ভাইরাল পৃথিবীর বাইরে জলবন্দি প্রান্তজনেরা

সুমনা রহমান চৌধরী

 



শিক্ষক, সমাজকর্মী

 

 

 

বন্যা আর অসম— যেন বা সমার্থক শব্দ। প্রতি বছর বন্যায় ডোবে এ রাজ্য। প্রতি বছর মানুষ তার যাবতীয় সহায় হারায়। ভিটে-মাটি-গবাদিপশু-চাষের জমি… তালিকার শেষ বুঝিবা নেই। তার মাঝেই আবার বেঁচে ওঠা। আবার ভোট। আবার ঘোড়া কেনা-বেচা। আবার রাজপাটে ক্ষমতাধরেদের বসা। কিন্তু বন্যাপরিস্থিতির স্থায়ী সমাধানে কোনও সরকারেরই কোনও হেলদোল থাকে না। জলবায়ু পরিবর্তনের মতো জরুরি বিষয় নিয়ে কোনও সংসদ অধিবেশন হয় না। টিভির পর্দায় তা নিয়ে কোনও প্রাইমটাইম শো হয় না। নির্বাচনের আগে দলগুলির জরুরি অ্যাজেন্ডা হিসাবেও পরিগণিত হয় না। উপরন্তু সরকার এবং রাষ্ট্রের মদতে অবাধে বন-জঙ্গল ধ্বংস চলে। নাগাল্যান্ড-মিজোরাম-অরুণাচল-অসম-মেঘালয় সহ সাতবোনের কোনও রাজ্যেরই বন-জঙ্গল, খনিজ পদার্থ আর অক্ষত নেই! নদীতে পলি আর পাহাড় থেকে বৃষ্টির জলের সঙ্গে নামা মাটি জমে। নদীগুলো নাব্যতা হারায়। শহরে আবর্জনার স্তূপ জমা হয়। মাস্টার ড্রেনেজ সিস্টেমের নামে অবৈজ্ঞানিক কাঠামো তৈরি হয় কোটি কোটি টাকা খরচে— যা দিয়ে শহর-শহর সংলগ্ন অঞ্চলের জল বেরোতে পারে না। বাঁধ মেরামতের কাজ হয় না। স্ল্যুইস গেট তৈরি হয় না। অবাধে গাছপালা-অরণ্য ধ্বংসের ফলে পরিবেশ ভারসাম্য হারায়। স্বাভাবিকের তুলনায় বেশি বৃষ্টিপাত হয়। জলের ভার বুকে বইতে না পেরে নদীগুলো দু-কূলের জনপদ ভাসায়। সেই জলে ভাসা জনপদে সরকারি কর্তাব্যক্তিদের নিয়ে হেলিকপ্টার উড়ে আসে মাঝে মাঝে। পরিস্থিতি খতিয়ে দেখতে। মুখ্যমন্ত্রী ত্রাণ তহবিলে অর্থ জমা হয় দেশ-বিদেশ থেকে। আর তার সঙ্গে চলে ত্রাণের নামে দুর্নীতি। ত্রাণসামগ্রীর তছরূপ। অসহায় জলে ডোবা নাগরিকেরা যা ত্রাণ পায় তার দ্বিগুণ অংশ যায় অসাধু ব্যবসায়ী থেকে পঞ্চায়েত মেম্বার, জেলা প্রশাসন সহ এমএলএ-মন্ত্রীদের পকেটে। দালালদের পকেটে। কিছু না জোটা মানুষেরা জল না নামা অব্দি রাগে দুঃখে থাকেন। জল নামে। ভোট আসে। সম্প্রদায়ভিত্তিক রাজনীতি আসে। নদীপূজার নামে সরকারি কোটি কোটি টাকার নমামি ব্রহ্মপুত্র, নমামি বরাক, নমামি কুশিয়ারা উৎসব হয়। মন্ত্র উচ্চারণ আর নাচ-গানের উৎসব, পূজাপাঠের মাঝে নদীর বুজে আসা একই অবস্থানে থাকে। সনাতন হিন্দু সংস্কৃতি বজায় রাখা, নদীর পুজো এসবের ডামাডোলে মানুষের স্মৃতি থেকেও বন্যার দুর্ভোগ মুছে গিয়ে হিন্দু-মুসলমান বাইনারি মুখ্য হয়ে উঠে। ক্ষুধা-দুর্ভোগ থেকে ধর্ম বাঁচানো মুখ্য হয়ে উঠে।

