স্বপন ভট্টাচার্য
প্রাবন্ধিক, গদ্যকার, অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক
এই লেখার বিষয় সম্পর্কে যে প্রশ্ন স্বাভাবিকভাবে উঠতে পারে তা হল, আমেরিকার গর্ভপাত মামলা নিয়ে আমরা এত চিন্তিত হয়ে পড়লাম কেন? খোলসা করে নেওয়া ভালো, সে দেশে গর্ভপাত মামলার রায় এল এই জুনের ২৪ তারিখে। ঠিক তার আগের দিন, অর্থাৎ ২৩ জুন নিউ ইয়র্কের কড়া আগ্নেয়াস্ত্র আইনকে সুপ্রিম কোর্ট ৬-৩ সংখ্যাগরিষ্ঠতায় জনগণের মৌলিক অধিকারের পরিপন্থী বলে ঘোষণা করে দিল। এবং এটা হল তখন, যখন পটাপট বাচ্চাদের স্কুলে ঢুকে গুলি করে মেরে দেওয়া শয়তান এবং অর্ধোন্মাদদের সংখ্যা সে দেশে জিওমেট্রিক প্রোগ্রেশনে বেড়ে চলেছে। ২৪ জুন ওই একই কোর্ট ৫-৪ সংখ্যাগরিষ্ঠতায় সে দেশের পঞ্চাশ বছরের অ্যাবরশন আইনসিদ্ধতা বাতিল করে দিল। মনে পড়ল, জো বাইডেন ক্ষমতায় আসার প্রেক্ষিতে ইউভাল নোয়া হারিরি-র একটা সাক্ষাৎকার শুনেছিলাম যাতে তাঁকে প্রশ্ন করা হয়েছিল— এই যে ডেমোক্র্যাটদের জয়, এটাকে কি আপনি সামাজিক স্তরে আমেরিকান জীবনে কোনও পরিবর্তনের সূচনা হিসাবে দেখতে চান? তিনি বলেছিলেন, একেবারেই না। বরং ট্রাম্প হেরে গিয়ে ট্রাম্পিয়ানার শক্তি বৃদ্ধি ঘটার সব সম্ভাবনাতেই আলো-বাতাস লাগার সুযোগ বেড়ে গেল, তার কারণ সেনেটে না হলেও রিপাবলিকানদের সুপ্রিম কোর্ট সংখ্যাগরিষ্ঠতা আমেরিকান জীবনকে সবরকমভাবেই প্রভাবিত করতে সচেষ্ট থাকবে। আমেরিকা এখন জাত, ধর্ম, গায়ের রঙের ভিত্তিতে গাঢ়ভাবে দ্বিবিভাজিত। সমাজে এসব ফল্টলাইন যে নতুন করে তৈরি হল তা নয়, কিন্তু তারা আর প্রসারিত হবে না এই অনুমান করাই তো যেত কালো পিতৃপুরুষের রক্তবাহী অভিবাসী কেনিয়ান উৎসের সন্তান বারাক ওবামা পরপর দুটি টার্ম নির্বাচনে জিতে আট বছর প্রেসিডেন্ট হিসেবে কাটিয়ে দেওয়ার পরে। কিন্তু ডোনাল্ড ট্রাম্পের চার বছর সেই সমাজকে এমন এক নির্ণায়ক মোড়ে এনে দাঁড় করিয়েছে যেখানে তিনি না থেকেও ব্যাপকভাবেই আছেন। শ্বেতস্বন্ত্রাস, বন্দুক এবং গর্ভপাত নিয়ন্ত্রণে ট্রাম্পের ছায়াপ্রতিনিধি হলেন তাঁর আমলে নিযুক্ত সুপ্রিম কোর্টের তিনজন বিচারপতি। স্মরণে রাখতে হবে ২০২০ নির্বাচনের ঠিক আগে ট্রাম্প তাঁর শেষ সফল ট্রাম্প কার্ডটি খেলেছিলেন সে বছরের সেপ্টেম্বরে জাস্টিস অ্যামি কোনে ব্যারেটকে সুপ্রিম কোর্টে রুথ গিনসবার্গের অবসরের পরে নিয়ে এসে। রুথ আমেরিকার নারীর গর্ভের স্বাধীনতাকে রাজ্য দ্বারা নিয়ন্ত্রিত করার ঘোর বিরোধী ছিলেন, কিন্তু অ্যামি সেই ২০০৬ থেকে বলে আসছেন তিনি সুযোগ পেলে এই গর্ভপাত আইনকে উল্টে দেওয়ার বাসনা রাখেন। ৯ সদস্যের