অগ্নিপথ, অগ্নিবীর ও ঠিকা সৈন্যের কথকতা

সুমন কল্যাণ মৌলিক

 



প্রাবন্ধিক, মানবাধিকার কর্মী

 

 

 

সারা দেশ আজ অগ্নিপথ। রেলপথে, পিচঢালা সড়কে, জনপদের ব্যস্ত মোড়ে বা গ্রামের কাঁচা রাস্তায় আগ্নেয় মশাল নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে যুবসমাজ। তাদের দৃপ্ত পদচারণা, অবিমিশ্র ঘৃণা, কর্কশ স্লোগান ভেঙে দিচ্ছে কর্পোরেট মিডিয়া ও আইটি সেলের সৌজন্যে গড়ে ওঠা আচ্ছে দিনের মিথ। সীমান্তপারের চক্রান্ত, টুকরে টুকরে গ্যাং-এর চক্রান্ত বা আর্বান নকশালদের নতুন কারসাজি— এইসব গল্পকথা বলে আর এই স্বতঃস্ফূর্ত বিক্ষোভকে রোখা যাচ্ছে না। সোজা কথা হল ভারতীয় সেনার চাকরিকে চার বছরের ঠিকা প্রথায় বেঁধে ফেলার এই প্রকল্পকে ভারতের যুবসমাজ সজোরে প্রত্যাখান করছে। বছরে ২ কোটি চাকরির গল্প বহু আগেই গঙ্গা দিয়ে ভেসে গেছে, এখন আসন্ন লোকসভা নির্বাচনের আগে এই খুড়োর কল ঝুলিয়ে নির্বাচনী ভোটব্যাঙ্ক সুনিশ্চিত করার প্রকল্পকে সমবেত প্রতিবাদ ইতিমধ্যেই প্রশ্নচিহ্নের মুখে ফেলে দিয়েছে। প্রকল্প ঘোষণার তিনদিনের মধ্যে একাধিক পরিবর্তন, সংযোজন ও নতুন প্রতিশ্রুতি (অবশ্য মোদি সরকারের প্রতিশ্রুতির পরিণতি কী হতে পারে তা সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের জানা) প্রমাণ করছে সরকার ইতিমধ্যেই খানিকটা ব্যাকফুটে। অবশ্য দেশের যুবসমাজের এই বিক্ষোভ কেন তা নিয়ে যুক্তিসঙ্গত আলোচনার কোনও উদ্যোগে সরকার এখনও পর্যন্ত আগ্রহী নয়। লাঠি, গুলি, এফআইআর, হুমকিতে বিশ্বাসী এই সরকার ইতিমধ্যেই আন্দোলনকারী যুবকদের ভবিষ্যৎ নষ্ট করে দেওয়ার হুমকি দিয়েছে। গণ-আন্দোলন, বিক্ষোভ, প্রতিবাদ— সমস্ত কিছু শাসকনির্ধারিত লক্ষ্মণরেখা মেনে চলবে এ আশা করা বাতুলতা। এই স্বতঃস্ফূর্ত গণআন্দোলন অবশ্যই অতীব সম্ভাবনাময়। এই আন্দোলনের পরিণতি কী হবে তার উত্তর সময়ের গর্ভে লুকিয়ে আছে কিন্তু ঠিকা সেনা তৈরির এই প্রকল্পের ইতিবৃত্ত, যুবসমাজের প্রতিবাদের কারণ ও শাসকের দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা সম্পর্কে একটা সাধারণ ধারণা তৈরি করা বর্তমান সময়ে জরুরি হয়ে উঠেছে।

 