ফি বছরের অসমের প্রান্তিক জনপদের এইসব খবর কোনও মিডিয়াতেই ভাইরাল হয় না। খবরের কাগজের প্রথম পাতায় এইসব জলে ডোবা সর্বস্ব হারানো মানুষদের আর্তি জায়গা পায় না। এবারেও হত না। যদি না শহর জলে ভাসত। যদি না বরাক নদীর জল শহর শিলচরকে ভাসিয়ে নিয়ে যেত। শহরে বাস করা প্রিভিলেজড মানুষদের অসুবিধা-কষ্টে মিডিয়া থেকে রাষ্ট্র— সবার রাতের ঘুম হারাম হয় এ তো জানা কথাই!

বরাক উপত্যকার এবছরের ভয়াবহ বন্যা নিয়ে বিশদে যাওয়ার আগে অসমের দুই উপত্যকার নদ-নদীগুলো সম্পর্কে একটা প্রাথমিক ধারণা দেওয়া প্রয়োজন। দুই বৃহত্তম নদ-নদীকে ভিত্তি করে গোটা রাজ্যকে দুটো উপত্যকায় ভাগ করা হয়েছে। ব্রহ্মপুত্র নদের দু-তীরের জনপদ নিয়ে ব্রহ্মপুত্র উপত্যকা। এবং বরাক নদীর আশেপাশে গড়ে উঠা জনপদ নিয়ে বরাক উপত্যকা।

ব্রহ্মপুত্র নদসংলগ্ন চর-অঞ্চলগুলো প্রতিবছর বন্যায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। হাজার হাজার মানুষ ভিটেমাটি সব হারান। বহু চর ব্রহ্মপুত্রের বুকে ডুবে যায়। সেইসব ডুবে যাওয়া চরের মানুষরা প্রাণটুকু হাতে নিয়ে অন্য ভেসে থাকা চরের উদ্দেশ্যে পাড়ি দেন। এসব প্রতি বছরের ঘটনা। সেসব নিয়ে জাতীয় মিডিয়াও বেশি মাথা ঘামায় না। রাজ্য মিডিয়াও না। সরকার তথা প্রধান বিরোধী দলগুলোও না। চর অঞ্চলের পূর্ববঙ্গীয় মূলের দরিদ্র মুসলমান জনগোষ্ঠীর বাস্তুহীন হওয়ার খবর কী করেই বা জরুরি খবরের আওতায় পড়তে পারে! জলবায়ু পরিবর্তনের নির্মম শিকার এই মানুষগুলো কী করেই বা কোনও টিভি চ্যানেলের প্রাইম-টাইমের কয়েক মিনিট সময় দাবি করতে পারেন! সে যাক। এইভাবেই প্রতিবছর বন্যায় ডুবে যাওয়ার, কাগজপত্র-ভিটেমাটি হারানোর, সরকার দ্বারা বলপূর্বক উচ্ছেদ হওয়ার ভবিতব্য নিয়ে তারা বেঁচে আছেন স্বাধীনতা-পরবর্তী সময় থেকেই।

অসমের দ্বিতীয় বৃহত্তম নদী— বরাক নদীর উৎপত্তিস্থল বড়াইল পাহাড়ের দক্ষিণে। দৈর্ঘ্য ৯০০ কিমি। এই নশো কিলোমিটারে মাঝেই সে এই উপত্যকার তিনটে বড় জেলা ছুঁয়ে বয়ে গেছে— কাছাড়, করিমগঞ্জ, হাইলাকান্দি। অসংখ্য শাখানদী আর উপনদী মিলিয়ে। করিমগঞ্জ জেলার কাছাকাছি এসে বরাক নদী ভাগ হয়েছে দুটো বড় উপনদীতে— সুরমা আর কুশিয়ারা। এ দুটো বাদেও আরও উপনদী এই তিন জেলার উত্তর-দক্ষিণে ছড়িয়ে আছে। সোনাই, ঘাঘরা, কাটাখাল, সিংলা, লঙ্গাই, ধলেশ্বরী, জিরি, সিরি, জাটিঙ্গা, মথুরা প্রভৃতি।