বর্তমান সুপ্রিম কোর্টে ৬-৩ রিপাবলিকান সংখ্যাগরিষ্ঠতা গড় আমেরিকান নারী-পুরুষ, ধনী-দরিদ্র, সাদা-কালো— সকলের ক্ষেত্রেই নির্ণায়ক হয়ে দাঁড়াচ্ছে। পূর্বানুমান মিলে যাচ্ছে এই যা, নতুবা যা ঘটছে তা অপ্রত্যাশিত নয় একেবারেই। আমার আলোচনার বিষয় আইন নয়, যদিও আইনকে এড়িয়ে এই বিতর্কে ঢোকাই সম্ভব নয়, কিন্তু তার চেয়েও বেশি করে আমার দৃষ্টি আকর্ষিত হয়েছে বিজ্ঞানজগতের প্রতিক্রিয়ার প্রতি। নেচার বা সায়ন্সের মতো পত্রিকা সম্পাদকীয় ছাপছে এবং মাথা খুঁড়েও বোঝাতে পারছে না কতটা অবৈজ্ঞানিক এই রায়।
রো বনাম ওয়েড
যে মামলার রায় উলটে দিয়ে গর্ভপাত আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রে অবৈধ ঘোষিত হল তা রো বনাম ওয়েড (Roe vs Wade) কেস নামে প্রসিদ্ধ। আমেরিকার খ্রিস্টান সংখ্যাগুরুত্ব কিন্তু বর্ণনির্বিশিষ্ট— সেখানে কালোরাও মূলত খ্রিস্টান যদিও গর্ভপাতজনিত ‘হত্যা’ আর পটাপট গুলি চালিয়ে ‘হত্যা’ একই খ্রিস্টীয় ব্যাখ্যায় ভিন্ন-ভিন্নভাবে তারা বহুদিন ধরেই দেখে আসছে। গর্ভপাত, খ্রিস্টীয় মতে ‘হত্যা’— ভ্রূণহত্যা। “Before I formed you in the womb I knew you, before you were born I set you apart” (Jer. 1:5). Psalm 139:16— তুমি মাতৃগর্ভে আসার আগেই আমি তোমাকে জেনেছি, আমি তোমাকে স্বতন্ত্র করে গড়েছি, তোমার জন্মের আগেই— এই হল ঈশ্বরকথা। অতএব, গর্ভপাত আইনসিদ্ধ হলেও নীতিসিদ্ধ নয় এবং খ্রিস্টীয় মতে তা পাপ, আইনানুগ হলেও তা পাপ। ভ্রূণ হল— তোমার শরীরে তোমার প্রতিবেশী, তাকে হত্যা কোরো না, প্রতিবেশীকে হত্যা পাপ। যে দেশে বন্দুকের সংখ্যা মানুষের সংখ্যার থেকে বেশি, যে দেশে মানুষের হাতে সারা পৃথিবীর ৪২ শতাংশ আগ্নেয়াস্ত্র প্রাইভেট পর্যায়ে আছে সে দেশে এই সারমন শুনতে যেমনই লাগুক না কেন, নারীকে গর্ভের অধিকার দেওয়ার প্রশ্নে আইনকে ঈশ্বরের ইচ্ছাই মানতে হবে এই ছিল প্রতিপাদ্য।
আমেরিকায় গর্ভপাত আইন করে নিষিদ্ধ হয় প্রথম যে প্রদেশে তা হল কানেকটিকট। সেটা ১৮২১ সাল এবং ১৮৬৮ সালের মধ্যে ৩৭টির মধ্যে ২৭টি রাষ্ট্রে গর্ভপাত নিষিদ্ধ হয়ে যায় এবং অচিরেই সব কয়টি স্টেটেই কোনও না কোনও গর্ভপাত আইন কার্যকর হয়ে যায়। রো বনাম ওয়েড মামলা ১৯৭৩ সালে এই পরিপ্রেক্ষিতে একটি ল্যান্ডমার্ক জাজমেন্ট। এই মামলার সূত্রপাত ১৯৬৯-এ যখন নর্মা ম্যাককরভি তৃতীয়বার গর্ভধারণের পরে টেক্সাসের আদালতে ‘প্রিম্যাচিওর টার্মিনেশন’ চেয়ে বসেন। স্বনামে নয়, নর্মা লড়েছিলেন ‘জেন রো’ এই ছদ্মনামে। টেক্সাসে গর্ভপাত আইনসিদ্ধ নয়, ফলে নর্মার আইনজীবীরা তাঁদের ডিস্ট্রিক্ট অ্যাটর্নি