কণিষ্ক চৌধুরী
প্রাবন্ধিক, শিক্ষক
পূর্ব প্রকাশিতের পর
পাঁচ.
রামমোহনকে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির এই অপছন্দের কারণগুলি উপরিত্বকের বিষয়। বিরোধের কারণ আরও গভীরে। একটু ভেঙে বলা দরকার।
কোম্পানির একচেটিয়া কারবারের অধিকারের সঙ্গে ছিল ইংল্যান্দের বাণিজ্যিক পুঁজিবাদের একটি গভীর সম্পর্ক। সেটা চোখ এড়ালে চলবে না। ১৭৫৭-পরবর্তী পর্বে কোম্পানি এই বাণিজ্যকর্মটির পাশাপাশি পেয়ে গেল শাসনক্ষমতাও পড়ে পাওয়া চোদ্দ আনার মতো। শুরু হল লুণ্ঠনের কাল।
১৭৫৭ থেকে ১৮৩৩— এই সময়টি কখনওই একমাত্রিক ছিল না। নানা ওঠাপড়া, সংঘাত, আপস ও প্রতারণার সমন্বিত সময়ের এক জটিল বিন্যাস। উপনিবেশ ও তার বিকাশের পর্বগুলিকে চিহ্নিত করা যেতে পারে এইভাবে:
প্রথম পর্ব
- ১৭৫৭: পলাশীর যুদ্ধ। কোম্পানির জয়, সিরাজের পরাজয়। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ক্ষমতার বিপুল বৃদ্ধির সূচনা-মুহূর্ত।
- ১৭৫৭-৬৪: বক্সারের যুদ্ধ। বাংলায় স্বাধীন নবাবি শাসনের পূর্ণ অবসান। মীরকাশিমের পরাজয়।
দ্বিতীয় পর্ব
- ১৭৬৫: ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির দেওয়ানি লাভ। দ্বৈত শাসনের আবির্ভাব।
- ১৭৭০: ছিয়াত্তরের মন্বন্তর। বাংলার এক-তৃতীয়াংশ মানুষের মৃত্যু।
- ১৭৭২: দ্বৈত শাসনের অবসান। বাংলার গভর্নর হিসেবে ওয়ারেন হেস্টিংস-এর আবির্ভাব।
তৃতীয় পর্ব[1]
- ১৭৭৪: কোম্পানির ভূখণ্ডের গভর্নর জেনারেল হিসেবে ওয়ারেন হেস্টিংস।
- ১৭৮৬: হেস্টিংসের কর্মকালের অবসান। গভর্নর জেনারেল হিসেবে লর্ড কর্নওয়ালিস-এর আগমন।
- ১৭৯৩: চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের প্রচলন এবং কর্নওয়ালিসের কার্যকালের পরিসমাপ্তি।
- ১৮১১: চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত সম্পর্কে কোম্পানির মোহভঙ্গ।
চতুর্থ পর্ব
- ১৮১৩: চার্টার আইন— ভারতের সঙ্গে ব্রিটেনে কোম্পানির একচেটিয়া ব্যবসা রদ।
- ১৮৩৩: চার্টার অ্যাক্ট।
এই ঐতিহাসিক পর্বের প্রথম দুটি পর্বের ইতিহাস হল এক নির্লজ্জ লুণ্ঠনের ইতিহাস। ১৭৫৭-তে সিরাজউদ্দৌল্লার হত্যার পর মীরজাফরকে মুর্শিদাবাদের নাজিম পদে অভিষিক্ত করানো হল আর শুরু হল এই অবাধ লুণ্ঠনের পর্ব। ক্লাইভ ও তার অন্যান্য ইংরেজ সঙ্গীরা মুর্শিদাবাদের কোষাগার থেকে প্রায় এক কোটি টাকা লুঠ করে। ক্লাইভ নিজে নিয়েছিল ১৯ লক্ষ টাকা। এছাড়াও ক্লাইভ পেয়েছিল ২৪ পরগণার জায়গির যেখান থেকে তার আয় হত ৬.