অশোক মুখোপাধ্যায়
পূর্ব-প্রসঙ্গ: মস্তিষ্কের নজরদারি
প্রথম সঙ্কেত তন্ত্র
সংবেদন ও প্রত্যক্ষণের তাৎপর্য ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে পাভলভ আরও কিছু মূল্যবান তত্ত্ব উপস্থিত করলেন। তাঁর মতে এক একটা উদ্দীপক থেকে স্নায়ুতন্ত্রের মাধ্যমে মস্তিষ্কে যে সমস্ত সংবেদন আসে তার প্রত্যেকটাই আসলে প্রাণীটির কাছে একটা প্রত্যক্ষ সংবাদ (information)। মুখ থেকে খাদ্যের গন্ধ যখন ঘ্রাণকেন্দ্রে পৌঁছয় তখন তা যেন খাদ্য এসে গেছে বলে একটা খবর হয়। সেই খবর গেলেই ঘ্রাণকেন্দ্র থেকে আবার সংবাদ চলে যায় সঞ্চালককেন্দ্রে এবং হাইপোথ্যালামাসে। তার ফলে আনুষঙ্গিক কাজগুলো পর পর হতে থাকে। কান দিয়ে যে শব্দ ঢুকছে তাও আর একটা সংবাদ, কিন্তু তা খাদ্যের সংবাদের সঙ্গে অসম্পর্কিত। এই সব সংবাদই আসছে মূর্ত বস্তু থেকে সরাসরি।
কিন্তু তারপর যখন ঘন্টার শব্দের সঙ্গে খাদ্যপ্রাপ্তির সংবাদ যুক্ত হয়ে গেল, তখন থেকে ঘন্টার শব্দ ঘন্টার দিক থেকে একটা সংবাদ, কিন্তু খাদ্যের দিক থেকে দেখলে একটা সঙ্কেত (signal) হয়ে উঠল। ঘন্টা বাজলেই সংশ্লিষ্ট প্রাণীটি বুঝতে পারে, খাবার আসছে বা এসে গেছে। অর্থাৎ, একটা বিশেষ ধরনের শব্দের সংবেদনটি খাদ্যের উপস্থিতি বা আগমনের সঙ্কেত বা সূচক (indication) হয়ে উঠল। পাভলভ এদের নাম দিলেন প্রথম সঙ্কেত (first signal) বা প্রাথমিক সঙ্কেত (primary signal)। আর যে ক্ষমতার দ্বারা উচ্চতর স্তন্যপায়ী প্রাণীর মস্তিষ্ক ক্রমাগত বিভিন্ন সঙ্কেত গ্রহণ ও বিশ্লেষণ করতে পারে, বাইরের পরিবেশ পরিস্থিতি সম্পর্কে প্রত্যক্ষণের জন্ম দিতে পারে এবং তার ভিত্তিতে ক্রিয়া করতে পারে, তাকে তিনি বললেন প্রথম সঙ্কেত তন্ত্র (first signal system)। এই “প্রথম” বা “প্রাথমিক” বিশেষণ ব্যবহারের কারণ আমরা একটু পরে দেখতে পাব।
সঙ্কেত সংক্রান্ত এই বিষয়টা আমাদের ভালো করে বুঝে নিতে হবে, কেন না, মানুষের চিন্তা করার প্রক্রিয়ার ভিত্তি এখান থেকেই শুরু হয়। মানুষ যে চিন্তা করতে পারে, তারও প্রাথমিক ভিত্তি হচ্ছে এই শর্তাধীন পরাবর্ত গঠন ও বর্জনের ক্ষমতা, প্রত্যক্ষণের মাধ্যমে সঞ্চালনক্রিয়া, এক কথায়, এই প্রথম সঙ্কেত তন্ত্র। কিন্তু শুধুমাত্র এটুকুর দ্বারাই চিন্তা করার ক্ষমতা আয়ত্ত হয়নি। যদি হত, অন্যান্য উচ্চতর স্তন্যপায়ী প্রাণীও চিন্তা করতে পারত। মানুষের ক্ষেত্রে এই ক্ষমতাগুলো প্রথমে অনেক দূর বিকশিত হয়েছে। মস্তিষ্কের গঠন ও এইসব ক্ষমতার প্রশ্নে মানুষ অন্যান্য প্রাণীদের তুলনায় স্বাতন্ত্র্য লাভ করেছে, উন্নততর অবস্থায় পৌঁছেছে। তারপর একটা নতুন সামর্থ্য সে অর্জন করেছে।