জেনারেল, হেনরি ওয়েড-এর বিরুদ্ধে কোর্টে গেলেন এই দাবি নিয়ে যে, টেক্সাসের গর্ভপাত আইন অসাংবিধানিক, তা যে কোনও নারীর মৌলিক অধিকারের পরিপন্থী। জেলা আদালত নর্মার যুক্তিকে মান্যতা দিয়ে বলে যে টেক্সাসের ‘অ্যাবর্শন স্ট্যাটিউট’— গর্ভপাত নিয়ন্ত্রণবিধি সংবিধানসম্মত নয়। উভয়পক্ষই সুপ্রিম কোর্টে গেলে ২২ জানুয়ারি ১৯৭৩ তারিখে সর্বোচ্চ আদালত ৭-২ সংখ্যাগরিষ্ঠতায় এই ব্যাপারে সহমত হন যে, আমেরিকার সংবিধানের ১৪তম সংশোধনীতে ‘রাইট টু প্রাইভেসি’— গোপনীয়তার অধিকার, মৌলিক অধিকাররূপে স্বীকৃত। এই অধিকার নারীর গর্ভের উপর তারই অধিকারের স্বীকৃতি বলেই বোঝায়। সুতরাং, গর্ভপাত আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানের নিরিখেই নারীর, অর্জিত নয়, মৌলিক অধিকার। যদিও, ‘রাইট টু অ্যাবরশন’-কে চূড়ান্ত অধিকার তখনও বলেনি কোর্ট এবং বলা হল— অধিকার আর ‘রাজ্যের মাতা ও শিশু স্বাস্থ্যরক্ষা দায়’, এই দুয়ের মধ্যে ভারসাম্য থাকতে হবে। কোর্ট এই দুই পরস্পরবিরোধী দায়কে মিলিয়ে দিতে একটি ‘ট্রাইমেস্টার টাইমটেবিল’ ঘোষণা করলেন সারা দেশের জন্য। বলা হল— গর্ভের প্রথম তিনমাসে রাষ্ট্র কোনওভাবেই নিয়ন্ত্রণ কায়েম করতে পারবে না, তিন থেকে ছয় মাসের গর্ভে মাতার স্বাস্থ্যভাবনাই গুরুত্ব দিতে হবে রাষ্ট্রকে, ভ্রূণের নয় আর তৃতীয় ট্রাইমেস্টারে, অর্থাৎ ছয় থেকে চূড়ান্ত গর্ভের দশায় রাষ্ট্রই নিয়ন্ত্রক— তখন মায়ের জীবন ও স্বাস্থ্যরক্ষায় যদি জরুরি হয় তবেই, নচেৎ নয়।
এই হল রো বনাম ওয়েড মামলার শাঁস, যা গর্ভপাত আইনসিদ্ধকারী ‘রো’-অধিকাররূপে সমধিক পরিচিত। সুপ্রিম কোর্টে ১৯৯২-তে রো আইনকে চ্যালেঞ্জ করা হলেও সেবারও তা বাতিল করা যায়নি, যদিও ট্রাইমেস্টার টাইমটেবিলটি বর্জিত হয়। কিন্তু রো আইনে বর্ণিত রাজ্যের কড়া নজরদারিত্বের (strict scrutiny) প্রভিশনটিকে ছুটি দিয়ে অবাঞ্ছিত মাতৃত্ব (undue burden)-কে মূল বিবেচ্য বিষয় করার কথা বলা হয় এবারে। এই আইন ‘কেসি’ সংশোধনী নামে পরিচিত। এ বছরের ২৪ জুন তারিখে যে মামলায় রো আইন অসিদ্ধ বিবেচিত হল তা হল ডবস বনাম জ্যাকসন উইমেন্স হেলথ অর্গানাইজেশন মামলা। এই মামলা ২০১৮ সালের মিসিসিপি রাজ্যের মামলা, সেখানে প্রথম ১৫ সপ্তাহের পরে অ্যাবর্শন আইনসিদ্ধ ছিল না। জ্যাকসন উইমেন্স হেলথ অর্গানাইজেশন এই প্রভিশনটির বিরুদ্ধে কোর্টে যায় রো আইনের সংবিধানস্বীকৃত অবস্থানকে সামনে রেখে। ২৪ জুন রো এবং কেসি— উভয়ের আইনসিদ্ধতা কেড়ে নিয়ে কোর্ট জানিয়ে দিল ‘the Constitution does not confer a right to abortion’— সংবিধান গর্ভপাতের অধিকার দেয়নি এবং “the authority to regulate abortion is returned to the people and their elected representatives”— গর্ভপাতের নিয়ন্ত্রণ মানুষের হাতে হবে তাদের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের দ্বারা।
