অরুণপ্রকাশ রায়
পূর্ব প্রকাশিতের পর
নবম পর্ব
এই ধারাবাহিকে এর আগে অনেকবারই ‘কিরপা করো মহারাজ’-এর উল্লেখ এসেছে। পুনরুক্তি মার্জনীয়, ফের আবারও সে কাওয়ালির রেফারেন্স আনতেই হচ্ছে। আজমেঢ়-এর দরগায় ‘কিরপা করো মহারাজ’-এর বহু ভার্সন শুনেছি, তবে বাহাউদ্দিন কাওয়ালের গাওয়া, অখ্যাতনামা এক লেখিকার রচনা এই কাওয়ালিটির সত্যিই কোনও জবাব নেই। লেখিকা এই জন্য লিখছি, কারণ কোথাও একটা পড়েছিলাম— কোনও এক সন্তানহীনা মহিলা খাজাসাহেবের চৌকাঠে বসে স্বরচিত এই রচনাটি বারংবার চোখের জল ফেলতে ফেলতে ইবাদত হিসেবে পেশ করে বরপ্রাপ্ত হয়ে সন্তানলাভ করেছিলেন। যতবার শুনি সে গল্প, গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে। আমার মতো ঘরছাড়া কিছু মানুষ হয়তো রেসোনেট করতে পারবেন এই গানটির সঙ্গে, বেঙ্গালুরু বা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কোনও ঝাঁ-চকচকে শহরে বসে।
হম ওছে সব বাত কে, সো তুম পুরে মহারাজ।
আপনি ওর নিবাহীও, সো বাঁ পাকড়ে কি লাজ।
পাত্তা টুটা ডাল সে, সো লে গয়ি পবন উড়ায়ে।
অবকে বিছড়ে কব মিলেঙ্গে, দূর বড়ে হ্যায় আয়।
আর কখনও পারলে বহু শিল্পীর গলায় হাজারবার শোনা ‘ছাপ তিলক’ যা হজরত আমির খুসরোর স্বাক্ষর, বাহাউদ্দিন সাবের উপস্থাপনায় শুনে দেখবেন— নানা রাগ, নানা গায়নশৈলীর এক অনবদ্য সমাহার এই গানটি।
ঘটনাচক্রে মনে পড়ে গেল একটি হিমাচলি লোকগীতির কথা। ‘আউন তা গালানিয়া সাচ বো, মারে বাঙ্কুদেয়া চাচুয়া’— বাংলা অনুবাদ করলে কতকটা এরকম দাঁড়াবে ‘বারে সত্যি কথাটা বলেই ফ্যালো বা ঝেড়ে কাশো তো, আমার বঙ্কু-র বাবা।’ স্বামীকে সন্তানের পিতা বলে অভিহিত করাটা গ্রামবাংলার এক অতি পুরনো প্রথা, তাই না? তবে বাবাকে চাচুয়া বলে ডাকাটা কিন্তু বেশ হিমাচলি! সে যাক, মোদ্দা কথাটা হল এই যে, এই লোকসঙ্গীতটির সুর ও ‘ছাপ তিলক সব ছিনি রে মোসে নয়না মিলাকে’ গানটির অদ্ভুত সাদৃশ্য। তবে এ বলতে পারব না যে, কে আগে সুরারোপ করেছিলেন এই গান দুটিতে, বা কেই বা অনুকরণ করেছিলেন প্রথম দুটি পংক্তিতে। রেকর্ডিং রাখলাম। আর ‘ছাপ তিলক’ এর সঙ্গে অসম্ভব মিল আরও একটি প্রবাদপ্রতিম বলিউড ফিল্মি গানে, ‘ইনহি লোগো না লে লিনা দুপাট্টা মেরা।’ খুসরো তাঁর জীবদ্দশায় কাওয়াল বাচ্চোঁ কা ঘরানা সৃষ্টি করেও ক্ষান্ত হননি, ছাপ রেখে গিয়েছেন আধুনিক গান ও লোকসঙ্গীতেও, সবার অজান্তে।
