প্রবুদ্ধ ঘোষ
দাবা-প্রশিক্ষক, সাহিত্য-গবেষক
দাবায় দু ধরনের স্যাক্রিফাইস হয়; একটা নির্ভুল আরেকটা তালের নিজস্ব।
দাবার ইতিহাসে ভালো দাবাড়ু অনেকেই আছেন। তাঁদের কেউ ওপেনিংয়ের বিশেষজ্ঞ, কেউ মিডলগেমে প্রতিপক্ষের রক্ষণ ভাঙতে ওস্তাদ আবার কেউ এন্ডগেমে তাবড় দাবাড়ুকে পর্যুদস্ত করেছেন। তাত্ত্বিক দাবাড়ুও অনেকেই আছেন, যাঁরা না গবেষণা করলে আধুনিক দাবাপদ্ধতির খোলনলচে বদলাত না। কিন্তু, তাল একজনই। যাঁর খেলার পদ্ধতিতে ঘুম ছুটে যেত তৎকালীন শ্রেষ্ঠ দাবাড়ুদের। অনেক তত্ত্ব আর অনুশীলনের পরিশ্রমের পরেও তালের চাল বুঝতে হিমসিম খেতেন তাঁরা; যখন বুঝতেন ততক্ষণে অনেকটা দেরি হয়ে গেছে। কারণ, তালের স্যাক্রিফাইস। তাল দাবায় অষ্টম বিশ্বচ্যাম্পিয়ন। সোভিয়েত যুগের দাবা যে বৈশিষ্ট্যগুলির জন্যে রূপকথাসম হয়ে গেছে, মিখাইল তাল তার অন্যতম। মরফি, আলেখাইন, ফিশার, কাসপারভ, কার্লসেনরা যেমন এক একটা দাবাযুগকে সংজ্ঞায়িত করেন, মিখাইল তাল সেরকম কোনও যুগের উদ্গাতা নয়। কিন্তু, তাল নবায়ন ঘটিয়েছিলেন কম্বিনেশন-ভাবনায়; বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো এক-একটা কম্বিনেশন ও আচমকা স্যাক্রিফাইস তাবড় দাবাড়ুর শিরদাঁড়ায় হিমস্রোত নামিয়ে দেয়। তাল সেই সুপরিকল্পিত চালপ্রবাহকে শিল্পে উন্নীত করেছিলেন। মাত্র সাড়ে তেইশ বছর বয়েসে বিশ্বচ্যাম্পিয়ন। বিশ্বসেরা থাকার মেয়াদ মাত্র একবছর, ১৯৬০-৬১। কিন্তু, তাল-পরবর্তী দাবার বিশ্বসেরারাও মানেন, কেন তিনি কিংবদন্তি।
***
তাল পিস্ স্যাক্রিফাইস করলে নির্দ্বিধায় খেয়ে নাও, কিন্তু পেট্রোসিয়ান পিস্ স্যাক্রিফাইস করলে খবরদার খেও না।
–মিখাইল বটভিনিক
ওয়াশিংটন স্কোয়ার পার্কে দাবার বোর্ড আর ঘড়ি সাজিয়ে বসে থাকতেন এক অকালপ্রৌঢ়। পাশে লেখা থাকত, “এই সেই দাবাড়ু, যে মিখাইল তালকে হারিয়েছিল।” ওই ভদ্রলোককে চ্যালেঞ্জ জানাতে পারতেন যে কেউ, টাকার বিনিময়ে উনি খেলতেন। ব্লিৎজ দাবা, পাঁচ মিনিটের খেলা। ওঁকে হারাতে পারলে টাকা ফেরত, আর না পারলে উনি টাকাটা জিতে নেবেন। এমনকি হলিউডি সিনেমাতেও এই ভদ্রলোকের আদলে স্বল্পোস্থিতির চরিত্র তৈরি করা হয়েছে। উনি কিন্তু আদৌ ‘কল্পনির্মিত’ চরিত্র নন, সত্যিই তালকে হারিয়েছিলেন তিনি। তালের কিশোর বয়সে অন্যতম মুখ্য প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন জোসিফ ইস্রায়েল জিলবার, তাঁরও জন্ম লাতভিয়ার রিগাতে। ১৯৪৯ সালে রিগায় অনুষ্ঠিত পাইওনিয়ার প্যালেস চ্যাম্পিয়নশিপে ১৩ বছরের তাল প্রথমবার ১৬ বছরের জিলবারের মুখোমুখি হয়েছিলেন। তাল কিং-পন ওপেনিং দিয়ে শুরু করেছিলেন, জবাবে জিলবার