এহেন নদীময় বরাক উপত্যকাতেও এবছরের মতো ভয়ঙ্কর বন্যা স্মরণাতীত কালে দেখা যায়নি। অনেক প্রবীণ মানুষেরা বলছেন ১৯৬৭ সালের বন্যার সঙ্গেই এবছরকার বন্যার তুলনা হতে পারে। প্রতি বর্ষাতেই বরাক এবং তার উপনদীগুলো দু-তীরের জনপদ প্লাবিত করে। সেখানকার মানুষ স্কুল বা উঁচু জায়গায় শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় নেন। নিচু ধানের জমি জলের তলায় তলিয়ে থাকে দেড়-দুমাস। আবার পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়। কিন্তু এবছরের মতো বন্যার এত বিশাল ব্যাপ্তি, এত করাল থাবা আর দেখা যায়নি। শহর-গ্রাম কিছুই রেহাই পায়নি। প্রান্তিক খেটেখাওয়া মানুষ থেকে শহরের বাবুশ্রেণিও বন্যার জলে খাদ্য-জল-আলোবিহীন থেকেছেন। লাশ পুড়ানোর বা কবর দেওয়ার একটুকরো শুকনো মাটি পাওয়া যায়নি। দালান-অট্টালিকার একতলা অব্দি জল বয়ে গেছে। শহরের অলিগলিতে ভেসে গেছে লাশ। এসব শহর শিলচরের চিত্র। যা ভাইরাল হয়েছে জাতীয় থেকে রাজ্য মিডিয়ায়। সঙ্গে ভাইরাল হয়েছে মানুষের ক্ষোভ। রাগ। পানীয় জলের হাহাকার। রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী তিনবার হেলিকপ্টার নিয়ে শিলচর ছুটে এসেছেন। ত্রাণ নিয়ে ছুটে গেছে বিভিন্ন এনজিও থেকে ক্লাব, সংস্থা, দল। সেসবের খবর জাতীয় মিডিয়ায় আছে। সোশ্যাল মিডিয়ায় আছে। যে খবরটুকু নেই তা হল গ্রাম কাছাড় আর গ্রাম করিমগঞ্জের বন্যার ভয়াবহতার খবর। আর যা নেই তা হল ত্রাণ সহায়তা নিয়ে সাম্প্রদায়িক বিভেদের উগ্র রাজনীতি। আমি যেহেতু করিমগঞ্জ জেলার নাগরিক, তাই এই জেলার বন্যা এবং ত‍ৎপরবর্তী ভয়াবহতাটুকু এই প্রতিবেদনে তুলে ধরছি।

করিমগঞ্জ জেলার চারদিকে বয়ে গেছে চারটি নদী। করিমগঞ্জের সাব-ডিভিশন বদরপুর অঞ্চলের পাশ দিয়ে বরাক নদী। শহর করিমগঞ্জের মধ্যভাগ হয়ে বয়ে গেছে কুশিয়ারা। আরেক পাশে লঙ্গাই নদী। আনিপুর-পাথারকান্দি ইত্যাদি অঞ্চল হয়ে সিংলা নদী। প্রতিবছর এই নদীগুলোর আশেপাশের নিচু জনপদ প্লাবিত হয়। কিন্তু এবারকার মতো ভয়াল রূপ তার কোনওবারেই ছিল না। তার প্রধানতম কারণ, এপ্রিলের শেষ দিক থেকে শুরু হওয়া অতিবৃষ্টি। এবং দ্বিতীয় সবচেয়ে বড় কারণ সরকারের অদূরদর্শিতা। অবহেলা। গাফিলতি। বহুবছর ধরে বাঁধগুলোর সংস্কার না করা, নদীগুলোর নাব্যতা বজায় রাখায় কাজ না করা, স্ল্যুইস গেট তৈরি না করা, শহর থেকে গ্রামে ড্রেনেজ সিস্টেমের নামে কোটি কোটি টাকা ব্যয়ে সম্পূর্ণ অবৈজ্ঞানিক ড্রেনেজ কাঠামো তৈরি করা— যা দিয়ে বৃষ্টির জলটুকু অব্দি বেরোতে পারে না। ফলত নদীর জল গ্রাম-শহরে ঢুকার আগেই জমা জলে কৃত্রিম বন্যার সৃষ্টি হয় এই জেলায়। একঘন্টার ভারী বৃষ্টিতেই শহর জলমগ্ন। এক হাঁটু জল। নদীগুলো পলি আর মাটিতে ঠাসা। গভীরতা নেই। এমতাবস্তায় যখন পাহাড় সহ অন্যান্য উঁচু জায়গা থেকে সমতলে জল নামে নদী আর বইতে পারে না। দুকূল উপচে তুমুলভাবে আশেপাশের জনপদে প্রবেশ করে। তার মাঝে বৃষ্টির জমা জল। জল যাওয়ার কোনও রাস্তা নেই। সব মিলিয়ে ভয়ঙ্কর অবস্থা ধারণ করে এবারে করিমগঞ্জ জেলা। একদিকে কুশিয়ারার উপচে উঠা জলরাশি। আরেকদিকে লঙ্গাই এবং সিংলা নদীর বাড়তে থাকা জল। বরাক নদীর জল কাছাড় তথা কাছাড় জেলার সদর শহর শিলচরকে ভাসানোর সঙ্গে সঙ্গে বদরপুরকেও ভাসিয়ে যায়। চারদিকে শুধু জল আর জল। অথৈ জল। আর তার সঙ্গে একনাগাড়ে ঝরে পড়া বৃষ্টি।