৫ লক্ষ টাকা। লুণ্ঠন এখানেই থামল না। ১৭৬০ খ্রিস্টাব্দে মীরজাফরকে অপসারণ করে মীরকাশিমকে নবাবের পদ দান করে কোম্পানি। এর জন্য কোম্পানির কাউন্সিলের সদস্যদের নজরানা হিসেবে মীরকাশিমকে দিতে হয় ১৬ লক্ষ টাকা। নবাব পদ বিক্রি তখন কোম্পানির কাছে এক লাভজনক ব্যবসায় পরিণত হয়। মীরকাশিমের সঙ্গে কোম্পানির বিরোধের পরিণতিতে ১৭৬৩ খ্রিস্টাব্দে মীরজাফরকে তারা আবার নবাব পদ দান করে। বিনিময়ে মীরজাফরকে দিতে হয় ১৮.৫ লক্ষ টাকা। এসবের মধ্যে দিয়ে কোম্পানির থেকেও কোম্পানির কর্মচারীরা অনেক বেশি লাভবান হয়। ১৭৬৩ খ্রিস্টাব্দ থেকেই বাংলার আর্থিক ব্যবস্থায় সরাসরি অনুপ্রবেশ করে কোম্পানির কর্মকর্তারা রাজ্যের অন্তর্বাণিজ্যের ওপর একচেটিয়া কর্তৃত্ব স্থাপনে অগ্রসর হয়।[2]
১৭৬৪ খ্রিস্টাব্দে বক্সারের যুদ্ধের বেদনাদায়ক পরিণতিতে কোম্পানির সামনে লুণ্ঠনের সিংহদরজা খুলে গেল। ১৭৬৫ খ্রিস্টাব্দে কোম্পানি সম্রাট শাহ আলমকে বাধ্য করল বাংলা-বিহার-ওড়িশার দেওয়ানি তাদের হাতে তুলে দিতে। এর ফলে কোম্পানি এই তিন প্রদেশের রাজস্ব সংগ্রহের অধিকারী হয়ে ওঠে। আর নবাব (নাজিম)-এর হাতে থাকল প্রশাসনের দায়িত্ব। এইভাবে দ্বৈত শাসনের সূত্রপাত। কোম্পানি রাজস্ব আদায়ের জন্য নিযুক্ত করল রেজা খাঁ (বাংলা) এবং সিতাব রায় ও দেবী সিংহ (বিহার)-কে। রাজস্ব সংগ্রহের নামে তারা শুরু করে দস্যুতা। তাদের বীভৎস অত্যাচার ও শোষণে কেবল কৃষক, হস্তশিল্পীরাই নয়, জমিদাররাও বিপর্যস্ত হয়ে পড়ল। ১৭৬৪-৬৫-তে রাজস্ব আদায় হয়েছিল ১ কোটি ২৩ লক্ষ টাকা। ১৭৬৫-৬৬-তে তা হয়ে দাঁড়াল ২ কোটি ২০ লক্ষ টাকা। “এই ভূমি রাজস্ব ও কর্মচারীদের উৎকোচ, ব্যক্তিগত ‘ব্যবসা’ ব্যতীত ‘প্রকাশ্য’ ব্যবসায়, অর্থাৎ বাংলা ও বিহারের জনসাধারণের টাকা দ্বারা এদেশে পণ্য ক্রয় করিয়া এবং য়ুরোপের বাজারে তাহা বিক্রয় করিয়া যে মুনাফা পাওয়া যাইত তাহার পরিমাণও অবিশ্বাস্য! রাজস্বের এক অংশ দ্বারা এদেশ হইতে পণ্য ‘ক্রয়’ করিয়া য়ুরোপে চালান করা হইত, এবং সমগ্র মুনাফা গ্রাস করিত কোম্পানি, ইহাকে বলা হইত ‘কোম্পানির লগ্নি’।”[3] মার্কস, রেনল্ডস প্রমুখ এই প্রকাশ্য ব্যবসার নাম দিয়েছেন ‘প্রকাশ্য দস্যুতা’। এই দস্যুতার ফলেই দেখা দিল ছিয়াত্তরের মন্বন্তর (বাংলা ১১৭৬ ও ইংরাজি ১৭৭০)। এই দুর্ভিক্ষের বছরেও সংগৃহীত রাজস্বের পরিমাণ পূর্ববর্তী বছরের থেকে ৬.