ফ্রেঞ্চ ডিফেন্স বেছে নিয়েছিলেন। তবে, বালকবয়সের ভুল ও অনভিজ্ঞতার ছাপ খেলায় স্পষ্ট; দ্বাদশ চালে তাল জিলবারের মন্ত্রীকে ফাঁদে ফেলার সুযোগ হাতছাড়া করে নিজের গজ খাইয়ে দিলেন। কয়েক চাল পরে ভুল করলেন জিলবারও। আর, এরপরেই শুরু হল তালের আক্রমণাত্মক নীতির খেলা। তখনও তাল এক সামান্য বালক দাবাড়ু, কিন্তু সুসংগঠিত আক্রমণে জিলবারের দুর্গ ভেঙে ফেললেন। পিস্ স্যাক্রিফাইস করে কালোর রাজাকে দুর্গচ্যুত করলেন এবং মুহূর্মুহূ আক্রমণে জিতলেন মাত্র ৩৩ চালে। ঠিক তিনবছর পরে লাটভিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপে বদলা নিলেন জিলবার। সিসিলিয়ান ডিফেন্সে কালো নিয়ে খেলে হারালেন তালকে। তালকে আক্রমণের সুযোগ না দিয়ে দাবাবোর্ডের মাঝখান (সেন্টার ফাইল) দিয়ে আক্রমণ শানিয়ে কিস্তিমাত করলেন তালকে। পরের বছর জিলবার খেললেন ড্রাগন ভেরিয়েশন। কালো নিয়ে অন্যতম আক্রমণাত্মক খেলা, নিজের দুর্গ সামলে কালোর বিশপের ভেদক্ষমতা সাদার বাঁদিক (ক্যুইন-সাইড) ছিন্নভিন্ন করে দেয়। কিন্তু, ঠান্ডা মাথায় কালোর পিস্গুলোর আক্রমণ ভোঁতা করে কিস্তিমাত করলেন তাল। শেষবার জিলবার তালের মুখোমুখি হয়েছিলেন ১৯৫৮ সালে। তখন তাল বিশ্বদাবায় প্রতিষ্ঠিত নাম। বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী দাবা-দেশ সোভিয়েতের সেরা দাবাড়ুদের হারিয়ে সোভিয়েত সেরা হয়েছেন ১৯৫৭ ও ১৯৫৮ সালে। সেই সেরা সময়ের তালকে হারালেন জিলবার, সেই লাটভিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপেই। জিলবার ও তাল দুজনেই ততদিনে যথেষ্ট পরিণত দাবাড়ু, বালকবয়সের ভুল করার অবকাশ নেই আর। দুজনেই আক্রমণাত্মক খেলার জন্যে পরিচিত। জিলবারের সাদা। তালের পরিচিত ঘরানার স্যাক্রিফাইস, ১৭ নম্বর দানে একটি পিসের বিনিময়ে দুটি পন জিতলেন।
কিন্তু, জিলবার প্রতি-আক্রমণে বন্ধ করে দিলেন তালের জেতার রাস্তা। চেনা কৌশল— পিস্ বেশি থাকলে দ্রুত অন্যান্য পিসগুলিকে খাওয়াখাওয়ি (এক্সচেঞ্জ) করে নিতে হয় এবং দ্রুত এন্ডগেমে পৌঁছতে হয় যাতে জয়ের পথ খুলে ফেলা যায়। জিলবারের এই কৌশল প্রতিহত করার চেষ্টা করেও অসফল হলেন তাল। এন্ডগেমে তালের দুটি পন এবং জিলবারের একটি বিশপ ও একটি পন। ৫৪ চালের মাথায় হার স্বীকার করলেন তাল।