আপনারা মিডিয়ায় ভাইরাল হওয়া শিলচর শহর দেখেছেন। গ্রাম করিমগঞ্জ দেখেননি। কারণ আগেই বলেছি গ্রাম খবরে আসে না। মিডিয়ায় ভাইরাল হয় না। গ্রামের মানুষ বন্যায় মরে গেলেও তাতে কারও কিছু আসে যায় না। কখনও আসে যায়নি। এতটা প্যাথেটিক বন্যা, এতটা অসহায় মানুষ নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না। ইলেকট্রিসিটি নেই। খাওয়ার জল নেই। মাটির বাড়ির উঠোনে কোমর জল। সাপের ভয় থেকে যেকোনও সময় ঘর ধসে যাওয়ার ভয়। কোথাও বেরোনোর রাস্তা নেই। মরে গেলেও লাশ ঘরে রাখতে হবে। বাইরে কবর দেওয়ার বা জ্বালানোর জায়গা নেই। টাকা নেই। পয়সা নেই। সন্ধ্যাবেলা কুপি ল্যাম্প জ্বালানোর কেরোসিনটুকু নেই। কাকে বলবে, কী বলবে, কেন বলবে এসব কিচ্ছু জানে না মানুষগুলো। অভাব আর দারিদ্র কী জিনিস তা এদের না দেখলে অনুভব করতে পারবে না কেউ। এই যেমন এখন এই প্রতিবেদনটা যখন আলো-ঝলমলে ঘরে বসে পড়া হবে তখন কেউ অনুভবটুকুও করতে পারবেন না কতটা নিকষ অন্ধকারে এই মানুষগুলো ডুবে রয়েছেন!

