সুব্রত ঘোষ
আশীষ লাহিড়ীর আর এক নাম প্রত্যাশা। প্রত্যাশা পাঠকের। আশীষ লাহিড়ীরই সৃষ্টি করা বিশাল পাঠ-চক্রের। প্রবন্ধ হোক বা বই— প্রকাশিত হওয়ার খবরে এই পাঠ-চক্রের অন্তর্গত সদস্যরা এই আশায় বুক বাঁধে যে নতুন কিছু পাওয়া যাবে। যদিও তাঁর রচনার তার কোন মূল সুরে বাঁধা থাকবে সে ব্যাপারে পাঠক অবহিত।
বিজ্ঞানের ইতিহাস, রবীন্দ্রনাথ, সমকালীন ঘটনা— রচনার বিষয় যাই হোক না কেন তার থেকে মথিত হয়ে যা উঠে আসে তা পারিজাত; এক্ষেত্রে যার নাম যুক্তিবাদ। যুক্তিবাদের বাণী প্রচার করতে কোনও শব্দ বা বাক্য উচ্চারণ করতে এতটুকু দ্বিধাগ্রস্ত হন না। অসংখ্য রচনায় বহু বছর ধরে তিনি ঋদ্ধ করে চলেছেন তাঁর পাঠকদের। একথা বললে অত্যুক্তি হবে না যে এভাবেই আশীষ লাহিড়ী এখন নিজে একটা প্রতিষ্ঠান।
যদিও নিজেকে লিটল্ ম্যগাজিন বিশ্ববিদ্যালয়ের একনিষ্ঠ ছাত্র বলে দাবি করেন, এই বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ্ডি পেরিয়ে তিনি অনেকটা পথ হেঁটেছেন। খ্যাতনামা পত্র/পত্রিকার পাঠকরা সেজন্য এত পিপাসার্ত।
যতটা প্রত্যাশা তার কতখানি পূরণ করতে পেরেছেন সেই মাপকাঠিতেই তাঁর বইয়ের আলোচনা সীমাবদ্ধ রাখা উচিত হবে না। কারণ এ আলোচক একমাত্র বিচারক হতে পারে না।
আমাদের আলোচ্য শ্রীলাহিড়ীর সাম্প্রতিক প্রকাশিত গ্রন্থ ‘অবিরত দ্বৈরথে বিজ্ঞান’— হিন্দু-ইসলামি-খ্রিস্ট্রীয় সংস্কৃতিবলয়।
একশো বিরাশি পৃষ্ঠার বইয়ে পরিশিষ্ট ও উপসংহার বাদ দিয়ে দশটি অধ্যায়। প্রাচীন হিন্দু দর্শন-ধর্ম-বিজ্ঞান নিয়ে পাঁচটি, মুসলিম বিজ্ঞান নিয়ে তিনটি ও খ্রিস্ট্রীয় বলয়ের ওপর দুটি অধ্যায় ব্যয় করা হয়েছে। অবশ্য পৃষ্ঠার হিসাব কষলে মুসলিম বিজ্ঞান সর্বাপেক্ষা গুরুত্ব পেয়েছে এবং হিন্দুধর্ম সবচেয়ে কম। শ্রীলাহিড়ীর বেশ কিছু রচনার পাঠক হিসাবে এর একটা কারণ নির্ণয় করা সম্ভব। প্রাচীন হিন্দু বিজ্ঞান নিয়ে এর আগে একাধিক বই ও রচনায় বহু আলোচনা করেছেন। এমনকি আলোচ্য বইয়ের অন্তর্গত অনেক বিষয় তাঁর পূর্বপ্রকাশিত বহু রচনায় স্থান পেয়েছে।
ভূমিকার আলোচ্য ‘দ্বৈরথের ত্রিধারা’। কেন ‘মোটের ওপর’ ত্রিধারা সেটাকে ব্যক্ত করে পাঠককে এগিয়ে যেতে সাহায্য করেছেন। খিস্ট্রধর্মের আত্মসমর্পণ, ইসলামি বলয়ে আটশো বছর ধরে ধর্মের প্রভূত্ব, ভারতের হিন্দুদের দ্বিচারিতা ক্ষেত্র যে লেখকের বিচরণভূমি সে ব্যাপারে কোনও ধোঁয়াশার অবকাশ রাখেননি। বর্তমানকালে ধর্ম বিজ্ঞানের সঙ্গে আপস করার প্রবণতায় যে সন্তোষ প্রকাশ পেয়েছে সেখানে মাদার টেরিজার সেন্টহুড প্রাপ্তির পদ্ধতি কয়েক ফোঁটা চোনা ফেলে দেয় যে কথাটা ভূমিকায় উল্লেখিত হয়নি।