প্রকল্পের ইতিবৃত্ত

কেন্দ্রীয় সরকারের বহু বিজ্ঞাপিত এই প্রকল্পের নাম— ‘অগ্নিপথ সেনা নিয়োগ প্রকল্প’। এই প্রকল্পের মাধ্যমে স্থল, আকাশ ও নৌসেনা নিয়োগ হবে এবং যারা নিযুক্ত হবে তাদের বলা হবে ‘অগ্নিবীর’। ১৭-২১ বছরে (আন্দোলনের চাপে ইতিমধ্যেই সর্বোচ্চ বয়সসীমা বেড়ে হয়েছে ২৩) যুবারা চার বছরের চুক্তিতে সেনায় নিযুক্ত হবে। এই চার বছর সময়পর্বে তারা ৩০,০০০-৪০,০০০ টাকা স্কেলে মাইনে পাবে। এছাড়া ডিউটিতে থাকাকালীন যে সমস্ত ভাতা, দুর্ঘটনাজনিত বিমা ও চিকিৎসার সুবিধা পাওয়া যায়, সেটাও তারা পাবে। এই চার বছরে তারা ‘সেবানিধি’ নামে এক কনট্রিবিউটরি প্যাকেজের আওতায় থাকবে যার মধ্যে অগ্নিবীরদের মাস মাইনের তিরিশ শতাংশ সেবানিধি প্রকল্পে জমা হবে, সমপরিমাণ টাকা সরকারও দেবে। চার বছর পর এই চুক্তিসেনারা এককালীন ১১.৭ লাখ টাকা পাবেন (সুদ সহ) এবং সেটা হবে করমুক্ত। সরকারের গড়পরতা হিসাব অনুযায়ী প্রতিবছর ৪৬,০০০ হাজার অগ্নিবীর নিযুক্ত হবে এবং চার বছর পর পারফরম্যান্সের ভিত্তিতে এর ২৫ শতাংশ সেনাবাহিনিতে স্থায়ীভাবে নিযুক্ত হবে। আর সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ (৭৫ শতাংশ) এককালীন টাকাটা নিয়ে বাহিনি থেকে বিদায় নেবে। কোনওরকম অবসরকালীন সুবিধা (পেনশন, গ্র্যাচুইটি, চিকিৎসা) তারা পাবে না। অবশ্য একথাও বলা হয়েছে কেন্দ্রের আধা-সামরিক বাহিনি, রেলওয়ে প্রটেকশন ফোর্স বা রাজ্য সরকারের বিভিন্ন চাকরিতে তারা সুবিধা পাবে। তবে সেই সুবিধা বা সংরক্ষণের কোনও আইনি ভিত্তি আছে কি না তা প্রকল্পের কোথাও উল্লেখ নেই। প্রতিবাদ তুঙ্গে ওঠার পর দেখা গেল সরকার বিভিন্ন ঘোষণা করছে যা চরিত্রগতভাবে নিছকই প্রতিশ্রুতি। এমনকি বেসরকারি সংস্থাগুলি যাতে তাদের নিয়োগের সময় এই অগ্নিবীরদের কিছু সুবিধা দেয় তার জন্য সরকারের পক্ষ থেকে অনুরোধ রাখা হয়েছে। এই প্রকল্পের কথা প্রথম শোনা যায় ভারতের প্রথম চিফ অব ডিফেন্স স্টাফ বিপিন রাওয়াতের গলায়। সেই সময় এই প্রকল্পের নাম ছিল ‘ট্যুর অব ডিউটি’। প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং, আর্মি, নৌ ও বিমানবাহিনির প্রধানরা একযোগে এই প্রকল্পকে সমর্থন করে বলেছেন অগ্নিপথ ভারতীয় সেনার দক্ষতা, যুদ্ধ করার ক্ষমতা, প্রযুক্তি ব্যবহারের সক্ষমতার ক্ষেত্রে যুগান্তকারী পরিবর্তন আনবে। সরকারের আশা ৬-৭ বছরের মধ্যে ভারতীয় সেনার গড় বয়স ৩২ থেকে কমে ২৪-২৬ বছরের মধ্যে হয়ে যাবে। যদিও অবসরপ্রাপ্ত বিভিন্ন সেনাকর্তারা এই প্রকল্পকে এক বিপর্যয় বলে ইতিমধ্যেই বক্তব্য রাখতে শুরু করেছেন।