৫ শতাংশ বৃদ্ধি পায়। একই সময়ে ইংরেজ পরিদর্শকেরা শস্যের বাণিজ্যের ওপর একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ কায়েম করে প্রচুর অর্থলাভ করেছিল। এসবের ফল হল ভয়ঙ্কর— বাংলার এক-তৃতীয়াংশ মানুষের মৃত্যু।[4]
১৭৭২-এ বাংলার গভর্নর হিসেবে হেস্টিংস কাজ শুরু করে এই দ্বৈত শাসনের অবসান ঘটালেন। রেজা খাঁ ও সিতাব রায়কে বরখাস্ত করে রাজস্ব সংগ্রহের কাজটি কলকাতা কাউন্সিল (পরে বোর্ড) অফ রেভিনিউ-এর অধীন নিয়ে এলেন। নবাবের ভাতা ৩২ লক্ষ থেকে ১৬ লক্ষ টাকা করা হল। দেওয়ানি ও ফৌজদারি আদালত মুর্শিদাবাদ থেকে কলকাতায় নিয়ে আসা হল। ফলে প্রশাসনে নবাবদের আর কোনও ভূমিকাই থাকল না। প্রশাসন, আইন ও বিচারের সম্পূর্ণ ক্ষমতা হেস্টিংস কোম্পানির হাতে তুলে দিলেও মুঘল আইন ও আদালতের খুব একটা পরিবর্তন ঘটালেন না। এখানে মুসলমান আইন ছিল মুসলমানদের জন্য এবং হিন্দু আইন হিন্দুদের জন্য। বিচারব্যবস্থার পরিবর্তন করা না হলেও, নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা ছিল কোম্পানির হাতেই। আদালতে পার্সি ভাষা ব্যবহারের ধারাবাহিকতা বজায় থাকলেও ‘হিন্দু’ ও ‘মুসলিম’ আইনগুলিকে ইংরাজি ভাষায় রূপান্তরিত করার প্রক্রিয়া শুরু হয় এই সময়েই।[5]
যে-বছর ওয়ারেন হেস্টিংস বাংলার গভর্নর জেনারেল হন, সে-বছর (১১৭২) রামমোহনের জন্ম। রামমোহনের শিক্ষাজীবন যখন শুরু হয় (১৭৮০) তখন ওয়ারেন হেস্টিংস ব্রিটিস ভূখণ্ডের গভর্নর জেনারেল। ফলে হেস্টিংসের ধর্মনিরপেক্ষতার নীতি (the policy of religious neutrality) তখনও কার্যকর ছিল। কার্যকর ছিল কোম্পানির একচেটিয়া বাণিজ্য-কর্তৃত্ব। এই একচেটিয়া কর্তৃত্বের অবসান ঘটে ১৮১৩-তে। হেস্টিংসের লক্ষ্য ছিল নিজের ব্যক্তিগত লাভের পাশাপাশি কোম্পানির স্বার্থকেও রক্ষা করা। ঔপনিবেশিক শাসনের মূল ভিত্তিটিকে তিনিই প্রতিষ্ঠা করেন। বুকাননের মতে, “He… laid the real foundations of the British power in India.”