ভারতে বিজ্ঞান গবেষণার বর্তমান দূরবস্থার কারণ নিয়ে ধ্রুব রায়নার যে সব মন্তব্য উপস্থাপিত করেছেন ভারতের বিজ্ঞান গবেষণা সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল কোনও ব্যক্তির তার সঙ্গে একান্নবর্তী হওয়া মুশকিল। যেখানে বিজ্ঞান গবেষণার বরাদ্দ অতি সামান্য (সরকারের অগ্রাধিকার তালিকায় বিজ্ঞান অনুপস্থিত), সেখানে টাকা মঞ্জুরের প্রণালী নিয়ে আলোচনা অর্থহীন। দুরবস্থার কারণ অনেক গভীরে যে আলোচনার সুযোগ এখানে নেই।
‘বড়মন্ত্রীর গুলিসুতোভক্ষণ’, ‘পয়গম্বরি হিন্দু বিজ্ঞান’, ’শাস্ত্রদোহ বনাম আপসপন্থা’, ’ফলিত জ্যোতিষ, গণিত জ্যোতির্বিজ্ঞান’, ’ভাস্করাচার্যের দুই রাহু’— এই পাঁচ শিরোনামে হিন্দু বিজ্ঞান নিয়ে যে আলোচনা তার অনেকটাই শ্রীলাহিড়ীর অন্য বহু প্রবন্ধ/গ্রন্থে উচ্চারিত হয়েছে। তাঁর নিবিষ্ট পাঠক এ অংশ পাঠ করে নতুনভাবে উপকৃত হওয়ার কিছু পাবেন বলে মনে হয় না।
তবু কয়েকটা কথা বলতেই হয়। বিজ্ঞানমনস্ক যুক্তিবাদের হয়ে সওয়াল করতে গিয়ে ভেঙ্কটরামন রামকৃষ্ণনের বক্তব্য টেনে এনে ‘সায়েন্টিফিক টেম্পার’ প্রসঙ্গ আলোচনায় সংবিধানকে সাবুদ হিসাবে উপস্থাপিত করেছেন। সংবিধান তো অনেক পুরনো কথা। ২০১৩ সালে প্রকাশিত ভারত সরকারের Science, Technology and Innovation Policy (STIP2013)-তে Scientific Temper-এর কথা বলা হয়েছিল। ২০২০ সালের Science, Technology and Innovation Policy (STIP2020)-তে গিয়ে দাঁড়াল True Scientific Temper (মোটা অক্ষর এ আলোচকের)। কে বলবে আমাদের সরকার বিজ্ঞানমনস্কতা নিয়ে আদৌ ভাবিত নন! তবে হ্যাঁ, বিজ্ঞানমনস্ক যুক্তিবাদ কাকে বলে সংবিধান থেকে শুরু করে STIP2020, সেটা কোথাও বলা হল না। বিজ্ঞান-অবিজ্ঞানের প্রভেদরেখা সম্বন্ধে কার্ল পপারের বক্তব্যটা লেখক এখানে খোলসা করে বলে দিলে অনেক পাঠকই উপকৃত হতেন বলে মনে হয়। একই কথা প্রযোজ্য আশিস নন্দীর নাম উল্লেখের প্রসঙ্গে – তাঁর বক্তব্য তুলে না ধরলেও অন্তত সূত্রের উল্লেখ প্রয়োজন ছিল। আর্যভট ‘নীচ’ জাতিভুক্ত অথচ বইয়ের ছবিতে উপবীত ধারণ করে আছেন। কল্পনা করতে অসুবিধা হয় না উনি আমাদের লোক দেখাবার জন্য এ ব্রাহ্মণদের কারিকুরি। ভাস্করাচার্যের পেল সমীকরণ (ব্রহ্মগুপ্ত সমীকরণ বলেও এর সমধিক পরিচিতি) নিয়ে চক্রবাল পদ্ধতিতে তার সমাধানের পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা এই বিশেষ অধ্যায়কে এক মর্যাদা দান করেছে। এই সমীকরণ নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা আছে কানপুর আইআইটির প্রাক্তন অধ্যাপক অশোক মল্লিকের ‘সংখ্যার গল্প’ ও The Story of Numbers বই দুটিতে। এই সমীকরণের পরাবৃত্ত (hyperbola) রূপ এবং সমীকরণ সমাধানের বিশেষ অসুবিধার কথা ভেবে পরশুরাম (রাজশেখর বসু) নিশ্চয় এই দুটো লাইন লেখেননি—
কোথাকার এক বাঁকা প্যারাবোলা
ফোকাস্ কোথায় জানে কোন শালা?
