শুভঙ্কর দাশশর্মা
শুভঙ্কর দাশশর্মার মফস্বলের নাটকের দল থেকে পথচলা শুরু। বেশ কিছু প্রযোজনায় অভিনয়ের সঙ্গে নাট্যরচনা ও নির্দেশনায় মনোনিবেশ। বিভিন্ন লিটল ম্যাগাজিনের জন্য কবিতা, গল্প রচনা করেছেন। পরবর্তীতে মিনার্ভা রেপার্টরি থিয়েটারে ক্যাজুয়াল আর্টিস্ট হিসাবে যোগদান। একই সঙ্গে অরুণ মুখোপাধ্যায়ের নির্দেশনায় বেশ কিছু নাটকে অভিনয়ের অভিজ্ঞতা সঞ্চয়। ‘রস’ নাটক রচনার জন্য সায়ক থেকে শ্রেষ্ঠ নাট্যকারের পুরষ্কার লাভ। পেশাগতভাবে বিজ্ঞাপন ও ছবির স্ক্রিপ্ট লিখলেও থিয়েটারই প্রথম পরিচয়। মিনার্ভা রেপার্টরি থিয়েটারের বর্তমান প্রযোজনা, অরুণ মুখোপাধ্যায় নির্দেশিত ‘খড়ির গণ্ডী’ (ব্রেখটের The Caucasian Chalk Circle অবলম্বনে) নাটকের বঙ্গীকরণ করেছেন।
বাংলা থিয়েটারের ব্যাপারটা বেশ বড়সড় পরিধির ব্যাপার। গুটিকয়েক সরকারি হলকে কেন্দ্র করে কেন্দ্রীভূত ক্ষমতার কায়েমি প্রয়োগ, হল না পাওয়ার হাহাকার আর তাম্-ঝাম্ সর্বস্ব দশ-বারোটা প্রোডাকশন, এইসবের বাইরে থিয়েটারের একটা বহুধাবিস্তৃত যাপনের ইতিহাস আছে। মাঝেমাঝে আকাশের দিকে তাকালে মনে হয় এই বিরাট আকাশে কোটি কোটি নক্ষত্রের সমাবেশে কতটুকু এই পৃথিবী! আর আমরা তো ধূলিকণা মাত্র, জলকণা মাত্র। মনে হয়, দল বেঁধে মেঘ হয়ে উঠি অথবা বৃষ্টি হয়ে ঝরে পড়ি। তাই আমাদের থিয়েটার হয়ে ওঠে সমবেত চর্চার মিলনভূমি।
আমাদের একদল ছেলেমেয়ে দু’চোখে স্বপ্নের কাজল প’রে, প্রত্যাশায় বুক বেঁধে থিয়েটার নিয়ে ভাবে। কেন ভাবে? ব্যক্তিগত প্রতিষ্ঠার লোভে? ওরা কি আর কিছুই পারে না? তাই থিয়েটারে নাম কিনে পাড়া মাতাতে চায়? নাকি থিয়েটার একটা মিলিত স্বপ্নের বীজ? এক থেকে বহু হয়ে ওঠার নিরন্তর চেষ্টা?
যে কোনও শিল্পের প্রাথমিক শর্ত বিনোদন। থিয়েটারেরও তাই। আজ অব্ধি যে যে ভালো থিয়েটার মানুষের মন ছুঁয়েছে তাতে মানুষ বিনোদিত হয়েছে। তবে বিনোদনই থিয়েটারের একমাত্র শর্ত হতে পারে না। প্রত্যক্ষে বা পরোক্ষে থিয়েটার আমাদের স্বাধীন বা পরাধীন অস্তিত্বের সাথে এক চিরন্তন সংযোগস্থাপনকারী মাধ্যম।
কমার্শিয়াল থিয়েটার থেকে গণনাট্য-নবনাট্য গ্রুপ থিয়েটার পেরিয়ে এই শতাব্দীর থিয়েটার এক অদ্ভুত চরিত্র নিয়েছে। সেমি-কমার্শিয়াল, সেমি-আ্যমেচারিস্, মালিকানা-নির্ভর, অলাভদায়ক, অনুদানপুষ্ট (আদতে অপুষ্ট), প্রযোজনাভিত্তিক, ব্যক্তিতান্ত্রিক এক শিল্পমাধ্যম হয়ে উঠছে আমাদের বাংলা থিয়েটার। তারই মাঝে গজিয়ে উঠেছে কিছু বেশি ক্ষমতাসম্পন্ন ও কম ক্ষমতাসম্পন্ন থিয়েটার মাফিয়া। এঁরা একই পথের পথিক। কায়েমি স্বার্থের তাগিদে কখনও বন্ধু, কখনও আবার শত্রু। এঁদের পারস্পরিক সম্পর্ক ভোটে লড়া রাজনৈতিক দলগুলোর মতো। তাই এদের আছে ক্যাডারবাহিনী। এঁরা নাট্যদালাল পরিবেষ্টিত। এঁরা সরকারি সুবিধায় লালিত ও লালায়িত। এঁরা অযোগ্য তৈলপাটকারিদের তোষামোদে দন্তবিকাশ করেন (কখনও হাসেন আবার কখনও বা দাঁত খিঁচোন), এঁরা ভগবান সাজতে চান এবং এঁরাই পরমেশ্বর-পরমেশ্বরী হয়ে গন্ধ শুঁকে বলে দেন শিল্পসংস্কৃতির মন্দ-ভালোর খতিয়ান। এঁদের কেউ কেউ আবার রাজনৈতিক নেতা-নেত্রী এবং দাপুটে। এঁদের বড় বড় পদ আছে, তাই পদলেহনকারীর সংখ্যাও কম নয়। তাই ব্যক্তি যখন ক্ষমতার উৎস তখন উদগ্র ও উলঙ্গ শাসানির বিরুদ্ধে কলম উঁচিয়ে ধরাটা জরুরি মনে হল।
