চোরা না শোনে

মন্দাক্রান্তা সেন

 

একটি ছায়াছবি। এখনও হয়নি। হচ্ছে। ধর্মান্ধ মৌলবাদীরা সেখানেই ঝাঁপিয়ে পড়ল। এরা শিল্প বোঝে না। সৃজনশীলতার ধার ধারে না। বোঝে শুধু ধর্মের নামে হামলাবাজি। চিত্রপরিচালক সঞ্জয় লীলা বনশলীর নির্মীয়মাণ চলচ্চিত্র পদ্মাবতীর সেট আক্রমণ করে, পরিচালককে শারীরিক হেনস্থা করে এরা খুব বীরত্ব প্রকাশ করল। মূল লক্ষ্য একটি ড্রিম সিকোয়েন্স। শিল্পের কারণে একে সৃষ্টি করা যেতেই পারে। সঞ্জয় কখনও দাবি করেননি তিনি ইতিহাস-বিশেষজ্ঞ। তিনি একজন সৃজনশীল ব্যক্তি। তাঁর শিল্পসৃষ্টিতে আঘাত মৌলবাদীদের সম্যক ঘৃণ্য পরিচয়। আমরা জানি আলাউদ্দিন খিলজি একজন বিকৃত লম্পট ছিলেন। রানী পদ্মাবতীর মতো এক ভুবনমোহিনী রূপসীকে কামনা করা তার পক্ষে স্বাভাবিক। এতে ইতিহাস বিকৃত করার প্রশ্ন ওঠে না। বরং তা বিশদ হয়। ইতিহাস শুধু রাজা-রাজড়ার যুদ্ধের কথা বলে, মানুষের ব্যথা-বেদনা-লোভ-লালসা-স্বপ্ন-হতাশার বিবরণ তাতে নেই। সেটা কল্পনা করেন শিল্পী। সেখানেই ইতিহাস বইয়ের পাতা থেকে বেরিয়ে জীবন্ত জাগ্রত হয়ে ওঠে। জানি না বনশলী এই ফতোয়া মেনে আপোষ করবেন কিনা। কিন্তু আমরা তাঁর পাশে আছি।

হিন্দু মৌলবাদীদের আরেকটি সাম্প্রতিক বক্তব্য তাজমহল নিয়ে। যে তাজমহল সারা পৃথিবীর কাছে ভারতের একটি প্রতীকস্বরূপ, সেটা নাকি ভারতীয় সংস্কৃতির কলঙ্ক। এবং সেটা নাকি আদতে একটা শিবমন্দির ছিল। তাই সেখানে শিবের স্তোত্রপাঠও শুরু হয়ে গেল। হে হিন্দুধর্মের আরাধ্য তেত্রিশ কোটি দেবদেবী, তোমাদের ধ্বজাধারী শিষ্যদের ঘটে কি একটুও বুদ্ধিশুদ্ধি জ্ঞানগম্যি দিতে নেই! প্রস্তাবিত হয়েছে তাজমহলের নাম বদলে তাজ মন্দির করা হবে। এবার, ইতিহাস বিকৃত করছে কারা? যে-কোনও কিছুকে মন্দির বানানোই এদের মোক্ষ। কোনদিন দেখবেন সুলভ শৌচালয়কে মন্দির বলে দাবি করা হচ্ছে।

ইসলামী মৌলবাদীদেরও বলিহারি। বাদুড়িয়াতে কালীপুজোর দিন তারা মণ্ডপ আক্রমণ করে বসল। মূর্তি ভেঙে দিল। এরা কী মনে করে? যা ইচ্ছা করে পার পেয়ে যাবে আমরা হিন্দু মৌলবাদকে ঘৃণা করি বলে? তার বিরুদ্ধে সবিশেষ গলা ফাটাই বলে? এরাও সমান ঘৃণ্য। তাৎক্ষনিক তিন তালাককে আদালত অবৈধ ঘোষণা করল। কিন্তু এরা তা মানে না। এরা শরিয়তকে নিজেদের সুবিধেমতো ব্যবহার করে। নারীর অধিকার খর্ব করে। ইসলাম ধর্মে সুদ নেওয়া নিষেধ হলেও আর পাঁচজন লোকের মতো ব্যাঙ্কে টাকা রেখে সুদ নেয়। ভারতের সংবিধান রচনার সময় ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের স্পর্শকাতর গোষ্ঠী ঠাউরে তাদের অন্যায় সুবিধা দেওয়া হয়েছে। একই সার্বভৌম দেশে আইন অভিন্ন হওয়াই তো বাঞ্ছনীয়! কে শোনে কার কথা। কথায় বলে না, চোরা না শোনে ধর্মের কাহিনী!