জিলবার চারবার সোভিয়েত চ্যাম্পিয়নশিপের সেমিফাইনালে উঠেছিলেন, ১৯৫৬, ১৯৫৭, ১৯৫৮ ও ১৯৬২ সালে। ১৯৫৮ সালে তাঁর কেরিয়ারের উত্তুঙ্গ কালে তালকে পিছনে ফেলে লাতভিয়ান শীর্ষ দাবা প্রতিযোগিতায় সেরার শিরোপা পেয়েছেন। দেশের অন্যতম সেরা দাবাড়ু, কিন্তু লাতভিয়ান পরিচিতির জন্যে মস্কোর স্বীকৃতি পেলেন না তেমন। আর, সোভিয়েত দাবার অন্য মহারথীদের বিশ্বজোড়া খ্যাতিতে কেই বা মনে রাখবে জিলবারকে? চ্যাম্পিয়ন ওই একবারই হয়েছিলেন, কিন্তু ১৯৭৩ সাল অবধি ধারাবাহিকভাবে প্রথম তিনের মধ্যে থাকতেন জিলবার। ’৭৪ সালে আমেরিকায় চলে আসেন। ৪৭ বছর বয়সে স্যুইৎজারল্যান্ডের বিয়েল মাস্টার্স চ্যাম্পিয়নশিপ জিতলেন। তারপর? পল পাওয়েল লিখছেন ১৯৮০ সালে নিউ ইয়র্কের এক সন্ধের কথা। “এক অকালপ্রৌঢ়, রাস্তার ভবঘুরে বোধহয়, দাবা প্রতিযোগিতা যেখানে হচ্ছিল তার পাশের দেওয়ালে লিখে দিয়ে গেল, ‘উলফ্গ্যাং আনজিকর, বদলা আমি নেবই’। আশ্চর্য হলাম, কিন্তু কোনও ঘরহারানো পাগল ভিখারির কাণ্ড ভেবে পাত্তা দিলাম না। পরের দিন দেখি ওই দেওয়ালের পাশে বসে ভবঘুরে পাগলটা দাবা খেলছে। এক উঠতি দাবাড়ু, কিছুদিনের মধ্যেই যে ইন্টারন্যাশন্যাল মাস্টার হবে, তাকে চৌষট্টি খোপের ধাঁধায় নাস্তানাবুদ করছে।” পাওয়েল খোঁজখবর করে জানতে পারেন ইসরায়েল জিলবারের নাম, জানতে পারেন সোভিয়েত দাবায় তাঁর কৃতিত্ব ও বিশ্বচ্যাম্পিয়ন তালকে হারানোর কথা। কিন্তু কোনওদিন কেউ জানতে পারেনি আনজিকারের (এক জার্মান গ্র্যান্ডমাস্টার) সঙ্গে তাঁর এই শত্রুতার কথা। অনেকরকম গুজব ছড়ায়— আনজিকার আর জিলবারের স্ত্রী নাকি পরকীয়া করতেন; কেউ বলে জিলবার আকণ্ঠ মদে ডুবে থাকতেন আর নেশার পয়সা জোগাতে টাকার বিনিময়ে দাবা খেলতেন। পথচলতি মানুষ, পার্কে বেড়াতে আসা লোকেরা দেখতেন এক অকালপ্রৌঢ় বসে আছে দাবার বোর্ড সাজিয়ে। পাশে লেখা— “৫ ডলারের বিনিময়ে এঁর সঙ্গে একটা ছবি তোলার বা একটা ম্যাচ খেলার সুযোগ। ইনি তালকে হারিয়েছিলেন।”
***
শোনো হে, প্রতিপক্ষকে এমন এক গভীর জঙ্গলে নিয়ে যেতে হবে তোমায়, যেখানে ২+২ = ৫; আর, মনে রেখো সেই গভীর ধাঁধাঁ থেকে বেরনোর পথ দুজনের মধ্যে একজনই খুঁজে পাবে।
–মিখাইল তাল
রিস্ক। ঝুঁকি নেওয়া। যে কোনও খেলায় খেলোয়াড়কে ঝুঁকি নিতেই হয় বিশেষত সমমানের বা বেশি দক্ষ প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে। দাবাতেও নিতে হয়। কিন্তু, দাবায় ঝুঁকি শুধুমাত্র ভাগ্য আর সুযোগের ওপরে নির্ভরশীল নয়! সেই ঝুঁকিতেও থাকে পরিকল্পনা এবং প্রতিপক্ষের একটা ভুলের জন্যে অপেক্ষা করার ধৈর্য। মিখাইল তালের খেলা তথা তাঁর আক্রমণপদ্ধতি কেন ভয়ঙ্কর নান্দনিক? কারণ, তাতে ঝুঁকির মাত্রা প্রবল। তাল ভাগ্যে বিশ্বাস করতেন না। ভরসা রাখতেন প্রতিপক্ষের দুর্গ ভাঙার দক্ষতায় এবং প্রতিপক্ষকে অপরিকল্পিত গোলকধাঁধায় নিয়ে গিয়ে ফেলার। গেমের পরিস্থিতি যদি অনুকূলে না থাকে, তাহলে জটিল করে দিতে হবে পরিস্থিতি— তারপরে আরও পরিকল্পনা আর কৌশলের প্যাঁচ!