ক্ষমতার দখলদারি নিয়ে এঁদের যাবতীয় মাথাব্যথা, এ বলে আমার থিয়েটার, ও বলে আমার। কিন্তু আমরা তো জানি, ‘রাস্তা কারোর একার নয়’।
দাদাদিদিদের বড়ই কুত্তা পোষার শখ, কুত্তাদের বড়োই পা চাটার শখ। কাজেই খাপে-খাপ, খেয়োখেয়ি চালু। এরা যারপরনাই খেয়োখেয়িপ্রবণ, তবে নিজেরা বিপদে পড়লে বলেন, ‘খেয়োখেয়ি যেন বাইরে বেরিয়ে না আসে’। এরা ইন্টেলেক্টের পরাকাষ্ঠা,এঁরা রাজনৈতিকভাবে সংকরপ্রজাতির অপরচুনিস্ট্,তাই মানুষের যাপনের দর্শন আর শাসনের দন্তনখ(প্র)দর্শন মিলিয়ে মিশিয়ে ঘেঁটে দেন,ইতিহাস বিকৃত করেন সুবিধামতোন। এঁরা ডোবারম্যান বলয়ে সুরক্ষিত থাকেন। এঁদের কাছের লোকেরা সুযোগসন্ধানী তঞ্চক। এ কমিটি সে কমিটি অলংকৃত করেন। এঁদের কেউ কেউ সরকারি হলকে দলীয় সম্পত্তি বানিয়ে তোলেন আবার কেউ কেউ পেয়ারের ভাইকে বানান সরকারি প্রশিক্ষণ শিবিরের প্রশিক্ষক। এঁদের নির্লজ্জ আত্মকেন্দ্রিকতা ও স্বজনপোষণ জন্ম দেয় ভুঁইফোড় কিছু ধড়িবাজের। এঁরা চাইলেই খাজা নাটকের একশো রজনী পার হয়, কল শোয়ে কলকল করে বেনোজলের বুদ্বুদ। এঁরা চাইলেই ভালো নাটকের শো যে কোনও দিন বন্ধ হয়ে যেতে পারে। যে কোনও দলের সামান্য অনুদান পিছলে যেতে পারে। তাই সাবধান, এদের ঘাঁটাবেন না, প্রচুর গন্ধ বেরোবে।
মিনার্ভা নাট্যসংস্কৃতি চর্চাকেন্দ্র আয়োজিত কর্মশালায় ঘটে যাওয়া ঘটনা একটা উদাহরণ মাত্র।
ঘটনাটা সবাই জানে। রেপার্টরি থিয়েটারের আর্টিস্ট নির্বাচনের জন্য কেন্দ্রীয় কর্মশালার আগে জেলায় জেলায় কর্মশালা হয়।বর্ধমান-বীরভূম জেলার কর্মশালা হচ্ছিল বর্ধমানের রবীন্দ্রভবনে।সেখানেই ওয়ার্কশপ চলাকালীন(৮থেকে ১২ অক্টোবর) মদ্যপ হয়ে জনৈক প্রশিক্ষক প্রেমাংশু রায় ছাত্রদের সাথে দুর্ব্যবহার আর ছাত্রীদের সর্বসমক্ষে মানসিকভাবে যৌনহেনস্থা করেন।মধ্যরাতে নিজের ঘরে ডেকে কুপ্রস্তাব দেন।ছাত্রীদের জানান,তাঁর সাথে একঘন্টা শুলে এক বছরের জন্য সরকারি রেপার্টরির চাকরি পাওয়া যাবে।এমনকি প্রাণনাশের হুমকি দেন,বলেন তাঁর অবাধ্য হলে প্রভাবশালী ব্যক্তির(অনেকেই তাঁকে বাংলা থিয়েটারের অভিভাবক বলে ঘোষণা করেন) সাহায্যে ওদের থিয়েটার করাই নাকি বন্ধ করে দেবেন।চারদিন ধরে এসব তাণ্ডব চলার পর পঞ্চম দিন ভোররাতে সন্ত্রস্ত ছেলেমেয়েরা ফেস-বুক লাইভে এসে এসব জানায়। বাংলার নাট্যকর্মী আর সমাজকর্মীরা প্রতিবাদে সামিল হয়।এখন আস্তে আস্তে বোঝা যাচ্ছে প্রেমাংশুর হুমকি নেহাত অমূলক নয়।এমনকি আমার আর নাট্যনির্দেশক সঙ্গীতা পালের বিরুদ্ধে প্রেমাংশু রায় মানহানি মামলার হুমকি দিয়েছে।
এটাই ক্ষমতার প্রচলিত কায়দা।গোষ্ঠী থেকে ব্যক্তিকে বিচ্ছিন্ন করো,হামলা করো,মামলা করো।কিন্তু জেনে রাখো, আধিপত্যের আস্ফালন আর মদতদাতার অভিসন্ধি ফাঁস হয়ে গেছে। জেলায় জেলায় গড়ে উঠছে প্রতিবাদ-প্রতিরোধ।
এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে আমাদের প্রতিবাদ সত্যিই উদ্দেশ্যপ্রবণ। কারণ ডুবো পাহাড়ের মাথায় গজিয়ে ওঠা একটি আগাছার নাম প্রেমাংশু রায়। সবশেষে একটাই কথা বলার। কথাটা আমার নয়, অন্যের শিখিয়ে দেওয়া কথা—
‘Trusting in the power
lasts for long
but long is not for ever’
— Bertolt Brecht