 

কেন এই আগ্নেয় প্রতিবাদ

অগ্নিপথ প্রকল্প ঘোষণা হওয়ার পর থেকে দেশে যে প্রতিবাদের ঝড় উঠেছে তার কারণ একাধিক। প্রথমত একথা কারও অজানা নয় ভারতে সরকারি চাকরির প্রধান দুই উৎস সেনাবাহিনি ও ভারতীয় রেল। নয়া উদারনৈতিক অর্থনীতির নিয়ম মেনে রেলের যে কর্পোরেটকরণের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে তাতে রেলে শূন্যপদের সংখ্যা ধীরে ধীরে অবলুপ্ত করে দেওয়া হচ্ছে। শুধু বিগত দুই বছরে রেলে ২ লক্ষ পদ চিরকালের জন্য বাতিল ঘোষণা করা হয়েছে। এই অবস্থায় সাধারণ যুবকদের কাছে সেনাবাহিনিই একমাত্র ভরসার জায়গা রয়েছে। শিক্ষিত, মধ্যবিত্ত শ্রেণির লোকেরা যতই সেনার চাকরিকে দেশপ্রেমের মোড়কে গৌরবান্বিত করার চেষ্টা করুক না কেন আদতে এই সব পরিবারের সন্তানরা কেউই সাধারণ সৈনিকের কাজ করেন না। ভারতে সেনার চাকরি নেয় মূলত গরীব পরিবারের সন্তানেরা, কারণ অন্য চাকরির সুযোগ তাদের কাছে খুব একটা অবশিষ্ট থাকে না। আর এই চাকরির ক্ষেত্রে উচ্চ শিক্ষাগত যোগ্যতার চেয়েও অনেক বেশি দরকার শারীরিক সক্ষমতা। সেনার চাকরি এই গরীব মানুষদের কাছে এক আর্থিক নিরাপত্তা ও সামাজিক সম্মানের প্রতীক। যারা গ্রামভারতের অবস্থা সম্পর্কে কণামাত্রও অবহিত, তারা জানে হাজার হাজার যুবক সেনার চাকরির পরীক্ষা দেবে বলে দীর্ঘদিন ধরে কঠোর শারীরিক অনুশীলন করে। আমরা যদি প্রতিবাদের ভরকেন্দ্রগুলি লক্ষ করি তাহলে দেখতে পাব বিহার, উত্তরপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থান যেখানে কৃষি ও সামান্য অসংগঠিত ক্ষেত্র ছাড়া কর্মসংস্থানের সেরকম কোনও সুযোগ নেই, সেখানে আন্দোলনের তীব্রতা সবচেয়ে বেশি। এই যুবকেরা অবসরকালীন সুবিধাবর্জিত চুক্তিতে সেনা নিয়োগের গল্পটা কিছুতেই মানতে পারছে না।

দ্বিতীয়ত এই মুহূর্তে ভারতে কর্মসংস্থানের চিত্রটাও অনুঘটকের কাজ করেছে। গত পঞ্চাশ বছরে বেকারির হার সর্বোচ্চ। জিএসটি, কোভিড, বিমুদ্রাকরণ পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে। সমস্ত পাবলিক সেক্টরে নতুন নিয়োগের উপর অঘোষিত নিষেধাজ্ঞা জারি রয়েছে। এই অবস্থায় কর্মসংস্থানের একটা বড় উৎসকে ঠিকাকরণের এই পরিকল্পনাকে যুবসমাজ প্রত্যাখান করবে এটাই স্বাভাবিক।

