেমেয়েরা গত দুবছর নিজের সিলেবাসে কী কী ছিল জানে না। উপরন্তু ফেব্রুয়ারি মাসে ক্লাস শুরু হওয়ার পরেও বিরাট ভালোভাবে নিয়ম মেনে ক্লাস হয়েছে, তা নয়। আমাদের ছাত্রছাত্রীরা দিশেহারা। এই রাজ্যের ভেঙে পড়া শিক্ষাব্যবস্থা আমাদের রাজ্যের ছেলেমেয়েদের এই ধরনের সুইসাইডাল দাবি করার দিকে ঠেলে দেয়। তারা ভুলে যায়, জীবনের ১২/১৩ বছরের পরীক্ষা দেওয়ার অভ্যাস কিছুতেই ২ বছরে নষ্ট হয়ে যায় না। তারা বুঝতে পারছে না, আসলে নষ্ট হয়ে গেছে তাদের ছাত্রমন, শেখার মন, জানার মন; বুঝতে পারছে না কারণ এই ধ্বংসলীলা তাদের অজান্তে চালানো হয়েছে।
তাহলে কি এই দাবিকে সমর্থন করব আমরা? আমরা আমাদের ছেলেমেয়েদের টুকে পাশ করার পদ্ধতির প্রতি আরও অনুরক্ত হতে শেখাব?
আসলে, এইরকম একটা সেমেস্টারের গোড়ায় এসে অফলাইন অথবা অনলাইন— কোনও একটা পক্ষ নেওয়া কঠিন, কারণ জীবনটা ইভিএম মেশিনের বোতাম না, লেখাপড়াটা তো না-ই। এই পক্ষ বা সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় ছিল অনেকটা আগে। পেরিয়ে আসা সময়ে নিয়মিত ক্লাস, প্র্যাক্টিকালের দাবি জোরালো হওয়া জরুরি ছিল, সপ্তাহের শেষে ছোট ছোট ক্লাস টেস্ট অফলাইনে নিতে থাকা জরুরি ছিল, আর সব চাইতে জরুরি ছিল প্রত্যেকটি ছাত্রছাত্রীর সামনে একটা সুন্দর শিখন তুলে ধরা, ফেস্ট/ফ্রেশার্সের সময়ে নেওয়া যত্ন আর পরিকাঠামোর সিকিভাগও এই বিষয়ে চমৎকার উপকারী হত। এসব জটিল সমীকরণের মাঝে রাজ্যজুড়ে শিক্ষা দপ্তরের কী সিদ্ধান্ত দাঁড়াল? যা সামনে এল, তা সবচাইতে বেশি ভয়ঙ্কর।
মিশ্র পদ্ধতিতে পরীক্ষা হচ্ছে। কলকাতা ও যাদবপুর ছাড়া রাজ্যের সব বিশ্ববিদ্যালয় ও তার অধীনস্থ কলেজে অনলাইন পদ্ধতিতে পরীক্ষা হচ্ছে। স্নাতক স্তরের ২/৪/৬ সেমেস্টার হচ্ছে এবার। ষষ্ঠ সেম মানে অন্তিম পরীক্ষা— যা নির্ধারণ করবে পরবর্তী পদক্ষেপ। এক ভয়ানক অসম ফলাফলের সম্মুখীন হবে এই ব্যাচ। অফলাইনে পরীক্ষা দেবে যারা, দীর্ঘদিন বাদে মাথা-হাত-চোখ একসঙ্গে চালিয়ে প্রতিযোগিতা করতে বাধ্য হবে তাদের সঙ্গে যারা কেবল হাত আর চোখের সুসঙ্গতি রেখে টাটকা নোট ঝেড়ে নামিয়ে ফেলবে। আরেকটা বড় অংশ, নানান পরিকাঠামোগত কারণে দিতেই পারবে না অনলাইনে হওয়া পরীক্ষা। এই বিপুল হতাশার সেফটি ভালভ হিসেবে পুঁজিবাদ ওদের মেটাভার্স দিয়েছে, আমরা কী দিতে পারি?
ভোটের নির্ঘন্ট দেখে যারা রাজনৈতিক ক্রিয়াকলাপ এবং ন্যারেটিভ ঠিক করে, তাদের শায়েস্তা করার একমাত্র রাস্তা সারা বছর খেটে খাওয়া মানুষের দাবি-দাওয়া নিয়ে তাদের জীবন-সংগ্রামের পাশে থাকা; এই দ্বিতীয় ধরনের রাজনীতি পশ্চিমবঙ্গের ক্ষয়িষ্ণু রাজনৈতিক সুস্থতা ফেরাতে পারে। একইভাবে সেমেস্টারের একমাস আগে সিলেবাস শেষ হয়নি, নিয়মিত ক্লাস বা প্রাক্টিকাল হয়নি ইত্যাদি কথাগুলো দিয়ে তৈরি শর্ট কাটের বদলে সারা বছর ধরে ভালোভাবে ভালোবেসে লেখাপড়া করা, মস্তিষ্ক সঞ্চালনের মাধ্যমে শেখার-জানার অনুশীলন, নিজেকে ভাঙা-গড়া, নতুন নতুন ভাবনার জন্ম দেওয়া এবং অবশ্যই, জীবনবোধের মধ্যে অন্তর্নিহিত শিক্ষাগুলোকে বইয়ের পাতার সাথে মিলিয়ে মিলিয়ে চলার আনন্দ উপভোগ করার লড়াই দ্রুত শুরু করা দরকার। এমন আনন্দ পেতে হলে শিক্ষাকে বাজারে বেচে দেওয়ার বিরূদ্ধে এককাট্টা হতে হবে, ফি বেড়ে চলার বিপদ নিয়ে সজাগ হতে হবে, নয়া শিক্ষানীতির ভিতরের ঘুণগুলোকে চিনে নিয়ে সেগুলোর বিনাশ করতে হবে— এই এতগুলো কঠিন লড়াইয়ে কোনও শর্ট কাট নেই, টুকে টুকে এগোনোর উপায় নেই।
এই রাজনৈতিক সংগ্রাম আমাদের ছাত্রসমাজকে যে কোনও সুবিধেবাদী ঝোঁক থেকে পিছিয়ে আনতে পারে। এই কঠিন লড়াই করতে গিয়ে, বিশেষত আজকের প্রলোভনের সময়ে এক অংশের ছেলেমেয়ে বামপন্থী আন্দোলনকে ভুল বুঝতে পারে, তারা তাৎক্ষণিকতার মোহে দীর্ঘতর বিপদকে আলিঙ্গন করার মতো ভুলও করতে পারে। কিন্তু সামাজ বদলানোর বৃহত্তর সংগ্রামে নেমে একটা ছোট্ট অংশের ছাত্রছাত্রীর চোখে চটজলদি প্রিয় হতে গিয়ে তাদের ভ্রান্তি সম্পর্কে সোচ্চার হতে, তাদের সচেতন করার লড়াইতে যদি ভুল হয়, ইতিহাস আমাদের কাউকে ক্ষমা করবে না।
[1] Online Education Market & Global Forecast… Research and Markets. Dec, 2019.
[2] Koksal, Ilker. The Rise of Online Learning. Forbes. May 2, 2020.