আমার এক মামা, শ্রী মলয় দাশগুপ্ত, একেবারে আওয়াল দরজা-র সঙ্গীতরসিক ছিলেন, এবং অভাবনীয় কল্পনাশক্তির অধিকারী। ২০০৯ সালে একবার হঠাৎ জিজ্ঞেস করেছিলেন যে, ”আচ্ছা বল তো দেখি, একটা ঝাঁকড়াচুলো লোক একটা সুফি গান গাইছে কিছু একটা বাজিয়ে আর অনতিদূরে একটা পাথরের আড়ালে এক নিষ্ঠূর আততায়ী বন্দুক নিয়ে তাক কষছে, কোন গানটা রে?” আমি হতচকিত হয়ে অনেক মাথা-টাথা চুলকেও কোন সন্তোষজনক জবাব দিতে পারিনি। পরবর্তী প্রশ্নটিও আউট অফ সিলেবাস, “‘দয়াল বাবা কলা খাবা গাছ লাগাইয়া খাও’, এ গানটা ইউটিউবে শুনেছিস?” বলাই বাহুল্য যে, এরও উত্তর তখন আমার কাছে ছিল না। গতবছর কৌশিক নামে জনৈক শিল্পীর গাওয়া এক বাংলা কাওয়ালি দুর্ঘটনাক্রমে শুনে ফেলে মনে পড়েছিল রাঙামামার কথা। ‘কাল্ব’ অর্থাৎ ‘হৃদয়’, আর ‘কলা খাবা’ খুব সম্ভবত ‘কিবলা কাবা’ মানে কাবা-র দিক্নির্দেশ পশ্চিম দিক। তা কৌশিক বেশ গেয়েছেন কিবলা-কে অজান্তে ক্যাবলা অভিহিত করে। গানটা সত্যিই কিন্তু সুফিয়ানা কাওয়ালি ছিল কোনও এক প্রাচীনকালে। ‘আয়না বসাইয়া দে মোর কলবের ভিতর, দয়াল বাবা কিবলা কাবা আয়নার কারিগর’ কিন্তু যে সে লেখা নয়। যদি শিল্পীরা লিরিক-এর কিছুটা কদর করেন অথবা শ্রদ্ধেয় লোকসঙ্গীতশিল্পী ও বন্ধুবর অভিজিৎ বসুর সঙ্গে একবার আলোচনা করে নেন, তা হলে বাংলা সুফিসঙ্গীত অনেক ঋদ্ধ হবে, এ নিশ্চিত।
এ ব্যাপারে আমাদের প্রতিবেশী রাষ্ট্র বাংলাদেশের গবেষণা নিঃসন্দেহে অনেক উঁচুদরের। বছর চারেক আগে একবার আপিসের কাজে ঢাকা গিয়েছিলাম, সহকর্মীদের কাছে তাপস নামের এক কম্পোজার-মিউজিশিয়ানের কথা শুনে গান বাংলা প্লাটফর্মটির সঙ্গে পরিচয় হয়। এটি প্রায় বাংলাদেশি কোক স্টুডিওর সমার্থক। দারুণ রিসার্চ ও ফিউশন, কৈলাশ খের থেকে বাঁশি-র রসিকা শেখর— বহু ভারতীয় শিল্পী আছেন এই প্রজেক্টে, উপরি পাওনা বাংলাদেশের বাউলদের গিমিক-ফ্রি পরিবেশনা গান বাংলার ভিডিওগুলিতে। শুনে দেখবেন কেমন লাগে।
ঢাকা এয়ারপোর্টে আমার একটি অতিপ্রিয় চশমার খাপ হারিয়ে গিয়েছিল, এখন বুঝতে পারি, কেন। ইমিগ্রেশন অফিসারের সঙ্গে শাহ আব্দুল করিম, হাসান রাজা আর লালন নিয়ে আলোচনার সময় কেই বা চশমার খাপের কথা খেয়াল রাখে! রাঙামামার দূরদর্শিতা আমাকে এখনও অবাক করে দেয়, উনি কি তেরো বছর আগেই অনুমান করে ফেলেছিলেন যে, কৈলাশ খের তাঁর ‘টুটা টুটা এক পুরিন্দা আয়সে টুটা’ ছেড়ে ‘গান বাংলায়’ লোকসঙ্গীতশিল্পীদের সঙ্গে জ্যামিং করবেন?