১৯ জুন থেকে যখন জল ঢুকতে শুরু করে, খোদ শহর করিমগঞ্জের সত্তর শতাংশ বাড়ি-ঘর জলমগ্ন হয়ে পড়ে। গ্রামের অবস্থা আরও শোচনীয়। দক্ষিণ করিমগঞ্জের কালিগঞ্জ এলাকার গ্রামগুলো, রাতাবাড়ি, দুল্লভছড়া, সুপ্রাকান্দি, উত্তর করিমগঞ্জের লামাডিমপুর, মানিককোনা, মাইজগ্রাম, পাথু, লাফাশাইল, লঙ্গাই ঘাট, ইনায়েতপুর, শনিবাড়ি সহ শোনবিল, বদরপুরের গ্রামাঞ্চল— সমস্ত জেলার কয়েকশো গ্রাম এখনও জলের তলায়। কয়েকশো বিঘা ধানী জমি জলের তলায়। কয়েকশো বিঘে সবজিক্ষেত জলের তলায়। কয়েক হাজার গবাদিপশুর অবস্থাও মানুষের মতোই শোচনীয়। কিছু জলে ভেসে গেছে। কিছু গবাদিপশু জাতীয় সড়কের পাশে বা গ্রামের কোনও উঁচু জায়গায় অস্থায়ীভাবে রাখার ব্যবস্থা করা হয়েছে। মাটি-বাঁশবেতের ঘর, আধপাকা বাড়ি সহ অনেক বাড়িতে প্রায় চাল-ছোঁয়া জল। সেসব বাড়ির মানুষ পাশের স্কুলে বা উঁচু জায়গায় আশ্রয় নিয়েছেন। আবার অনেক বাড়ির ভেতরে ঘরটুকু অব্দি জল পৌঁছায়নি। কিন্তু বাড়ির উঠোন সহ চারপাশ জলে ঘেরা। সেসব বাড়িতে মানুষ থাকছেন। বাড়ি ছেড়ে যাননি। কিছু বাড়ির ঘরের ভেতরে হাঁটুজল, সেখানে মানুষ ঘরের ভেতর খাটের উপরে খাট তুলে তাতেই থাকা-রান্নার ব্যবস্থা করে নিয়েছেন। বাড়ির চারধার কচুরিপানা, বেতগাছের জঙ্গল, অন্যান্য ছোট বড় গাছ তথা জঙ্গলে ঘেরা। জোঁক এবং প্রচণ্ড মশায় দুর্বিষহ সেখানকার জনজীবন। চারদিকে অথৈ জল। অথচ একবিন্দু পানীয় জল নেই। জলবন্দি মাটির বাড়ি ধসে মৃত্যু হয়েছে শিশু সহ বয়স্ক মানুষের। মাটির যে ঘরগুলো জলে ঘেরা হয়ে এখনও টিঁকে আছে কোনওমতে, জল কমলেই সেগুলো হুড়মুড়িয়ে ভেঙে পড়বে। ফিশারি, পুকুরে মাছ চাষ করেছিলেন অনেক নিম্নবিত্ত, মধ্যবিত্ত মৎস্যচাষিরা। অনেকে ঋণ করে মাছের পোনা কিনে ফিশারিতে ছেড়েছিলেন। বন্যার জল সব ভাসিয়ে নিয়ে গেছে। ঘরে খাওয়ার কিছু নেই। চারদিকের এক মানুষ সমান অথৈ জল ভেঙে কোথায়ই বা খাবার আনতে যাবেন এই মানুষেরা!

এই জলমগ্ন বাড়িগুলো, পরিবার-গ্রামগুলো সরকারি ত্রাণ পরিষেবার আওতায় এখনও নেই। এক অদ্ভুত নিয়মে জলমগ্ন বাড়িতে বাস করা নাগরিকদের, নৌকায় দশদিন ধরে রাত কাটানো সাত সদস্যের পরিবারকে, জলবন্দি গরিবস্য গরিব প্রান্তিক নাগরিকদের সরকারি ত্রাণ তহবিল দেখতে পায় না। রিলিফ ক্যাম্পে আশ্রয় নেওয়া, স্কুলবাড়ি বা উঁচু জায়গায় অস্থায়ীভাবে আশ্রয় নেওয়া পরিবারদের ত্রাণ পরিষেবা প্রদান করেই রাষ্ট্র তার দায়িত্ব পূরণ দেখাতে চায়। সরকার তার দায়িত্ব পূরণ দেখাতে চায়। রাজনৈতিক দলগুলো তাদের দায়িত্ব পূরণ দেখাতে চায়। তাও এই রিলিফ ক্যাম্পে থাকা মানুষেরাও সরকারি ত্রাণ পরিষেবা যথেষ্টভাবে পাচ্ছেন না বলে বিভিন্ন মিডিয়ায় অভিযোগ করছেন।

আমার কাছে অনেক প্রান্তিক মানুষের ইন্টারভিউ আছে, যাঁরা সরকারি ত্রাণ একদিন পেয়েছেন মাত্র। তাও দু কিলো চাল, আড়াইশো গ্রাম ডাল আর এক কাপ লবণ। আজ্ঞে হ্যাঁ, এক কাপ লবণ। তা দিয়ে সাত সদস্যের এক পরিবার দশদিন খাবেন! পঞ্চায়েত মেম্বার সহ যারা সরকারি ত্রাণ বণ্টন করছেন, তারা আধ কিলো ডাল দিয়ে দু কিলো ডালের কাগজে টিপ সই নিচ্ছেন। দিনের আলোয়। অসহায় মানুষ কিছু বলছেন না, যদি এটুকুও না মেলে!? ভাবছেন মিথ্যে বলছি? প্রমাণ দিই। বরাক তথা আসামের বিভিন্ন নিউজ মিডিয়া সহ সোশ্যাল মিডিয়া ঘুরে দেখলেই কয়েক হাজার ভিডিও আর নিউজ পাওয়া যাবে ত্রাণসামগ্রী লুঠের।