১৯৫৬ সালের সোভিয়েত চ্যম্পিয়নশিপের ফাইনাল রাউন্ড। তালের প্রতিপক্ষ আলেকজান্দার টলুশ, যিনি বরিস স্প্যাসকির প্রশিক্ষক ছিলেন। কেরেস, বটভিনিক, স্মাইস্লভদের সঙ্গে টক্কর ছিল তাঁর। ১৯৫৩ সালে বিখ্যাত বুখারেস্ট প্রতিযোগিতায় পেট্রোসিয়ান, স্মাইস্লভ, স্প্যাসকি, জাবোদের হারিয়ে ট্রফি জিতেছিলেন। চারবার লেনিনগ্রাদ চ্যাম্পিয়নশিপের বিজেতা। ওদিকে তালের খুব একটা ভালো যাচ্ছিল না সেই বছরের সোভিয়েত প্রতিযোগিতা। স্প্যাসকির কাছে হেরে গেছেন, বোলেস্লাভস্কির সঙ্গে ড্র। লিসিৎসিনকে হারিয়েছেন বটে, তবে এন্ডগেমে খুঁত ছিল অনেক। তবে, একটা মজার ঘটনা ঘটেছে মার্ক তাইমানভের সঙ্গে নবম রাউন্ডের খেলায়। তাইমানভ তাঁর স্ত্রীকে টেলিফোন করে দিয়েছিলেন টুর্নামেন্ট দেখতে আসার জন্য। এক সদ্য কৈশোর-পেরোনো দাবাড়ুকে কেমন নাকানিচোবানি খাওয়াবেন, সেটা দেখাতে হবে না? কিন্তু, দু ঘণ্টা পরে তাইমানভ উঠে গিয়ে স্ত্রীকে ফোন করে বলেছিলেন, “আজ আসার প্রয়োজন নেই!” বহু যুদ্ধে জেতা অভিজ্ঞ তাইমানভ কোনওরকমে হার বাঁচিয়েছিলেন। তবে, এই প্রতিযোগিতা থেকেই তালের নিজস্ব দাবাপদ্ধতি ডানা মেলতে শুরু করে। দুর্মর জেদে প্রতিপক্ষের রক্ষণ ভেঙে ফেলার নীতি, প্রয়োজনে একাধিক পন বা পিস স্যাক্রিফাইস করা। টোলুশ সিসিলিয়ান ন্যাইডর্ফে ‘পয়জনড্ পন’ ছকে খেলেছিলেন। সাদার b2 পনকে খেয়ে নেয় কালোর মন্ত্রী, বদলে সাদা কিছু পজিশনাল অ্যাডভান্টেজ পায়। ববি ফিশার এই ঝুঁকিপূর্ণ ভেরিয়েশনকে নতুন তত্ত্বে হাজির করেছিলেন পরে। তবে, টোলুশ আশা করেননি তালের পাল্টা আক্রমণ। একটা বিশপ খাইয়ে দিয়েছিলেন তাল, কিন্তু মাঝছক (সেন্টার) দিয়ে আক্রমণ শানিয়েছিলেন।
ক্যাসল্ না-করা কালোর রাজাকে রুক, নাইট আর ক্যুইন দিয়ে ঘিরে ফেলেছিলেন। ১৯৫৭ সালে রিগা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিহাস ও দর্শনে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন তাল; ১৯৫৭ সালেই তাঁর গ্র্যান্ডমাস্টার খেতাব অর্জন এবং এক অবিস্মরণীয় কিংবদন্তি জমানায় প্রবেশের দৌড় শুরু হয়।
তাল যাঁকে হারিয়ে বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হয়েছিলেন, তিনি সোভিয়েত দাবাঘরানার চিরকালীন রোল-মডেল। সোভিয়েত দর্শনের সঙ্গে দাবা-দর্শনকে মিলিয়ে বিশ্বদাবায় সোভিয়েতযুগের আধিপত্য প্রতিষ্ঠার মূল কারিগর তিনিই— মিখাইল বটভিনিক। বটভিনিক ওপেনিংতত্ত্বে নতুন কিছু ভেরিয়েশন যোগ করলেন; প্যানভ-বটভিনিক অ্যাটাক কারো-কান সিস্টেমে সাদার জন্যে বেশ কার্যকরী, সেমি-স্লাভ ডিফেন্সে বটভিনিক ভেরিয়েশন। কিন্তু, বটভিনিকের তত্ত্বে ঝটিকা-আক্রমণ নেই, আচমকা স্যাক্রিফাইস নেই; আছে শান্ত কিন্তু শক্তিশালী স্ট্র্যাটেজি। ধীরে ধীরে প্রতিপক্ষকে ঘিরে