আমরা যখন সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির কথা বলি, একটা কথা প্রায় সবাই বলেন, কোনও ধর্ম হিংসার কথা বলে না। আমি বিরুদ্ধমত পোষণ করি। হিন্দু ধর্মের মহাকাব্যে দেখি কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ শুরু হওয়ার প্রাক্কালে মানসিক অবসাদে ভেঙে পড়া অর্জুনকে কৃষ্ণ যুদ্ধের অবশ্যম্ভাবিতার কথা বলে চাঙ্গা করছেন। কৃষ্ণের মতে, যুদ্ধের নিয়তি আগে থেকেই ঠিক করা আছে। যোদ্ধা বা মানুষ তার কুশীলবমাত্র। এই উপদেশসমূহই হিন্দুদের ধর্মগ্রন্থ শ্রীমদভগবৎগীতা। অর্থাৎ প্রয়োজন অনুসারে হিংসা কর্তব্য। আবার ইসলামের গোড়াপত্তনই হিংসার মাধ্যমে। ছোট ছোট পরস্পর বিবদমান আরব গোষ্ঠীগুলিকে এক ছাতার তলায় একত্রিত করতে নবী হজরত মহম্মদকে তরবারি ব্যবহার করতে হয়েছিল। অর্থাৎ দুই ধর্মের আদিযুগে হিংসার কথা আছে। কিন্তু এটা কোনও যুক্তি নয় যে আজও তার প্রয়োজনীয়তা আছে। তাছাড়া পূর্ববর্তী যুগে যে হিংসার কথা বললাম তা অন্তর্ধর্মীয়, ধর্মগুলির নিজেদের মধ্যে। তা আন্তঃধর্মীয় নয়। ইতিহাসে যে বড় বড় যুদ্ধগুলি ঘটে গেছে, তা রাজায় রাজায় যুদ্ধ। তাতে ধর্মের কোনও ভূমিকা ছিল না। মুসলমান বাদশার সেনাপতি হিন্দু, হিন্দু রাজার মিত্র মুসলমান, এরকম উদাহরণ ভারতের ইতিহাসে ভুরি ভুরি। গজনীর মাহমুদ সোমনাথ মন্দির লুঠ করেছিলেন, সেখানে মসজিদ স্থাপন করেননি। যেরকম বাবরও অযোধ্যার রামমন্দিরে বাবরি মসজিদ স্থাপন করেননি। ঔরঙ্গজেব জিজিয়া কর চালু করেছিলেন। খুব খারাপ কাজ। কিন্তু কর না দিলে গণহত্যার কথা বলেননি। উপরন্তু এটাকে মুঘল সাম্রাজ্যের পতনের একটা কারণ হিসেবে ধরা হয়। এটা ধর্মনিরপেক্ষ মূল্যায়ন।

এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, সাম্প্রতিক সাম্প্রদায়িক হিংসা একটি রাজনৈতিক অভিসন্ধিজাত ঘটনা। ভোটব্যাংক টেনে যেনতেন প্রকারেণ ক্ষমতাদখলের চক্রান্ত। একটি ধর্মীয় মৌলবাদ অপর মৌলবাদের জন্মদাতা। বিশেষ করে মৌলবাদী উগ্রপন্থার। একটি জঙ্গি হামলার পর আরেকটি দাঙ্গা– দেশের শাসককুল তাই চায়। যেন দেশের মানুষের দারিদ্র্য নেই, ক্ষুধা নেই, মাথা গোঁজার ঠাঁইয়ের অভাব নেই, শিক্ষা-স্বাস্থ্য-কর্মসংস্থানে কোনও দুর্নীতি নেই, তাদের একমাত্র ভাবার বিষয় ধর্মে ধর্মে হিংসা। প্রায়ই দেখা যায়, ধর্মীয় মৌলবাদীরা কোনও না কোনও রাজনৈতিক দলের আশ্রিত। ধর্মের নামে এই রাজনীতি ধূর্ত ও সংগঠিত। এদের হারাতে গেলে শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষকে এর বিরুদ্ধে এককাট্টা হতে হবে। আমদের দেশের সংসদীয় গণতন্ত্রে ভোটের বাক্সে (বা যন্ত্রে) তার প্রতিফলন ঘটাতে হবে।

মানুষ আজ বিপন্ন, তা সে সঞ্জয় লীলা বনশলীই হোন, কিংবা আমি-আপনি। বনশলী স্বপ্ন দেখিয়ে আক্রান্ত হয়েছেন। আর আমাদের প্রকৃত স্বপ্ন অন্য। আমাদের স্বপ্ন এক সত্যিকারের সাম্প্রদায়িক হিংসাহীন ধর্মনিরপেক্ষ ভারতের। সেই স্বপ্নে কারও বাধা আমরা সহ্য করব না। এবং বিশ্বাস করব, সেই স্বপ্ন সত্যি হবে।

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4660 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

1 Comment

  1. লেখাটায় কিছুই পেলাম না। আপনি খুব রেগে গেছেন, এটাই বুঝলাম!

আপনার মতামত...