এই পার্থক্যগুলি প্রথমে বুঝে নেওয়া দরকার।
অধিকাংশ প্রাণীই বাইরের পরিবেশ থেকে সংবেদনগুলো পায় নাকের সাহায্যে। এটাই তাদের সর্বাধিক শক্তিশালী সংবেদন উৎস। গন্ধ শুঁকেই এরা বেশিরভাগ জিনিস চিনতে পারে, একটা জিনিসের সঙ্গে আর একটার পার্থক্য বুঝতে পারে। কোনটা খাবে, কোনটা খাবে না, কোনটা ভালো এবং উপকারী, কোনটা ক্ষতিকারক ও বিষাক্ত— এই সবকিছুই এরা গন্ধের তফাত দিয়ে নিরূপণ করতে পারে। ফলে বাস্তব জীবন নির্বাহে এরা যে সমস্ত শর্তাধীন উদ্দীপক বা সঙ্কেতবাচক উদ্দীপক খুঁজে পায়, স্বাভাবিক অবস্থায় তারও প্রায় সবই গন্ধনির্ভর। এই কারণে, কোনও পশুপাখিকে খাবারে বিষ মিশিয়ে মেরে ফেলা সহজসাধ্য কাজ নয়। আবার গৃহপালিত পশুপাখিকে অসুস্থ হলে ওষুধ খাওয়ানোও যথেষ্ট ঝামেলার কাজ। অর্থাৎ, এরকম পরাবর্ত গড়ে তোলা কার্যত অসম্ভব। একমাত্র কৃত্রিম অবস্থায়, গৃহপালিত কুকুর বেড়াল খরগোশ গিনিপিগ হাতি গরু ছাগল ঘোড়া গাধা ইত্যাদির ক্ষেত্রে, কিছু কিছু বিশেষ ধরনের শব্দ (যেমন, পরিচিত লোকের পায়ের আওয়াজ বা দরজা খোলার শব্দ, থালাবাসনের শব্দ, নাম ধরে ডাক, ও অন্যান্য), আলো, খাবার দেবার বাটি হাতে বেরোনো, ইত্যাদি শর্তাধীন উদ্দীপক হিসাবে গড়ে উঠতে ও কাজ করতে পারে। করেও থাকে।
বাঘ সম্পর্কে জিম করবেট লিখেছেন: বাঘ হয়তো একটা গরু শিকার করে এনে খানিকটা খেয়ে বাকিটা পরে খাবে বলে ঝোপের মধ্যে রেখে দিয়েছে। এদিকে একজন শিকারি হয়তো সেখানে গিয়ে অখেয়ালবশত সেই পড়ে থাকা দেহাবশেষ হাত দিয়ে ছুঁয়ে সামান্য জায়গা বদল করে ফেলেছে। বাঘটি যখন ফিরে আসবে, সে কিন্তু গন্ধ শুঁকেই পরিবর্তনটা ধরে ফেলবে। এসেই তৎক্ষণাৎ খেতে শুরু করবে না। এদিক ওদিক তাকাবে, চারপাশে ঘুরে ঘুরে গন্ধ শুঁকে বিপদের সম্ভাবনা আছে কিনা দেখবে। তারপর নিরাপদ বোধ করলে খাবে। শিকারি কুকুর গন্ধ শুঁকে শিকারের পেছনে অনেক দূর পর্যন্ত খুঁজে খুঁজে যেতে পারে। পুলিশের কুকুর সন্দিগ্ধ পলাতক ব্যক্তির ব্যবহৃত জামাকাপড়ের বা জুতোর গন্ধ থেকে সেই ব্যক্তির গন্ধ পায় এবং তা দু-চারদিন বাদেও চিনতে পারে; তার ভিত্তিতে অনুসরণ করে তাকে খুঁজে বের করতে পারে (যদি সে ইতিমধ্যে কোনও জলাশয় পার করে না থাকে)।
কানও এদের খুব শক্তিশালী ইন্দ্রিয়। শ্রবণতন্ত্র খুব সজাগ ও সুবেদী (sensitive)। কুকুর বেড়াল খুব নিশ্চিন্তে গভীর ঘুমে আবিষ্ট অবস্থাতেও সামান্য অপরিচিত আওয়াজে জেগে ওঠে। এরা পরিচিত ও অপরিচিত লোকের পায়ের ক্ষীণ শব্দ অনেক দূর থেকে শুনতে পায় এবং আলাদা করতে পারে। বাড়ির পোষা গরু ঘোড়া বা বেড়াল কুকুরকে প্রদত্ত নাম ধরে ডাকলে তারা একভাবে সাড়া দেয়।