ফেলা, মিডলগেম থেকে এন্ডগেমে পৌঁছবার পথে প্রতিটা চালে সামান্য অ্যাডভান্টেজ নিতে নিতে প্রতিপক্ষকে পিষে দেওয়া। বটভিনিক সোভিয়েত দর্শনের আদর্শ দাবাড়ু। ১৯৪৮-১৯৬৩ অবধি বিশ্বচ্যাম্পিয়নের মুকুট তাঁর মাথায়। মাঝে ১৯৫৭ সালে স্বদেশীয় ভ্যাসিলি স্মাইস্লভের কাছে মুকুট হারিয়েছিলেন কিন্তু পরের বছর ফের স্মাইস্লভকে হারিয়ে বিশ্ববিজয়ী। সেই বটভিনিকের দাবাদর্শনে অন্তর্ঘাত ঘটিয়েছিলেন তাল। ১৯৫৯ সালের ক্যান্ডিডেটস প্রতিযোগিতায় তাল অবিশ্বাস্য উচ্চতায় নিয়ে গেলেন নিজেকে। পেছনে ফেলে দিলেন পল কেরেস, টাইগ্রান পেট্রোসিয়ান, ভ্যাসিলি স্মাইস্লভ এবং ষোড়শবর্ষীয় ববি ফিশারকে। এঁদের মধ্যে তিনজন বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হয়েছিলেন। ১৯৬০ সালে তাল ৬-২ ব্যবধানে হারান বটভিনিককে, ১৩টি গেম ড্র হয়। ১৫ মার্চের প্রথম খেলায় তাল বটভিনিককে হারিয়ে দেন সাদা নিয়ে। কিন্তু সবচেয়ে আলোচিত ষষ্ঠ গেম— তাল কালো ঘুঁটিতে খেলছেন— ২১ নম্বর দানে Nf4, নিজের ঘোড়াকে খাইয়ে দিলেন তাল।
দর্শকাসন থেকে গুঞ্জন ক্রমে কোলাহলে পরিণত হল, আয়োজকরা বাধ্য হলেন দর্শকহীন ঘরে বোর্ড সরিয়ে নিয়ে যেতে। ২৪ নম্বর দানে আবারও স্যাক্রিফাইস, এবার f-file-এর বোড়ে। বটভিনিক কিছু ভুল করলেন, ভুল পরিকল্পনা। ৪৬ নম্বর চালে গিয়ে পরাজয় স্বীকার করলেন বটভিনিক, কারণ কালোর একটি বোড়ে তখন অপ্রতিরোধ্য গতিতে মন্ত্রী হওয়ার দিকে এগোচ্ছে। ১৯৬১ সালে ফের বটভিনিক প্রত্যাহ্বান জানালেন তালকে। সোভিয়েত-মানসিকতা! মস্কো-অহং? লাটভিয়ার দাবাড়ুর কাছে পরাজয় কি মস্কোর দাবাড়ু স্বীকার করে নিতে পারে? ১৯৬১ সালে মিখাইল তাল কিডনির সমস্যায় অসুস্থ, বটভিনিকের প্রত্যাহ্বানে বিশ্বচ্যাম্পিয়নশিপে খেলতে পারবেন না বলে জানান রিগার ডাক্তাররা। বটভিনিকের স্পষ্ট প্রতিক্রিয়া— ‘তাল অসুস্থ? বিশ্বাস করতে পারি, যদি মস্কোর কোনও ডাক্তার সার্টিফিকেট দেয়।’ তাল লাটভিয়ার দাবাড়ু। মস্কোপন্থী বটভিনিক মস্কো ছাড়া কিছুই বিশ্বাস করতেন না! দাবার রাজনীতি… দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে সোভিয়েত পুনর্নিমাণের যুগে ঝ্দানভের সেই বিখ্যাত বিবৃতি আছে না, “শিল্প সাহিত্য বিজ্ঞান সবক্ষেত্রেই আমরা উত্তম ও সর্বোত্তমের মধ্যে উৎকর্ষের প্রতিযোগিতায় বিশ্বাস করি!” বটভিনিকের মানসিকতা সেটা অনুসরণ করত, তাই তালের অসুস্থতার কথা বিশ্বাস করার থেকেও তাঁর বেশি দায় ছিল নিজেকে ‘সর্বোত্তম’ প্রমাণ করার। তাল মুকুট খোয়ালেন বটভিনিকের কাছে। সাংবাদিক সম্মেলনে বটভিনিক আক্রমণ অব্যাহত রাখলেন, “If Tal was well-prepared, if he spent more time to explore the typical positions, then, of course, his great talent would’ve made him much more dangerous than he is now, because I think he simply doesn’t work enough.” কয়েকমাস পরের ব্লেড সুপার টুর্নামেন্টে আবার শিরোনামে তাল। ১৯ ম্যাচে ১৪.