তৃতীয়ত আরও একটা বড় সমস্যা হল যে সমস্ত অগ্নিবীররা স্থায়ী নিয়োগ পাবে না তাদের অন্য জায়গায় পুনর্নিয়োগের ব্যাপারে সরকার যে সমস্ত প্রতিশ্রুতি দিয়েছে তা কেউ বিশ্বাস করতে পারছে না। এক্ষেত্রে প্রথমে আধা-সামরিক বাহিনিতে নিয়োগের প্রশ্নটি অভিজ্ঞতার আলোকে দেখা যেতে পারে। দীর্ঘদিন ধরে সেনার অধ্যক্ষরা দাবি করেছেন সেনাদের ৩৭ বছর হওয়ার আগেই (অর্থাৎ তাদের অবসর নেওয়ার আগেই) তাদের আধা-সামরিক বাহিনিতে ”lateral entry” করালে তাদের পুনর্নিয়োগের বিষয়টি হয়ে যাবে, আবার ফাঁকা জায়গায় সেনাতে নতুন নিয়োগ হবে। কিন্তু আজ অবধি তা হয়নি, বরং বয়স হয়ে গেছে বলে তাদের সুযোগ বন্ধ হয়ে গেছে। তাই আধা-সামরিক বাহিনিতে নিয়োগের প্রশ্নটি হালে পানি পাচ্ছে না।

চতুর্থত অবসর গ্রহণের পর সেনাদের অন্য কাজে নিয়োগের ব্যাপারটা তদারকির দায়িত্বে আছে ডিপার্টমেন্ট অব এক্স-সার্ভিসম্যান ওয়েলফেয়ার। এদের রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে বেশিরভাগ লোকের কাজ হচ্ছে বিভিন্ন সিকিউরিটি এজেন্সিতে কম মাইনের গার্ডের। তা নিয়ে সেনাদের মধ্যে ক্ষোভ প্রচুর। আর যেহেতু সার্বিকভাবে কর্মসংস্থানের হাল খুব খারাপ তাই সেনারা দলে দলে চাকরি পাবেন, এটা বাস্তব নয়। স্থায়ী চাকরির মানুষদেরই যখন এই সমস্যা তখন চুক্তিভিত্তিক সেনাদের পুনরায় চাকরি পাওয়ার সম্ভাবনা অবশ্যই ক্ষীণ। এছাড়া মনে রাখা দরকার এই চুক্তি-সেনাদের চাকরি দিতে হবে— এমন কোনও আইনি সংস্থানও এই প্রকল্পে নেই। তাই বিজেপি পার্টি অফিসে দারোয়ানের কাজ (কথা সৌজন্য, বিজেপি নেতা কৈলাস বিজয়বর্গী) বা মোদিকথিত পকোড়া বিক্রির কাজই বোধহয় এই চুক্তিসেনাদের ভবিতব্য হতে চলেছে বলে যুবাদের একটা বড় অংশ মনে করছেন। এককথায় যুবদের এই প্রকল্পের বিরোধিতার যথেষ্ট যুক্তিগ্রাহ্য কারণ আছে।

 

সেনার দক্ষতাবৃদ্ধির দাবির সত্যতা বিচার

অগ্নিবীর প্রকল্পের ক্ষেত্রে সরকারপক্ষের প্রধান দাবি হল এতে সেনার গড় বয়স কমবে এবং দক্ষতা বাড়বে। কেন্দ্রীয় প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং এবং তিন বাহিনির প্রধান এক নিঃশ্বাসে বারবার এই কথাগুলো উচ্চারণ করছেন। আর যেহেতু সেনাবাহিনির দক্ষতা ও দেশের নিরাপত্তার প্রশ্নটি অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত তাই বিষয়টিকে আমাদের অবশ্যই গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করতে হবে। যেহেতু সেনার মতো এক শৃঙ্খলাবদ্ধ বাহিনিতে কর্মরত আধিকারিকদের প্রকাশ্যে মত প্রকাশের অধিকার নেই, তবে এই ইস্যুতে অবসরপ্রাপ্ত আধিকারিকদের অনেকেই গণমাধ্যমে নানান প্রশ্ন তুলেছেন যা সরকারের দাবির শূন্যগর্ভ অবস্থাকে প্রকাশ করে। অবসরপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট জেনারেল বি এস রাজু, মেজর জেনারেল জি ডি বক্সি, বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্সের প্রাক্তন চিফ ইন্সপেক্টর বি এন শর্মা, প্রাক্তন মেজর জেনারেল অমৃত পাল সিং, লেফটেন্যান্ট জেনারেল (ডিজি অপারেশন) বিনোদ ভাটিয়া, মেজর জেনারেল যশ মোর প্রমুখরা এক সম্ভাব্য বিপর্যয়ের ছবি এঁকেছেন।