[6] আইন-আদালতের দেশীয় ব্যবস্থা এবং দেশীয় ধর্ম ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে হস্তক্ষেপ না করার নীতি হেস্টিংস গ্রহণ করলেও, জমির ওপর বিপুল কর বসাতে তিনি দ্বিধা করেননি। অভ্যন্তরীণ বাণিজ্যের ওপর কোম্পানি ও তার কর্মকর্তাদের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার ফলে ভারতীয় বণিকরা বিপুলভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে থাকে। “এই আক্রমণ, ইংরেজ আধিকারিকদের ব্যক্তিগত ব্যবসার ক্ষেত্রে ভারতীয় বণিকদের তুচ্ছ সহায়ক হয়ে থাকতে বাধ্য করল: মহাজন, দালাল ও উপ-ঠিকাদার হিসাবে।”[7] বিরাট পরিমাণে ক্ষতি হয় অভ্যন্তরীণ বাণিজ্যের। প্রাক্তন অভিজাত ও ক্ষমতাবান ব্যক্তিদের আয় কমে যাওয়ায় চাহিদাও হ্রাস পায় ভীষণ পরিমাণে। একই কারণে হস্তশিল্পী ও অন্যান্য যারা বিভিন্ন পেশার সঙ্গে যুক্ত, তাদের অবস্থা ক্রমশ খারাপের দিকে যাচ্ছিল। পরিবহন ও উৎপাদনসামগ্রী তৈরিতে নিযুক্ত হাজার হাজার ঘোড়সওয়ার ও হস্তশিল্পীর কর্মচ্যুতি, যারা এতদিন ঐতিহ্যপূর্ণ দ্রব্য সরবরাহ ও পরিবহনের পরিষেবায় যুক্ত ছিল, প্রাক্তন প্রভাবশালী ব্যক্তিরা কদর করত, কিন্তু তাদের সম্বন্ধে পরবর্তী ইংরেজ উত্তরাধিকারীদের কোনও আগ্রহ ছিল না।[8] বিপুল অর্থ ও বাণিজ্যসম্পদের অধিকারী জগৎ শেঠদের অবনতির একেবারে তলানিতে ঠেলে দিল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির প্রবর্তিত অর্থনীতি।[9]
১৭৬৫-তে দেওয়ানি লাভের পর, বিশেষ করে ১৭৭২-এ হেস্টিংস ক্ষমতায় আসার পর দুটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের দিকে নজর দিতে হবে। প্রথমত, নবাবি আমলের প্রশাসনের সঙ্গে যুক্ত ফৌজদার, জিলাদার, থানাদার, কোতোয়াল, চৌধুরী, পাটওয়াড়ি, মণ্ডল এবং জমিদাররা দ্রুত সমাজজীবন থেকে অপসৃত হতে শুরু করে। দ্বিতীয়ত, ১৭৬০-এর দশকে কোম্পানির সঙ্গে যুক্ত ইংরেজ আধিকারিক ও কর্মচারীরা পদত্যাগ করতে শুরু করে বা তাদের পদত্যাগ করতে বাধ্য করা হয়। ফলে উপযুক্ত প্রশিক্ষিত আধিকারিক ও কর্মচারীর অভাবে কোম্পানি সমস্যায় পড়ে যায়। এরকম একটা পরিস্থিতিতে হেস্টিংস সাবেক কালের অভিজ্ঞ দেওয়ান, ওয়াদ্দেদার, সিকদার প্রমুখকে এইসব শূন্যস্থানে নিয়োগ করতে শুরু করেন। এই সাবেক উপাধিধারী ব্যক্তিদের এবার দেখা গেল নতুন ভূমিকায়, কোম্পানির সহযোগী রূপে। জন্ম নিল নতুন অভিজাত সম্প্রদায়ের।[10]