৫ পয়েন্ট নিয়ে শীর্ষস্থান দখল করলেন; পেছনে রইলেন পেট্রোসিয়ান (যিনি পরবর্তী বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হবেন), পল কেরেস, এফিম জেলার, মিগুয়েল ন্যাইডর্ফরা। দাবাপ্রেমী মাত্রেই জানেন যে, কেরেস, জেলার, ন্যাইডর্ফ এঁরা প্রত্যেকেই দাবা-ওপেনিংয়ের আলাদা আলাদা তত্ত্বের প্রবক্তা। নিজের সেরা সময়ে ছবার ক্যান্ডিডেটস প্রতিযোগিতায় খেলার সুযোগ অর্জন করেছেন। কিন্তু, ক্যান্ডিডেটস জেতা ও বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হওয়া ওই একবারই।
***
তাল দাবায় সত্য খুঁজতে খেলতেন না, সৌন্দর্য উপভোগ করতেন। এই সুন্দরকে খোঁজার আনন্দ আমাদের অনেকের দাবা-ধারণার থেকে আলাদা।
–গ্যারি কাসপারভ
তাল তখন অস্তমিত সূর্য। লাটভিয়াতেও সোভিয়েত সূর্যের ছায়া লম্বা হয়ে আসছে। তবে লাটভিয়া তখনও সোভিয়েতের অন্তর্ভুক্ত। ইউরোপীয় ইউনিয়ন লাটভিয়ায় থাবা বসাবে আরও ১৭ বছর পরে। ১৯৮৭ সালের ফেব্রুয়ারি। তালের প্রতিদ্বন্দ্বী জোহান হিয়ার্তার্সন, আইসল্যান্ডের প্রতিভাবান গ্র্যান্ডমাস্টার। বাইশ বছর বয়সে গ্র্যান্ডমাস্টার খেতাব অর্জন করেছেন, একুশ বছর বয়েসে রেইজাভিক ওপেন প্রতিযোগিতায় বিশ্বের সেরা দাবাড়ুদের বিরুদ্ধে লড়ে প্রথম স্থানাধিকার করেছেন। আর, তাল তখন একান্ন বছরের প্রৌঢ়। অভিজ্ঞ ঠিকই কিন্তু উদীয়মান হিয়ার্তাসনের বিরুদ্ধে ফেভারিট নন। তালের সাদা। রুই লোপেজ বা স্প্যানিশ ওপেনিং দিয়ে শুরু করেছেন। ক্ল্যাসিকাল ভেরিয়েশন, চিগোরিন ডিফেন্স সাজিয়ে প্রত্যুত্তর দিচ্ছেন জোহান। বাইশ চাল অবধি ব্যাকরণ মেনে খেলা হচ্ছে। সাদার সামান্য সুবিধাজনক অবস্থান কারণ, কালো-ঘরের বিশপ সক্রিয় হয়ে উঠেছে এবং গুরুত্বপূর্ণ a-file সাদার দখলে, তবে কালোরও যথেষ্ট সুযোগ আছে পাল্টা-আক্রমণের ছক কষার। তখনও কিন্তু ইঞ্জিনের যুগ নয়, তখনও অবধি তথ্যভাণ্ডারে মিলিয়ে মিলিয়ে কবে একইরকম পজিশনে কী চাল খেলেছিল, তা জানা সম্ভব নয়। তাল চব্বিশ নম্বর চালে দিলেন Be3, অত্যাধুনিক ইঞ্জিনের মতে এটি তুলনামূলকভাবে নিম্নমানের চাল। কিন্তু তাল ততক্ষণে পরিকল্পনা সাজিয়ে নিয়েছেন— কালো যেদিকে ক্যাসল্ করেছে, সেদিকের প্রতিরক্ষা ধ্বংস করতে হবে। সাতাশ নম্বর চালে ছোট একটি ভুল করলেন হিয়ার্তাসন, Ng7 চাল দিয়ে। তাল নিষ্ক্রিয় নাইটকে সক্রিয় করলেন, নিজের ক্যুইন ও রুককে আধা-আক্রমণাত্মক অবস্থানে সাজিয়ে নিলেন। অর্থাৎ ব্যূহরচনার প্রস্তুতি সারা হল। ৩৬ নম্বর চালে চূড়ান্ত নান্দনিক চাল, নিজের রুকটিকে স্বেচ্ছায় বলি দেওয়া!