সর্ষের তেল দেওয়া হচ্ছে, সে তেলের গন্ধ খোদ বণ্টন যারা করছেন তারাই সহ্য করতে পারছেন না। দুধ আসছে আধ লিটার প্যাকেটের। শরণার্থী ক্যাম্পের বারান্দায় তা এসে পৌঁছালে সেখানে ঠাঁই নেওয়া বন্যাক্রান্তরা তা দেখার আগেই অন্য ব্যক্তি এসে তা তুলে নিয়ে যাচ্ছেন অন্য কোথাও মজুত করতে। ফলত সেসব ক্যাম্পের শিশুরা, বয়স্ক মানুষেরা দুধ পাচ্ছেন না। এসব খোদ স্কুলে, রিলিফ ক্যাম্পে ঠাঁই নেওয়া বন্যাক্রান্ত অসহায় মানুষদের অভিযোগ। ক্যামেরার সামনে মুখ দেখিয়ে করা অভিযোগ।

দিনকয়েক আগে হাইলাকান্দিতে এক বন্যাক্রান্ত গরিব কিশোরকে কোনও এক এনজিওর তরফে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল তোমার কী সাহায্য চাই? সে বলেছে পঞ্চাশ কিলো চাল আর পাঁচ কিলো ডাল হলেই আমার পরিবারের একমাস চলে যাবে। ভাইরাল সে ভিডিও দেখে অনেকে হেসেছেন। অনেকে কিশোরের উত্তরকে বোকামি ভেবে আহা-উহু করেছেন। সমস্ত হাসি-ঠাট্টা, আহা-উহু পেরিয়ে কিশোরের কথিত চাল আর ডাল-ই তো বৃহত্তর গ্রামীণ দরিদ্র ভারতবাসীর স্বপ্ন। বিপর্যস্ত নাগরিকের এই সামান্য স্বপ্নটুকুও রাষ্ট্র এবং তার এজেন্টরা বাস্তবে পূরণ করতে পারে না। পূরণ করার ইচ্ছা প্রকাশ করে না।

সারা দেশের সাম্প্রদায়িক বিভাজনের নগ্ন অমানবিক রূপ এই অসহায় সময়ে আরও স্পষ্ট করে ফুটে উঠেছে। খুব স্পষ্টভাবে সরকারি-বেসরকারি ত্রাণ পরিষেবা— যাও বা হিন্দু অধ্যুষিত জলমগ্ন গ্রামগুলোতে জুটছে, তা মুসলমান জলমগ্ন গ্রামগুলোতে পৌঁছাচ্ছে না। মুসলমান গ্রামগুলোতে সরকারি হেলিকপ্টার থামে না। গ্রামের মানুষের কাপড় ওড়ানো বা ডাকাডাকিতেও। এসব ভিডিও সেইসব মানুষ-ই সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করেছেন। স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন সহ বিভিন্ন ক্লাব বা ব্যক্তি উদ্যোগে তোলা ত্রাণ পরিষেবাও সেসব গ্রামে খুব নগণ্য হারে পৌঁছায়। অনেকক্ষেত্রে পৌঁছায়ই না। এই প্রসঙ্গেই শিলচরের ভাইরাল হওয়া কিছু ভিডিওর কথা মনে পড়ল, যেখানে দেখা গেছে বজরং দলের তরফে পানীয় জল দেওয়ার আগে পরিবারের সদস্যদের দিয়ে ‘ভারত মাতা কি জয়’ স্লোগান উচ্চারণ করাতে।