ধর্ম বনাম বিজ্ঞান
ডবস বনাম জ্যাকসন উইমেন্স হেলথ অর্গানাইজেশন মামলায় সুপ্রিম কোর্টের সামনে সওয়াল হয় ২০২১-এর ডিসেম্বরে। জুনে এর রায় এলেও ২ মে ২০২২ তারিখে পলিটিকো নামের এক সংবাদ সাময়িকী জাস্টিস স্যামুয়েল অ্যালিটোর একটি লিক হয়ে যাওয়া বয়ান হাতে পায়। তাতে নয় সদস্যের বেঞ্চের সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামত যে পঞ্চাশ বছরের আইনসিদ্ধ গর্ভপাত ধারাটি বাতিল করতে চলেছে তা স্পষ্টই বলা ছিল। আগেই বলা হয়েছে সুপ্রিম কোর্টের অ্যাবরশন-বিরোধী অবস্থান পাকা হয় অ্যামি কোনি ব্যারেট বেঞ্চে আসবার পরে। তিনি চেয়ারে আসার আগে থেকে সোচ্চারভাবে অ্যাবরশন-বিরোধী। এর ফলাফল কী হল দেখুন। মিসিসিপি রাজ্যের আইনকে মান্যতা দিতে সম্মত হলেও প্রধান বিচারপতি জন রবার্টস রো আইন বাতিল করে গর্ভপাত একেবারে সংবিধানবিরোধী ঘোষণার পক্ষে ছিলেন না। সেই অংশের ফলাফল নির্নীত হল ৫-৪ গরিষ্ঠতায়। অ্যামিকে নিয়োগের অঙ্কটা বুঝুন একবার। যাই হোক, রায়ের কপি লিক হয়ে যাবার পরে অন্তত আটশো বিজ্ঞানী এবং বহু বিজ্ঞান সংগঠন কোর্টকে জানিয়েছেন রিপ্রোডাক্টিভ হেলথ কেয়ার— প্রজননগত স্বাস্থ্য সুব্যববস্থার একটা অঙ্গ হল অ্যাবরশন। অবাঞ্ছিত মাতৃত্ব থেকে মুক্তি শুধু নয়, আধুনিক চিকিৎসাব্যবস্থা ভ্রূণের গঠনগত পর্যায়েই প্রায় সমস্ত মুখ্য ত্রুটি সনাক্ত করতে পারে। তেমন ভ্রূণের ডাক্তারের তত্ত্বাবধানে অপসারণই সব অর্থে বাঞ্ছিত। সে দেশে পাঁচ দশকের অ্যাবরশন আইনের প্রভাব সমাজের উপর যতটা নেগেটিভ তার চেয়ে অনেক বেশি পজিটিভ সে দেশের নারীস্বাচ্ছ্যন্দের নিরিখে। তবে সে দেশে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের ভালো খ্রিস্টান হওয়ার একটা দায় যে থাকে সেটা বোঝা গিয়েছিল জাস্টিস অ্যামি শপথ নেওয়ার পরপরই। কুড়িটা রাজ্য অ্যাবরশন নিয়ন্ত্রণ আইনের খসড়া তৈরিই রেখেছিল যাদের মধ্যে তেরোটি হল ‘ট্রিগার স্টেট’ যারা সুপ্রিম কোর্টের রায় আসবার সঙ্গে সঙ্গে তা কার্যকর করে দিতে বদ্ধপরিকর ছিল। সম্ভাব্য পরিণতি আন্দাজ করে বহু বিজ্ঞানী, সমাজবিজ্ঞানী, অর্থনীতিবিদ, অ্যাথলিট, জনস্বাস্থ্যে কাজ করছেন এমন সংস্থা বা ব্যক্তি শত শত প্রকাশিত গবেষণা ও গবেষণাপত্রের উদাহরণ দেখিয়ে সুপ্রিম কোর্টের কাছে আবেদন রেখেছেন এই মর্মে যে প্রচলিত ধারণা, ধর্মবিশ্বাস যাই বলুক না