এর পেছনে রয়েছে সুচিন্তিত পরিকল্পনা, রুকটিকে কালো যদি আত্মসাৎ করে তবে তার মাশুল দিতে হবে ক্যুইন খেতে দিয়ে বা কিস্তিমাত হয়ে! হিয়ার্তাসন লোভ সংবরণ করলেন, কিন্তু চল্লিশ চালের মাথায় সাঙ্ঘাতিক আরেকটি ভুল করলেন। হিউম্যান এরর, মানুষের পক্ষে এমন ভুল আশ্চর্য নয়। কিন্তু, তাল সাজিয়ে ফেললেন পাঁচ চালের দুর্দান্ত একটি কম্বিনেশন! অর্থাৎ পাঁচ চাল পরে কীভাবে কিস্তিমাত হবে এবং বিপক্ষের সম্ভাব্য প্রতিটি চালের প্রত্যুত্তর কী হবে সেটা ভেবে দাবার নান্দনিক ইতিহাসে জায়গা করে নিলেন। ১৯৮৭ সালেই হিয়ার্তাসন ইন্টারজোনাল প্রতিযোগিতায় জিতে বিশ্ব ক্যান্ডিডেট দাবায় অংশ নিয়েছেন চ্যাম্পিয়নশিপের দাবিদার হয়ে। তাল ধ্রুপদী ধরনের দাবায় আর তেমন সাফল্য পাননি। কিন্তু ১৯৮৮ সালে দ্বিতীয় বিশ্ব ব্লিৎজ দাবা প্রতিযোগিতার বিজয়ী হলেন, তাও আবার গ্যারি কাসপারভ, আনাতোলি কারপভদের মতো তরুণ তুর্কিদের পেছনে ফেলে। বরিস গেলফাঁ ইজরায়েলের সর্বকালের শ্রেষ্ঠ দাবাড়ু, যিনি তিপ্পান্ন বছর বয়েসেও নিয়মিত বিশ্বদাবার শীর্ষতম প্রতিযোগিতাগুলিতে অংশগ্রহণ করেন। কিন্তু, বাহান্ন বছর বয়েসে বিশ্ব ব্লিৎজ দাবায় চ্যাম্পিয়ন হওয়ার নজির তালের মতো আর কারও নেই।
১৯৯২ সালে। সোভিয়েত ততদিনে ইতিহাস হয়ে গেছে, বিশ্ব দাবায় লাটভিয়ার প্রতিনিধিত্ব করতে উদ্গ্রীব ছিলেন তাল। জীবনের শেষ ম্যাচ ভ্লাদিমির অ্যাকোপিয়ানের বিরুদ্ধে; বাকুর অ্যাকোপিয়ান বিশ্ব জুনিয়র দাবার তৎকালীন চ্যাম্পিয়ন। তাল সাদা ঘুঁটিতে অ্যাকোপিয়ানের আক্রমণ সামলাতে ব্যস্ত। তরুণ অ্যাকোপিয়ানে সমস্ত আক্রমণ নিবদ্ধ করেছেন রাজা যেদিকে ক্যাসল্ করেছে, সেই দিকে। যুদ্ধের পরিভাষায় ‘হেভি আর্টিলারি ফায়ার’ শুরু করছে ক্যুইন, রুক ও বিশপ। তাল প্রতি-আক্রমণে বেছে নিয়েছেন মাঝছক (centre)। একত্রিশ নম্বর চালে, যখন অ্যাকোপিয়ান বিশ্বাস করতে শুরু করেছেন যে, আক্রমণে সাফল্য এসেই গেছে, তখনই আস্তিনের ভেতর থেকে লুকোনো ঘোড়ার চাল সমস্ত পজিশন বদলে দিল! Ng5!