এবারে ফিরে আসি এক সুফিয়ানা সফরের গল্পে। সালটা বোধহয় ২০১৬, আজমেঢ় গিয়েছিলাম এক বন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে। দরগাহ থেকে কিলোমিটার দুয়েক দূরে একটি হোমস্টেতে ছিলাম, আমার থাকার ঘরের এককোণে ধুলোমাখা একটি বুকশেল্ফে গোটাকতক কবিতার বই ছিল, তার একটি ছিল ‘দা নেগলেক্টেড পোয়েট্রিজ অফ গুলজার’, তার মধ্যে থেকে একটি আবৃত্তির লিঙ্ক রাখলাম, ‘সর্দি থি ঔর কোহরা থা, গুলজার’ গুগল-এ টাইপ করলে পুরো কবিতাটিও পেয়ে যেতে পারেন, ভাল লাগবে যদি পড়েন বা শুনে দেখেন। আমার আজমেঢ়ি বন্ধুটি একজন সুফি বক্তা, দেশবিদেশে তার ভক্তসংখ্যা প্রচুর। ছ ফুটের ওপর লম্বা, শুকচঞ্চুনাশা, আমার টুইটারতুতো আইফোনধারী এ-হেন বন্ধুটি দুনিয়া ঘুরে বেড়ায় ও অভিজ্ঞতা ধার দিয়ে থাকে লাখো অনুগামীদের।
সলমন চিশতি আজমেঢ় দরগার গদ্দিনশীন, একবার আমার এক পাঞ্জাবিনী বান্ধবী, আমার বাড়িতে সলমনকে দেখে বলেছিলেন, “ইয়ার অরুণ, পেহলে বাতা দিয়া হোতা কে তুমহারা দোস্ত ইতনা হ্যান্ডসম হ্যায় তো ম্যায় আচ্ছে কাপড়ে ডালকে, মেকআপ শেকাপ করকে আতি।” সে এক চিত্তির, খাবার টেবিলে বসে আমার বান্ধবীর চোখ আর সুফি সন্তের থেকে সরে না, আর সে বেচারা মাথা নিচু করে পরোটা দিয়ে মেটেচচ্চড়ি খেয়ে চলেছে। খেয়ে উঠে কোনওক্রমে আঁচিয়ে নিয়ে সে আমার গুরুগ্রামের ভাড়াবাড়ির সতেরোতলার ব্যালকনিতে ‘কিবলা’ খুঁজে সন্ধ্যাহ্নিক করতে বসেছিল সাদা কুর্তা-পাজামা পরে। হঠাৎ দেখি ব্যালকনি আলো করে সলমন নামাজ আদা করছে, এক দৈবী সূর্যাস্তকে সাক্ষী রেখে। ফোন-ক্যামেরায় বন্দি করে উঠতে পারিনি দৃশ্যটি, হাত থেমে গিয়েছিল সকলের। সলমন আমার বান্ধবীর উপরোধে তার নতুন কেনা অতিকায় মার্সেডিজকেও আশীর্বাদী পুঁতির মালা দিয়ে মন্ত্রপূত করে দিয়েছিল। আর বান্ধবীর মেয়ে মেহের (আমার মেয়েরই বয়সী), তাকে একটু মুচকি হেসে তার নামের মানে জিজ্ঞেস করেছিল। তা সে থতমত খেয়ে চুপ করে থাকাতে তার মাথায় হাত বুলিয়ে সলমন বলেছিল, “জানো, এই যে মেহরৌলি-গুরগাঁও রোড চলে গেছে এই বাড়ির পেছন দিয়ে, সে নামেরও একখান চমৎকার মানে আছে, ওয়ালিও কি মেহের, মেহের ও ওয়ালি, মেহরৌলি, কী দারুণ, তাই না?” বাকরুদ্ধ মেহের পরে আমার মেয়ে আরশিকে বলেছিল, “ওহ ওয়াও, হি ইজ সো কুল।” এয়ারপোর্ট অভিমুখে রওয়ানা হবার সময় সলমন দু হাত তুলে তার আরাধ্যের কাছে প্রার্থনা করেছিল আমার সপরিবার সুখশান্তি ও আমার বাসায় যাতে সবসময় অতিথিসমাগম লেগেই থাকে এবং আমার ‘দস্তরখান’ যেন ‘হামেশা’ ভরা থাকে। সেদিন ৪৫ ডিগ্রির গরমে হঠাৎ এক পশলা বৃষ্টি নেমেছিল। গাড়িতে বসার আগে বিড়বিড় করে পড়া সেই স্পেশাল ‘দুয়া’টি আমার কানে লেগে রয়েছে।
