রৌহিন ব্যানার্জি
প্রবন্ধকার, কলামনিস্ট, সমাজকর্মী
সিঙ্গুর— দেউচা পাঁচামি— ফারাক্কা। এক ব্র্যাকেটে আসবে কি না, এখনও নিশ্চিত বলা যায় না— প্রচুর মিল যেমন আছে, তেমনই বেশ কিছু অমিলও আছে। ভাঙ্গর এবং নন্দীগ্রামকে এই তালিকায় ইচ্ছে করেই রাখা হল না— ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করি নন্দীগ্রামের গল্পটা আলাদা। ভাঙ্গরের গল্প আরও আলাদা। সে আলোচনা অন্যত্র করা যাবে— আপাতত ওপরের তিনটি স্থানের আলোচনায় সীমাবদ্ধ থাকি, কারণ এগুলির ক্ষেত্রে মিল এবং অমিলগুলি অনেকটা একই ধরনের। অন্য কিছু নামও আলোচনায় অবশ্যই আসবে, প্রসঙ্গক্রমে।
মিল কোথায় কোথায়? প্রথম এবং প্রধান মিল অবশ্যই, তিন জায়গাতেই ব্যক্তিমালিকানাধীন সংস্থার প্রোজেক্টের জন্য জমি প্রয়োজন, সাধারণ মানুষ জমি দিতে নারাজ, প্রশাসন ব্যক্তি-মালিকের পক্ষে। এবং হ্যাঁ, তিন জায়গাতেই ক্ষতিপূরণের গল্প আছে— এমন দাবীও আছে যে এরকম ‘প্যাকেজ’ নাকি দুনিয়ার কোথাও কখনও দেওয়া হয়নি। অথচ এমন দাবী সত্ত্বেও তিন জায়গাতেই সাধারণ কৃষকেরা নিজেদের জমি দিতে নারাজ। আবার অমিল দেখতে গেলে, সিঙ্গুর এবং ফারাক্কা কৃষিজমি হলেও দেউচা তা নয়। সিঙ্গুরে ব্যক্তি-মালিকের জন্য হলেও জমি অধিগ্রহণ করেছিল সরকার, দেউচাতেও তাই, কিন্তু ফারাক্কায় জমি অধিগ্রহণই হয়নি, সরাসরি জমিমালিকের সঙ্গে প্রতিষ্ঠানের লেনদেনের কথা হয়েছে। এবং, সিঙ্গুরে যিনি ছিলেন প্রধান প্রতিবাদী, যার তীব্র আন্দোলনের ধাক্কায় শুধু টাটাবাবুরা হাত গুটিয়ে ফিরে যেতে বাধ্য হননি— সেই আন্দোলনের ধাক্কাতেই শেষ অবধি পতন হয় চৌত্রিশ বছরের বামফ্রন্ট সরকারের, সেই ‘অগ্নিকন্যা’ই দেউচা এবং ফারাক্কার ক্ষেত্রে প্রশাসনিক প্রধান এবং পুলিশমন্ত্রী। কিন্তু তা সত্ত্বেও, প্রধান মিলটা সেই থেকেই যাচ্ছে— ‘অনিচ্ছুক জমিমালিক’ এবং প্রশাসনিক অতি-সক্রিয়তা।
আরেকটা খুব গুরুত্বপূর্ণ মিল আছে দেউচা পাঁচামি এবং ফারাক্কায়— দুইক্ষেত্রেই ব্যক্তিমালিকানাধীন সংস্থাটির মালিকের নাম গৌতম আদানি— যে আমাদের, আমার আপনার সামান্য সঞ্চয়ের কয়েক হাজার কোটি টাকা ব্যাঙ্ক থেকে ঋণ নিয়ে সেই টাকা শোধ করেনি— আর করবেও না, কারণ ব্যাঙ্ক সেই ঋণ ‘মকুব’ (রাইট অফ) করে দিয়েছে— আহা, গরিব মানুষ অত টাকা কোত্থেকে পাবে বলে। এবং যারা এ বছরের বেঙ্গল সামিট-এর ছবি দেখেছেন, প্রায় সব গুরুত্বপূর্ণ ছবিতে আসর আলো করে বসে আছেন এই তস্করশ্রেষ্ঠ। মমতা ব্যানার্জীর ঠিক পাশেই। হ্যাঁ সেই মমতা ব্যানার্জী, যিনি সিঙ্গুরে ধর্নায় বসেছিলেন, যিনি সরকার গড়ার সময়ে ঘোষণা করেছিলেন, তার সরকার কখনও জোর করে কৃষিজমি অধিগ্রহণ করবে না। তা তিনি সে কথা রেখেছেন বই কি। দেউচায় তিনি কোনও জোর করছেন না— প্যাকেজ দিয়ে রেখেছেন। বাদবাকি যা করার, করছেন কেষ্টবাবু ও তার অর্বুদপতি দেহরক্ষীবৃন্দ। ঠিক যেমন ভাঙ্গরে করেছিলেন আরাবুল। আর ফারাক্কায় সরাসরি আদানিবাবুই যা করার করছেন, পুলিশ সামান্য ‘সহায়তা’ দিচ্ছে মাত্র। বঙ্গজননী নিষ্কলঙ্ক সততার প্রতীক। তাঁর পুলিশ ফারাক্কায় পুরুষ মহিলা নির্বিশেষে বাধাদানকারীদের ওপর লাঠি চালাচ্ছে নির্বিচারে।