ভারতে ব্রিটিশ আধিপত্যের সূচনা ক্লাইভের হাত ধরে হলেও ঔপনিবেশিক ক্ষমতার প্রকৃত ভিত্তিভূমি তৈরি করেছিলেন ওয়ারেন হেস্টিংস। হেস্টিংসের পর দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপটি গ্রহণ করেন কর্নওয়ালিস। এটি হল ১৭৯৩-এর চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত। এই চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের যথার্থ উৎপত্তিকাল কিন্তু ওয়ারেন হেস্টিংসের সময়েই। সময়কালটি চিহ্নিত করা যায় ১৭৭৫ থেকে ১৭৯৩। রণজিৎ গুহ লিখেছেন:
চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের যথার্থ উৎপত্তিকাল… ১৭৭৫ থেকে ১৭৯৩ সাল। বলা বাহুল্য, আগের পর্যায়ের ভাঙনের কাজ এই যুগেও চলেছে: পুরনো জমিদারিব্যবস্থার চূড়ান্ত সর্বনাশ এই যুগেই ঘটে, সেচের অভাবে গ্রাম্য কৃষিব্যবস্থায় নিদারুণ সঙ্কট দেখা দেয়, একাধিক দুর্ভিক্ষ বাংলা ও বিহারে বিপর্যয় আনে, এবং কৃষকদের মধ্যে বেকারি ও দারিদ্র্যের তীব্রতা আরও বৃদ্ধি পায়। কিন্তু পুরনো ব্যবস্থার ধ্বংসলীলার মধ্যেই এই যুগ চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের দিকে এগিয়ে গেছে দুদিক থেকে: প্রথমত, এই যুগেই জমিতে ব্যক্তিগত মালিকানার প্রশ্ন প্রথম উত্থাপিত হয় এবং ১৭৮৯ থেকে ১৭৯৩ সালের মধ্যে তা আইনে পরিণত হয়; দ্বিতীয়ত, বাংলার কৃষিব্যবস্থা ইংল্যান্ডের অবাধ বাণিজ্যের আওতায় এসে পড়ার ফলে গ্রাম্য শিল্পের ধ্বংসের সূচনা দেখা দেয় এবং কাঁচামালের জন্য এদেশের অর্থনীতির ওপর ইংল্যান্ডের শিল্পস্বার্থের চাহিদার চাপ ক্রমেই বাড়তে থাকে।[11]
রণজিৎ গুহ চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের এই ১৮ বছরের ইতিহাসকে দুটি ভাগে বিভক্ত করেছেন— প্রথম পর্ব (১৭৭৫-৮৫) এবং দ্বিতীয় পর্ব (১৭৮৫-৯৩)। ১৭৬০ থেকেই ইংল্যান্ডে শিল্প বিপ্লব জোর কদমে শুরু হয়ে গেছে। রণজিৎ গুহ দেখিয়েছেন, চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের প্রথম পর্বে (১৭৭৫-৮৫) বাংলার কৃষি সমস্যা যতই ইংল্যান্ডের শিল্প বিপ্লবের আওতায় এসে পড়ে, ততই শিল্পস্বার্থের মুখপাত্রদের পক্ষ থেকে একদিকে যেমন এদেশের জমিতে ব্যক্তিগত মালিকানা প্রতিষ্ঠার জন্য লড়াই শুরু হয়, তেমনই অপরপক্ষে ইংল্যান্ডে কোম্পানির একচেটিয়া ব্যবসায়ের অধিকার কেড়ে নেওয়ার জন্য শুরু হয় পার্লামেন্টারি সংগ্রাম। পিটের ইন্ডিয়া অ্যাক্ট[12] (১৭৮৪) এবং ম্যাকফারসনের শাসনব্যবস্থায় (১৭৮৫-৮৬) এই পর্বের শেষ।