প্রথম কথা হল, মাত্র ছয় মাসের মধ্যে প্রশিক্ষণ দিয়ে একজন অগ্নিবীরকে লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুত করা সম্ভব! সেনাতে একটা কথা সবার জানা ন্যূনতম সামরিক দক্ষতা (basic military skill) অর্জন করতে নিদেনপক্ষে দশ মাস সময় দরকার। আর যুদ্ধের জন্য তৈরি হতে দুই বছর। আবার নৌ ও বিমানবাহিনির ক্ষেত্রে (যেখানে আধুনিক প্রযুক্তির প্রয়োগ সর্বাধিক) সময়টা কম করে চার বছর। তাহলে এই অগ্নিবীররা আদতে কী শিখবে? অবসরপ্রাপ্ত সেনা আধিকারিকদের আশঙ্কা এরা সাধারণ জেনারেল ডিউটি সেনাতে পরিণত হবে এবং যুদ্ধের জন্য যোগ্য হয়ে ওঠার আগেই তাদের সেনাতে কর্মজীবন শেষ হয়ে যাবে। এক্ষেত্রে উদাহরণ দিয়ে একজন বলেছেন যদি অগ্নিবীরদের কর্মজীবনের মেয়াদ ৪৮ মাস হয়, তার মধ্যে ৬ মাস ট্রেনিং। বাকি ৪২ মাসের মধ্যে সেনার নিয়ম অনুযায়ী ৮ মাস ছুটি ও ২ মাস ক্যাজুয়াল লিভ। তাহলে তারা প্রকৃতপক্ষে ডিউটি করতে পারবে মাত্র ৩২ মাস। এভাবে যদি চলতে থাকে তাহলে অনেকে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন ২০৩২ সালের মধ্যে ভারতীয় সেনা দক্ষতা অর্জন তো দূরের কথা,এক ‘কিন্ডারগার্টেন ফোর্স’-এ রূপান্তরিত হবে।

দ্বিতীয়ত, অনেকের অভিযোগ এইভাবে চার বছরের ইন্টার্নশিপ সেনা চালু হওয়া ভারতীয় সেনার সংস্কৃতি ও শৃঙ্খলায় একটা বড় আঘাত হানবে। প্রকৃত যুদ্ধের ময়দানে একজন স্থায়ী সেনা ও চুক্তিসেনার মধ্যে জরুরি সহমর্মিতা ও সহযোগিতা গড়ে উঠবে না। কোনও রেজিমেন্টেই এটা নিয়ে ঐক্যের পরিবেশ গড়ে উঠবে না। অবসরপ্রাপ্ত আধিকারিকদের অনেকেই সঙ্গত কারণে প্রশ্ন তুলেছেন একজন চুক্তিসেনা, যার জানা নেই কদিন পর তার চাকরিটাই থাকবে কি না, সে কি যুদ্ধের ময়দানে সুস্থির থাকতে পারবে!