আলোচ্য বইয়ের সবচেয়ে মূল্যবান অংশ সেই সব অধ্যায় (৬-৮) যেখানে আরবিক ও সংশ্লিষ্ট বিষয় আলোচিত হয়েছে। মূল্যবান এই কারণে যে আরবিক বিজ্ঞান ও সংশ্লিষ্ট বিষয় নিয়ে আমাদের চর্চা খুব সীমিত। এমনকি আশীষ লাহিড়ীর রচনাও এ আলোচকের খুব বেশি গোচরে আসেনি। শুরুর আলোচনা জিম খালিলির বই Pathfinder— The Golden Age of Arabic Science-ভিত্তিক। কীভাবে উন্নত সভ্যতার বই আরবি ভাষায় অনুবাদ করে সেখান থেকে জ্ঞান আহরণ করে নিজেদের বিজ্ঞান, বিশেষভাবে প্রযুক্তির উন্নতি ঘটিয়ে জীবনযাত্রা উন্নত করে তুলল সে বিবরণ পাঠকের উপভোগ করার রসদে পরিপূর্ণ। এভাবে উন্নতি বিংশ শতাব্দীর জাপানকে মনে করিয়ে দেয় যখন ‘টুক্লিবাজ জাত’ বলে জাপান প্রাথমিকভাবে পরিচিত হয়েছিল। এরপর জাপান নিজেকে কোথায় নিয়ে গিয়েছিল সে সবই আমাদের জানা। ‘ফলিত জ্যোতিষ থেকে গণিত জ্যোতিষ’ অংশ বিশেষভাবে মনোগ্রাহী। আলোচনার শেষে শ্রীলাহিড়ীর পর্যবেক্ষণ গুরুত্বপূর্ণ।
…ইসলামি জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের ফলিত জ্যোতিষচর্চার সঙ্গে ভারতীয় পণ্ডিতদের জ্যোতিষচর্চার একটা গুণগত তফাত ছিল— সেটা হল ব্যাবহারিক অনুশীলনের দিক থেকে। ইসলামি পণ্ডিতদের ফলিত জ্যোতিষচর্চায় বাস্তবিক পর্যবেক্ষণের ওপর জোর পড়েছিল অনেক বেশি। এজন্য মস্ত মস্ত মানমন্দির তাঁরা তৈরি করেছিলেন। ভারতীয় পণ্ডিতদের অ্যাস্ট্রলজি চর্চা কিন্তু ছিল মূলত গণনা-নির্ভর। প্রাচীন বা মধ্যযুগের ভারতে উজ্জয়িনীর বাইরে খুব বড় কোনও মানমন্দিরের খবর পাওয়া যায় না। কাজেই ক্রমাগত বাস্তব অনুশীলন-লব্ধ ফলের সঙ্গে ফলিত জ্যোতিষের কাল্পনিক ধ্যানধারণা-নির্ভর সূত্রগুলির যে-বিরোধ, তা সংশোধনের অবকাশ ভারতে কম ছিল। ইসলামি সংস্কৃতিবলয়ে কিন্তু সেই সুবিধাটা ছিল।
যেহেতু এ অধ্যায়ের আলোচনা জিম-আল-খলিলের পুস্তক-ভিত্তিক, খলিলের দুই অতি গুরুত্বপূর্ণ উচ্চারণ নিয়ে শ্রীলাহিড়ীর মৌনতা পাঠককে হতাশ করবে (যদিও দ্বিতীয়টা নিয়ে অন্যভাবে কিছু আভাস দিয়েছেন):
In fact, for a period stretching over seven hundred years, the international language of science was Arabic.
