ছটি কবিতা
সন্ধ্যা
…ফুল নেই
ফুলের গাছ বুকে নিয়ে সন্ধ্যা দাঁড়িয়ে আছে,
নিঃস্ব…
হাওয়ায় ভেসে আসছে দূরের বাংলা গান
ছিল পাখির পালকের মতো নরম অন্ধকার
তোমার চোখের পথে
হেঁটে যেতে যেতে নিছকই মনে পড়ছে আবার
আজ তোমার নীল শাড়ি পরার দিন
ফুল নেই
আমাদের সমস্ত ফুল নিয়ে চলে গেছে শহরতলির মেঘ…
এই নরদেহ
হুর পরী দেখার নসিব সকলের হয় না। ইকবালের হয়েছিল। বেহুঁশ জ্বরের ঘোরে ইকবাল দেখেছিল নীল দিগন্ত পেরিয়ে মাঝরাতে ডানা মেলে উড়ে আসছে হুর পরী।
ইকবাল দেখেছিল পরীর গোলাপী স্তন ও ডানা, পিঠ ছাড়িয়ে চুল, মসৃণ নাভি, গায়ে কস্তুরী গন্ধ!
পরী তাকে দিয়েছিল বাদামী পালক, রূপোলী জ্যোৎস্না, কিছু ভেজা স্বপ্ন…
ইকবাল আর কখনও সুস্থ হয়ে ওঠেনি
তার অসুখ সারেনি।
এই পৃথিবীতে যারা পুরুষজন্ম লাভ করেছে,
শুধু তারা জানে—
হুর পরীর দেখা পেলে অসুখ সারে না আর।
শব্দ
অবশেষে আমি ধরা পড়ে যাচ্ছি ডাক্তারের কাছে
যা কিছু লুকোনো ছিল
যা কিছু রাখা ছিল আড়াল করে
যা কিছু জানতে পারেনি কেউ এতদিন,
ডাক্তার জেনে ফেলছে সব!
বুকের উপর স্টেথো চেপে ধরে শব্দ শুনছে ডাক্তার
বলছে, ‘জোরে জোরে শ্বাস নিন’
আমি তার কাছে জানতে চেয়েছি—
‘এত মন দিয়ে বুকের ভেতর তুমি কী শুনছ ডাক্তার?’
কিছুক্ষণ চুপ থেকে ডাক্তার উত্তরে বলেছে,
‘কান্না’
অশীতিপর
বাবা ভয় পান নিঃসঙ্গতা
ভয় পান অন্ধকার
বাগানের জামরুল গাছ বেয়ে ধূসর সন্ধ্যা নামে,
বাবা বসে থাকেন বারান্দায় আকাশের দিকে চেয়ে!
বাবা মনে রাখতে পারেন না কিছুই
ভুলে যান জন্মতারিখ, ছেলে-মেয়ের নাম
বাড়ির ঠিকানা!
ভুলে যান নিজের যাবতীয় অতীত!
একা একাই কথা বলেন
একা একাই ডেকে ওঠেন—
‘শালুক একটু আমার পাশে এসে বসো’
কিংবা
‘শালুক তোমার রান্না শেষ হল?’
শালুক একটি ফুলের নাম
শালুক আমার মায়ের নাম
আমার মা একটি ঝরে যাওয়া ফুল!
দৃষ্টিকোণ
তুমুল ঝড়বৃষ্টি হলেই আমি হারান মণ্ডলের কথা ভাবি। ভাবি দেশের মানুষের কথা। ভাবি মহৎ হব। ত্যাগ আর বৈরাগ্যই জীবন। হারান মণ্ডলকে ভাবতে ভাবতে ঢুকে পড়ি তার এক চিলতের কুঁড়েঘরে। সে কি আজ মাছ ধরতে বেরিয়েছে? সে কি সকালবেলায় পান্তাভাত আর পেঁয়াজ খেয়েছে? তার জরাজীর্ণ নৌকা, গলায় জড়ানো শতচ্ছিন্ন গামছা আমাকে ভাবায়। আমি রেডিওতে জর্জ বিশ্বাস শুনতে শুনতে মদ খাই আর দুঃখে ডুবে যাই। কার্ল মার্ক্স আর রবীন্দ্রনাথ খুলে শান্তির খোঁজ করি। সাম্য, প্রেম, পূজা ও সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার কথা ভাবি।
বস্তুত আমি হারান মণ্ডল, রবীন্দ্রনাথ, কার্লমার্ক্স— এদের কাউকেই দেখিনি কখনও। আয়নায় নিজেকে দেখেছি।
দেখেছি আমার সঙ্গে উপরিউক্ত তিনজনের কোনও মিল নেই।
শাওন রাতে যদি
জোনাকির মতো আলো জ্বেলেছিলে অন্ধকারে
বৃষ্টির শব্দে আমরা ঝরে গেছি অনন্ত মিথুনে
আমাদের প্রেম, ভেসে গেল বহুদূর আচ্ছন্ন রাতে
দ্রোহ পুড়ে গেল মোহে,
দেহের আগুনে…
হাওয়ায় হাওয়ায় উড়িয়েছি নিশান
বুকের ঈশাণে রেখেছি প্রবালদ্বীপ
সারাটা রাত এইসব আলো অন্ধকার
সারাটা রাত,
তোমার কপালের টিপ…
হিমের কুহক পথে ফিরে এসে দেখি
সুগন্ধ ছড়িয়ে রেখেছ নিষেধের জলে
দেখেছি এক পৃথিবী, তোমার শরীর
যেন কবিতার পৃষ্ঠা শিরোনামহীন!
যেন অথই জলে ভেসে গেছে—
ভালোবাসার দিন…
সেই থেকে আজও দেখি জোনাকির পথে
আমাদের দিশাহীন অপরূপ ব্যথায়
সারারাত একা একা চাঁদ খসে যায়…