এই পর্ব শেষ করব ‘দস্তানগোই’ নামক একটি অবলুপ্ত প্রায় ত্রয়োদশ শতাব্দীর উর্দু গল্প বলার গল্প দিয়ে। সাদা পোশাক, সাদা কোনাচে টুপি, হাতের মুদ্রা, দিল্লির টাকশালি বা কারখানদারি বা বেগামাতি জবানে নেহাতই গল্পচ্ছলে বলা অনেক গভীর তত্ত্ব এই কলার বিশেষত্ব। দিল্লির ইন্ডিয়া হ্যাবিটট সেন্টারে আলাপ হয়েছিল সাদা চাইনিজ কলারের জামা ও জিন্স পরা এক দিব্যকান্তি যুবকের সঙ্গে। স্টেজ জুড়ে সে তার কি অসাধারণ বাগ্মিতা! যেন ভেসে বা উড়ে বেড়াচ্ছে স্টেজময়। আমরা দর্শক ও শ্রোতা মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনছি তার গল্প। আলাপ হয়ে গিয়েছিল ভালোরকম, অঙ্কিতের সঙ্গে। কখনও কোনও প্রোগ্রামে হয়তো পেছনের দিকে চুপিসাড়ে গিয়ে বসতে যাব, হঠাৎ কানে ভেসে আসত সাদর ভর্ৎসনা, ‘আরে হজরত, আগে আকরকে বৈঠে, ইস নাচীজ কা হৌস্লাফজাঈ করে, পিছে কাহে ছুপ রাহে হ্যায়?’
যতবার শুনেছি অঙ্কিত চাড্ডার দস্তানগোই, কানে লেগে রয়েছে ওর গলার আওয়াজ, ওর হাসি। আর চোখে লেগে রয়েছে অঙ্কিতের অনণুকরণীয় হাতের মুদ্রা আর অডিয়েন্স কানেক্ট। বছরকয়েক আগে এক সকালে, আমি তখন বেঙ্গালুরুতে, ফোন এল ঐতিহাসিক ও সুফি গবেষক রানা সাফভি-র। পুনেতে প্রোগ্রাম করতে গিয়ে এক ভরসন্ধেবেলা লেক-এর ধারে পায়চারি করছিল এক বন্ধুর সঙ্গে, অঙ্কিত। কোনওভাবে পা পিছলে জলে পড়ে যায়, সাঁতার জানত না ও, আর ফেরেনি কোনওদিন। রানাসাহিবা আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন যে, আমি লোদি রোড শ্মশানে শেষ দেখা দেখতে আসব কিনা, তিনি ভেবেছিলেন আমি গুরগাঁওতেই থাকি, আমি ওঁকে বলেছিলাম, উনি যেন আমার তরফ থেকে অঙ্কিতের কপালে একবার ভালবেসে হাত রাখেন। দুজনেরই গলা বুজে এসেছিল আমাদের।
চার বছর হয়ে গেল দেখতে-দেখতে, অঙ্কিতের সঙ্গে আর দেখা হয়নি। আমি আর কোনওদিন কোনও দস্তানগোইয়ের লাইভ অনুষ্ঠান শুনতে যাইনি, শুধু মাঝেমধ্যে ওর কথা যখনই মনে পড়ে, কানে হেডফোন লাগিয়ে ঘরের কোণে বসে একমনে শুনতে থাকি, অঙ্কিতকে। লিঙ্কটা অবশ্যই শুনুন, অঙ্কিতের টেড-টকের ভিডিও…
ও বলে গিয়েছে গল্প কখনও নিজের মধ্যে চেপে না-রাখতে, আমার প্রথম শ্রেণিতে পড়া ‘ভবম হাজাম’-এর গল্পের মতো। তাই গল্পের সফরকে, আর অঙ্কিতকে জিইয়ে রাখলাম আমার এই ধারাবাহিক কলমে।
[চলবে]