সুমন সেনগুপ্ত
প্রাবন্ধিক, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাস্তুকার
এই সময়টা মোবাইলের সময়, এই সময়টা হোয়াটসঅ্যাপের সময়। এই সময়ে রোজ নতুন নতুন তথ্য তৈরি হয়, আর তার মধ্যে থাকে কিছু সত্যি, কিছু অর্ধসত্যি আর কিছু মিথ্যে। একজন মানুষ যখন তাঁর মোবাইলে কোনও বার্তা পান, তা সত্যি না মিথ্যে যাচাই না করেই অনেক সময়ে তিনি তাঁর পরিচিতদের মধ্যে সেই বার্তা পাঠিয়ে দেন। রোজ আমরা এই ধরনের বহু বার্তা পেয়ে থাকি, কিন্তু কোন বার্তা ঠিক বা কোনটা ভুল তা না জেনে যদি আমরা এই ধরনের বার্তা পাঠিয়ে দিই, তার ফল যে ভয়াবহ হতে পারে, তার অজস্র উদাহরণ আমাদের কাছে আছে। ২০২১ সালের বাংলার নির্বাচনের আগে যখন বিভিন্ন জায়গায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার খবর পাওয়া যাচ্ছিল, তখন এই ধরনের বার্তা আসার প্রবণতা বেড়ে গিয়েছিল। এই সময়েই বসিরহাটে যখন দাঙ্গা পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়, তখন একটি ছবির ক্লিপ দেখিয়ে বলা হয়েছিল, সংখ্যালঘুরা হিন্দু নারীদের ধর্ষণ করছে, স্বাভাবিকভাবেই তা নিয়ে হইচই পড়ে যায়। আরও অশান্ত হয়ে ওঠে বাংলার বিভিন্ন জায়গা। সেই সময়েই অনেকে অল্ট নিউজের কথা জানতে পারেন। অল্ট নিউজ একটি সংস্থা, যাঁরা সম্পূর্ণ এককভাবে এই ধরনের খবর বা বার্তা যাচাই করে থাকেন। তাঁদের নিজস্ব পদ্ধতিও আছে, তা অত্যন্ত সরল, যে কোনও মানুষই এটা করতে পারেন। সেই সংস্থার অন্যতম কো-ফাউন্ডার হলেন মহম্মদ জুবেইর। সেই জুবেইর কিন্তু বসিরহাট দাঙ্গার সময়ে দেখিয়েছিলেন, যে বিজেপির আইটি সেল এবং বিজেপির মুখপাত্র নূপুর শর্মা যে টুইট করেছিলেন, বাংলায় মুসলমান মানুষজনের হাতে লাঞ্ছিত হচ্ছেন হিন্দু মহিলারা, তা একটি ভোজপুরি ছবির অংশ। তখন জুবেইর এবং অল্ট নিউজের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, এইরকম কোনও ঘটনা ঘটেনি, সুতরাং এই ধরনের বার্তা পেলে তাকে ভুয়ো বা মিথ্যে বলে ভাবতে হবে। পরে কলকাতা পুলিশ এবং বাংলার পুলিশের তরফ থেকেও বলা হয়, যে হ্যাঁ, ঐ ছবিটির সঙ্গে বসিরহাটের কোনও সংযোগ নেই, ঐ ছবিটি ভোজপুরি সিনেমার, এবং তা যেন শেয়ার না করা হয়।
এই ধরনের কাজ করাকে বলে স্বাধীন তথ্য অনুসন্ধানকারী বা ইন্ডিপেনডেন্ট ফ্যাক্টচেকার। যারা ভুয়ো খবর ছড়ান, তাদের কাছে এই ধরনের ইন্ডিপেনডেন্ট ফ্যাক্টচেকারদের উপস্থিতি বিপজ্জনক। তাই বিজেপির আইটি সেল থেকে এই ধরনের মানুষদের বিরুদ্ধে প্রচার করা হয়। এবার তাই অনেক চিন্তাভাবনা করে, এই মহম্মদ জুবেইরকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। বেশ কিছুদিন ধরেই তাঁর বিরুদ্ধে পুলিশে অভিযোগ করা হয়েছে বিজেপির পক্ষ থেকে। গ্রেপ্তারের দাবি করা হয়েছে, আর হবে না-ই বা কেন? তিনি তো বিজেপি এবং হিন্দুত্ববাদী শক্তির মিথ্যে প্রচারের সামনে মাথা নোয়াননি। তিনিই প্রথম, যাঁর কাছ থেকে আমরা জানতে পারি, টাইমস নাউ চ্যানেলে বসেই বিজেপির মুখপাত্র মুসলমানদের পয়গম্বর সম্পর্কে মিথ্যে কথা বলেছেন, যার ফলে আরব দেশের তরফ থেকে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীকে লক্ষ্য করে বক্তব্য রাখা হয়। চাপে পড়ে বিজেপির তরফ থেকে নূপুর শর্মা এবং নবীন জিন্দালদের ৬ বছরের জন্য দল থেকে সাসপেন্ড করাও হয়। এই সমস্ত অপমান কি বিজেপি সহজে হজম করতে পারে? তাই ২০১৮ সালের একটি টুইটকে ধরে বলা হয়, জুবেইরের টুইটটি ধর্মীয় ভাবাবেগে আঘাত করেছে, তার জন্য তাঁকে গ্রেপ্তার করা হল।