দেখা যাবে যে কোম্পানির বিরুদ্ধে অবাধ বাণিজ্যের অভিযান এবং যৌথ কৃষিস্বত্বের বিরুদ্ধে জমিদারি মালিকানার আক্রমণ, এই দুই চেষ্টাই আপাতত চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছতে না পেরে শেষ পর্যন্ত একটা মাঝামাঝি আপসে এসে থেমে যায়। দ্বিতীয় পর্বের (১৭৮৫-৯৩) বৈশিষ্ট্যটি মোটামুটি এইরকম: চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের তত্ত্বকে প্রথমে বিহারের মোকারারি বন্দোবস্তে এবং তারপর বিহার ও বাংলার দশসালা বন্দোবস্তে কার্যকরী করার চেষ্টা, এবং ইংল্যান্ডের বস্ত্রশিল্পের স্বার্থেই শেষ পর্যন্ত দশসালা বন্দোবস্তের ফলাফলের জন্য অপেক্ষা না করে ১৭৯৩ সালে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তকে আইনে পরিণত করা।[13]
ইংল্যান্ডের ইতিহাসে ১৭৬০-১৮০০ এই পর্বটি যথেষ্ট ঘটনাবহুল। এই পর্বেই শিল্প বিপ্লবের সূচনা হয় প্রথমে বস্ত্রশিল্পে। ১৭৬৪ খ্রিস্টাব্দে হারগ্রিভসের স্পিনিং জেনি-র আবিষ্কার বস্ত্রবয়ন শিল্পে একটা বিরাট পরিবর্তনের সূচনা করে। আর্করাইট ও ক্রম্পটনের প্রচেষ্টায় এই পরিবর্তন আরও গতি পেয়ে যায়। কয়লা ও লৌহশিল্পেও আসে একই রকম অগ্রগতি। ১৭৬৫ খ্রিস্টাব্দে জেমস ওয়াটের স্টিম ইঞ্জিন যে বিপ্লবের সূচনা করে, তারই প্রত্যক্ষ পরিণতিতে আবির্ভাব ঘটে ১৭৮৫ খ্রিস্টাব্দে কার্টরাইটের বাষ্পচালিত তাঁতযন্ত্রের। এইভাবে ইংল্যান্ডের শিল্প বিপ্লব গতি পেয়ে যায়। এই বিপ্লবের ফল: একদিকে সমস্ত কারখানাজাত পণ্যের মূল্যহ্রাস, বৃহদায়তন শিল্পোৎপাদনের শুরুয়াত, পুঁজিপতিদের আকাশছোঁয়া মুনাফা, মূলধন ও জাতীয় সম্পদের আকস্মিক বৃদ্ধি; আর অন্যদিকে দ্রুত হারে শ্রমজীবী মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধি, শ্রমিক শোষণের সুসংবদ্ধ রূপ, শ্রমিকদের সম্পদহরণ ও জীবনের অনিশ্চয়তা ইত্যাদি।
শিল্প বিপ্লবের ফলে অর্থনীতি ও সমাজের এই পরিবর্তন অনিবার্যভাবেই সামুদ্রিক বাণিজ্যের সূত্র ধরে উপনিবেশে হানা দিল। ভারতে উপনিবেশ স্থাপনের প্রক্রিয়াটি তাই একেবারেই আকস্মিক নয়। বরং সুনির্দিষ্ট কার্যকারণের ফল। আর সেইজন্য ভারতে ব্রিটিশ উপনিবেশের উত্থান-পতনের সঙ্গে যুক্ত রয়েছে নানা আন্তর্জাতিক ঘটনাসমূহ। শিল্প বিপ্লবের কথা এখানে উল্লেখ করা হয়েছে, তেমনই উল্লেখ করতে হবে আমেরিকায় ব্রিটিশ উপনিবেশের অবসানের কথাও। ১৭৮১-তে ইয়র্কটাউনে ফরাসি ও আমেরিকান বাহিনির কাছে কর্নওয়ালিসের আত্মসমর্পণের ফলে ব্রিটেন শেষপর্যন্ত তার আমেরিকান উপনিবেশগুলি হারায়— এই ঘটনা ভারতে ব্রিটেনের অধিকৃত অঞ্চলের ওপর জোরালো মনোনিবেশ দাবি করে।[14]