.
It is often still claimed that the modern scientific method was not established until the Renaissance by Francis Bacon in his Novum Organum (1620) and by Descartes in his treatise Discours de la Methode (1637). But there is no doubt that Ibn al-Haytham, along with al-Razi and al-Biruni, … arrived there much earlier.
আর এক মন্তব্য পরের অধ্যায়ের আলোচনা প্রসঙ্গে উত্থাপনের জন্য না রেখে এখনই করে ফেলা যায়। সেটা হল দুই অধ্যায়ের পাঠে সমকালীন মানচিত্রের অভাব ভীষণভাবে অনুভব করা যায়। খলিলের বই ও অন্যান্য ইংরেজি বই (যেমন Andrew Gregory-র EUREKA! The Birth of Science ও Ehsan Masood-এর Science and Islam— A History) পাঠকালে এ অভাব বোধ হয় না।
ইসলামি সংস্কৃতিবলয় এবং ইসলামি কৃষ্টিবলয় এই শব্দগুচ্ছ যথেচ্ছ ব্যবহৃত হয়েছে তিনটি অধ্যায়ে (৬-৮)। কিন্তু দুই বলয় বলতে কী বোঝাতে চেয়েছেন লেখক সেটা আর একটু বিস্তৃত করলে পাঠক উপকৃত হতেন— যেমন আল-খালিলি তাঁর বইয়ের শিরোনামে Arab Science ব্যবহার না করে ‘Arabic Science’ কেন বলেছেন এবং ‘Arabic Science’ কতখানি জায়গা জুড়ে তার বিচরণভূমি বুঝিয়ে দিয়েছেন। আবার ধর্মের নামে বিজ্ঞানকে ডাকা (যেমন হিন্দু/খ্রিস্টীয় বিজ্ঞান) খালিলি একেবারেই অনুমোদন করেন না। সেটা অবশ্য তাঁর ব্যাপার।
বইয়ের সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ ও শিক্ষাপ্রদ আলোচনা সপ্তম অধ্যায়ে— ‘উপমহাদেশে ইসলাম: বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি’। অশ্ব-প্রযুক্তি, অবরোধ-যন্ত্র, আগ্নেয়াস্ত্র প্রযুক্তির ব্যবহার, ইসলামি কৃষ্টিবলয়ে বিজ্ঞানের উদ্ভব ও বিকাশ ইত্যাদির পথ পেরিয়ে ইসলামের সঙ্গে ভারতের বিজ্ঞানের সাক্ষাৎ প্রসঙ্গ আলোচনার মাধ্যমে বেশ কিছু তথ্য পাঠককে গভীরভাবে ঋদ্ধ করার রসদে পূর্ণ। এ অধ্যায় অবশ্যই দীর্ঘ আলোচনার দাবি রাখে। কিন্তু অন্য সকল রচনার মতই স্থানাভাব প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়ায়। পাঠককে আকর্ষিত করার ও তাঁর জ্ঞানভাণ্ডারকে সমৃদ্ধ করার মত তথ্য এবং লেখকের বিশ্লেষণের পর তাঁর কিছু সিদ্ধান্ত জড়ো করে সাজিয়ে ফেলে একটা আপস করা যেতে পারে।
- ইসলাম-প্রভাবিত যেসব শাসক ভারতে ক্ষমতা বিস্তার করেছিল তারা বিজ্ঞানমনস্ক ছিল না।