পরের দানে ডিস্কভারড অ্যাটাক, অ্যাকোপিয়ানের ক্যুইন খেয়ে নিলেন তাল। তালের শোক-প্রতিবেদনে নিউ ইয়র্ক টাইমস লিখেছিল, “known in chess circles as a swashbuckling attacker who reveled in daring sacrifices and all-but-unfathomable complications over the board,” চিরকালীন শত্রুদেশের দাবা-সাংবাদিকের শ্রদ্ধা উপচে পড়েছিল সেই নিবন্ধে। ২৮ জুন হসপাতালে ভর্তির সময়েও জানতেন আবার ফিরে এসেই নতুন উদ্যমে ছারখার করে দেবেন তাবড় দাবাড়ুদের প্রতিরক্ষা। কারণ, ঠিক আগের মাসেই মস্কোর প্রতিযোগিতায় হারিয়েছেন সেই সময়ের বিশ্বসেরা কাসপারভকে। কাসপারভ। তালের প্রিয় জুনিয়র। কাসপারভকে প্রশিক্ষণ দিতেন, এমনকি কাসপারভের প্রতি তিনি ‘পক্ষপাতদুষ্ট’ বলে কারপভের সঙ্গে ঝামেলাও বেঁধেছে বহুবার। ৯ নভেম্বর ১৯৮৫, কাসপারভ তাঁর জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচ খেলতে নামবেন বিশ্বচ্যাম্পিয়ন আনাতোলি কারপভের বিরুদ্ধে। তার ঠিক আগের রাতেই তালের ফোন এল, “শোনো হে, কাল আমার জন্মদিন, এটা ভুলো না যেন!” ৯ নভেম্বর তালের জন্মদিন আর, সেইদিনেই বিশ্বদাবার সর্বকনিষ্ঠ চ্যাম্পিয়নের খেতাব জিতলেন কাসপারভ। বহুবছর পরের এক সাক্ষাৎকারে কাসপারভ বলেছিলেন, “He was the only one I knew who didn’t calculate the variants, he saw them… He was a man in whose presence others sensed their mediocrity.”
***
তাল ১৯৯২ সালের ২৮ জুন মারা গেলেন মস্কোর হাসপাতালে, কাসপারভ জমানা শুরু হওয়ার আগে সর্বকনিষ্ঠ বিশ্বচ্যাম্পিয়ন। ১৯৬৯ সালে একটি কিডনি বাদ গেছিল, যকৃতের সমস্যা ঘন ঘন। তালের ঘনিষ্ঠরা জানত যে, প্রায়ই প্রতিযোগিতা চলাকালীন তাঁকে যকৃৎ ও বৃক্কের সমস্যায় হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়, কিন্তু হাসপাতালের বিছানা থেকে উঠেই ফের প্রতিযোগিতায় খেলতে চলে আসেন। তালের কাছেও ব্যাপারটা জলভাত হয়ে গেছিল কম্বিনেশন আর স্যাক্রিফাইসের মতোই! আর, তালের খেলা মানেই বোর্ডে বসেই সিগারেটের প্যাকেট শেষ হয়ে যাবে। যকৃতের অসুস্থতা সত্ত্বেও মদ্যপান আর বোহেমিয়ান যাপন— কিন্তু ভালোবাসা অটল দাবার প্রতি। সেখানে সামান্য আপস নেই! পজিশন খারাপ জেনেও আচমকা স্যাক্রিফাইসে পরিস্থিতিকে জটিল করে দেবেন, জটিল পরিস্থিতিতে হঠাৎ প্রতি-আক্রমণে ধাঁধিয়ে দেবেন প্রতিপক্ষের সুবিন্যস্ত ভাবনাকে। ২৯ জুন নিউ ইয়র্ক টাইমসের বিখ্যাত দাবাবিশেষজ্ঞ রবার্ট বায়ার্ন তালের মৃত্যুর পরে শোক-প্রতিবেদনে লিখেছিলেন—
তালের মতো দাবাকে ভালোবাসতে খুব কম জন পেরেছে। বহু দাবাড়ুর কাছে দাবা খুব শ্রমসাধ্য খেলা কিন্তু তালের কাছে দাবা অনায়াস সহজ, প্রেমের মতোই।