তৃতীয়ত, সবাই অভিযোগ তুলছেন এই প্রকল্পের একটা অঘোষিত উদ্দেশ্য হল পেনশন ও আনুষঙ্গিক খরচ কমানো। নয়া-উদারবাদী অর্থনীতির নিয়ম মেনে স্থায়ী চাকরিকে ঠিকাকরণে রূপান্তরের যে পরিকল্পনা কেন্দ্রীয় ও রাজ্য স্তরে নেওয়া হয়েছে, অগ্নিপথ তার আরেকটি প্রয়োগ মাত্র।

 

শাসকের নীল নকশা

এখনও পর্যন্ত আলোচনায় পরিষ্কার যে প্রতিবছর এক বিপুল সংখ্যক চুক্তিসেনা বা অগ্নিবীররা সেবানিধি প্রকল্পে তাদের পাওনা বুঝে নিয়ে বেকার অবস্থায় ঘরে ফিরে আসবে। এই ভয়ঙ্কর কর্মহীন সময়ে তাদের বেশিরভাগ সরকারি বা বেসরকারি সংস্থায় পুনরায় নিযুক্ত হবেন না— এটাই বাস্তবতা। তাহলে ন্যূনতম সামরিক শিক্ষণপ্রাপ্ত এই অগ্নিবীরদের কেউ অন্যভাবে ব্যবহার করবে না তো! এই আশঙ্কার তীর অবশ্যই আজকের হিন্দু ফ্যাসিবাদী শক্তির দিকে যাবে। এক্ষেত্রে স্বাভাবিকভাবেই আলোচনার মধ্যে নাৎসি জার্মানির এস এস বাহিনির কথা উঠছে। ইহুদিদের প্রতি ঘৃণা ও বিদ্বেষের রাজনীতিকে প্রতিষ্ঠা দিতে, কমিউনিস্টদের গণশত্রু প্রমাণ করতে এবং দাঙ্গাহাঙ্গামা, খুন-জখম করে বিরুদ্ধ মতকে স্তব্ধ করতে হিটলারের এই বাহিনির এক ভয়ঙ্কর ভূমিকা ছিল। ইতালিতে মুসোলিনির অন্যতম অস্ত্র ছিল ব্রাউন শার্টের দল। ইতিহাস দেখায় এই বাহিনিগুলির সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ ছিল প্রাক্তন সেনারা। একথা কোনও গোপন খবর নয় যে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ মতাদর্শগতভাবে এই ফ্যাসিবাদী মডেলকে অনুসরণ করে। এদের অন্যতম তাত্ত্বিক নেতা সাভারকারের বক্তব্য ছিল হিন্দুদের সামরিকীকরণ ও ভারতীয় সেনার হিন্দুকরণ। সংঘের প্রথমদিককার অনেক নেতা (যাদের মধ্যে মুঞ্জে প্রধান) স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে সংঘের পক্ষ থেকে সামরিক স্কুল খোলার চেষ্টা করেছেন। এই মুহূর্তে যেভাবে ভারতকে এক সামরিক, ফ্যাসিবাদী, হিন্দুরাষ্ট্রে পরিণত করার প্রয়াস চলছে তাতে অগ্নিপথ শাসকদের কাছে এক সরবরাহ লাইনের জোগান দেবে। ইতিমধ্যেই সংঘ পরিবার এই প্রকল্পের প্রচারে নেমে পড়েছে ও যুবকরা যাতে এই প্রকল্পে যুক্ত হয় তার জন্য হেল্প ডেস্ক খোলার ঘোষণা করেছে। এখনও পর্যন্ত স্বতঃস্ফূর্ত বিরুদ্ধতা অবশ্যই সরকারকে চাপের মুখে ফেলেছে। এই প্রকল্পকে প্রত্যাহারের দাবিটা যদি গণতান্ত্রিক মূল্যবোধে বিশ্বাসী মানুষের দাবি হয়ে উঠতে পারে তবে তা অবশ্যই মৌলবাদ ও নয়া-উদারবাদী আগ্রাসনের বিরুদ্ধে চলমান লড়াইয়ে শক্তি জোগাবে।

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4880 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...