- অষ্টম/নবম শতাব্দীতে খলিফারা নিজেরাই উদ্যোগী হয়ে পণ্ডিতদের সসম্মানে আহ্বান করতেন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিচর্চার নানাক্ষেত্রে নতুন নতুন গবেষণায় নামতে। এবং সে আহ্বান ছিল সঙ্কীর্ণতা-মুক্ত।
- গুপ্তযুগের আগেই ভারতে খ্রিঃপূঃ ১০০ থেকে ৪০০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত সময়পর্বে তত্ত্ব আর অনুশীলনের মধ্যে অদ্ভুত এক বিচ্ছেদ লক্ষ করা যায় (ওয়েন্ডি ডনিগার)। মেহরৌলির বিশেষ গুণসম্পন্ন লৌহস্তম্ভের উদাহরণ ডনিগারের বক্তব্যে অন্যমাত্রা যোগ করেছে।
- ভারতের সঙ্গে ইসলামি কৃষ্টিবলয়ের প্রথম রাজনৈতিক ও সামরিক পরিচয় ঘটল ভারতে বিজ্ঞানচর্চার স্বর্ণযুগেই (পঞ্চম থেকে অষ্টম শতাব্দী, আবার দ্বাদশ শতাব্দীতে দ্বিতীয় ভাস্কর)।
- বাস্তব পর্যবেক্ষণ ও পরীক্ষানিরীক্ষা মারফত সংগৃহীত তথ্যের সামান্যীকরণের ভিত্তিতে পুনরায় পরীক্ষা চালিয়ে ধারণার ঠিক-ভুল যাচাই করে তবে সিদ্ধান্তে আসতে হবে— আধুনিক বিজ্ঞানের এই মূলমন্ত্রটি ইসলামি কৃষ্টিমণ্ডলের বিজ্ঞানেরও মূলমন্ত্র ছিল।… ভারতের বিজ্ঞানচর্চা ইউরোপকে যতটুকু প্রভাবিত করেছিল সেটাও কিন্তু ইসলাম মারফত; অন্তর্মুখী ভারতীয়রা নিজেরা সে বিষয়ে কিছুই করেননি, হয়তো উদাসীনই ছিলেন। এটাই সম্ভবত ভারতীয় কৃষ্টিবলয় আর ইসলামি কৃষ্টিবলয়ের বিজ্ঞানের প্রধান প্রভেদ।
- এই জায়গাটিতেই ভারতে আর ইসলামি কৃষ্টিবলয়ে বিকশিত বিজ্ঞানের ইতিহাসের মিল। উভয়ক্ষেত্রেই বিজ্ঞানের বিকাশ ত্বরান্বিত হয়েছে তখনই, যখন ধর্মধ্বজীদের প্রতাপ অন্তত কিছুটা কমেছে, আর উভয়ক্ষেত্রেই বিজ্ঞানচর্চার পতন প্রত্যক্ষভাবে জড়িয়ে আছে ধর্মধ্বজীদের উগ্র উত্থানের সঙ্গে।
অতি মূল্যবান সপ্তম অধ্যায় বিষয়ে একটি মন্তব্য করতেই হচ্ছে যেখানে এ আলোচক ঠোক্কর খেয়েছেন। সেটা হল বিষয় থেকে বিষয়ান্তরে যাওয়াটা বহুক্ষেত্রে যুক্তির পথ ধরেনি। উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে ৭৩ পৃষ্ঠার তৃতীয় অনুচ্ছেদে চারটে বিষয়ের ওপর নজর দিতে বলার পর পাঠক যখন আশা করে আছেন এই চারটে বিষয় আলোচিত হবে তখন লেখক অন্য নতুন বিষয়ে প্রবেশ করে গেছেন। আলোচকের প্রস্তাব এই অধ্যায়টি পাঠক-বান্ধব করে তোলার জন্য নতুন করে লিখে ফেলা যেতে পারে।