কিসে ‘বাধাদান’? আদানি বাংলাদেশে বিদ্যুৎ বেচবে, তার হাইটেনশন তারের লাইন যাবে মালদার আম, লিচুবাগানের ওপর দিয়ে। এতে রাজি নন চাষিরা। তার ফলে তাঁদের মিথ্যা মামলায় ফাঁসানো হল, ভয় দেখানো হল। এরপর স্থানীয় কৃষক লুৎফর রহমানের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে একটি মামলা করেন। বিচারক সব্যসাচী ভট্টাচার্যের এজলাসে রায় দেওয়া হয় যে “আবেদনকারীর সম্পত্তির রিকুইজিশন বা অধিগ্রহণ না করে এবং/অথবা আবেদনকারীকে যথাযথ ক্ষতিপূরণ না দিয়ে উল্লিখিত ট্রান্সমিশন লাইনের কাজ আবেদনকারীর সম্পত্তির ওপর করা যায় না।” (একটি বহুল প্রচারিত বাংলা দৈনিক এটার খবর করে যে “আদানিদের নিরাপত্তা দেবে রাজ্য হাইকোর্ট”)— অথচ এই রায়ের পরেও অনিচ্ছুক মালিকদের বাগানের ফলন্ত আম ও লিচু গাছ কেটে নেওয়া শুরু হল প্রশাসনের সক্রিয় মদতে। এতেই ‘বাধাদান’ করতে গেছিলেন কৃষকেরা। বাকিটা আদানি এবং প্রশাসন বুঝে নিয়েছেন, তাদের নিজ নিজ স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে। সংযুক্ত কিষাণ মোর্চার পক্ষ থেকে একটি প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে—
এটা দুঃখের বিষয় যে শাসকদলের স্থানীয় নেতৃত্ব এবং স্থানীয় পুলিশ নির্লজ্জভাবে কর্পোরেটদের পক্ষ নিয়ে আন্দোলনকারীদের হুমকি, এমনকি প্রাণনাশের হুমকি দিচ্ছে। মারধর ও মিথ্যা ফৌজদারি মামলা দায়ের করার মত পদক্ষেপ নিয়ে আন্দোলন ভাঙতে চাইছে তারা। আজ ফরাক্কা থানার পুলিশ সব সীমা ছাড়িয়ে গিয়ে বিনা প্ররোচনায় প্রতিবাদীদের শান্তিপূর্ণ অবস্থানের ওপর অমানুষিক, বর্বর আক্রমণ নামিয়ে এনেছে। পুলিশের লাঠির আঘাতে ও ছোঁড়া পাথরে বহু প্রতিবাদী রক্তাক্ত হয়েছে। গুরুতর জখম অন্তত ১২ জন। তাঁদের চিকিৎসা চলছে।
এই ট্র্যাডিশনের পূর্বানুবৃত্তি আমরা দেখেছি ফারাক্কা বাঁধ তৈরির সময়ে, সল্টলেক উপনগরী তৈরির সময়ে, নন্দীগ্রামে, হরিপুরে, সিঙ্গুরে (তখন অবশ্য মিডিয়া এত সর্বগ্রাসী ছিল না, ফেসবুক ইত্যাদিও ছিল না— ফলে অনেক খবরই সামনে আসত না), ভাঙ্গরে, হলদিয়ায়, দেউচায়। দেউচার ক্ষেত্রে অবশ্য পুলিশ সরাসরি ময়দানে নামেনি— কারণ সেখানে সরকারের ‘ন্যাস্টি বিজনেস’ সামলানোর জন্য রয়েছে এক সুপারম্যান— মাথায় অক্সিজেন কম যাওয়া শ্রীকেষ্টবাবু। যার দেহরক্ষীর সম্পত্তি নাকি তার নিজের এবং তার সততার প্রতীক নেত্রীর ঘোষিত সম্পত্তির যোগফলের চেয়েও অনেক গুণ বেশি। তো বিষয়টা হল, দেউচায় তাই প্রশাসনের প্রয়োজন পড়েনি— পরমব্রতরাই গিয়ে কাজ সেরে এসেছেন। পেছনে অনুব্রত দাঁড়ালে উচ্চিংড়েকেও টেরাডাকটাইল মনে হয়— প্রাচীন অরণ্য প্রবাদ। কিন্তু প্রশ্ন হল, এই ট্র্যাডিশনটি আসলে কী? যা সরকার নির্বিশেষে— কংগ্রেস, বামফ্রন্ট, তৃণমূল— সবাই কখনও না কখনও পালন করে আসছে— প্রয়োজনে গায়ের জোরেও? কী সেই মুলো, যা ঝুলছে বলে রাজা আসে যায় কিন্তু দিন বদলায় না?