অনেকেই জানতে চাইতে পারেন, কী ছিল মহম্মদ জুবেইরের টুইটে? অনেকেই হয়তো হৃষিকেশ মুখার্জীর নাম শুনেছেন, এই সময়ের ছেলেমেয়েরা অনেকেই হয়তো শোনেননি। ১৯৮৩ সালে, তিনি একটি হিন্দি ছবি বানান, “কিসি সে না কেহনা”। সেই সময়ে আমরা ঐ ছবি দেখে অনাবিলভাবে হেসেছি। কিন্তু ২০১৪ সালের পরে এমন একটা সরকার এল, যে আমাদের হাসি কেড়ে নিল। সবকিছুতেই আমরা ধর্ম দেখি। আমাদের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত লাগে। ঐ ছবির একটি দৃশ্যের স্ক্রিনশট শেয়ার করেছেন ২০১৮ সালে। একজন টুইটার ব্যবহারকারী ২০২১ সালে টুইটারে যোগ দিয়ে সেই টুইট নিয়ে দিল্লি পুলিশকে অভিযোগ করেন। তার ভিত্তিতেই জুবেইরকে গ্রেপ্তার করা হয়। ‘হানিমুন হোটেল’-এর নাম বদল করে ‘হনুমান হোটেল’ হলে কি হনুমানের অবমাননা হয়? দিল্লি হাইকোর্টে মহম্মদ জুবেইরের আইনজীবীরা এই প্রশ্ন তুলেছেন, তাহলে গ্রেপ্তার করলে হৃষিকেশ মুখার্জীকে করতে হয়। কিন্তু পুলিশ সেসব শুনবে কেন? তাদের ওপরমহল অর্থাৎ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের চাপ আছে, জুবেইরকে গ্রেপ্তার করতেই হবে।
আরও যা ভয়ঙ্কর, তা হল যেদিনে জুবেইরকে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে, সেইদিনেই দেশের প্রধানমন্ত্রী বিদেশে গিয়ে, ভারতে কত বাকস্বাধীনতা আছে, তা নিয়ে বক্তব্য রাখছেন। কীভাবে বাকস্বাধীনতা রক্ষা করা জরুরি, তা নিয়ে বিশ্বের নেতাদের সামনে বক্তব্য রাখছেন। তার আগের দিন, তাঁর মন কি বাত অনুষ্ঠানে কীভাবে জরুরি অবস্থার সময়ে বাকস্বাধীনতা খর্ব করা হয়েছিল, তার উদাহরণ দিচ্ছেন, আর এদিকে মহম্মদ জুবেইরের মতো সাংবাদিককে কোনও কারণ ছাড়া গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। সবচেয়ে যেটা ভয়ঙ্কর, তা হল, জুবেইরের কম্পিউটার এবং ল্যাপটপের দখল চেয়েছে দিল্লি পুলিশ। এরপরে যদি সেই ল্যাপটপে বা কম্পিউটারে কোনও তথ্য ঢুকিয়ে দিয়ে বলা হয়, জুবেইর নাশকতা করতে চেয়েছিলেন, আমরা তো সেটাই বিশ্বাস করব। যে সত্য উদ্ঘাটনের কাজ তিনি এবং তাঁদের সংস্থা করে যাচ্ছিলেন, তা দেশের সরকারের চালিকাশক্তি বিজেপির জন্য অসুবিধা তৈরি করছিল, তাই জুবেইরকে গ্রেপ্তার করাটা জরুরি ছিল।
শুধু জুবেইর নয়, তার আগের দিন মানবাধিকারকর্মী তিস্তা শীতলওয়াড়কেও গ্রেফতার করার পিছনে একটাই যুক্তি, এই সরকার কোনও সমালোচনা সহ্য করতে রাজি নয়। সব ধরনের বিরোধী স্বরকে স্তব্ধ করতে তাঁরা বদ্ধপরিকর। ইন্দিরা গান্ধি, ১৯৭৫ সালে যে ভুলটা করেছিলেন, সেই ভুল নরেন্দ্র মোদি বা অমিত শাহ করবেন না, তাঁরা জরুরি অবস্থা ঘোষণা না করেও জরুরি অবস্থা কায়েম করেছেন। আমরা যাঁরা সামাজিক মাধ্যমে এর বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলছি, তাঁরা যদি ওই ভার্চুয়াল জগতের বাইরে বেরিয়ে না আসতে পারি, তাহলে ওঁরা কিন্তু রোজ জিতে যাবেন। জুবেইরের পরে আমি আপনি যে গ্রেপ্তার হব না, তার নিশ্চয়তা কি দেওয়া যাচ্ছে? সমস্ত গণমাধ্যম ওঁদের সঙ্গে, সঙ্গে আছে প্রচুর পরিমাণ অর্থ, তাই যে কোনও মিথ্যেকে ওঁরা সত্যি বলে চালিয়ে দিতে পারবে নিমেষে, আর তাই এই ধরনের স্বাধীন ফ্যাক্টচেকারদের আরও বেশি করে প্রয়োজন, যাঁরা সত্যিকে সামনে নিয়ে আসবেন নির্ভীকভাবে। রবীন্দ্রনাথ যে ভারতবর্ষকে কল্পনা করেছিলেন, চিত্ত ভয়শূন্য রেখে মুক্তবুদ্ধির চর্চার করা, মাথা উঁচু করে কাজ করার পরিবেশ এদেশে খর্ব হচ্ছে প্রতিদিন, সেটাই এই মুহূর্তে আমাদের সবচেয়ে বড় আশঙ্কার জায়গা।