চোখ কিন্তু এদের এতটা কার্যকর নয়। কুকুর বেড়ালকে খুব চওড়া ব্যস্ত গাড়িচলা রাস্তা পার হতে দেখলেই এটা খুব ভালো করে বোঝা যায়। কিংবা এদের থেকে সামান্য দূরে খাবারের টুকরো মাটিতে ছুঁড়ে দিলেও ব্যাপারটা স্পষ্ট হয়ে উঠবে। এরা চোখ দিয়ে খাবারের টুকরোগুলো প্রথমে দেখতে পাবে না। খাবার দেওয়া হয়েছে বুঝে (শর্তাধীন পরাবর্ত হিসাবে) নাক ঘুরিয়ে গন্ধ শুঁকে খুঁজে বের করবে। দৃষ্টিশক্তি এদের ক্ষেত্রে ঘ্রাণশক্তির সহায়ক মাত্র।
স্পর্শানুভূতিও এদের খুব দুর্বল। গায়ের চামড়া লোমে ঢাকা বলে এরা চাপ, বেদনা বা আঘাতের স্তরে না যাওয়া পর্যন্ত কোনও স্পর্শ সংবেদনই প্রায় লাভ করতে পারে না। মুখের দিকে ছাড়া।
মানুষের ক্ষেত্রে বিষয়টা ঠিক উলটো।
ঘ্রাণশক্তিতে মানুষ খুব অসহায়। খুব তীব্র না হলে মানুষের নাক দুনিয়ার অধিকাংশ জিনিসেরই গন্ধ টের পায় না। আর যে সীমিত সংখ্যক জিনিসের গন্ধ পায়ও, তা দিয়ে তাদের ভালো মন্দ উপকারিতা অপকারিতা বিচার করতে পারে না। অজৈব বিষাক্ত পদার্থগুলি বেশিরভাগই মানুষের কাছে গন্ধহীন। আর জৈব পদার্থগুলির গন্ধ পেলেও তার সাহায্যে মানুষ তাদের কোনওটারই বিষময়তা (toxicity) এবং তার মাত্রা ধরতে পারে না। এই জন্য খাদ্যে বিষ মিশিয়ে কুকুর বা বেড়ালের তুলনায় মানুষকে মেরে ফেলা খুব সহজ।
শ্রবণশক্তির ক্ষেত্রেও মানুষের শব্দ শোনার পরিসর ছোট। মানুষের কান সাধারণত ২০ থেকে ২০০০০ পর্যন্ত কম্পাঙ্ক বিশিষ্ট শব্দ শুনতে পায়। এর চাইতে কম বা বেশি কম্পাঙ্কের কোনও শব্দই মানুষ শুনতে পায় না। এইজন্যই জগতের বহু শব্দই মানুষের কর্ণগোচর হয় না। কুকুর বেড়াল অনেক নিম্নতর কম্পাঙ্কের শব্দ শুনতে সক্ষম। বাদুর আবার অনেক বেশি কম্পাঙ্কবিশিষ্ট শব্দ (বিজ্ঞানে যাকে মানুষের সাপেক্ষে শব্দোত্তর তরঙ্গ বলা হয়) শুনতে পারে।
এইসব তথ্য জেনে মনে হতে পারে, মানুষের অবস্থা কুকুর বেড়াল বাঘ সিংহ হাতি ঘোড়ার তুলনায় বেশ অসুবিধাজনক। তা কিন্তু নয় ব্যাপারটা। কুকুর বেড়ালের গন্ধ পাওয়াটা বেশি জরুরি বলে এদের মাথার একটা বড় অংশ জুড়ে থাকে নাক ও নাসিকাতন্ত্র। মস্তিষ্কেও ঘ্রাণকেন্দ্র অনেকটা জায়গা দখল করে রাখে। অন্যান্য সংবেদন গ্রহণের জন্য বরাদ্দ জায়গা কমে যায়। বিবর্তনের পথ ধরে প্রাইমেট বর্গে এসে বানর গিবন ওরাংউটান গরিলা শিম্পাঞ্জি ইত্যাদির বেলায় নাকের ও ঘ্রাণের গুরুত্ব কমে গেছে; বৃক্ষচারী জীবনের সুবিধার্থে চোখ ও দর্শনের ভূমিকা বড় হয়ে উঠেছে। ফলে নাসিকাতন্ত্র ছোট হয়ে মস্তিষ্কে ঘ্রাণ সংবেদনকেন্দ্রও ছোট হয়ে গেছে, সেই জায়গায় অগ্রমস্তিষ্কের আয়তন বেশ বড় হয়েছে।