এই যখন গোটা জেলার অবস্থা তখন আমরা কজন প্রাইমারি শিক্ষক ব্যক্তি উদ্যোগে টাকা তুলে জলমগ্ন গ্রামগুলোতে পাড়ি দিয়েছিলাম যতটুকু সম্ভব ত্রাণ সহায়তা পৌঁছাতে। তাতে আমাদের যে অভিজ্ঞতা তা ভয়াবহ। যে ৭২০ পরিবারে আমরা ত্রাণ সহায়তা পৌঁছেছি, সেখানে আমাদের আগে আর কোনও ত্রাণ সহায়তা পৌঁছায়নি। সম্ভবত আমাদের পরেও একই রয়েছে তা। কয়েকটা ভাঙাচোরা নৌকায় আমরা কচুরিপানা-ঘাসের জঙ্গলে ভরা জলভূমি ঠেলে মানুষগুলোর বাড়ির দোরগোড়ায় হাজির হয়েছিলাম। বাড়ির উঠোনে কোমর জল। এভাবেই আছেন গত ১৯ জুন থেকে। মুসলমান গ্রামগুলোর অবস্থা আরও ভয়াবহ। এক তো কোনও বেসরকারি উদ্যোগেও ত্রাণ পৌঁছায় না। তারপর গ্রামের পঞ্চায়েত মেম্বারের মাধ্যমে যে সরকারি ত্রাণ এসেছে স্কুলবাড়ি বা উঁচু জায়গায়, সেখানে জল ঠেলে এই মানুষেরা অনেকেই যেতে পারেননি। যাঁরা যেতে পেরেছেন কলাগাছের ভেলা বা কোনও জরাজীর্ণ নৌকায়, তাদের দু কিলো চাল আর আড়াইশো ডাল দিয়ে কাগজে পাঁচ কিলো চাল আর দু কিলো ডালের পাশে টিপ সই করিয়ে রাখা হয়েছে। দুধ থেকে তেল ইত্যাদি কোনও সামগ্রীই মিলছে না। তাও চাল-ডাল জুটেছে মাত্র একদিন। লবণ জুটেছে এক কাপ। আর কিছু তাঁরা পাননি। এমনকি পানীয় জল। অথবা জল পরিশুদ্ধ করার ক্লোরিন ট্যাবলেটও সরকারের তরফে মিলেনি। একদম ভেতরের দিকের প্রত্যন্ত দুর্গম অঞ্চলের হিন্দু গ্রামগুলোতেও তা। অসুখ করলে এই জল ঠেলে হাসপাতালে যাওয়ার অবস্থা নেই। পোয়াতি মায়েদের এই জলেই সন্তান প্রসব করতে হবে। দ্বিতীয় কোনও উপায় নেই।

আমরা মাত্র কয়েকজন শিক্ষক— যাদের কোনও প্রশাসনিক ক্ষমতা নেই, ব্যাকআপ নেই, লাইফবোট নেই, খাদ্যভাণ্ডার নেই, তথ্য নেই, ম্যাপ নেই, কিছুই নেই— জলমগ্ন এই সহায়হীন মানুষগুলোর বাড়ি খুঁজে পেয়েছি। নিজেদের যেটুকু ক্ষমতা তা নিয়ে তাঁদের বাড়ির দোরগোড়ায় পৌঁছতে পেরেছি। সেসব গ্রামের মানুষেরা বলেছেন, নৌকার মাঝিরা বলেছেন আমাদের, ‘এভাবে বাড়ি খুঁজে খুঁজে বাড়ির উঠোনে পৌঁছে সহায়তা করতে আমাদের কাছে আর কেউ আসেননি কখনও। আপনারাই প্রথম।’ শুনে প্রশ্ন জেগেছে মনে, যাদের সমস্ত প্রশাসনিক ক্ষমতা-ব্যাকআপ রয়েছে, লাইফ বোট থেকে হেলিকপ্টার রয়েছে, বিশাল খাদ্যভাণ্ডার রয়েছে, কাড়ি কাড়ি টাকার তহবিল রয়েছে, লোকবল রয়েছে, তারা চাইলে কী করতে পারত? কতটা করতে পারত? জলবন্দি দরিদ্র নাগরিকেরা কি একবেলা, কোনওদিন কোনওবেলা না খেয়ে এইভাবে অসহায় দিনযাপন করতেন? উত্তরটা হল, না। হত না। সবকিছু ভালো হত। সব মানুষ সহায়তার আওতায় আসতেন।