ইংল্যান্ডে তখন বাণিজ্যিক পুঁজির জায়গা দখল করল শিল্প পুঁজি। ভারতকে শুধু ব্যবসার ক্ষেত্র হিসেবে টিঁকিয়ে রাখতে আর ব্রিটিশ পুঁজিপতিরা রাজি হয়নি। যতদিন পর্যন্ত ইংরেজ বণিকরা ভারতে তৈরি শিল্পজাত পণ্য ক্রয় করে ব্যবসা করেছে ততদিন ভারতের শিল্পসম্ভাবনা ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি। কিন্তু পরবর্তীকালে [শিল্প বিপ্লবের পর] ব্রিটেনে উৎপাদিত শিল্পপণ্য ভারতে বিক্রি করা শুরু হয়। অর্থাৎ ভারতকে ব্রিটিশ পণ্যের বাজার হিসেবে ব্যবহার করার উদ্যোগ শুরু হয়।
সংক্ষেপে বলা যায় শিল্প বিপ্লবের ফলে বাণিজ্য পুঁজির সঙ্গে শিল্প পুঁজির সংঘাত লেগে যায়। এই সংঘাতের আরও একটি কারণ হল আমেরিকায় ব্রিটিশ উপনিবেশের অবসান (১৭৭৬)। ফলে অবাধ বাণিজ্যের চাপ অখণ্ডভাবে এসে পড়ল ভারতীয় উপনিবেশে। উপযোগবাদী জেরেমি বেন্থাম ও তাঁর অনুগামীরা ছিলেন অবাধ বাণিজ্য নীতির সমর্থক। তাঁরা চেয়েছিলেন ভারতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির একচেটিয়া ব্যবসার অবসান ঘটাতে। ১৮১৩ খ্রিস্টাব্দের চার্টার অ্যাক্টের মধ্যে দিয়ে ভারতে কোম্পানির একচেটিয়া বাণিজ্যের অবসান এবং অবাধ বাণিজ্য নীতির সূত্রপাত ঘটল। আর এইভাবে ব্রিটিশ শিল্প পুঁজি ভারতে প্রবেশ করল।
রামমোহন রায় বেন্থামের উপযোগবাদ দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন। তাঁর কাছে ইহজাগতিক স্বার্থই প্রধান, যদিও অনাধ্যাত্মিক নৈতিকতাকে তিনি গ্রহণ করেননি। তাঁর মনে হয়েছিল ভারতে এই অবাধ বাণিজ্য নীতি সদর্থক বিকাশের সূচনা করবে। ইউরোপের অভিজ্ঞতায় তিনি এটাই দেখেছিলেন। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির পরিচালকবর্গ ভারতীয় বাণিজ্যে কোম্পানির একচেটিয়া কর্তৃত্ব বজায় রাখতেই সচেষ্ট থাকত। ফলে কোম্পানির সঙ্গে রামমোহনের যে সুসম্পর্ক থাকবে না, এটা বলাই বাহুল্য। রামমোহনের সঙ্গে কোম্পানির সম্পর্ক পর্যালোচনার ক্ষেত্রে এই দুই ভিন্নমুখী অর্থনৈতিক ভাবনার প্রেক্ষাপটটি তাই এড়িয়ে যাওয়া গেল না। প্রকৃতপক্ষে অবাধ বাণিজ্য নীতির সমর্থক ও প্রচারক জেরেমি বেন্থামের সার্থক ভারতীয় প্রতিনিধি ছিলেন রামমোহন রায়। যে বিবাদ ব্রিটিশ পার্লামেন্টের মধ্যে চলছিল তারই একটি খণ্ডাংশ দেখা গেল কোম্পানি ও রামমোহন রায়ের সংঘাতের মধ্যে।