উদাহরণ দিলে বুঝতে সুবিধা হবে।
বেড়াল বা কুকুরের বেলায় দুই চোখের দর্শনক্ষেত্র অনেকটাই আলাদা। কোনও জিনিস আকারে খুব বড় না হলে অথবা খানিকটা দূরে না থাকলে এরা কোনও জিনিস উভয় চোখে এক সঙ্গে দেখে না। এক এক চোখে আলাদা আলাদা জিনিস দেখে। এদের যেটা আছে তাকে বলা হয় দ্বিমাত্রিক দৃষ্টি (two-dimensional vision)। কিন্তু প্রাইমেটদের নাক সাপেক্ষে চোখের অবস্থান এমন যে এরা দুই চোখে একই জিনিস দেখতে পারে (চিত্র – ১০)। এর ফলে এদের দেশ প্রত্যক্ষণের (space perception) ক্ষমতা, অর্থাৎ, যে কোনও জিনিসের আকার আয়তন দূরত্ব উচ্চতা/গভীরতা বোঝার সামর্থ্য অনেক বেশি। চোখের এই ক্ষমতাকে বলা হয় বিশ্লেষণমূলক (stereoscopic) এবং ত্রিমাত্রিক (three-dimensional) দৃষ্টি। মানুষও উচ্চতর প্রাইমেট হিসাবে এই ত্রিমাত্রিক দৃষ্টিশক্তি নিয়ে জন্মগ্রহণ করে।
শুধু তাই নয়। মানুষের দ্বিপদী ঋজু ভঙ্গিমার ফলে একদিকে তার মাথার আয়তন অনেক বেড়ে গেছে। (মস্তিষ্ক : শরীর) তৌলিক অনুপাতও প্রচুর পরিমাণে বৃদ্ধি পেয়েছে। একটা সহজ উদাহরণ দিই। হাতির ক্ষেত্রে এই অনুপাত হল (১ : ৫৬০), আর মানুষের ক্ষেত্রে (১ : ৩৫)। মানবমস্তিষ্কের ওজন গিবনের তুলনায় দ্বিগুণ, শিম্পাঞ্জির চারগুণ, ওরাংউটানের ছয়গুণ এবং গরিলার তুলনায় দশগুণ ভারি। এই মস্তিষ্কের শতকরা আশিভাগই হল অগ্রমস্তিষ্ক। এতে দর্শন কর্টেক্সের বিস্তৃতি ও জটিলতা অনেকখানি বৃদ্ধি পেয়েছে। তাছাড়া, দর্শনক্ষেত্রের যদি একটা জ্যামিতিক কাঠামো কল্পনা করা হয়— অর্ধবৃত্ত ভূমিবিশিষ্ট পিরামিড— সেটা চতুষ্পদী প্রাণীর তুলনায় দ্বিপদী মানুষের ক্ষেত্রে অনেক বড় হবে (চিত্র – ১১)। হাতি বা ঘোড়ার দর্শন পিরামিড বড় হলেও একদিকে এদের চোখের ত্রিমাত্রিক দৃষ্টি নেই, দ্বিতীয়ত এদের দর্শন কর্টেক্সও আবার তেমন বিকশিত নয়।
এর ফলে নাক ও কান দিয়ে বহির্জগতের সংবেদন কম পেলেও মানুষ চোখের মাধ্যমে এক-একবারে অনেক বেশি সংখ্যক ও ব্যাপকতরভাবে সংবেদন ও সঙ্কেত লাভ করতে পারে। ফলে একদিকের ঘাটতি শুধু পুষিয়ে গেছে তাই নয়, অনেকটা বাড়তি সুবিধাও হয়েছে। জিনিস চেনার ক্ষমতা প্রচুর বেড়ে গেছে। প্রত্যক্ষণের ক্ষেত্রে সঠিকতার মাত্রা আরও বৃদ্ধি পেয়েছে এবং বহির্বাস্তব সম্পর্কে অনেক বেশি নিখুঁত ও নির্ভুল ধারণা পাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। ফ্রেডরিক এঙ্গেল্সের উপমাটি যথার্থ যে একটা ইগল পাখি মানুষের তুলনায় অনেক বেশি দূর থেকে দেখতে পায়, কিন্তু মানুষের চোখ এক ঝলক দেখে অনেক বেশি জিনিস বুঝতে পারে।[1] একজন ব্রিটিশ অ্যানাটমিস্ট ও সাংস্কৃতিক নৃতত্ত্ববিদ, গ্রাফটন ইলিয়ট-স্মিথ (১৮৭১-১৯৩৭), এই প্রসঙ্গে সুন্দর একটি মন্তব্য করেছেন: “Vision is the foundation of our intelligence and the chief source of our knowledge.”[2]
এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে মানুষের হাত। প্রাইমেট স্তর থেকেই সামনের পা দুটোর চলন ছাড়াও গাছের ডাল এবং খাদ্যবস্তু আঁকড়ে ধরার কাজে ব্যবহার শুরু হয়েছিল। মানুষের দ্বিপদী চলনের ফলে অগ্রপদ চলনের কাজ থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত হয়ে হাতে পরিণত হয়েছে। আর এই হাত দিয়ে নানারকম কাজ করতে করতে বিভিন্ন বস্তুর আকার ও ধর্ম সম্পর্কে মানবমস্তিষ্ক অসংখ্য স্পর্শ সংবেদন লাভ করে চলেছে। চোখের দৃষ্টি এবং হাতের স্পর্শ থেকে প্রাপ্ত সংবেদনগুলিকে সংযোজিত করে মানুষ বাস্তব জগৎ সম্পর্কে অনেক বেশি প্রত্যক্ষণ ক্ষমতা অর্জন করেছে। এটা মানুষের ক্ষেত্রে এত দূর বিকশিত হয়েছে যে বহু ক্ষেত্রেই মানুষ চোখ দিয়ে দেখে স্পর্শানুভূতিটা কেমন হবে বলতে পারে, বা কিছু কিছু ক্ষেত্রে স্পর্শ করেই দেখতে কেমন হবে বলতে পারে। গুরুমস্তিষ্কে কর্টেক্সে যে সংবেদক ও সঞ্চালক রয়েছে তাতে দুই হাতের জন্য নিযুক্ত স্নায়ুকোষের সংখ্যাই সবচেয়ে বেশি।
মানুষের হাতের এই অতি-সংবেদনশীলতার জন্যই দৃষ্টিহীনদের পক্ষে হাতের— মূলত আঙুলের— অগ্রভাগ দিয়ে স্পর্শানুভূতির সাহায্যে ব্রেইল পদ্ধতিতে বই পড়া সম্ভব হয়। এমনকি পজিট্রন এমিসন টোমোগ্রাফি (positron emission tomography) বা পেট পরীক্ষা পদ্ধতিতে তেজষ্ক্রিয় আইসোটোপ দিয়ে মস্তিষ্কের কোষ থেকে ছবি তুলে দেখা গেছে, হাত দিয়ে কোনও কিছু ধরা ও ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখার সময় একজন দৃষ্টিমান ব্যক্তির তুলনায় দৃষ্টিহীন ব্যক্তির হস্তসঞ্চালক অঞ্চলের অনেক বেশি স্নায়ুকোষ সক্রিয় হয়ে ওঠে।
এই সমস্ত আলোচনা থেকে বোঝা যাচ্ছে, চোখ এবং হাতের দৌলতে মানুষের প্রাথমিক সঙ্কেত তন্ত্রও অন্য সমস্ত প্রাণীর তুলনায় অনেক বেশি সমৃদ্ধ, বৈচিত্র্যময় ও সম্ভাবনাপূর্ণ হয়ে গড়ে উঠেছে। কিন্তু মানুষের চিন্তাশক্তির জন্য আরও বড় একটা সামর্থ্য অর্জন করতে হয়েছে। সেটা হল মানুষের ভাষা। যেটা তার একটা অতিরিক্ত সঙ্কেততন্ত্র। তবে সেই প্রসঙ্গে ঢোকার আগে আমাদের অন্য দুটো বিষয় বুঝে নিতে হবে।
[ক্রমশ]
[1] Engels: 1974, 174.
[2] Cited by Clark: 1946, 3.