আমরা দেখিয়েছি দুর্গম জলমগ্ন বাড়িগুলোতেও ত্রাণ পরিষেবা পৌঁছে দেওয়া যায়। সরকারের সদিচ্ছা থাকলে কোটি কোটি টাকা ত্রাণের নামে উড়িয়ে, ত্রাণ কেলেঙ্কারি-তছরুপ না করেও, এর অর্ধেক টাকায় সমস্ত নাগরিককে ত্রাণ পরিষেবার আওতায় আনা যায়। প্রত্যেকের বাড়ির দোরগোড়ায় সহায়তা পৌঁছে দেওয়া যায়। সরকার ইচ্ছা করলে সমস্ত ত্রাণ তছরুপ বন্ধও করতে পারে। কারা ত্রাণ তছরুপ করছে, কাদের মদতে ত্রাণ চুরি হচ্ছে সরকার সব জানে। প্রশাসন সব জানে। চক্র আধিকারিকের অফিসের সামনে রোজ ট্রাক ট্রাক ত্রাণসামগ্রী জড়ো হয়। গ্রামের বন্যাপীড়িতরা বলছেন তারা কিছুই পাচ্ছেন না প্রায়। যা জুটছে তা দিয়ে একদিন পাড়ি দেওয়াও সম্ভব নয়। তাহলে সেই ট্রাক ট্রাক মাল যাচ্ছে কোথায়?

ইতিমধ্যেই গবাদিপশুর মড়ক শুরু হয়েছে। প্রান্তিক দরিদ্র মানুষের এই বন্যায় রুজি-রোজগার সব গেছে। যেভাবে জল জমে আছে এবং যেভাবে লাগাতার বৃষ্টি হয়েই যাচ্ছে, তাতে আগামী তিন মাসের আগে পরিস্থিতি অনুকূল হবে না। ফলত চাষাবাদও এবার কিছুই করা সম্ভব হবে না। ধানের বীজ ফেলার মাঠ বা সময়ই তো থাকবে না! এমতাবস্থায় যদি গবাদিপশুগুলোও মড়কে মরে যায়, গ্রামীণ কৃষক তথা খেটেখাওয়া পরিবারের সর্বস্ব যাবে! গ্রামীণ অর্থনীতি শূন্যতে গিয়ে দাঁড়াবে। দুর্ভিক্ষ শুরু হবে সমস্ত জেলায়।

আমাদের এই কয়েকদিনের কাজ করার বাস্তব অভিজ্ঞতা বলছে প্রশাসন এবং সরকারের সদর্থক সাহায্য ছাড়া জেলার কয়েকশো গ্রামের লক্ষাধিক মানুষকে সহায়তা পৌঁছানো সম্ভব নয়। কোনওমতেই নয়। সরকার যদি সাম্প্রদায়িক বিভাজনের রাজনীতি ত্যাগ করে সমস্ত নাগরিকের সাহায্যার্থে অন্তত সপ্তাহ বেসিসে রেশন দেওয়া শুরু না করে, সরকারি খাদ্যভাণ্ডার থেকে চাল ডাল তেল সয়াবিন বিস্কুট দুধ জল ব্লিচিং সহ প্রয়োজনীয় সামগ্রী যথেষ্টভাবে না দেয়, স্বাস্থ্যবিভাগ থেকে বিনামূল্যের ওষুধের সরবরাহ না করে, পশুখাদ্য থেকে গবাদিপশুর ওষুধ বিতরণ না করে, ইলেকট্রিসিটি বন্ধ থাকা গ্রামগুলোতে পরিবার অনুযায়ী কেরোসিন তেল দেওয়ার ব্যবস্থা না করে, মশার জন্য ডিডিটি ওষুধ জল-জঙ্গলে ঘেরা জায়গাগুলোতে স্প্রে না করায়, প্রশাসনের মজুত করে রাখা লাইফবোটগুলোকে যদি জলমগ্ন প্রান্তিক বাড়িগুলোতে সহায়তা পৌঁছাতে না ব্যবহার করে, সরকারের ত্রাণভাণ্ডার থেকে যে অসাধু ব্যবসায়ী-পঞ্চায়েত মেম্বার-ডিপার্টমেন্টের কর্মী ত্রাণ তছরুপ করছে— তাদের দেখার জন্য কোনও ভিজিল্যান্স না গঠন করে, উদ্যমী নাগরিক— যারা বন্যাত্রাণে জনগণকে সাহায্য করতে চায় বিনাস্বার্থে, তাঁদের যদি সরকারের ত্রাণভাণ্ডার সহ প্রশাসনের তরফে সাহায্য না করা হয়— তবে এই বন্যাপরবর্তী পরিস্থিতি থেকে গ্রামের নিম্নবিত্ত, মধ্যবিত্ত মানুষেরা বাঁচতে পারবেন না। অনাহারে, অর্ধাহারে, রোগে, মড়কে, বাড়ি ধসে মৃত্যু তাদের অবধারিত। প্রান্তিক মুসলমান-হিন্দু উভয়েরই।

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4879 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...