এখানে একটি বিষয়ের অবশ্যই উল্লেখ প্রয়োজন। তা হল রামমোহনের অর্থনীতি সংক্রান্ত ভাবনাগুলির প্রকাশ মূলত তাঁর জীবনের শেষদিককার রচনা ও লক্ষ্যগুলির মধ্যে প্রকাশ পেলেও, অবাধ বাণিজ্য নীতি সংক্রান্ত ভাবনার সঙ্গে তার অনেক আগেই পরিচয় ঘটে থাকতে পারে। লেসে ফেয়ার বা অবাধ বাণিজ্য নীতির অন্যতম প্রধান প্রবক্তা অ্যাডাম স্মিথের এই বিষয় সংক্রান্ত বিখ্যাত গ্রন্থ ‘An Inquiry into the Nature and Causes of the Wealth of Nations’ প্রকাশিত হয় ১৭৭৬ খ্রিস্টাব্দে। রামমোহনের পক্ষে এ বই হাতে পাওয়া এবং গভীরভাবে অধ্যয়ন করা কিছু অস্বাভাবিক নয়। ১৭৯০-এর দশক থেকেই তিনি ইংরাজি চর্চা শুরু করেছিলেন। তাই ওই দশকেই হয়তো অ্যাডাম স্মিথের ভাবনাচিন্তার সঙ্গে তাঁর পরিচয় ঘটে। পরিণত বয়সে যে ভাবনা তিনি প্রকাশ করেছেন তার সূত্রপাত সম্ভবত এই সময়েই। আর স্পষ্টবক্তা রামমোহন নিজের কথা কখনওই গোপন রাখতেন না। সোচ্চারেই প্রচার করতেন নিজের মত। অবাধ বাণিজ্য নীতির প্রতি সমর্থনই যে কোম্পানির সঙ্গে বিরোধের প্রধানতম কারণ এমন সিদ্ধান্ত বোধহয় ভুল হবে না।
(আবার আগামী সংখ্যায়)
[1] তৃতীয় এবং চতুর্থ পর্ব শিল্প বিপ্লবের সময়কাল।
[2] হাবিব। ২০১৯ : ২৯।
[3] রায়, সুপ্রকাশ। ১৯৬৬ : ১২।
[4] ফারুকি। ২০১৯ : ৮২।
[5] পূর্বোক্ত, ৮৩-৮৪।
[6] উদ্ধৃত Mukherjee. 2011 : 315.
[7] হাবিব। ২০১৯ : ৩৯।
[8] পূর্বোক্ত।
[9] দ্রষ্টব্য, Little. 2016.
[10] Sen, Ranjit. 1985 : 36-39.
[11] গুহ, রণজিৎ। ২০১০ : ২৬-২৭।
[12] ১৭৮৪-র পিটের ভারত শাসন আইন একদিকে কোম্পানির স্বার্থ এবং অন্যদিকে অধিকতর নিয়ন্ত্রণের জন্য পার্লামেন্টের আকাঙ্খা উভয়কেই ধারণ করতে যথাসম্ভব চেষ্টা করেছিল। এই আইন অনুযায়ী বাংলা ছাড়া অন্য দুটি প্রেসিডেন্সির গভর্নর ও কাউন্সিলরসমূহকে গভর্নর জেনারেল ও কাউন্সিলের নির্দেশ মেনে চলতে হবে এই সব বিষয়ে— ‘দেশের শক্তিসমূহের সঙ্গে কোনও আদানপ্রদান, অথবা যুদ্ধ, অথবা যুদ্ধের সময়ে এইসব প্রেসিডেন্সির রাজস্ব অথবা [সশস্ত্র] বাহিনির প্রয়োগে’ কিংবা অন্য কোনও বিষয় যেগুলি কোর্ট অফ ডিরেক্টরস কলকাতার জন্য সংরক্ষণ করতে পারে। (ফারুকি, অমর। ব্রিটিশ শাসনের প্রতিষ্ঠা ১৭৫৭-১৮১৩। কলকাতা: কে পি বাগচী। ২০১৯ : ৯৭-৯৮)
[13] দ্রষ্টব্য, টীকা ১১। ২৭-২৮।
[14] ফারুকি, অমর। ২০১৯ : ৯৪-৯৫।