সেই মুলোর আসল নাম, কর্পোরেট। মুনাফা। এই কর্পোরেটের সঙ্গে কিন্তু মারওয়াড়ি ‘বেওসায়ি’দের তফাত আছে। খুব তুল্যমূল্য না হলেও, চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের আগের আর পরের জমিদারদের যেমন তফাত, এ-ও অনেকটা সেরকম। কর্পোরেটরা ঝাঁ চকচকে, ‘মাল্টি-ন্যাশনাল’, ‘ল-অ্যাবাইডিং’ ব্যবসায়ী। আজ্ঞে হ্যাঁ, বড় দরের কর্পোরেটরা সমস্ত আইন নিখুঁতভাবে মেনে চলেন, সেজন্য তাদের আলাদা মাইনে করা ল সেলও থাকে। নিয়মিত অডিট হয়। এঁরা ‘দেশপ্রেমী’ এবং ‘প্রয়োজনে’ সরকারকে বিভিন্ন সহায়তা দিয়ে থাকেন। শুধু ‘ক্যাচ’টা হল, এই ‘আইন’গুলি তাদের পছন্দমতোই ডিজাইন করা হয়ে থাকে। এমন আইন, যা মানলে তাদের মুনাফা বাড়ে বই কমে না। এরকমভাবে কেন করা হয়? কারণ আইন যাঁরা চর্চা করেন, তাঁদের ইনস্টিটিউটগুলি এঁদের টাকায় চলে। আইনের বই যাঁরা লেখেন, তাঁদের প্রকাশনা এঁদের টাকায় হয়। আইন যাঁরা প্রণয়ন করেন, তাঁরা এঁদেরই অর্থানুকুল্যে ভোটে জিতে সংসদে আসেন। অতএব, ল ইজ অফ দ্য কর্পোরেট, বাই দ্য কর্পোরেট, ফর দ্য কর্পোরেট। সততায় বেশি মুনাফা হলে আমি অসৎ হতে যাব কোন দুঃখে?
মুখ্যমন্ত্রী কে, কোন রাজনৈতিক দলের, তিনি ব্যক্তিগতভাবে সৎ না অসৎ, এগুলো ততটা গুরুত্বপূর্ণ নয়— যতটা গুরুত্বপূর্ণ এই ডিজাইনটা। বিধান রায়, সিদ্ধার্থ রায়, জ্যোতি বসু, বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য বা মমতা ব্যানার্জীর চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ অন্য কতগুলি নাম— টাটা, বিড়লা, বাজাজ, খৈতানদের ট্র্যাডিশন বহন করে চলেছে আম্বানি, আদানি, জিন্দাল, কোটাকেরা। শুধু পোশাকের রং বদলাচ্ছে, দিন বদলাচ্ছে না। আদানি ‘শিল্প’ আনবে, অতএব সে চাইলে ফারাক্কার আম-লিচুর বাগান ধ্বংস করবে প্রশাসন— কয়েক হাজার কৃষকের আপত্তি ধোপে টিঁকবে না। আদানি চাইলে চলে যেতে হবে দেউচার আদিবাসীদের— কয়লাখনির শ্রমিক হতেই হবে কৃষক/পশুপালক/মধু সংগ্রাহককে। যেমন টাটা চেয়েছিল বলে নষ্ট হয়ে গেছে সিঙ্গুরের হাজার একর তিনফসলি কৃষিজমি। বাজাজ, বিড়লারা চেয়েছিল বলে সল্টলেক ভেড়ি থেকে উচ্ছেদ হতে হয়েছিল ভেড়ি মালিকদের, স্থানীয় কৃষকদের। আম্বানি চেয়েছে বলে এখন উচ্ছেদ হতে হচ্ছে রাজারহাটের কৃষকদের। জিন্দাল চেয়েছে বলে হলদিয়া, শালবনির আদিবাসীদের। কারণ তারাই চালায় দেশটা। আমি আপনি শুধু ভোট দিই— ওরা সরকার গড়ে। মুকেশ আম্বানির ছেলের বিয়েতে দেশের প্রধানমন্ত্রী হাতজোড় করে ছুটে যান ফাইফরমাশ খাটতে। বিশ্বজোড়া এই ট্র্যাডিশন— জালের ঘরের আড়ালে বসে দেশ চালায় আসল রাজারা। পশ্চিমবঙ্গ তার বাইরে হবে কী করে? অতএব…
গোটা পৃথিবীকে গিলে খেতে চায় সে-ই যে ন্যাংটো ছেলেটা
কুকুরের সাথে ভাত নিয়ে তার লড়াই চলছে, চলবে।
পেটের ভিতর কবে যে আগুন জ্বলেছে এখনও জ্বলবে!