কেন, তথ্য বলছে অ্যাবরশন রাইট আমেরিকান নারীর পক্ষে অনুকূল ফলাফল এনে দিয়েছে এই পঞ্চাশ বছর ধরে। ২০০৭-এর একটা মামলায় জাস্টিস অ্যান্টনি কেনেডি অ্যাবরশন-বিরোধী রায় দিয়ে বলেছিলেন— it was protecting women from depression and a loss of self-esteem— মহিলাদের ডিপ্রেশন ও আত্মসম্মানবোধ হানির সম্ভাবনা থেকে বাঁচানোর স্বার্থেই অ্যাবরশন নিয়ন্ত্রণ করা দরকার। তখনই একটা জরুরি বিষয় তিনি উল্লেখ করেছিলেন, এতে যে এর উল্টোটা হয়, অর্থাৎ নারীর মন ও শরীরের উপর যে ধনাত্মক প্রভাব পড়ে, তার সপক্ষে যথেষ্ট ডেটা নেই। ২০০৭-এর পরে হলেও, এখন এ বিষয়ে অনেক তথ্য বিজ্ঞানীদের হাতে আছে। ‘টার্ন অ্যাওয়ে’ স্টাডি হল এমন একটা গবেষণা প্রকল্প যেখানে সহস্রাধিক নারী যারা গর্ভপাত করিয়েছেন, তাঁদের সঙ্গে সমসংখ্যক স্বাস্থ্য বা অন্যান্য কারণে ফিরিয়ে দেওয়া (turn away) একই সামাজিক স্তরের নারীর তুলনা করে দেখা গিয়েছে, ঋণাত্মক অর্থনৈতিক বা স্বাস্থ্যজনিত প্রতিক্রিয়া যা হয়েছে, তা ওই টার্ন অ্যাওয়ে গ্রুপের নারীদের মধ্যেই এবং যারা গর্ভপাত করাতে পেরেছেন তাঁরা বরং অপেক্ষাকৃত বেশি সুখের মুখ দেখেছেন। শুধু তাই নয়, বিজ্ঞান গবেষণা প্রমাণ করেছে অ্যাবরশন নারীজীবনের আয়ুবৃদ্ধি ঘটিয়েছে সে দেশে। সন্তানধারণের পর ডেলিভারিতে যা মৃত্যু হয়, তথ্য বলছে, অ্যাবরশনে তার তুলনায় ১৪.৫ গুণ কম মৃত্যু হয়, এ তথ্য অবশ্য লিগ্যাল অ্যাবরশনের, জড়িবুটি অ্যাবরশন আমেরিকায় হয় কিনা কে জানে!
বিদ্বজ্জনেদের নজরে এসেছিল মিসিসিপি রাজ্যের অ্যাটর্নি জেনারেল লিন ফিটজের জমা দেওয়া বয়ান। তাতে বলা হচ্ছে— that abortion access is no longer necessary because women have the ability to succeed in their professional lives without it— অ্যাবরশনের প্রয়োজন ফুরিয়েছে, কেন না দেখা যাচ্ছে স্ত্রীলোকেরা এটা ছাড়াই তাদের পেশাগত জীবনে সাফল্যের মুখ দেখতে সক্ষম। This, the brief explains, is due to the availability of highly effective contraceptives; state assistance, such as adoption services; and policies including those that prevent employers from discriminating on the basis of pregnancy— তার কারণ উঁচুমানের গর্ভনিরোধক বেরিয়েছে, (অবাঞ্ছিত বাচ্চাকে) দত্তক নেওয়ানোর ব্যবস্থা আছে, সরকারি সহায়তা আছে আর গর্ভের দরুন কর্মপ্রার্থীদের প্রতি অবিবেচনার বিরুদ্ধে আইন আছে। সুতরাং banning abortion would actually empower women to raise children while pursuing careers— অ্যাবরশন নিষিদ্ধ হলে তা স্ত্রীলোককে কেরিয়ার সামলে