অষ্টম অধ্যায়ের আলোচনার কেন্দ্রে এমন এক ব্যক্তির বই যিনি এই উপমহাদেশের জীবিত যুক্তিবাদী আন্দোলনের নেতাদের মধ্যে অগ্রণী এবং বিশ্ববন্দিত পদার্থবিদ। অথচ ভারতীয় বিজ্ঞানীদের মধ্যে কতটা পরিচিত সে বিষয়ে সন্দেহ আছে। তিনি পারভেজ আমিরালি হুডভয়। শ্রীলাহিড়ী হুডভয়কে পাঠকের সঙ্গে পরিচিত করিয়েছেন। তবু একটা গুরুত্বপূর্ণ তথ্য বাদ পড়ে গেছে। তিনি ২০০৩ সালে ইউনেস্কো প্রদত্ত কলিঙ্গ পুরস্কারে সম্মানিত এবং সম্ভবত ২০০৪ সালে ভারতীয় বিজ্ঞান কংগ্রেসের আমন্ত্রণে কলকাতায় এসেছিলেন, একটা আধ-বেলা যাদবপুরের সেন্ট্রাল গ্লাস ও সিরামিক রিসার্চ ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানীদের সঙ্গে ভাববিনিময় করেছিলেন। এর সঙ্গে আলোচকের সংযোজন যে এই আলোচকের সুযোগ হয়েছিল তাঁর সঙ্গে পৃথকভাবে কিছু আলোচনা করার। পাকিস্তানের মতো দেশে বাস করে ঈশ্বরবিরোধী মনোভাব নিয়ে যে সব যুক্তিবাদী মতবাদ প্রচার করেন তাতে প্রাণসংশয়ের আশঙ্কা আছে কি না, এ প্রশ্নের উত্তরে তাঁর স্বাভাবিক বলিষ্ঠ প্রকাশভঙ্গিতেই বলেছিলেন— “মোটেই না, পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী পারভেজ আমিরালি হুডভয়ের ওজনটা নিয়ে সজাগ। এরকম কোনও ঘটনা ঘটালে তার ফল কী হতে পারে সেটা তাদের মোটেই অজানা নয়।”
ফিরে আসা যাক অষ্টম অধ্যায়ের কথায়। ‘বৈজ্ঞানিক মিরাক্ল অধিবেশন’, ‘জিন থেকে এনার্জি’-র বিষয় যেখানে স্থান পেয়েছে সেসব গা ছমছম করা রহস্য মোচনের ভার পাঠকদের জন্য তোলা থাকল। আলোচক এখানে নাক গলাতে সাহস পায়নি। কেবল খেয়াল রাখতে হবে একটি মন্তব্য (পৃ.১০৩) পূর্ব অধ্যায়ের পুনরুক্তি— সেটা এড়ানো গেলে ভাল হত।
সপ্তম অধ্যায়ের ত্রুটিমুক্ত হয়ে নবম অধ্যায় (‘খ্রিস্টীয় কৃষ্টিমণ্ডলে বিজ্ঞান’) অতি সুশৃঙ্খল, বিষয়-বিন্যাসের পরম্পরা রক্ষা করে এক শিক্ষাপ্রদ রচনা হয়ে উঠেছে। মধ্যযুগকে তিনভাগে ভাগ করে ওঠাপড়া, ধীরগতি-উচ্চগতি সব কিছুর মধ্যে দিয়ে ইউরোপে বিজ্ঞানের যাত্রাপথকে বর্ণনা করায় লেখকের মুন্সিয়ানা প্রকাশ পেয়েছে। টমাস অ্যাকুইনাস, গ্রোসেটেস্ট, রজার বেকন, চতুর্থ ক্লেমেন্ট, জাঁ বুরিদাঁ, পিয়ের দুহেমের হাত ধরে ইউরোপের বিজ্ঞানের সুপরিণত রূপ পরিগ্রহ করার সমগ্র পরিক্রমা অবশ্যই সুখপাঠ্য। অভিভাবক পরিবর্তনের সঙ্গে এই সময়ের বিজ্ঞানের চরিত্র বদল নিয়ে শ্রীলাহিড়ীর অভিমত:
“সামন্তশ্রেণির হাত থেকে ক্ষমতা চলে এল পুঁজিপতিশ্রেণির হাতে, এবং প্রথম পর্বে তাঁরা মেনে নিলেন, বিজ্ঞানের শুধু নয়, কিছুটা বিজ্ঞানমনস্কতার বিকাশ ছাড়া পুঁজিতান্ত্রিক সমাজ এগোবে না। এই সদিচ্ছা অবশ্য খুব বেশিদিন টেঁকেনি। একটা সময় এল যখন বিজ্ঞান কেবল উৎপাদনের এবং মুনাফা অর্জনের অপরিহার্য শক্তি রূপে বিবেচিত হল; আর কিছু নয়। তখন পুঁজিপতিরা নিজেরাই বুদ্ধিবিমুখ হিং টিং ছট আর প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মকে শ্রেণিস্বার্থে মদত দিল। খ্রিস্ট্রীয় কৃষ্টিমণ্ডলে এখনও সেই ধারাই চলছে।”
‘বাঁদুরে কুনাট্যরঙ্গ’-র মূল বিষয় হয়ত অনেকের জানা। তবু একটা ঔৎসুক্য থেকে যায় জানতে আমেরিকার কোন কোন রাজ্যে এখনও ডারউইনের প্রবেশ নিষিদ্ধ। ইনটেলিজেন্ট ডিজাইন নিয়ে আলোচনা অবশ্যই বহু পাঠকের কাছে অজানা এবং সেজন্য অতীব মূল্যবান।
বইয়ের শেষ অধ্যায় মরিস ডির্যাকের তোলা প্রশ্ন নিয়ে আলোচনা ‘তবু ধর্ম টিঁকে আছে কেন’। এ আলোচকের প্রশ্ন— ধর্ম টিঁকে থাকবে না কেন? যদি আলোচ্য বইতে উদ্ধৃত পল ডির্যাকের হাইসেনবার্গকে করা প্রশ্নটাকে যথাযথ বলে মেনে নিই তবে স্বীকার করতেই হবে ঈশ্বরের উদ্ভব তো মানুষের অসহায়তা বোধ থেকে— প্রথমত প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে, পরবর্তীকালে সামাজিক শোষণ থেকে। বিজ্ঞান কোনওদিন এমন স্তরে পৌঁছুবে বলে মনে হয় না যখন মানুষের জীবনে অসহায়তা বোধ কিংবা অনিশ্চয়তা সম্পূর্ণরূপে দূর হবে। হয়ত সে অবস্থা কাম্যও নয়। কারণ randomness প্রকৃতির অন্তর্নিহিত ধর্ম। প্রিয়জন গুরুতর অসুস্থ হলে এক ভ্যানরিক্সা করে ১২ কিলোমিটার দূরের এক গ্রামীণ স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নিয়ে যাওয়া হল যেখানে কোনও ডাক্তার নেই। সাফাইওয়ালা একটা ইনজেকশন দিল। তারপর যা হওয়ার সেটাই হল। এইসব মানুষের ঈশ্বর ছাড়া কে আছে।
পরিশিষ্ট-১: যেহেতু পারভেজ হুডভয়ের রচনা তাই এ নিয়ে কোনও মন্তব্য করা থেকে বিরত থাকাই সমীচীন।
নিরীশ্বরবাদীদের দেশভিত্তিক হিসেব (পরিশিষ্ট-২) তথ্য হিসাবে পাঠকদের কাছে অতিরিক্ত পাওনা। এই পরিশিষ্ট নিয়ে দুটি কথা বলাই যেতে পারে। প্রথমত এই তথ্যসম্ভার নিয়ে এক রাশিবিজ্ঞানসম্মত বিশ্লেষণ করা যেতে পারে— দারিদ্র/অশিক্ষার সঙ্গে নিরীশ্বরবাদের কোনও সহগতি (correlation) আছে কিনা।