বাচ্চা মানুষ করতে বাড়তি বল জোগাবে। জো বাইডেন কেন যে বিলাপ করে বলছেন রো আইন বাতিল করে আমেরিকাকে দেড়শো বছর পিছিয়ে দেওয়া হল তা কিছুটা বোঝা যায় অ্যাটর্নি জেনারেলের এই বয়ানটুকু পড়লে। এর অন্তর্নিহিত বার্তা তো একটাই— অনেক হয়েছে, অনেক কিছু পেয়েও এসেছ মায়েরা গত পঞ্চাশ বছরে, কিন্তু আর নয়। no longer necessary বাক্যবন্ধটির মধ্যে নারীর গর্ভের স্বাধীনতা কেড়ে নেওয়ার যে সোচ্চার ঘোষণা আছে, যে প্রচ্ছন্ন পিতৃতান্ত্রিক ও ধর্মীয় নীতিবাদ আছে, যে অবজ্ঞা আছে, তার মধ্যে নারীনিয়ন্ত্রক অতি-দক্ষিণপন্থী প্রবণতার প্রতিটি চিহ্ন স্পষ্ট। সে দেশের বৈভব, প্রাচুর্য, বিশ্বময় দাদাগিরি, মুক্ত মন-মুক্ত জ্ঞানের চর্চা, শিল্প সাহিত্য বিজ্ঞানে ঔদার্যের জয়গান— এত সব কিছুর প্রতিস্পর্ধায় এই নির্ণায়ক মানসিকতার প্রসার ও জয়— এটাই হল আমেরিকান ড্রিমের আজকের অবস্থা।
এর জবাবেও কোর্টে বিজ্ঞানীরা তথ্য দিয়ে জানিয়েছিলেন যারা অ্যাবরশন পেয়েছেন তাদের তুলনায় যারা পাননি তাদের অবস্থা আদপেই ভালো তো নয়ই পেশাগত বা আর্থিকভাবে, বরং ৯০০-র উপর এমন প্রতিতুলনা আছে যেখানে মাথাযন্ত্রণা থেকে আর্থ্রাইটিস— বিভিন্ন রোগে ভোগা নারীদের গর্ভপাতের অনুরোধ প্রত্যাখ্যাত হয়েছিল। মাতৃত্বের জন্য নিজেকে তৈরি করা মায়েদের তুলনায় অবাঞ্ছিতভাবে গর্ভসঞ্চার ঘটে যাওয়া মায়েদের শরীরের নানা প্যারামিটার একেবারেই নেগেটিভ সব দেশে, আমেরিকাও ব্যতিক্রম নয়। উপরন্তু লিগ্যাল অ্যাবরশনের কারণে মৃত্যুর হার নগণ্য হলেও অবাঞ্ছিত মাতৃত্বে প্রসবকালীন মৃত্যুহার রীতিমতো উল্লেখযোগ্য এমনকি আমেরিকাতেও। এর সঙ্গে মদ্যপানের হার, পারিবারিক হিংসা, সন্তানের প্রতি অবহেলা এসব কিছু তো আছেই। নেচার পত্রিকায় প্রকাশিত একটা পরিসংখ্যানে জানা যাচ্ছে আমেরিকাতে প্রতি চারজন প্রজননক্ষম মহিলার মধ্যে একজন অন্তত একটি অ্যাবরশন করাবেন। আরও জানা যাচ্ছে অবাঞ্ছিত গর্ভসঞ্চার ঘটে দারিদ্রসীমার নীচে থাকা মহিলাদের মধ্যে অন্তত পাঁচগুণ বেশি হারে। উন্নতমানের কন্ট্রাসেপটিভ বা ভ্রূণের পরিচর্যার উপযোগী খাদ্যাহার এদের সাধ্যের বাইরে। দরিদ্র মানুষের এক চতুর্থাংশ আফ্রিকান-আমেরিকান। তাদের মধ্যে মৃত্যুহার এমনিতেই বেশি— প্রতি ১০০,০০০ মায়ের মধ্যে ৪৪ জন। এই হার সারা প্রথম বিশ্বের সন্তান জন্মদানকালীন মৃত্যুহারের তুলনায় চারগুণ বেশি। এই কারণে বিজ্ঞানীদের আবেদন ছিল— “Black women, in particular, who continue to experience the effects of racially-motivated policies and practices that impact their maternal health, must have the right to decide whether to continue a pregnancy to term.”