এ তো নিরীশ্বরবাদীদের হিসাব। খাঁটি নাস্তিকের হিসেব নয়, বরং ধর্মের গণ্ডি ভেঙে বেরিয়ে আসা মানুষদের হিসেব নিয়ে আলোচনা করেছেন যুক্তিবাদী আন্দোলনের নিরলস যোদ্ধা দেবাশিস্ ভট্টাচার্য। এই মানুষগুলোকে ‘নন্ রিলিজিয়াস’ বলে এক বৃহত্তর অভিধায় অভিহিত করা হচ্ছে। দেবাশিস্ বাংলায় এদের ‘ধর্মমুক্ত’ বলছেন। বিভিন্ন ব্যক্তি ও সংস্থার করা বিশ্বব্যাপী সমীক্ষার ফলকে জড়ো করে দেখানো যাচ্ছে যে ২০০৭ সালে ‘ধর্মমুক্ত’ মানুষের শতাংশের হিসাব যেখানে ১০.৫, ২০১৫-য় সেই সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়াচ্ছে ৩৩— যদিও এক উত্থান-পতন এর মাঝে থেকে গেছে।
সব শেষে যে পর্যবেক্ষণ মননশীল পাঠকের মনকে নাড়া দেয় তার সঙ্গে হয়ত আলোচ্য বইয়ের সরাসরি যোগ নেই। তবু চিন্তার খোরাক জোগাবার উপযুক্ত বলে মনে হয়েছে। গুপ্তযুগ (৩২০-৫৫০ বর্ষ অব্দ)-কে ভারতের ইতিহাসে স্বর্ণযুগ বলা হয়। গুপ্ত সাম্রাজ্যের রাজধানী ছিল পাটলিপুত্র (বর্তমানের পাটনা)। এবং এই সময়ের এবং পরবর্তীকালের যে সব বিজ্ঞানীদের কাজ নিয়ে আমরা গর্ববোধ করি (আর্যভট, বরাহমিহির, ব্রহ্মগুপ্ত, দ্বিতীয় ভাস্কর) তাঁদের অনেকের জন্ম পাটলিপুত্রে বা অন্য কোনও স্থানে। কিন্তু লক্ষ করার বিষয় সেই সময়ের সংস্কৃতি, বিজ্ঞানচর্চা, জ্ঞান অর্জনের কেন্দ্রবিন্দু উজ্জয়িনী যার অবস্থান বর্তমানের মধ্যপ্রদেশে। এ এক গবেষণার বিষয় যে পাটলিপুত্র, উজ্জয়িনী কেন এত উজ্জ্বল প্রভিভার বিচরণক্ষেত্র উঠল অথচ পরবর্তী কোনও সময়েই সেই সম্মানের স্থান ধরে রাখার পরিচয় আর পাওয়া গেল না। ভারতের অন্য অঞ্চল শিল্প, সাহিত্য, বিজ্ঞানে ভাস্বর হয়ে উঠল। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় কোনও সভ্যতা গড়ে ওঠে নদীর পার্শ্ববর্তী স্থানে; বর্তমানকালে দেখা যায় সমুদ্রতীরবর্তী রাজ্য অর্থনৈতিকভাবে এক সুবিধা ভোগ করে। এরকম কোনও কারণ খোঁজার কোনও কারণ আছে বলে মনে হয় না।
সমগ্র বইতে মুদ্রণ-বিভ্রাটের সংখ্যা নগণ্য। তবে ৭৯ পৃষ্ঠার দ্বিতীয় অনুচ্ছেদের ষষ্ঠ লাইনে ‘মামুন’-র স্থানে ‘মনসুর’ হয়ে যাওয়ায় পাঠক বিভ্রান্তির শিকার হতে পারেন। বইয়ের প্রচ্ছদ সুন্দর এবং যে হরফে বই ছাপা হয়েছে তা সুখপাঠ্য যদিও বইয়ের বাঁধাই সম্বন্ধে, অন্তত আমার কাছে যে কপিটি এসেছে তার ভিত্তিতে কোনও প্রশংসা করা যাচ্ছে না, বরং বলা যায় বড় দুর্বল।
অবিরত দ্বৈরথে বিজ্ঞান। আশীষ লাহিড়ী। নির্ঝর প্রকাশনী। ২০২২। বিনিময় মূল্য – ২৭৫ টাকা।
বিস্তারিত ও সুপাঠ্য রিভিউ-এর জন্য অনেক ধন্যবাদ, দাদা। কলকাতা বইমেলায় বইটির কপি বোধহয় খুব বেশি আসেনি, তাই দ্রুত ফুরিয়ে যায়, সংগ্রহ করতে পারিনি। আপনার রিভিউ পড়ে এখন কিঞ্চিৎ ক্ষতিপূরণ হল।
রিভিউ পড়ে বইটি পড়তে উত্সাহিত হলাম।