— কালো মহিলারা, বিশেষত তারা যাদের বৈষম্যজনিত অসাম্যের কারণে গর্ভাবস্থা এখনও প্রভাবিত হয়, গর্ভাবস্থা নিয়ন্ত্রণের অধিকার অবশ্যই তাদের পাওয়া উচিত। এছাড়া, অর্থনীতিবিদরাও পরিসংখ্যান দিয়ে দেখিয়েছেন কালো একক মাতাদের আর্থিক অবস্থার চোখে পড়ার মত উন্নতি হয়েছে ১৯৭০-এর পর থেকে অ্যাবরশন রীতিসিদ্ধ হওয়ার পরে। এই ‘রো-এফেক্ট’-এর বিপরীত প্রতিক্রিয়া তাদের মধ্যে যারা অ্যাবরশন করাতে পারেননি তাদের মধ্যে। তাদের ঋণ না মেটানোর হার ৭৮ শতাংশ বেড়েছে এবং দেউলিয়া ঘোষিত হওয়া, বসতবাটি থেকে উচ্ছেদ ইত্যাদির হার বেড়েছে ৮১ শতাংশ। আর যদি ফিটজের ওই কথায় আবার ফিরে যেতে হয়— abortion access is no longer necessary— তাহলে, মনে করিয়ে দিয়েছেন সে দেশের বিজ্ঞানীরা, এটাও বলা দরকার যে আমেরিকা হল একমাত্র তথাকথিত ‘সভ্য’ দেশ যেখানে সবেতন মাতৃত্বকালীন ছুটি সবেতন হবে এমন নিশ্চয়তা নেই। সিঙ্গল প্যারেন্টের গড় বাৎসরিক আয়ের দুই-তৃতীয়াংশ খরচ করতে হয় সন্তান প্রতিপালনে। এই ব্যয়, সে দেশের গড় ধরলে বছরে ১০,৪০০ ডলার। সেই মা যদি একটি সন্তানের মুখের দিকে তাকিয়ে দ্বিতীয় সন্তানের ব্যাপারে নিজে সিদ্ধান্ত নিতে চায় তাহলে দেশব্যাপী ঈশ্বরের সন্তানদের ঘোরতর sin হয়ে যাবে?
আপাতত, রায় ঘোষিত এবং ত্বরিত তা কার্যকর হয়েছে বা হতে চলেছে একাধিক স্টেটে। সুপ্রিম কোর্টের সামনে বিক্ষোভ দেখাচ্ছেন মায়েরা বা হবু-মায়েরা। শুরু করেছিলাম বন্দুক লবির জিত দিয়ে, তখন রায় হল নিউ ইয়র্কে বন্দুকের দোকানে গিয়ে সদ্য-সাবালক কেউ সতেরোটা বাচ্চা মারার ছক কষে পিস্তল বা স্টেনগান কিনতে চায়, তাকে কেনবার কারণ জিজ্ঞেস করাটা হবে আইনবিরুদ্ধ আর হবু-মা অবাঞ্ছিতভাবে এসে যাওয়া ভ্রূণের অপসারণ চাইলে সেটাও হবে আইনবিরুদ্ধ। কী বিচিত্র এই দেশ!
বিজ্ঞানতথ্য: Maxmen, Amy. Why hundreds of scientists are weighing in on a high-stakes US abortion case. Nature 599, 187-189 (2021). Oct 26, 2021.
পৃথিবীর বহু দেশে, আমেরিকায় এই গর্ভপাতের অধিকার কেড়ে নেওয়া আইনের বিষয়টি, প্রচণ্ড কুফলের সঙ্গে অতি দ্রুত উঠে আসবে।
‘উন্নত’ দেশ হিসেবে আমেরিকার কাজের প্রভাব সারা বিশ্বে অনুসৃত হয়। বহু অনুন্নত ,উন্নয়নশীল দেশের রোল মডেল আমেরিকার অগ্রগতি।
বলাবাহুল্য এই নারী বিদ্বেষী আইন, পৃথিবীর নানা দেশে ছড়িয়ে পড়বে, অপপ্রচারিত হবে ও অপপ্রয়োগে নারী জীবনকে দুঃসহ অবর্ণনীয় অবস্থায় এনে ফেলবে।দুরাত্মার হাত শক্ত করবে।
এই আইন, অবিলম্বে বাতিল হোক।নইলে সমূহ বিপদ।
হীরক সেনগুপ্ত